Sunday, January 22, 2017

ই-ভোটিংয়ে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন

আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোট অনুষ্ঠিত হবে ডিজিটাল ভোটিং পদ্ধতিতে, যা ই-ভোটিং হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত। এরআগে সীমিত পরিসরে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনসহ সংসদের উপ-নির্বাচনে টেস্ট কেস (পাইলট) হিসেবে এ পদ্ধতির প্রয়োগ চালাবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে সবাইর আগে এই প্রযুক্তির ব্যাপারে রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐকমত্য দেখতে চায় কমিশন। এর মাধ্যমে বিদ্যমান ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) এর বিলুপ্তি ঘটতে যাচ্ছে। এই প্রযুক্তিটির প্রচলন শুরু করেছিলেন এক-এগারোর পুনর্গঠিত কমিশন ড. শামসুল হুদার নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিশন।
জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবদুল মোবারক এ বিষয়ে প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ই-ভোটিং একটি প্রযুক্তিনির্ভর এবং সঠিক ভোটিং পদ্ধতি। এতে কারচুপি কিংবা অনিয়ম করার সুযোগ নেই। তিনটি পদক্ষেপ অনুসরণ করে সংশ্লিষ্ট ভোটারকে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে হবে এই পদ্ধতিতে। প্রথমটি ভোটকক্ষে প্রবেশ এবং নিজের সঙ্গে থাকা কার্ডটি মেশিনে পরীক্ষা, পরে আঙুলটি মেশিনে ছোঁয়ানো এবং এটা সম্পূর্ণ হলে গোপন কক্ষে গিয়ে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়া। তিনি বলেন, যখন ভোট দেওয়া হবে তাৎক্ষণিক সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার এবং কক্ষের বাইরে থাকা আরেকটি মেশিনে ভোটটি সম্পন্ন হয়েছে উপস্থিত ভোটাররা তা দেখতে পাবেন। তবে কে কাকে কিংবা কোন প্রতীকে ভোট দিচ্ছেন তা দেখা যাবে না। এটি বিশেষজ্ঞ একটি কমিটির সমন্বয়ে প্রস্তাব প্রস্তুত আছে। কিন্তু বিদায়ের আগে এ বিষয়ে আমরা কোনো সুপারিশ করব না বলে জানান এই নির্বাচন কমিশনার।
আর নির্বাচন কমিশনার মো. শাহ নেওয়াজ প্রতিদিনের সংবাদ বলেন, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) নয় আগামীতে বড় নির্বাচন হবে ডিজিটাল ভোটিং মেশিনে। যে মেশিনের নিরাপত্তা কবচ হিসেবে থাকবে ভোটারদের ফিঙ্গার প্রিন্টের সন্নিবেশ। ভোটারের ফিঙ্গার প্রিন্ট ম্যাচ করলে ভোটিং মেশিন চালু হবে; না করলে হবে না। আবার একজন ভোটারের ভোট দেওয়া সম্পন্ন হলে আপনা-আপনিই মেশিন লক হয়ে যাবে।
এ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ডিজিটাল ভোটিং মেশিন ব্যবহার করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার লক্ষ্যে কাজ করছেন তারা। এখন দরকার রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে সদিচ্ছা বা ঐকমত্য। ইতোমধ্যে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী তার মনোভাব স্পষ্ট করেছেন। অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান জানা দরকার। তিনি বলেন, এই প্রযুক্তি ব্যবহারের আগে স্থানীয় সরকারসহ ছোট ছোট সাধারণ ও উপ-নির্বাচনে ই-ভোটিং যাচাইয়ের জন্য পাইলটিংও (পরীক্ষামূলক ব্যবহার) করা হবে। আর সংসদ নির্বাচনে তা প্রয়োগ ঘটনানো হবে।
ইসি সচিব আরো বলেন, আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি হচ্ছে, একটি দল যা চায় অন্য দল চায় তার একেবারে বিপরীত কিছু। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এমনকি আমেরিকা নির্বাচন নিয়েও এবার প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন তোলাটাই শেষ কথা হওয়া উচিত নয়, দরকার প্রশ্নগুলো নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ ও প্রক্রিয়া চালানো। তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন যে এবার সুষ্ঠু ও অবাধ হতে পারলো এর কৃতিত্ব কেবল একা ইসির নয়, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী, তাদের কর্মী-সমর্থক, সরকারের আন্তরিকতা, ইসির প্রচেষ্টা এবং সর্বোপরি ভোটারদের চাওয়া। সবমিলিয়েই নারায়ণগঞ্জে সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ একটা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পেরেছে।
তিনি বলেন, আমাদের দরকার ডিজিটাল ভোটিং মেশিন। যে মেশিনে প্রতিটি ভোটের সুষ্ঠুতা-স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে, প্রতিটি নাগরিকের ভোট আমানত হিসেবে গচ্ছিত রাখে। কোনো দুর্বৃত্ত-দস্যু চাইলেও যেন কোনো নাগরিকের ভোটের আমানত খিয়ানত করা সম্ভব না হয়।
ইসির কর্মকর্তারা জানায়, সাবেক ড. এ টি এম শামসুল হুদা কমিশনের সময়ে প্রচলন শুরু হয় ডিজিটাল প্রযুক্তির। ওই কমিশনের উদ্ভাবিত পদ্ধতি ছিল ইভিএম। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন, নরসিংদীর পৌরসভার নির্বাচন এবং নারায়ণগঞ্জের কয়েকটি ওয়ার্ডে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে সাফল্য এসেছিল। এমনকি কুমিল্লার পুরো ওয়ার্ডে ব্যবহার হয়েছিল ইভিএম। এটি বর্তমান কমিশনের সময় এসেও ব্যবহার হয়। কিন্তু রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের কয়েকটি কেন্দ্রে ইভিএমে ক্রটি ধরা পড়ে। এ পরিস্থিতি পুরো নির্বাচনের এলাকায় রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। যার পরিপেক্ষিতে বর্তমান কমিশন ইভিএমের কার্যক্রম থেকে সরে আসে। তারা গ্রহণ করে নতুন উদ্যোগ। এরই অংশ হিসেবে কয়েক মাস আগে অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীকে পরামর্শক করে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন হয়। আগামী ছয় মাসের (জুন-জুলাই) মধ্যেই একটা প্রটোটাইপ ডিজিটাল ভোটিং মেশিন সরবরাহ করবেন। এরপর কয়েক মাস প্রটোটাইপ মেশিনের ত্রুটি, সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করা হবে।
কর্মকর্তারা আরো জানায়, রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে মেশিনটির সক্ষমতা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাদের মতামত/সুপারিশ নেওয়া হবে। এরপরও একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে প্রায় দেড় বছর সময়ে মেশিনের অনেকগুলো পাইলটিং করা হবে। সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে তবেই দেশি বা বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডিজিটাল ভোটিং মেশিন প্রস্তুত করা হবে বলে জানান কর্মকর্তারা।
ইসি সংশ্লিষ্টরা আরো জানান, মাত্র আঠারো মাস সময়ের মধ্যে ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন করা সম্ভব হলে ই-ভোটিং পদ্ধতি কেন নয়। ইসি সচিবালয় ডিজিটাল ভোটিং মেশিন নিয়ে প্রস্তুতিমূলক সব কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। এখন আমাদের দরকার জনগণ, রাজনৈতিক দল ও সরকারের তরফে আমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। যাতে আমরা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কাজটি শেষ করতে পারি। ডিজিটাল ভোটিং মেশিনের বিষয়ে অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, মাস দেড়েক আগে বিষয়টি নিয়ে একটা মিটিং হয়েছে। মিটিংয়ে ডিজিটাল ভোটিং মেশিন নিয়ে ইনডেপথ আলোচনা হয়েছে। তবে মেশিনের সামগ্রিক সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে বিস্তারিত বলতে রাজি হননি তিনি।
একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, ইভিএম এবং ই-ভোটিংয়ের মধ্যে রাত-দিন তফাত রয়েছে। কারণ এই প্রযুক্তিতে ভোটার চাইলেও তার ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে দ্বিতীয়বার ভোটিং মেশিন খুলবে না। এভাবে ভোটারদের একাধিক ভোট দেওয়ার সুযোগ চিরতরে বন্ধ করা হবে। অন্যদিকে, ভোট কেন্দ্র জবরদখল করে গায়েবি ভোট দেওয়াও বন্ধ করা হবে। নির্বাচন কমিশনের আইটি শাখা ও ভোটার তালিকা অনুবিভাগ জাতীয় নিবন্ধন শাখা নতুন ভোটিং মেশিন তৈরির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে এ বিষয়ে বর্তমান বিদায়ী কমিশন চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত রেখে যাচ্ছে না। নতুন কমিশন বাস্তবতা মেনে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
লেখক: গাজী শাহনেওয়াজ

No comments:

Post a Comment