র্যাব নিয়ে প্রশ্ন
বিলুপ্তি না সংস্কার
এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) নিয়ে নানা রকম আলোচনা-সমালোচনায় মুখর এখন দেশ। নারায়ণগঞ্জে ৭ খুনের সঙ্গে এই সংস্থার সদস্যরা জড়িত থাকায় ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে সংস্থাটি। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার পরিবর্তে খুনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ায় ভীত-সন্ত্রস্ত সাধারণ মানুষ। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে বিভিন্ন মহলে। দেশের গন্ডি পেরিয়ে সমালোচিত আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, সংস্থাটি গঠনের এক যুগের মাথায় এসে বিলুপ্তি, নাকি সংস্কার, প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়ে।
র্যাবের এই পরিস্থিতিতে বিব্রত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্যান্য সংস্থাও। ভেতরে-বাইরে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপের মুখে পড়েছে র্যাব নিজেও। কতিপয় সদস্যের কারণে গোটা সংস্থাটির কাঁধে এমন দুর্নাম মেনে নিতে পারছেন না কেউই। ম্লান হতে বসেছে এতদিনের অর্জন। বিশেষ করে পুলিশের অঙ্গ সংগঠন হওয়া সত্ত্বেও পুলিশ-র্যাবের দ্বন্দ্ব নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় আরো বেশি সামনে চলে এসেছে। তোপের মুখে পড়েছে গোটা সংস্থাটি।
সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ৭ খুনের ঘটনায় আদালতের পর্যবেক্ষণ আরো বেশি বিপাকে ফেলেছে র্যাবকে। প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের সংশ্লিষ্টতাকে ‘জাতির জন্য অত্যন্ত কলঙ্কজনক’, ‘সকল সরকারি কর্মচারীর জন্য লজ্জাজনক’ বলে উল্লেখ করেছেন আদালত। এ ঘটনা ‘আমাদের সকলের মাথা লজ্জায় নুইয়ে দিয়েছে’ বলেও উল্লেখ করেছেন আদালত। আদালত অবশ্য র্যাবের কার্যক্রমের প্রশংসাও করেছেন। এর পাশাপাশি ভবিষ্যতে এই বাহিনীতে নিয়োগ দিতে সতর্কতা অবলম্বন করতে বলেছেন।
ফলে র্যাব কি থাকবে, নাকি বিলুপ্ত হবে, এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে বিভিন্ন মহলে। এমন পরিস্থিতিতে র্যাবের ব্যাপারে কী ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে, তা জানতে প্রতিদিনের সংবাদ কথা বলেছে দেশের তিন বিশিষ্টজনের সঙ্গে। তাদের মতে, বিলুপ্তি নয়, দরকার র্যাবের পুনর্গঠন ও সংস্কার। তারা র্যাবকে আলাদা বাহিনী হিসেবে রূপদানেরও পরামর্শ দিয়েছেন। এমনকি র্যাবের ভেতরে সেনাবাহিনীর সদস্য থাকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। তারা বলেছেন, পুলিশের ভেতর থেকেই র্যাব করা যেতে পারে। রাষ্ট্রকে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই তা করা জরুরি। র্যাবের গঠন, ক্ষমতায়ন, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। এফবিআই বা আন্তর্জাতিক সংস্থার মতো প্রতিষ্ঠান হিসেবে অনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিয়ে দাঁড় করাতে হবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী এই সংস্থাটিকে।
নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন গত সোমবার ৭ খুনের মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে নারায়ণগঞ্জের সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন এবং সাবেক তিন র্যাব কর্মকর্তাসহ ২৬ আসামিকে মৃত্যুদন্ড এবং বাকি ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে ২৫ জনই র্যাবের। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম এবং আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে অপহরণের পর ঠান্ডা মাথায় হত?্যা করে লাশ ডুবিয়ে দেওয়া হয় শীতলক্ষ?্যা নদীতে। সেই রায় ঘোষণার পর থেকেই আরেক দফা বিতর্কের মুখে পড়ে র্যাব। দাবি ওঠে এই এলিট ফোর্সের বিলুপ্তির।
অবশ্য র্যাবের বিলুপ্তি কিংবা র্যাবের ভাবমূর্তি ক্ষুণেœর প্রশ্নে একমত নয় সরকার এবং সংস্থাটির প্রধান। এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘আমি আগেই বলেছি, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। যে অপরাধ করবে, তার শাস্তি হবে। সেখানেও (নারায়ণগঞ্জ) তা-ই হয়েছে। ব্যক্তির দায় কোনো অর্গানাইজেশন নেবে না। সুতরাং বিলুপ্তির কথা ভাবছি না।’ অনুরূপভাবে র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেছেন, ‘র্যাবের কিছু সদস্য ব্যক্তিগতভাবে অন্যায় কাজ করেছে। সেটা তাদের দায়; র্যাবের নয়। যেকোনো মূল্যে আমরা র্যাবকে ক্লিন রাখব। এটাই এই বাহিনীর প্রত্যয় ও প্রতিজ্ঞা।’ অবশ্য র্যাবপ্রধান গবেষণার মাধ্যমে র্যাবের এমন সমস্যার স্থায়ী সমাধানের কথা বলেন। দেশের নিরাপত্তা ও অপরাধ বিশ্লেষকদের সঙ্গে কথা বলে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদন থেকে র্যাব সম্পর্কে এসব তথ্য জানা গেছে।
যত বিতর্ক-প্রশংসা : জানা গেছে, র্যাবের যাত্রা শুরু ২০০৪ সালে। নিজস্ব ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ‘পুলিশবাহিনীর কার্যক্রমকে আরো গতিশীল ও কার্যকর করার লক্ষ্যে সরকার একটি এলিট ফোর্স গঠনের পরিকল্পনা করে। বাংলাদেশ পুলিশ, সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর সদস্যদের নিয়ে র্যাব গঠন করা হয়। শুরুর দিকের র্যাব বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল। বিশেষ করে ২০০৫ ও ২০০৬ সালে বাংলাদেশে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা উগ্র ইসলামী জঙ্গি তৎপরতা দমনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে র্যাব। সেই কর্মকান্ড এখনো অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে ৬৩টি জেলায় ২০০৫ সালে একসঙ্গে বোমা ফাটিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করা জেএমবির শীর্ষ নেতাদের আটক র্যাবের উল্লেখযোগ্য সাফল্য। ২০০৬ সালের ২ মার্চ শায়খ আব্দুর রহমান এবং ৬ মার্চ সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হয় র্যাব। কিন্তু ২০১১ সালে লিমন হোসেন নামে এক ১৬ বছর বয়সী কিশোরের পায়ে র্যাব সদস্যের গুলি করার ঘটনায় দেশজুড়ে বিতর্কের মুখে পড়ে র্যাব। গুলিতে গুরুতর আহত লিমনের বাম পা ঊরুর নিচ থেকে কেটে ফেলতে হয়। এ ঘটনায় র্যাবের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ক্রসফায়ারের নামে অসংখ্য ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের’ কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে র্যাবের বিরুদ্ধে সমালোচনা ক্রমেই বাড়তে থাকে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালে গ্রেফতারের আগেই র্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হন ৪৯ জন। হেফাজতে থাকাকালে ক্রসফায়ারে নিহত হন পাঁচজন। গ্রেফতারের আগে গুলিতে মারা গেছেন একজন। অর্থাৎ, র্যাবের হাতে নিহত হয়েছেন ৫৫ জন। এছাড়া র্যাব ও বিজিবির যৌথ অভিযানে গুলিতে একজনের প্রাণ গেছে। একইভাবে ২০১৫ সালে র্যাবের হাতে নিহত হয়েছেন ৫৩ জন। তাদের মধ্যে গ্রেফতারের আগে ক্রসফায়ারে ৩৭ জন, হেফাজতে থাকাকালে ১৩ জন, হেফাজতে থাকাকালে শারীরিক নির্যাতনে দুইজন এবং হেফাজতে থাকাকালে হার্ট অ্যাটাকে একজন প্রাণ হারান। এছাড়া র্যাব ও পুলিশের যৌথ অভিযানের সময় ক্রসফায়ারে একজন, র্যাব ও বিজিবির যৌথ অভিযানের সময় একজন এবং যৌথ অভিযানে দুইজন নিহত হয়েছেন। এর পরপরই আলোচিত ৭ খুনের ঘটনা ঘটে।
বিলুপ্ত নয়, সংস্কার : র্যাব বিলুপ্তির দাবিকে অযৌক্তিক মনে করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট ল’ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ। তিনি বলেন, ‘র্যাবের মতো বিতর্ক রাজনীতিতেও জড়িয়ে আছে। সেটা নিয়ে কথা হচ্ছে না। র্যাব ঝুঁকি নিয়ে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ মোকাবিলা করছে। তখন মানবাধিকার সংগঠনগুলো বিতর্ক তুলছে। বরং র্যাবের হাতে যে নিহতের সংখ্যা, সেটা শূন্যে নামিয়ে আনা যায় কিনা সেটাই চ্যালেঞ্জ। যে গুলি করা হচ্ছে, তা রাজনীতি, ঘুষ বা টাকার কারণে ঘটছে কিনা, তা দেখতে হবে। দেখতে হবে, গুলি করা জাস্টিফায়েড কিনা?’
এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, ‘র্যাব তদন্ত করে দেখবে, তাদের সাংগঠনিক কাঠামোতে কী কী ঘাটতি আছে। সেগুলো ঠিক করে ভবিষ্যতে জনমনে যেন আশঙ্কা সৃষ্টি না হয়, তা নিশ্চিত করাটাই হবে যুক্তিযুক্ত। প্রয়োজনে সাংগঠনিক দুর্বলতা থাকলে তা সংস্কার করা যেতে পারে। রাষ্ট্রযন্ত্রে যতগুলো বাহিনী আছে, সেগুলো যেন রাষ্ট্রের আইন মেনে পরিচ্ছন্নভাবে পরিচালিত হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। র্যাবকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা যাবে না; সাধারণ মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করতে হবে। নিয়োগ, প্রশিক্ষণ এবং পদায়নের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা থাকতে হবে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বলেন, বিলুপ্তি নয়, সংস্কার করতে হবে। র্যাবে, বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীকে যুক্ত করাটা বিব্রতকর। সেনাবাহিনীর মূল দায়িত্ব দেশ রক্ষা। সুতরাং সেনাবাহিনী থেকে র্যাবকে মুক্ত করতে হবে। পুলিশ থেকে নিয়েই র্যাবকে বিশেষায়িত করতে হবে। এর জন্য আলাদা কোনো আইনের দরকার নেই। পুলিশ আইন অনুযায়ী নোটিফিকেশন করেই তা সম্ভব।’
তবে র্যাবের ভেতরে সংস্কার আনতে হবে উল্লেখ করে এই মানবাধিকার বিশ্লেষক বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের ৭ খুনের ঘটনায় র্যাব জড়িত, এ প্রমাণিত। র্যাবের ভেতর আরো কোনো বিচ্যুতি রয়েছে কিনা, প্রশাসনিকভাবে সেগুলোর তদন্ত এবং বিচার করতে হবে। এ পর্যন্ত যতগুলো অভিযোগ উঠেছে, সবগুলোর বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে। এর জন্য তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে। যদি র্যাবকে বিচারের আওতায় আনা যায়, তাহলে মানুষের ভেতরে র্যাব নিয়ে যে ভীতি, সেটা কাটবে। র্যাবের ভেতরেও ভয় কাজ করবে। জবাবদিহিতার বিষয়টি নিশ্চিত হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান অবশ্য র্যাব বিলুপ্তির বিপক্ষে। তিনি বলেন, আদালত তার পর্যবেক্ষণ দিয়েছে একটি ঘটনার প্রেক্ষাপটে। কিন্তু র্যাবের সাফল্য নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। জঙ্গি দমন এবং মাদক নিয়ন্ত্রণসহ আইন-শৃঙ্খলার বিভিন্ন ক্ষেত্রেই র্যাব একটি আস্থার জায়গা সৃষ্টি করেছে। সুতরাং র্যাব বিলুপ্তির দাবি অযৌক্তিক। বরং র্যাবের ভেতরে সংস্কার আনতে হবে। যে অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী র্যাব পরিচালিত হচ্ছে, সেটার কোনো সংস্কার দরকার কিনা, কে কী করছেন সেটা নজর রাখা, অর্থাৎ র্যাবের দেখভাল দরকার। পুলিশ ইন্টার্নাল ওয়েবসাইটে (পিআইও) পুলিশ বিভাগের জন্য যেসব নিয়ম-কানুন রয়েছে, সেগুলো র্যাবের ক্ষেত্রে প্রতিপালন হচ্ছে কিনা, কোথায় কোথায় অমান্য হচ্ছে, সেগুলো দেখতে হবে। র্যাবের ভেতরে সুশাসন নিয়ে আসতে হবে।’
বরং র্যাবকে এখন আলাদা বাহিনীতে রূপ দেওয়ার সময় এসেছে দাবি করে এই অপরাধ বিশ্লেষক বলেন, ‘র্যাবকে কেন্দ্র করে সেনাবাহিনী ও পুলিশের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, সেটার সমাধান করতে হবে। সেনাবাহিনীকে র্যাব বা পুলিশের মধ্যে না এনে তাদের জায়গায় রাখতে হবে। সেনাবাহিনীর কাজ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা দেওয়া। আর পুলিশের কাজ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেখা। তাই পুলিশ থেকে র্যাবকে আলাদা করতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআইসহ বিভিন্ন দেশের শক্তিশালী পৃথক সংস্থার মতো রূপ দিতে হবে। আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন অ্যাক্ট অনুযায়ী র্যাবকে আলাদা বাহিনী করা যেতে পারে। আলাদা আইনের দরকার নেই। তবে এর জন্য সরকারের সদিচ্ছা প্রয়োজন।’
No comments:
Post a Comment