পুলিশের ‘অস্ত্র’ ইয়াবা!
তরুণ সমাজ থেকে শুরু করে মাদকসেবীর একটা বড় অংশ এখন ইয়াবায় আসক্ত। তাই ভয়াবহ এই মাদকদ্রব্যটিকে ‘মাদকের রাজা’ বললেও ভুল বলা হবে না। এই ‘রাজার’ আগ্রাসনে গোটা যুব সমাজ আজ ধ্বংসের দ্বরপ্রান্তে। সময়ের সাথে সাথে ইয়াবার চাহিদাও বাড়ছে। এর আগ্রাসন ঠেকানো যাচ্ছে না কিছুতেই। এর সহজলভ্যতা এটিকে আরো আগ্রাসী করে তুলতে ভূমিকা রাখছে। মিয়ানমার থেকে আসা এই মাদকদ্রব্যটি এখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘরোয়া কারখানায়-ও তৈরি হচ্ছে। খোদ রাজধানীতেই ভাড়াবাসায় গড়ে উঠা বেশ কয়েকটি কারখানার সন্ধান পেয়েছে গোয়েন্দারা। তরুণ সমাজে ইয়াবা এখন তাদের জীবন অনুষঙ্গের অন্যতম উপকরণ হয়ে উঠেছে। আবার এই ইয়াবাকেই ‘টু-পাইস’ কামানোর অন্যতম ‘হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যবহার করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
রাজিবুল হাসান (ছদ্মনাম)। থাকেন রাজধানীর মিরপুরের সাংবাদিক কলোনিতে। সম্প্রতি কনকনে এক শীতের রাতে একটু দেরিতেই বাসায় ফিরছিলেন। বাসার প্রায় কাছাকাছি আসতেই টহলরত পুলিশ তাকে তল্লাশির কথা বলে থামায় নিয়ে যায়। তার সারা শরীরে তল্লাশি করে কিছু না পেয়ে মানিব্যাগ হাতিয়ে নেন দায়িত্বরত এক পুলিশ সদস্য। এ সময় রাজিবুল নিজেকে ‘সাংবাদিকের ভাগ্নে’ বলেও পরিচয় দেন। তবু মন গলেনি পুলিশের। উল্টো ইয়াবাসহ আটকের হুমকিও দেওয়া হয়। একপর্যায়ে বাধ্য হয়েই ‘মামাকে’ ফোন করেন রাজিব। অনেক কষ্টে পুলিশের ‘ইয়াবা অস্ত্র’ থেকে রেহাই পান তিনি।
শুধু রাজিবুল নয়, রাজধানীর বিভিন্ন অলিগলি কিংবা রাজপথে এভাবেই নিরীহ মানুষকে ইয়াবাসহ আটকের হুমকি দিয়ে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন একশ্রেণির অসাধু পুলিশ সদস্য। দাবি অনুযায়ী টাকা না পেলে পুলিশের ‘ইয়াবা অস্ত্রের’ শিকার হচ্ছেন নিরীহ পথচারী। গত চল্লিশ দিনে এ রকম তিনটি ঘটনার সত্যতা মিলেছে। গত ১৭ ডিসেম্বর পুরান ঢাকায় বোনের বাসা থেকে কাজ শেষে রাত সাড়ে ১১টায় বনশ্রীর ই-ব্লকের বাসায় ফিরছিলেন আবু সালেহ। বনশ্রী ডি-ব্লকের কাছে তিনি পুলিশের জেরার মুখে পড়েন। একপর্যায়ে তাকেও ইয়াবাসহ ফাঁসানোর হুমকি দেওয়া হয়। নিরুপায় হয়ে পুলিশ সদস্যদের হাতে ৫০০ টাকা দিয়ে ‘উদ্ধার’ হন তিনি।
এর আগে ডিসেম্বরের ৬ তারিখে রাত সোয়া ১২টায় মুগদা জেনারেল হাসপাতালের গলিতে একইভাবে পুলিশের ‘ইয়াবা অস্ত্রের’ হুমকি পান অনিক ইসলাম নামে এক তরুণ। অনিক জানান, মোটরসাইকেলে দুই বন্ধু এক অনুষ্ঠান শেষে বাসায় ফিরছিলেন। পথে মুগদা জেনারেল হাসপাতালের সামনে পুলিশের তল্লাশির মুখে পড়েন। তাদের কাছে সন্দেহজনক কিছু না পাওয়ায় তারা চা-নাশতার জন্য টাকা চান। এ নিয়ে আমাদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক হয়। একপর্যায়ে এক পুলিশ সদস্য আরেক সদস্যকে বলেন, শালারা বেশি কথা বলতাছে। ওগো পকেটে ‘বাবা’ (ইয়াবা) ঢুকাইয়া আটক করে থানায় নিয়ে চল। এ কথা শুনে দুই বন্ধু একটু ভীত হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে পুলিশ সদস্যদের ২০০ টাকা দিয়ে নিজেদের ‘ছাড়িয়ে’ নেন তারা।
সর্বশেষ গত ৬ জানুয়ারি একই ঘটনার শিকার হন উত্তরার ৫ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা মোহাম্মদ বাবুলও। তিনি জানান, বিশ্ব সাহিত্যকেন্দ্রে নিজের একটি অনুষ্ঠান শেষে বাসায় ফেরেন রাত সাড়ে ১২টায়। ৫ নম্বর সড়কের ব্রিজের কাছে এলে থামার সংকেত দেন টহলরত পুলিশ সদস্যরা। কোনো কিছু না বলেও তারা আমার পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেন। আমি প্রতিবাদ করলে তারা অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করেন। তারা বলেন, বেশি বাড়াবাড়ি করলে ইয়াবা দিয়ে চালান দিয়ে দেব। একপর্যায়ে কিছু টাকা দিয়ে বাসায় চলে আসি।
এভাবেই ঢাকার রাস্তায় পুলিশের ‘ইয়াবা অস্ত্রের’ শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষজন। তবে এ বিষয়ে ডিএমপির উপকমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান জানান, পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে এ ধরনের কোনো অভিযোগ পেলে দায়ীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পুলিশ অপরাধ করলেও আইনের হাত থেকে তার রেহাই নেই। ভুক্তভোগীরা নিঃসংকোচে অভিযোগ দিলে দায়ী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলেও জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।
গত ১৯ ডিসেম্বর রাজধানীর ডেমরার সারুলিয়ায় অভিযান চালিয়ে ১১০০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ মোহাম্মদ নাসির আহমেদ নামে একজনকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তার বাসা থেকে ইয়াবা তৈরির যন্ত্রপাতি ও নানা উপকরণ জব্দ করা হয়। জব্দ হওয়া কাঁচামাল থেকে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ ইয়াবা উৎপাদন করা সম্ভব। আটক নাসির এক সময় ভেষজসহ বিভিন্ন ওষুধ বিক্রি করতেন। বেশি লাভের আশায় পুরনো ব্যবসা ছেড়ে তিনি ইয়াবা তৈরির ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। এর আগে ২৪ নভেম্বর রাজধানীর মিরপুরে ইয়াবা তৈরির কারাখানার সন্ধান পায় ঢাকা গোয়েন্দা পুলিশ। মিরপুর দুই নম্বরের একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে ৫০০ পিস ইয়াবা ও ইয়াবা তৈরির কারখানার যন্ত্রপাতি ও বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক উপাদান উদ্ধার করা হয়। জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার করা হয় ৫ ইয়াবা ব্যবসায়ীকে। সর্বশেষ গত ১২ জানুয়ারি রাজধানীর তেজগাঁওয়ের পূর্ব তেজতুরী বাজার এলাকা থেকে সাড়ে ৩৩ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ হাসিনা বেগম (৩০) নামে এক নারী মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করেছে র্যাব।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, প্রভাবশালীদের স্বজনরাই পরিচালনা করছেন ‘ইয়াবা’ তৈরির এই কারখানা। তারাই ঢাকাসহ দেশজুড়ে এ মারণঘাতী নেশাজাত দ্রব্যটি বাজারজাতের বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন। রাজনৈতিক দাপট, প্রশাসনিক ক্ষমতা আর মাদকের অর্থে পরিচালিত এ ইয়াবা চক্রের প্রতাপ আকাশছোঁয়া। তাদের বিরুদ্ধে ‘টুঁ-শব্দটি’ করারও উপায় নেই। এ কারণে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিভিন্ন সময় গ্রেফতার হওয়া ইয়াবা কারখানার মালিকরা জানান, সোডিয়াম বেনজোয়েট, ক্যাফেইন ও ভেনিলার পাউডার মিশিয়ে তারা নকল ইয়াবা তৈরি করেন। অনেক সময় ছোট আকারের ওষুধ কোম্পানি থেকে ইয়াবা সাইজের ট্যাবলেট তৈরি করিয়ে সেসব ট্যাবলেটে শুধু ইয়াবার ফ্লেভার (গন্ধ) মিশিয়ে তা বাজারজাত করা হয়। এসব নকল ইয়াবা প্রস্তুত করতে খরচ পড়ে প্রতি পিস ৩০ টাকা। এগুলো পাইকারিভাবে বিক্রি করা হয় ৯০ থেকে ১১০ টাকা দরে।
তবে রাজধানীতে ইয়াবা ট্যাবলেট প্রতি পিস খুচরা বিক্রি হয় ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায়। মাদকের এই চেইন বাণিজ্যে পুঁজির তিনগুণ লাভে রাতারাতি ধনাঢ্য হয়ে উঠছেন অনেকেই। ফলে চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী ছাড়াও অন্যান্য পেশার শিক্ষিত জনগোষ্ঠীও ইয়াবা কেনাবেচায় জড়িয়ে পড়েছেন। ইয়াবার পাইকারি ও খুচরা কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত কয়েকজন জানিয়েছেন, মিয়ানমার থেকে আমদানি করা ইয়াবার সঙ্গে ঢাকায় তৈরি ইয়াবার সূক্ষ্ম পার্থক্য বোঝার উপায় নেই। খুব ভালোভাবে পরখ করলে দেখা যায়, রং কিছুটা বদলে যায়, ফ্লেভারও কম থাকে। তবে সেবনের ক্ষেত্রে তেমন কোনো হেরফের নেই বললেই চলে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ছোট-বড় মিলিয়ে রাজধানীতেই গড়ে উঠেছে ইয়াবা তৈরির অসংখ্য কারখানা। গত ৬ মাসে এ ধরনের অন্তত ৬টি কারখানার সন্ধান পেয়েছে গোয়েন্দারা। এসব ঘটনায় গ্রেফতার ব্যক্তিদের কাছ থেকে মিলেছে ইয়াবা তৈরির চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। এর আগে গুলশানের মতো অভিজাত এলাকায় একাধিক ইয়াবার কারখানা ধ্বংস করেছিল আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। তার পরও আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে কতিপয় প্রভাবশালীর ছত্রছায়ায় ইয়াবা তৈরি হচ্ছে। ব্যবসাও চলছে জমজমাট। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইয়াবা ব্যবসায় জড়িতদের বিরুদ্ধে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার মতো কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় ইয়াবার আগ্রাসন রোধ করা কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করেন তারা। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র বলেছে, বিগত এক বছরে রাজধানী ও তার আশপাশ এলাকায় ডজনখানেক ইয়াবার কারখানার সন্ধান পাওয়া গেছে। কারখানাগুলো থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ইয়াবা তৈরির কম্প্রেসার, মোটর, মিশ্রণের যন্ত্র, স্প্রে মেশিন, কাঁচামাল সোডিয়াম বেনজোয়েট, ক্যাফেইন, ভেনিলা পাউডার ও কেমিক্যালসসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। একই সঙ্গে দেড় ডজন ব্যবসায়ী গ্রেফতার হন। পরে তাদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে ইয়াবা তৈরির চাঞ্চল্যকর বেশকিছু তথ্য।
রাজধানীতে দুই শতাধিক ইয়াবা ডিলার সক্রিয়। এই চক্র এতটাই বেপরোয়া যে বাড়ি বাড়ি গিয়েও এই মাদক সরবরাহ করছে তারা। সেবন ও বিক্রির জন্য গড়ে উঠেছে গোপন আস্তানা। রীতিমতো মাসিক বেতনে নিয়োগ দেওয়া বিশ্বস্ত লোকজনের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে এই ব্যবসা। আর এটি করা হয় এতই সূক্ষ্ম ও গোপনে যে, খুচরা বিক্রেতা ধরা পড়লেও মুল ডিলারদের আস্তানার ঠিকানা দিতে পারেন না তারা। এমনকি রাজধানীতে ইয়াবার ব্যবহার এতটাই বেড়েছে যে, কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম থেকে আসার পরও তৈরি হচ্ছে নকল ইয়াবা।
গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার খন্দকার নুরুন্নবী জানান, সম্প্রতি ঢাকায় ইয়াবা তৈরির কারখানা পাওয়ায় চিন্তিত পুলিশ। তবে এ মুহূর্তে আমাদের কাছে আরো কারখানা থাকার তথ্য নেই। তবে যেহেতু বিভিন্ন সময়ে কারখানার সন্ধান পাওয়া গেছে। তাই গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। সীমান্তপথে কড়া নজরদারির কারণে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বাসাভাড়া নিয়ে ইয়াবা কারখানা গড়ে তোলা হচ্ছে। ওইসব কারখানা থেকে উৎপাদিত ইয়াবা দিয়ে চাহিদা মেটানো হচ্ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশন্স) সৈয়দ তৌফিক উদ্দিন আহমেদ বলেন, এই সংস্থার লোকজন কম। এর পরও গোয়েন্দা নজরদারি করা হয়। নিয়মিত অভিযানও চলে মাদকের আখড়ায়। তবে রাজধানীতে গড়ে উঠা ইয়াবা কারখানার সঠিক পরিসংখ্যান তাদের জানা নেই।
লেখক: জুবায়ের চৌধুরী
No comments:
Post a Comment