শেয়ারবাজার
বোয়াল পুকুরে ছোট মাছ!
তৈরি পোশাক শিল্প খাত সংক্রান্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিল এবং ভারতের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আন্তর্জাতিক বাজার দখলের কৌশলে বাংলাদেশ কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে। এদিকে, পোশাকশিল্পের উন্নয়ন ও প্রসারে নতুন করে ছয় হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি ঘোষণা করেছে দেশটির সরকার। এর সঙ্গে ফোড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সীমান্ত শুল্ক নামের বাড়তি চাপ। বর্তমানে বাংলাদেশকে পোশাকপণ্যে শুল্ক দিতে হয় ১৫ শতাংশ। কিন্তু সীমান্ত শুল্ক আরোপ করা হলে তা গিয়ে দাঁড়াবে ৪০ শতাংশে, যদিও এই শুল্ক পৃথিবীর অন্যান্য দেশের উপরও প্রযোজ্য হবে বলে নির্বাচনী প্রচারণায় ঘোষণা ছিল ট্রাম্পের।
এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেছেন, গত দুই বছরে শ্রমিক মজুরি বেড়েছে ৩২ শতাংশ, বিদ্যুৎ খরচ বেড়েছে ১৫ শতাংশ, গ্যাস ১০ শতাংশ এবং পরিবহন ব্যয় বেড়েছে ৩০ শতাংশ। অর্থাৎ, সর্বসাকুল্যে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ১৭ দশমিক ১১ শতাংশ। তিনি আরো বলেছেন, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য অন্য দেশগুলো তাদের উদ্যোক্তাদের নানামুখী প্রণোদনা দিচ্ছে। ডলার ও ইউরোপের সঙ্গে নিজেদের মুদ্রামান সমন্বয় করছে। কিন্তু এ দেশে তারা এ ধরনের কোনো সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না।
আগামীতে যে কঠিন প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ গার্মেন্ট শিল্প, সেখান থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী? বিশ্লেষকদের মতে, এই প্রশ্নে সরকারকে আন্তরিকতার সঙ্গে এই শিল্পের পাশে দাঁড়াতে হবে। তা না হলে ২০২১ সালের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানির যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামোতে।
যে সময় গার্মেন্টশ্রমিকদের টেনশনে ঘুম হারাম হতে চলেছে, ঠিক সেই মুহূর্তে পুঁজিবাজারে যেন ঝড় উঠেছে। মূল্যসূচক লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটে চলেছে আকাশের দিকে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মূল্যসূচক সাড়ে ৫ হাজার পয়েন্ট এবং লেনদেন দুই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এভাবে সূচক ও লেনদেন বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিকে অনেকেই ভালো চোখে দেখছেন না। আশঙ্কার কথা উল্লেখ করে তারা বলেছেন, ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে বড় ধরনের ধসের সময়ও লেনদেন ও সূচক এভাবেই বেড়েছিল। তারা এই উল্লম্ফনকে স্বাভাবিক না বলে অস্বাভাবিক হিসেবে অভিহিত করছেন। তারা বলছেন, কোনো কারণ ছাড়াই দুর্বল ও জেড ক্যাটাগরির শেয়ারের দর বেড়ে যাচ্ছে অস্বাভাবিক হারে।
শেয়ারবাজারকেও আমরা একটি বড় মাপের পুকুরের সঙ্গে তুলনা করে বলতে পারি, এখানেও বোয়ালমাছেরা বসবাস করে। স্বাভাবিক নিয়মেই ছোট মাছগুলোর এখানে বেশিদিন টিকে থাকার কথা নয়। একে একে সবাইকেই বোয়ালের উদরে গিয়ে আশ্রয় নিতে হবে
১৯৯৬ ও ২০১০ সালে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পথে বসিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটকারীরা নতুন করে মাঠে নেমেছেন। তারা মিথ্যা তথ্য ও গুজব ছড়িয়ে তাদের কাজকর্ম শুরু করেছেন। ফলে দিন দিন শেয়ারবাজারের সূচক ও লেনদেন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিষয়টি সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) নজরদারিতে রেখেছে। ইতোমধ্যে তারা ১১টি কারসাজি চিহ্নিত করে অস্বাভাবিক বাজার বৃদ্ধিতে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে।
২০১০ সালে শেয়ার কারসাজির তদন্তে গঠিত কমিটির প্রধান খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বাজারের অস্বাভাবিকতা দেখে বলেছেন, ব্যাংক ডিপোজিটে সুদের হার কমে যাওয়ায় অনেকেই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে মনোযোগী হয়েছেন। তবে এর পরিমাণ এত নয় যে, শেয়ারবাজারকে অস্বাভাবিক করে তুলবে। প্রকৃত সত্যটি হচ্ছে, কারসাজরা আবারো এর সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করছেন। ১৯৯৬ ও ২০১০ সালে যারা কারসাজিতে মূল ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তারাই এখন মাঠ গরম করছেন। তাদের নাম বলা না গেলেও ঢেউ দেখে বলা যায়, নিচে কেউ সাঁতার কেটে চলেছে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি সবাইকে আগাম সাবধান করে বলেছেন, যারা শেয়ারবাজারে যাবেন, তারা সাবধানে কেনাবেচা করবেন। কোনো দুর্ঘটনায় পড়লে কাউকে দায়ী করবেন না। প্রধানমন্ত্রীর সাবধানবাণীর সঙ্গে এ ব্যাপারে আমার ভাবনার কথাটা বললে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হতে পারে। কৈশোরে নানার মুখ থেকে শুনেছি, যে পুকুরে বোয়ালমাছ বাস করে, সেই পুকুরে ছোট মাছের কোনো অস্তিত্ব থাকতে পারে না। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, ছোট মাছগুলোই হচ্ছে বোয়ালমাছের জন্য সুস্বাদু খাবার। পুকুরের সব ছোট মাছ বোয়ালমাছের উদর পূর্ণ করে থাকে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। শেয়ারবাজারকেও আমরা একটি বড় মাপের পুকুরের সঙ্গে তুলনা করে বলতে পারি, এখানেও বোয়ালমাছেরা বসবাস করে। স্বাভাবিক নিয়মেই ছোট মাছগুলোর এখানে বেশিদিন টিকে থাকার কথা নয়। একে একে সবাইকেই বোয়ালের উদরে গিয়ে আশ্রয় নিতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। আগেই বলেছি, প্রকৃতির নিয়ম বলে কথা। সুতরাং বড় পুকুরের স্ফটিক পানির মোহে ছোট মাছগুলোর সাবধানতা অবলম্বন করা নিজ নিরাপত্তার জন্যই জরুরি।
লেখক: কামার ফরিদ ,কবি ও সাংবাদিক
No comments:
Post a Comment