সবার দৃষ্টি নারায়ণগঞ্জে
চাঞ্চল্যকর ৭ খুনের রায় আজ
বহুল আলোচিত নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার রায় আজ।রায়কে কেন্দ্র করে গোটা দেশের মানুষের নজর আজ নারায়ণগঞ্জের দিকে। কী রায় হতে পারে, সে নিয়ে আলোচনায় মুখর নানা শ্রেণির মানুষ ও মহল। ফাঁসি, আজীবন কারাদন্ড, নাকি অন্য কোনো সাজাÑএ নিয়ে চলছে নানা হিসাব-নিকাশ। বর্বরোচিত এ হত্যাযজ্ঞের রায় কি কোনো দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পারবে- সে ভাবনাও রয়েছে সবার মধ্যে।
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল হঠাৎ করেই অপহৃত হন সাতজন। তিন দিন পর শীতলক্ষ্যায় ভেসে ওঠে একে একে সাত লাশ। প্রতিবাদ-বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে গোটা জেলা। স্বজনদের কান্নায় ভারী হয় বাতাস। সে বেদনা ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশে। বর্বরতায় স্তব্ধ হয়ে যায় বেদনার্ত মানুষ। এরপর দিন কাটে নানা শঙ্কায়। একদিকে স্বজন হারানোর বেদনা, অন্যদিকে বিচারহীনতার শঙ্কা-সবমিলে এক দুর্বিসহ সময় কাটে নিহতদের পরিবারের স্বজনদের। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে কেউ নামেন পথে, অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটে; তেমনি মামলা তুলে নিতে চলতে থাকে আসামিপক্ষের হুমকি-ধামকি, ভয়ভীতি প্রদর্শন। বর্বরোচিত এই হত্যাযজ্ঞের উপযুক্ত সাজা একদিন পাবেই আসামিরা।আজ সেই কাক্সিক্ষত দিন আজ। সকালে নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ আদালত সৈয়দ এনায়েত হোসেন এ রায় ঘোষণা করবেন। আসামিদের উপস্থিতিতে আদালতে রায় ঘোষণা করবেন বিচারক।
এর আগে গত বছরের ৩০ নভেম্বর বুধবার সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেনের আদালতে গ্রেফতারকৃত চাকরিচ্যুত র্যাব কর্মকর্তা এমএম রানার অসমাপ্ত যুক্তিতর্ক এবং এসআই বজলুর রহমান ও আসাদুজ্জামানের যুক্তিতর্ক সম্পন্ন হয়। ওই সময় নারায়ণগঞ্জ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওয়াজেদ আলী খোকন জানান, সাত খুনের দুটি মামলায় গ্রেফতারকৃত ২৩ ও পলাতক ১২ আসামির সবার যুক্তিতর্ক শেষ হওয়ার পর আদালত ১৬ জানুয়ারি রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘অমানবিক এ হত্যাকা-ে যারা জড়িত তারা কেউ রেহাই পাবে না’ বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। সাত খুনের ঘটনার পর নিহতদের স্বজনরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে সেদিন প্রধানমন্ত্রী বলেন, হত্যাকারীরা যে অবস্থানের হোক, যে দলেরই হোক কাউকে ছাড়া হবে না। তাদের খুঁজে এনে বিচার করা হবে। তখন থেকেই বিচারকে ঘিরে প্রত্যাশা জেগেছিল মানুষের মধ্যে।
আজ রায় ঘোষণার সময় আসামিদের আদালতে নিতে বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। মামলার ‘দুর্র্র্ধষ প্রকৃতির’ চার আসামি নূর হোসেন ও র?্যবের সাবেক তিন কর্মকর্তাকে আদালতে হাজিরের সময় যেন কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়, সে জন্য পুলিশ সদর দফতর থেকে পৃথক চিঠিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হয়েছে। এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন কারা উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজনস) তৌহিদুল ইসলাম। পুলিশ সদর দফতরের ওই চিঠিতে বলা হয়, নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুন মামলার আসামি ও কারাগারে শ্রেণিপ্রাপ্ত (ডিভিশনপ্রাপ্ত) আসামি লেফটেন্যান্ট কর্নেল (বরখাস্ত) তারেক সাঈদ, মেজর (বরখাস্ত) আরিফ হোসেন ও লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (বরখাস্ত) মাসুদ রানা বিভিন্ন বাহিনীর প্রশিক্ষণ পাওয়া কর্মকর্তা। তাঁরা আসামি হিসেবে দুর্র্ধষ প্রকৃতির। এ ছাড়া নূর হোসেনও একজন দুর্র্ধর্ষ আসামি বলে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের বিশেষ শাখা জানিয়েছে। এই অবস্থায় যেকোনো অপ্রীতিকর ঘটনা বা পলায়নের অপতৎপরতা রোধে অধিক সতর্কতার জন্য শ্রেণিপ্রাপ্ত এই আসামিদের ১৬ জানুয়ারি আদালতের ধার্য তারিখে হাতকড়া পরিয়ে ও রশি বেঁধে অতি সতর্কতার সঙ্গে আদালতে হাজির করার জন্য কারা কর্তৃপক্ষকে বলা যেতে পারে।
সাত খুনের মামলার আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। গতকাল রোববার নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, দেশের আপামর জনসাধারণ এ মামলাটিতে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চায়। ওই হত্যাকা-ের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের কাজ ছিল মানুষের জানমাল রক্ষা করা, মানুষের স্বাধীনতাকে সেফগার্ড করা, তারাই যদি অপরাধের সঙ্গে জড়িত হয়ে যান, সে অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য।’
জানা গেছে, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ সাতজনকে অপহরণ করে র্যাব। এরপর থেকে নজরুলের শ্বশুর শহীদ চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে আন্দোলন করা হয়। আন্দোলন চলাকালীন সময়েই ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীর ত্রিমোহনায় বন্দর শান্তিরচর এলাকা থেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ৬ জনের লাশ ও ১ মে অপর একজনের লাশ বিভৎস অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। লাশ উদ্ধারের পর আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠে নারায়ণগঞ্জ। নজরুল ছাড়াও উদ্ধারকৃত লাশের মধ্যে রয়েছে তার বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন ও গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম এবং আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহীম।
এদিকে আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারের লাশ উদ্ধার হলে আন্দোলন রাজপথসহ ছড়িয়ে পড়ে দেশের আদালত প্রাঙ্গনেও। এ হত্যাকোন্ডের সাথে র্যাব ১১’র ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার প্রমান মিললে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার আলোচিত হয়ে উঠে নারায়ণগঞ্জ । নিহতদের পরবিারকে সান্ত¦না দিতে নারায়ণগঞ্জ আসেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ আওয়ামীলীগ ও জাতীয়পার্টির শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দরাও। এ ঘটনায় পৃথক দৃটি মামলা দায়ের করেন নজরুলের স্ত্রী বিউটি ও নিহত আইনজীবী চন্দন কুমারের জামাতা বিজয় কুমার পাল।
পর্যায়ক্রমে গ্রেফতার করা হয় মামলায় প্রধান আসামি নূর হোসেন, চাকরিচ্যুত র্যাব-১১-এর তৎকালীন অধিনায়ক লে. কর্নেল তারেক মোহাম্মদ সাঈদ, উপ-অধিনায়ক মেজর আরিফ হোসেন, লে. কমান্ডার এমএম রানা, ল্যান্সনায়েক বিল্লাল হোসেন, সাবেক এসআই পুর্ণেন্দু বালা, হাবিলদার মো. ইমদাদুল হক, ল্যান্স নায়েক হীরা মিয়া, ল্যান্স করপোরাল রুহুল আমিন, সিপাহি আবু তৈয়ব, কনস্টেবল মো. সিহাব উদ্দিন, রেডিও অপারেটর গেইন (আরওজি) মো. আরিফ হোসেন, এএসআই বজলুর রহমান, এএসআই আবুল কালাম আজাদ, হাবিলদার ও গাড়িচালক নাসিরউদ্দিন, সিপাহী নুরুজ্জামান, বাবুল হাছান, সিপাহী সাবেক সেনা সদস্য আসাদুজ্জামান এবং নূর হোসেনের প্রধান বডিগার্ড মর্তুজা জামান চার্চিল, প্রধান ক্যাশিয়ার আলী মোহাম্মদ, ক্যাশিয়ার সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহ-প্রচার সম্পাদক আবুল বাশার, মাদক স্পট পরিচালনাকারী রহম আলী ও মিজানুর রহমানকে। পলাতকরা হলেনÑনূর হোসেনের সহযোগী ভারতে গ্রেফতার সেলিম, সানাউল্লাহ সানা, শাহজাহান ও জামাল উদ্দিন, র্যাবের কর্পোরাল লতিফুর রহমান, সৈনিক আবদুল আলী, সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সী, সৈনিক আলামিন শরীফ, সৈনিক তাজুল ইসলাম, সার্জেন্ট এনামুল কবির, এএসআই কামাল হোসেন, কনস্টেবল হাবিবুর রহমান।
অপহরণের নির্দেশদাতা নূর হোসেনের ভারতে পালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় প্রভাবশালী সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের জড়িত থাকার মোবাইল কথোপকথন গণমাধ্যমে প্রচারিত হলে আরো বেশি তোলপাড় সৃষ্টি হয়। একজন কাউন্সিলরের নির্দেশে কয়েক কোটি টাকার বিনিময়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার মেয়ের জামাই তারেক সাঈদ তার নি¤œ পদস্থ র্যাব কর্মকর্তাদের দিয়ে এমন জঘন্য ঘটনা ঘটানোয় র্যাবকে নিয়ে দেশজুড়ে জনমনে এক ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয়।
সাত খুনের ঘটনার সাথে জড়িত আসামিদের সাথে সখ্যতা থাকার অভিযোগে তৎকালীন র্যাবের এডিজি কর্নেল জিয়াউল হক, নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমানসহ হেভিওয়েট অনেককেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির মুখোমুখি হতে হয়।
এরপর সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনের ভারতে অনুপ্রবেশের দায়ে গ্রেফতার হওয়া, বাংলাদেশে তাকে ফিরিয়ে এনে বিচারকাজ শেষ হওয়া এবং বিচার চলাকালীন পুরো সময়জুড়ে বেশ আলোচিত হয়ে উঠে চাঞ্চল্যকর এই ঘটনাটি।
দুটি মামলার তদন্ত শেষে ২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল নূর হোসেন, র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় ডিবি পুলিশ। এতে দুটি মামলাতে সাক্ষী করা হয়েছে ১২৭ জন করে। মামলায় গ্রেফতার হন ২৩ জন। আর পলাতক আছেন ১২ জন। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়ে মাত্র আট মাসেই ৩০ নভেম্বর মামলার আইনি কার্যক্রম শেষ হয়। ১২৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ১০৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেন আদালত।
দুই মামলায় অভিযোগপত্রে র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তা তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, আরিফ হোসেন ও এম এম রানাসহ ২৫ র্যাব সদস্যকে আসামি করা হয়। বাকি ১০ জনের মধ্যে নূর হোসেন ও তার সহযোগী রয়েছেন। অব্যাহতি পাওয়া পাঁচজন হলেন- সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজি ইয়াসিন মিয়া, ইকবাল, হাসমত আলী হাসু, সিদ্ধিররগঞ্জ থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক রাজু ও আনোয়ার।
সাত খুন মামলার র্যাবের চাকরিচ্যুত কর্মকর্তাদের জবানবন্দি নেয়া হয়। এম এম রানার আদালতে দেওয়া ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ছিল ১১ পৃষ্ঠার। যেখানে উঠে এসেছে সাতজন হত্যাকা-ের রোমহর্ষক বিবরণ। ২০১৪ সালের ৫ জুন রানার আদালতে দেওয়া ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করেন নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। আলোচিত ৭ হত্যাকা-ের ঘটনায় প্রথম দায় স্বীকার করেন অপহরণ, হত্যা ও গুমের মিশনে নেতৃত্ব দেয়া রানা। ২০১৪ সালের ১৭ মে ভোরে ঢাকা সেনানিবাসের বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয় এম এম রানাকে। পরে কয়েক দফা রিমান্ডে নেওয়ার পর রানা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। সাত খুন নিয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন র্যাবের চাকরিচ্যুত মেজর আরিফ হোসেন। তিনি ২০১৪ সালের ৪ জুন ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দেন। তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করেন নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কেএম মহিউদ্দিন।
No comments:
Post a Comment