Saturday, December 30, 2017

দুর্যোগ: জানা ও বোঝার প্রযুক্তি

বজ্রঘাত শব্দের লাতিন রূপ হচ্ছে ‘টোনার’। আর টোনার শব্দটি স্প্যানিশ রূপ ‘ত্রোনাদা’, যার মানে বজ্রগর্ভ ঝড়। অতঃপর ইংরেজি রূপ টর্নেডো। কয়েক বছর আগে ‘সিডর, আইলা’ শব্দটি ছিল অপরিচিত। বর্তমানে এসব ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের কেবল পরিচয় নয়, ভয়ংকর ছোবলের চিহ্ন নিয়ে বয়ে বেড়াবে আরো দীর্ঘদিন। বাংলাদেশ ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে প্রায় প্রতিবছরই ঘূর্ণিঝড় হওয়ার আশঙ্কা থাকে। উত্তরে হিমালয় এবং সমুদ্র উপকূল ফানেল বা চোঙাকৃতির হওয়ার জন্য এ দেশে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে পতিত হয়।
বাংলাদেশ পৃথিবীর বৃহত্তর বদ্বীপ। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, নদীভাঙন, ভূমিকম্প নিত্যসহচর। গত শত বছরে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে অসংখ্য প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়। প্রতিবছর এপ্রিল-মে (চৈত্র-বৈশাখ) মাসে টর্নেডোর প্রকোপ দেখা যায়। বাংলাদেশে এটি ঘূর্ণিঝড় বা কালবৈশাখী নামে বহুল পরিচিত। সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় টর্নেডোর আঘাতে ৩৩ জনের অধিক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। আহত হয়েছে সহস্রাধিক মানুষ। দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছে শত শত ঘরবাড়ি, স্কুল, মাদরাসাসহ বিভিন্ন ভবন ও গাছপালা। সাধারণত টর্নেডো প্রচণ্ড গতিতে ঘুরতে থাকা বাতাসকে বোঝানো হয়ে থাকে। তবে এ প্রচ- গতিতে ঘূর্ণায়মান বাতাসকে টর্নেডো হতে গেলে তাকে অবশ্যই ভূপৃষ্ঠের সঙ্গে সংযুক্ত হতে হবে। টর্নেডোর আকার-আকৃতি বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এক ফানেলের আকৃতিতে দেখা যায়। বেশির ভাগ টর্নেডোয় বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ১১০ মাইলের কম থাকে। সাধারণত কয়েক মাইল যাওয়ার পরই এসব টর্নেডোর শক্তি হ্রাস হয়। কিন্তু একটি শক্তিশালী টর্নেডোতে বাতাসের গতিবেগ ৩০০ মাইল হতে পারে। এ ধরনের শক্তিশালী টর্নেডো ১০০ কিলোমিটারেরও বেশি এলাকাজুড়ে তাণ্ডব চালায়। সব সময়ই টর্নেডো একদিকে ঘোরে অর্থাৎ উত্তর গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার দিকে ঘোরে।
টর্নেডোর ধ্বংস ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে, ১৯৭১ সালে জাপানি ও আমেরিকান বিজ্ঞানী এ স্কেল উদ্ভাবন করেন। তার নামের সঙ্গে মিল রেখে এ স্কেলের নাম রাখা হয় ফুজিতা স্কেল। ফুজিতা স্কেলের উন্নত সংস্করণটি বর্ধিত ফুজিতা স্কেল নামে পরিচিত। এ স্কেল অনুসারে যেসব টর্নেডো শুধু গাছপালা ধ্বংস করে, এগুলো ইএফও টর্নেডো। আর দালানকোঠা উপড়ে ফেলতে সক্ষম, তাহলে ইএফ৫ জাতীয় টর্নেডো। যখন শীতল আর শুকনো বাতাসের সঙ্গে সিক্ত আর উত্তপ্ত বাতাসের সংঘর্ষ বাঁধে তখন এমন এক মারাত্মক ঘূর্ণিপাকের সৃষ্টি হয় যাকে বলে ‘মেসোসাইক্লোন’; পরিবেশ অনুকূলে এলে মেসোসাইক্লোনের নিচে জমা হতে থাকে ‘ওয়াল ক্লাউড’ নামের মেঘ। আর এ ওয়াল ক্লাউডের নিচেই ব্যাপক গতি ও ক্ষমতা নিয়ে ফুঁসতে থাকে টর্নেডোর ঘূর্ণিপাক। অনেক সময় লক্ষ করা যায়, একটি মাত্র টর্নেডো থেকে অনেকগুলো টর্নেডোর সৃষ্টি হয়েছে কিংবা পুরোনো ঝড়টি নতুন ঝড়ের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে তাকে আরো শক্তিশালী করে তুলছে। এ ধরনের টর্নেডোকে বলে ‘টর্নেডো পরিবার। আবার কখনো দেখা যায় একটি বড় মাত্রার ঝড় থেকে অনেকগুলো টর্নেডোর সৃষ্টি হয়েছে। যদি কোনো রকম বিরতিহীন এ রকম একের পর এক টর্নেডো সৃষ্টি হতে থাকে; তাহলে তাকে বলে ‘টর্নেডো মরক’। টর্নেডোর আকার বা স্থায়িত্ব দিয়ে এক ধ্বংসাত্মক ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায় না। অধিক জায়গা নিয়েও টর্নেডো কম ক্ষতিকর হতে পারে, বিপরীত অল্প জায়গা নিয়েও হতে পারে মারাত্মক, ভয়ংকর ইতিহাস উত্তীর্ণ।
আবহাওয়া অধিদফতরের কর্মকর্তা আয়েশা খাতুন বলেন, ‘আবহাওয়ার অনেক কিছুর মতো টর্নেডো এখনো ভালো করে বুঝে ওঠতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। সুনামি, ভূমিকম্পেরও আগাম সংকেত দেওয়া যায় না। শক্তিশালী রাডার টর্নেডো ধরতে পারলেও প্রচার করতে করতেই তো টর্নেডো হামলে পড়বে। এখন টর্নেডোর ক্ষয়ক্ষতি মাপা হয় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কত হলো তা দেখে। এ টর্নেডোর কোনোরূপ আগাম সংবাদ দেওয়ার প্রযুক্তি বাংলাদেশে নেই। স্থানীয়ভাবে এত অল্প সময়ে এ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে যে, স্যাটেলাইটের মাধ্যমে তা পর্যবেক্ষণ সম্ভব নয়। কেবল ঘটে যাওয়ার পরই জানা যায়। তবে পালস-ডপলার নামে একটি রাডারের সাহায্যে টর্নেডোর পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব।’ ঝড় পূর্বাভাস কেন্দ্রের আবহাওয়াবিদ এস এম কামরুল হাসান বলেন, ‘প্রাথমিক ধারণা অনুযায়ী, টর্নেডোটি ঊর্ধ্বাকাশের ১৫-২০ কিলোমিটার ওপর থেকে নিচে নেমে আসে। টর্নেডো যখন ভূমিতে আঘাত করে; তখন তা চোখের পলকে একের পর এক জনপদ ধ্বংস করে দেয়। বাংলাদেশে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় ২২ মার্চ ২০১৩ সালের আঘাত হানা ভয়াবহ টর্নেডো চিত্রটি প্রথম পাওয়া গেল।’
বাংলাদেশে স্পারসো (বাংলাদেশ স্পেস রিসার্চ অ্যান্ড রিমোট সেনসিং অর্গানাইজেশন) আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে এসব তথ্য সংগ্রহ করে। স্পারসোর এক তথ্য বিবরণীতে ১৮৯১ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে মোট ১৭৪টি বড় ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয়। ১৯৮০ সালের আগে বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় শনাক্তকরণের যন্ত্র বা প্রতিষ্ঠান ছিল না। সে বছরই প্রথম স্পারসো গঠন করা হয়। তারপর থেকে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে যত ঘূর্ণিঝড় গেছে সবগুলো স্পারসো পর্যবেক্ষণ করেছে। দুটি কৃত্রিম উপগ্রহ (স্যাটেলাইট) ব্যবহার করে স্পারসো। কৃত্রিম উপগ্রহদ্বয়ের মাধ্যমে ঘূর্ণিঝড়ের বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পর্কে আগাম তথ্য পাওয়া যায়। তার মধ্যে একটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের নোয়া, যাতে দুই ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে—জিওস্টেশনারী (মহাকাশে স্থির অবস্থায় থাকে) ও পোলার অরবিটিং (ঘূর্ণয়ান) কৃত্রিম উপগ্রহ। জিওস্টেশনারী কৃত্রিম উপগ্রহ পৃথিবী থেকে ২২ হাজার ২৪০ মাইল এবং পোলার অরবিটিং স্যাটেলাইট ৫৪০ মাইল দূরে অবস্থান করে। নোয়া স্যাটেলাইট থেকে স্পারসো প্রতিদিন দুটি করে স্যাটেলাইট ছবি পায়। অন্য স্যাটেলাইটটি হচ্ছে এফওয়াইটুসি। আবহাওয়াবিষয়ক কৃত্রিম উপগ্রহ। এ দুটি কৃত্রিম উপগ্রহ ব্যবহারের ফলে আট থেকে ১০ মাইল দূরের ঘূর্ণিঝড়ের অবস্থান নির্ণয় করা যায়। স্পারসো ১২ নভেম্বর ২০০৭ থেকেই সিডরের ওপর নজর রেখেছিল। প্রতি ঘণ্টায় সিডরের অবস্থান ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়কে জানানো হচ্ছিল। আগে থেকেই প্রস্তুতি থাকার ফলে অন্যবারের ঘূর্ণিঝড়ের চেয়ে ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম হয়েছে।
বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘বর্তমানে স্পারসো যে দুটি স্যাটেলাইট ব্যবহার করছে, তা দিয়ে অনেক আগে থেকে যেকোনো ঘূর্ণিঝড় শনাক্ত করা যাবে। তাছাড়া নোয়ার মাধ্যমে ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী বিভিন্ন ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও তথ্য জানা যায়। তবে এ ক্ষেত্রে কিছু সীমাবন্ধতা রয়েছে। আকাশ মেঘলা থাকলে নোয়া ছবি তৈরি করতে অক্ষম। কারণ এ ধরনের স্যাটেলাইট অনেকটা ক্যামেরার মতো কাজ করে থাকে। আলোর প্রতিফলনকে কাজে লাগিয়ে ছবি তৈরি করে, এজন্য সূর্যের আলোর প্রয়োজন হয়। এ সমস্যার সমাধান করা যায় যদি মাইক্রোওয়েভ স্যাটেলাইট ব্যবহার করা হয়। স্পারসো এ ধরনের কোনো স্যাটেলাইট নেই। এ ধরনের কৃত্রিম উপগ্রহ স্টেশন ব্যবহারের জন্য পৃৃথক করে ভূমিতে অবস্থিত স্টেশনের প্রয়োজন পড়ে। বাংলাদেশে এমন স্যাটেলাইটের একটি গ্রাউন্ড স্টেশন বসানো হলে ঘূর্ণিঝড়, বন্যাসহ যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের তথ্য আরো সঠিকভাবে জানা যাবে বলে আবহাওয়াবিজ্ঞানীরা মনে করেন।
যদিও বৈশাখ নববর্ষের বারতা নিয়ে আসে, তবে তার মাতাল হাওয়ার তোড়ে উড়িয়ে নিয়ে যায় হাজারও মানুষের স্বপ্ন। এ যেন স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের এক লুকোচুরি খেলা। আর এই লুকোচুরি খেলার মাঝেই বেড়ে উঠেছে পাললিক মাটিতে গড়া আমাদের জীবন। আমরা যেন অনেকটা বেতবৃক্ষের মতো। মচকাতে জানি, ভাঙতে শিখিনি। গত ২২ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিনটি গ্রামের ওপর দিয়ে মাত্র ১৫ মিনিট স্থায়ী ভয়াবহ টর্নেডো বা ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা নিয়ে আখউড়া আমোদাবাদ দীঘি গ্রামের বয়োবৃদ্ধ মোতাহের আলী বলেছেন, জীবনে এমন ঘটনা দেখেনি। চোখের পলকেই সব কিছু ধ্বংস হয়ে গেল। এ যেন এক মহাবিস্ময়!
লেখক :ইয়াসমীন রীমা ;সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Sunday, November 12, 2017

দ্রব্যমূল্য কেন নিয়ন্ত্রণহীন

দ্রব্যমূল্যের দৃশ্যত কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। চাল, তেল, পেঁয়াজ, আদা, রসুনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। চাল ও সবজির দাম বৃদ্ধির অজুহাত হিসেবে ব্যবসায়ীরা বন্যার কথা বলছেন। কিন্তু কিছু পণ্য আছে সরবরাহে ঘাটতি না থাকার পরও দাম বেড়ে গেছে। অর্থাৎ আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়াচ্ছে সিন্ডিকেট। আর এর মাশুল গুনছে সাধারণ মানুষ।
ব্যবসায়ীদের হাতে দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ চলে যাওয়ার পেছনে সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) দুর্বলতাকেও অনেকে দায়ী করেন। আমরাও মনে করি, টিসিবি ক্রমেই গুরুত্ব হারাচ্ছে। হাতেগোনা কিছু পণ্য মাঝেমধ্যে তারা খোলাবাজারে বিক্রি করে, যা বিদ্যমান বিশাল বাজারব্যবস্থায় কোনো প্রভাবই ফেলতে পারে না। টিসিবির দুর্বলতার জন্য নিজস্ব তহবিলের অভাবের সঙ্গে আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকেও দায়ী করা হয়। সরকার কেন টিসিবিকে সবল করার পদক্ষেপ নিচ্ছে না? বিষয়টি যেন সবারই জানা। এ দেশে রাজনীতিক আর আমলারা শুধু তাদের নিজ নিজ পেশায় নিজেদের নিয়োজিত রাখতে পারেননি, তারা তাদের পেশার পাশাপাশি বাণিজ্যেও জড়িয়েছেন প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষে। তবে ঢালাওভাবে সবাই নয়। আর এই একটি কারণেই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সমাজ বিশ্লেষকরা। তারা মনে করছেন, একই সঙ্গে রক্ষক ও ভক্ষকের ভূমিকায় থাকলে (বিশেষ করে রাজনীতিক ও আমলা) যা হওয়ার তাই হচ্ছে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পাশাপাশি বাড়ছে বাসাভাড়া, পরিবহন-ভাড়া, চিকিৎসা ও শিক্ষা খাতের ব্যয়। সরকারি-বেসরকারি সেবার দামও বাড়ছে। সেই অনুপাতে বাড়ছে না মানুষের আয়। ফলে জীবনযাত্রার মানেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, ১৬ কোটি মানুষের দেশে ৯ কোটি ১০ লাখই অতিদরিদ্র, দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির। বাজার অস্থিতিশীল হওয়া মানেই দেশের বেশির ভাগ মানুষের ওপর চাপ পড়া। তাই সরকারকে বাজারে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাই শুধু নয়, কর্মসংস্থানও বাড়াতে হবে। তখন উৎপাদন বাড়বে, বাড়বে ক্রয়ক্ষমতা। আয় বাড়লে মূল্যস্ফীতির আঘাতও হয় সহনীয়।
তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশ বাংলাদেশ। জনসংখ্যার বেশির ভাগ এখানে দারিদ্র্যসীমার মধ্যে বাস করে। বর্তমানে দেশের অন্যতম আলোচ্য বিষয় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি। কালোবাজারি, মুনাফাখোর, মজুদদার প্রভৃতির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য দ্রব্যগুলোর মূল্যবৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিদিন এবং ক্রমে এসব পণ্য সংগ্রহ করা কঠিনতর হচ্ছে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য। জনজীবন আজ বিপর্যস্ত, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মানুষকে অর্ধাহার ও অনাহারে দিন কাটাতে বাধ্য করছে। মানুষের একটু ভালোভাবে বাঁচার দাবি আজ সর্বত্র। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি তাদের প্রতিকূলে। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার সীমাকে অতিক্রম করে অশ্বগতিতে বেড়ে চলছে ব্যয়ের খাত।
দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে জীবনযাত্রার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। একটি পরিবার কীভাবে তাদের দৈনন্দিন জীবনকে নির্বাহ করবে তা নির্ভর করে তাদের আয়, চাহিদা এবং দ্রব্যমূল্যের ওপর। প্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের মূল্য যখন সহনীয় পর্যায়ে এবং সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে, তখন তাদের জীবন কাটে স্বস্তিতে। অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য যখন সাধারণ মানুষের আর্থিক সংগতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে যায়, তখন দরিদ্র এবং অতিদরিদ্র পরিবারে শুরু হয় অশান্তি। তাই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে একদিকে জনজীবনে নেমে আসে কষ্টের কালো ছায়া। অন্যদিকে মুনাফাখোর, কালোবাজারিদের কারণে দেশে বিরাজ করে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি।
পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে বর্তমানে ন্যায়সংগত মূল্যে কোনো পণ্যই আর পাওয়া যায় না। প্রতিটি পণ্যেই যেন অধিক মূল্যের আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে। অথচ এক বা দুই দশক আগেও এই অবস্থা ছিল না। মানুষ জীবন কাটাত সাধ্যের মধ্যে ভালো থেকে। শায়েস্তা খাঁর আমলে টাকায় আট মণ চালের কথা যেন সময়ের রূপকথা। ব্রিটিশ শাসনামলেও দেশের দ্রব্যমূল্য ছিল নিয়ন্ত্রিত অবস্থায়। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর দেশের অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হলেও দ্রব্যের মূল্য সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে ছিল। সামাজিক নিরাপত্তার সঙ্গে খাদ্য নিরাপত্তার সম্পর্ক রয়েছে। বেঁচে থাকার তাগিদ থেকেও কেউ কেউ অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে। আমরা আশা করব, দৃশ্য ও অদৃশ্যমান সব সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নিশ্চিত করা হবে সাধারণ ও নিম্নআয়ের মানুষের ভালোভাবে বেঁচে থাকার নিরাপত্তা।
লেখক:সাবরিনা শুভ্রা; বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, গবেষক ও কলামিস্ট,

Wednesday, November 8, 2017

জঙ্গিবাদ ঠেকাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কঠোর হচ্ছে 



শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জঙ্গিবাদ ঠেকাতে চলমান বিভিন্ন প্রক্রিয়াকে আরো জোরদার করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। হাতে নিচ্ছে সময়োপযোগী বিভিন্ন কার্যক্রম। এ লক্ষ্যে মন্ত্রণালয় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম এবং ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সঙ্গে নিয়মিত সমন্বয় করবে। জঙ্গি সম্পৃক্ততায় অভিযুক্ত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের গ্রেফতারের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়সহ প্রায় ১৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শিগগিরই কঠোর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। চলতি সপ্তাহে ঢাকার ইংরেজি মাধ্যমের তিনটি বিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রণালয়। দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পর্যায়ক্রমে জঙ্গিবিরোধী সভার আয়োজন করবে মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
জঙ্গিবাদে উসকানি দেওয়ার অভিযোগ ওঠায় আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে মাদ্রাসার পাঠ্যবইও বদলানো হচ্ছে। বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যবই থেকে জিহাদবিষয়ক উগ্র মতাদর্শের লেখা বাদ দিয়ে নতুন রচনা সংযোজন করে ছাপানো হচ্ছে নতুন বই। উগ্র ব্যাখ্যা থাকা মাদ্রাসার সহায়ক ও গাইডবই নিষিদ্ধ করতে কঠোর ধারা যোগ করে প্রণয়ন করা হচ্ছে শিক্ষা আইন। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশ অনুযায়ী মাদ্রাসার নতুন বই পর্যবেক্ষণে বিশেষজ্ঞ কমিটির সার্বক্ষণিক নজরদারি থাকবে। প্রয়োজনে যেকোনো সময় পাঠ্যবইয়ের কোনো রচনা বদলানোর সুপারিশ করতে পারবে। এই কমিটিতে স্বরাষ্ট্র, শিক্ষাসহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি থাকবেন।
সূত্র জানায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতর (ডিআইএ) ৩৬ হাজার সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন কার্যক্রমকে জোরদার করছে। ডিআইএর মাধ্যমে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জঙ্গি কার্যক্রমের সংশ্লিষ্টতা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে নজরদারিতে রাখছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জঙ্গিবাদবিরোধী সেল খোলা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। নির্দেশের পরও যারা সেল খোলেনি, সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জঙ্গি সংশ্লিষ্টতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ বাতিল করে শাস্তির মুখোমুখি করার উদ্যোগ নিয়েছে ইউজিসি।
জানতে চাইলে দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষাসচিব (অতিরিক্ত শিক্ষাসচিব) মহিউদ্দিন খান এ প্রসঙ্গে প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জঙ্গিবাদ চর্চা যেন না হয়, সেজন্য দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বেশি তদারকি ও নজরদারি করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও তাদের পদ্ধতিতে সন্দেহভাজন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজে নজরদারি ও অনুসন্ধান চালাচ্ছে।’ নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুই কর্মকর্তা বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১০ দিনের বেশি কোনো
শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকলে তা জানানোর জন্য গত বছর কড়া বার্তা দেয় মন্ত্রণালয়। এ নির্দেশ মানায় তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না অনেক প্রতিষ্ঠান। মাসের পর মাস শিক্ষার্থীরা অনুপস্থিত থাকলেও তা মন্ত্রণালয় ও পুলিশকে জানাচ্ছেন না সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা। সাম্প্রতিক সময়ে এভাবে আত্মগোপনে থেকে জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিয়ে হামলা চালিয়েছেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাবেক শিক্ষার্থীরা। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের বিশেষ নজর রাখার নির্দেশনা দেওয়া থাকলেও তারা রাজনৈতিক কর্মকান্ডের ওপর বেশি নজর রাখেন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকায় জঙ্গিবাদ সম্পর্কিত তথ্য আদান-প্রদান অনেকটা একমুখী হয়ে পড়ে।’
যোগাযোগ করলে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম ছায়েফউল্যা বলেন, ‘মাদ্রাসার পাঠ্যবইয়ের যেসব স্থানে বিতর্কিত পাঠ, বিশেষ করে জঙ্গিবাদে উৎসাহিত করার মতো বিষয় ছিল, তা বাদ দেওয়া হয়েছে। জঙ্গিবাদবিষয়ক জাতীয় কমিটির পরামর্শের ভিত্তিতে আমরা মাদ্রাসার কোরআন-হাদিস, আরবি ও ফিকহবিষয়ক বিভিন্ন পাঠ্যবই যৌক্তিক মূল্যায়ন করেছি।’
অভিযুক্ত ও দায়ী প্রতিষ্ঠান : ১৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ৯টি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল ও সাতটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় জঙ্গি সৃষ্টির উৎস হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে গত বছর শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়। গত চার বছরে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কমপক্ষে ৭২ জন ছাত্র ও শিক্ষকের বিরুদ্ধে জঙ্গি কর্মকান্ডে জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গত মঙ্গলবার কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া রাজধানীর লেকহেড গ্রামার স্কুলও ছিল জঙ্গিবাদের কেন্দ্রস্থল। বিভিন্ন সময়ে এ প্রতিষ্ঠানের অন্তত ১২ জন শিক্ষকের জঙ্গিবাদে যুক্ত থাকার প্রমাণ পায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
জঙ্গি কার্যক্রমে মদদের দায়ে লেকহেড গ্রামার স্কুল বন্ধের নির্দেশ গত রোববার দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। দেশের নিষিদ্ধ তিনটি জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে স্কুলটির সাবেক অধ্যক্ষসহ শিক্ষকদের কর্মকর্তার যোগসূত্র পাওয়া যায়। এর মধ্যে দুজন শিক্ষক ছিলেন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের মাতৃসংগঠন জামায়াতুল মুসলেমিনের ও দুজন হিযবুত তাহ্রীরের সঙ্গে যুক্ত। ঢাকার হলি আর্টিজানে হামলাকারীদের প্রশিক্ষণদাতা সাবেক মেজর জাহিদুল ইসলামও স্কুলটির প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করতেন। গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর রূপনগরে জঙ্গিবিরোধী এক অভিযানে তিনি মারা যান। ভারতের বিতর্কিত ইসলামী বক্তা জাকির নায়েকের মতাদর্শ পড়ানোয় দেশের পিস স্কুলগুলোও গত বছর বন্ধ করে দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
৩৫ পাঠ্যবই থেকে উসকানিমূলক লেখা বাদ : বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে মাদ্রাসার ৩৫টি বই পরিশুদ্ধরূপে আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে আসছে। জাতীয় শিক্ষানীতিতে বর্ণিত মাদ্রাসার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুসরণ করে বইগুলো থেকে ধর্মীয় উসকানিমূলক লেখা বাদ দেওয়া হয়েছে। বিতর্কিত লেখার পরিবর্তে নতুন আলোচনা যুক্ত হয়েছে। কোনটি জিহাদ আর কোনটি জঙ্গিবাদ, তা স্পষ্ট করে ২০১৮ সালের শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ করা হচ্ছে।
এর আগে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত যেসব পাঠ্যপুস্তকে জঙ্গিবাদ-সংশ্লিষ্ট বিষয় ছিল, সেসব বই জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কমিটি গঠন করে যাচাই করে। যাচাইয়ে কয়েকটিতে উসকানিমূলক ও অপব্যাখ্যা করার মতো তথ্য মিলে। মাদ্রাসার পাঠ্যবইয়ে জঙ্গিবাদ বিষয়ে পাঠ্য আছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে গত বছরের ২৪ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়। চিঠিতে মাদ্রাসার কোরআন, হাদিস, সংবিধান ও জাতীয় চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিষয় এবং কোনো রাজনৈতিক দল সম্পর্কে লেখা প্রবন্ধ বা রচনা বাদ দেওয়ার নির্দেশনা ছিল।
এর পরিপ্রেক্ষিতে মাদ্রাসা বোর্ড কর্তৃপক্ষ প্রথম থেকে দশম শ্রেণির ৩৫টি বই মূল্যায়নের উদ্যোগ নেয়। এ লক্ষ্যে আটটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠিত হয়। প্রতিটি কমিটিতে পাঁচজন করে মোট ৪০ জন সদস্য কাজ করেন। কমিটির দেওয়া প্রতিবেদনের আলোকে বিভিন্ন বইয়ে পরিবর্তন আনা হয়। এসব বই আগামী বছর শিক্ষার্থীদের হাতে যাচ্ছে।
বই সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে কমিটি : নতুন করে মুদ্রিত মাদ্রাসার পাঠ্যবই পর্যক্ষেণের জন্য প্রথমবারের মতো বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন হচ্ছে। কমিটির সদস্যরা বইগুলোতে নজর রাখবেন। পাঠ্যবইয়ে জঙ্গিবাদসহ বিতর্কিত আর কোনো পাঠ থাকলে তা পরিবর্তনে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়াই কমিটি গঠনের মূল লক্ষ্য। ১৫ সদস্যের এ কমিটি গঠন করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় মাদ্রাসা বোর্ডকে নির্দেশ দিয়েছে। স্বরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অন্তত ১৫ জন প্রতিনিধি কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হবেন। সব মিলিয়ে ৩০ সদস্যের কমিটি হতে পারে। আগামী শিক্ষাবর্ষের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যবই পৌঁছে দেওয়ার আগেই কমিটি গঠন হতে পারে বলে সূত্র জানায়।
উসকানিমূলক গাইডবই নিষিদ্ধ হচ্ছে : মাদ্রাসার বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের সহায়ক হিসেবে লেখা পাঁচটি প্রকাশনীর গাইডবইয়ে জঙ্গিবাদকে উসকে দেওয়া হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা এ অভিযোগ করে আসছেন। সেগুলোতে ধর্মকে অপব্যাখ্যা করা হচ্ছে। কথিত সহযোগী বা গাইডবইয়ের নামে চিহ্নিত পাঁচটি প্রকাশনীর বইয়ে উগ্র বাক্য আছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে গত বছর জমা দেওয়া এনসিটিবির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, আল ফাতাহ, আল ফালাহ, ইসলামিয়া, ইসলামিয়া কুতুবখানা ও আল ইসলাম প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত গাইড ও বইয়ে জিহাদ বিষয়ে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যেখান থেকে জঙ্গিবাদ উসকে যেতে পারে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় মনে করে, শিক্ষা আইনের খসড়ায় মাদ্রাসার পাঠ্যবইয়ের নামে সহযোগী নোট ও গাইডবইকে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। আইনটি শিগগিরই প্রণয়ন হবে। ফলে বাজারে গাইডবই থাকবে না।
লেখক:হাসান শান্তনু 

রোহিঙ্গা সংকট 

দ্বিপক্ষীয় আলোচনা মিয়ানমারের নতুন ফাঁদ


দ্বিপক্ষীয় আলোচনা মিয়ানমারের নতুন ফাঁদ।
নানা টালবাহানায় বারবার পিছু হটছে মিয়ানমার। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কোনো সদিচ্ছাই দেখা যাচ্ছে না দেশটির। নানা ধরনের আলোচনার নামে কালক্ষেপণের কৌশল নিয়েছে। নামমাত্র কিছু রোহিঙ্গা ফেরত নিয়ে চাইছে আন্তর্জাতিক চাপ প্রশমনের ও সংকটকে দীর্ঘায়িত করতে। এরই কৌশল হিসেবে এখন ত্রি বা বহুমুখী আলোচনার পরিবর্তে সংকট সমাধানের জন্য কেবলমাত্র বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করতে চাইছে। এ জন্য দেশটি রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর সেনাবাহিনীর সহিংসতা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের দেওয়া বিবৃতিরও ঘোর আপত্তি জানিয়েছে।
রোহিঙ্গা সংকটের অবসানে গত সোমবার নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনার পর সর্বসম্মতভাবে একটি বিবৃতি (প্রেসিডেন্সিয়াল স্টেটমেন্ট) দেয়। বিবৃতিতে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর সেনাবাহিনীর সহিংসতা বন্ধ করার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে পরিষদ। কিন্তু সেটি মেনে নিতে পারছে না মিয়ানমার। দুই দিন পর গতকাল বুধবার এক পাল্টা বিবৃতি দিয়ে জাতিসংঘের বিবৃতিতে আপত্তি জানান দেশটির স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি। তাতে প্রত্যাবাসন প্রশ্নে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনায় বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে এবং বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের দ্বিপক্ষীয় চেষ্টাতেই এ সমস্যার সমাধান আসতে পারে বলে মনে উল্লেখ করেন তিনি।
অথচ বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক মহল চাইছে, মিয়ানমারের সঙ্গে ত্রি বা বহুমুখী কূটনীতির মাধ্যমে সংকটের সমাধান। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও সংকটের স্থায়ী সমাধানে বিভিন্ন চুক্তিতে জাতিসংঘসহ অন্যান্য রাষ্ট্রকে সাক্ষী রাখতে। বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের ব্যাপারে মিয়ানমারের সঙ্গে যেকোনো আলোচনায় জাতিসংঘকে অবশ্যই রাখার পক্ষে আন্তর্জাতিক মহল। কারণ সংস্থাটির কাছে রোহিঙ্গারা যে মিয়ানমারের বাসিন্দা ও সেখানকার নাগরিক এ-সংক্রান্ত যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণাদি রয়েছে।
নিরাপত্তা পরিষদের বিবৃতিতে মিয়ানমারের বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে সংকট সমাধানের ইচ্ছা পোষণকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে না নিতে ও সংকটকে প্রলম্বিত করার ‘নতুন ফাঁদ’ বলে মনে করছেন কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, মিয়ানমার নতুন ফাঁদ পেতেছে। তাদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে যে সমাধান সম্ভব নয়, তার উদাহরণ দেশটি নিজেই দিয়েছে। কারণ এর আগে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে করা ১৯৯২ সালের চুক্তি নিজেরাই ভঙ্গ করেছে দেশটি। এমনকি নতুন করে পালিয়ে আসা ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে এবং সংকট সমাধানে গত দুই মাসেরও বেশি সময়ে কোনো সদিচ্ছার প্রমাণ দেয়নি দেশটি। নাগরিকত্ব নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি করছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সঙ্গে দুই দফা আলোচনায় নেওয়া প্রস্তাবের একটিও মানেনি দেশটি। উল্টো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশকে দুষছে। রোহিঙ্গা নির্যাতনকে বৈধতা দিতে ও আন্তর্জাতিক চাপ প্রশমনে রাশিয়া, চীন ও ভারতকে পক্ষে রাখতে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। এমনকি বিশ্ব জনমতকে উপেক্ষা করে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে। প্রতিদিনই বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে রোহিঙ্গারা।
হঠাৎ করেই মিয়ানমার দ্বিপাক্ষিক আলোচনার কথা কেন বলছে-জানতে চাইলে বিশ্লেষকরা বলেন, প্রধান কারণ আন্তর্জাতিক চাপ। দ্বিপাক্ষিক আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ করা গেলে আন্তর্জাতিক চাপ প্রশমন হবে। বিভিন্ন দেশের মিয়ানমারের উৎসাহে ঘাটতি পড়বে। অথচ শুরু থেকেই বাংলাদেশ বিভিন্ন ফোরামে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার পাশাপাশি বহুপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে সংকট সমাধানের প্রস্তাব দিয়ে আসছে।
এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেন, রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে আন্তর্জাতিক মহলের সহায়তা চাওয়ার পাশাপাশি দ্বিপক্ষীয় আলোচনার দ্বারও বাংলাদেশ উন্মুক্ত রেখেছে। ছলচাতুরির আশঙ্কা থাকলেও মিয়ানমারের আহ্বানে বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় গেছে। আমরা জানি এটা থেকে তারা সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবে। সে জন্য আলোচনায় আন্তর্জাতিক মহলকেও চাইছি। তারাও সরব আছে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা চাই।
মিয়ানমারের নেওয়া এই দ্বিপক্ষীয় পদক্ষেপের পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা এবং আইওএম দাতারা যে সম্মেলনের উদ্যোগ নিয়েছে; সেখানে মিয়ানমার দেখাতে চাইছে সংকট সমাধানে তারা উদ্যোগ নিয়েছে। এ ছাড়া চীনের পরামর্শেই মিয়ানমারের এ পদক্ষেপ। এর আগে নিরাপত্তা পরিষদে দেওয়া চীনা প্রতিনিধির ভাষণে সেই ইঙ্গিত ছিল। গত ২৫ অক্টোবর হঠাৎ করেই বাংলাদেশ সফরে এসে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় চীনের বিশেষ দূত সান গোসিয়াং বলেন, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান চায় চীন। দ্বিপক্ষীয় আলোচনার নামে সংকট সমাধান প্রলম্বিত আরেকটি নেতিবাচক দিক হচ্ছে, যে তাতে রোহিঙ্গা সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের সম্ভাবনা হ্রাস পাবে। দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে মিয়ানমার বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়ানো অন্যান্য দেশ ও সংস্থাকে নিষ্ক্রিয় করে দিতে চাইছে। যেন ভবিষ্যতে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ একাকী হয়ে পড়ে।
বিশ্লেষকরা আরো বলছেন, আন্তর্জাতিক সমাজের পক্ষ থেকে যেসব করণীয় চিহ্নিত করা হয়েছিল, সে বিষয়ে মিয়ানমার এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এমনকি উল্টো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। জাতিসংঘের মহাসচিব তিনটি পদক্ষেপের কথা বলেছিলেন, প্রথমত অবিলম্বে সেনা অভিযান বন্ধ করা; মিয়ানমারের অভ্যন্তরে মানবিক সহায়তা দেওয়ার পথে বাধাগুলো অপসারণ করা এবং সবার নিরাপদ, স্বতঃপ্রণোদিত, সম্মানজনক প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ভাষণে যে পাঁচ দফা প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সেখানেও সহিংসতা বন্ধ করার কথা বলেছিলেন। কিন্তু এ-যাবৎ এই বিষয়ে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে কোনো ঘোষণার লক্ষণ নেই। সেই অবস্থায় জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর প্রত্যক্ষ, কার্যকর ও নীতিনির্ধারণ পর্যায়ে সংশ্লিষ্টতা ছাড়া দ্বিপক্ষীয় আলোচনা ও পদক্ষেপ বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হবে বলে মনে হয় না।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, মিয়ানমার শুরু থেকেই দ্বিপাক্ষিক আলোচনার কথা বলছে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে অনিশ্চয়তার তৈরি করার জন্য। দ্বিপাক্ষিক আলোচনা চলবে অসুবিধা নেই। কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। নিরাপত্তা পরিষদকে শুরু বিবৃতি দিলেই হবে না। সংকট সমাধানে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে রেজুলেশন চাই। চাপের মুখে মিয়ানমার নানা আলোচনার কথা বলবে। কিন্তু সংকট সমাধানে বাধ্য করতে শক্ত অবস্থান লাগবে।
এই সাবেক কূটনীতিক বলেন, আমরা দ্বিপাক্ষিক আলোচনা চাই। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে যেসব চুক্তি হবে, সেগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অন্য দেশকে রাখতে হবে। চুক্তি কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে, তার দেখভালো জাতিসংঘ থাকবে।
মিয়ানমারের বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর (অব.) ইমদাদুল ইসলাম বলেন, নিরাপত্তা পরিষদের বিবৃতিতে মিয়ানমারের পাল্টা প্রতিক্রিয়া পরিস্থিতি জটিল করল। অথচ নিরাপত্তা পরিষদের এই বিবৃতি এমন শক্ত কোনো অবস্থান নয়। এটি কোনো ধরনের প্রস্তাবও নয়। তার মানে মিয়ানমার চাইছে না রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক মহল তৎপর থাক। দ্বিপাক্ষিক আলোচনার কথা বলে মিয়ানমার রোহিঙ্গা সংকট সমাধানকে জটিল ও প্রলম্বিত করতে চাইছে।
এই সাবেক কূটনীতিক বলেন, দ্বিপাক্ষিক আলোচনার দ্বার তো খোলাই ছিল। মিয়ানমারই সেখানে অনাস্থা তৈরি করেছে। এখন পর্যন্ত তারা জয়েন্ট ওয়ার্কিং কমিটি তৈরি করেনি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ যে নতুন চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছে, সে নিয়েও কোনো কথা বলছে না। উল্টো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে দেরির জন্য বাংলাদেশকে দুষছে। বলছে বাংলাদেশ নাকি দাতা সংস্থার সহযোগিতার জন্য প্রত্যাবাসন চাইছে না। এর আগে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মিয়ানমার সফরের সময় যেসব আলোচনা হয়েছিল, পরে মিয়ানমার তাদের আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে সেগুলো রাখেনি। ফলে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা চলুক, অসুবিধা নেই। কিন্তু সংকট সমাধানে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে হলে বহু পক্ষকে রাখতে হবে। যে পথেই যাক, কফি আনান কমিশনকে ধরেই আলোচনা চালাতে হবে। কারণ সেটি মিয়ানমারেরই করা। কমিশনের প্রস্তাবে সংকট সমাধানের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।

Tuesday, November 7, 2017

সংকট সমাধানে প্রয়োজন সমঝোতা  

অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আভাস


একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে নির্বাচনী রাজনীতিতে গতি-প্রকৃতির বদল হচ্ছে প্রতি সপ্তাহেই। রং বদলাচ্ছে রাজনীতির। সব দলের অংশগ্রহণে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিষয়ে কখনো আশা জাগছে আবার কখনোবা দেখা দিচ্ছে নিরাশাও। এক সপ্তাহ আগেও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলাকে কেন্দ্র করে রাজনীতি যতটা গুমোটের দিকে যাচ্ছিল, গত এক সপ্তাহে, বিশেষ করে এই সপ্তাহের শেষের দিকে সেখানে ইতিবাচক কিছু আভাস মিলেছে। নির্বাচন নিয়ে আশাব্যঞ্জক তথ্য মিলেছে।
গত এক সপ্তাহের রাজনীতি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাশাপাশি দেশি-বিদেশি কূটনৈতিক মহলের পক্ষ থেকেও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে মুখোমুখি অবস্থানে থাকা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পক্ষ থেকেও কিছুটা নরম সুরেই কথা বলতে শোনা গেছে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের অনেক বেশি সংযত থাকতে দেখা গেছে।
সর্বশেষ ৭ নভেম্বর উপলক্ষে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে যে উত্তাপ ছড়ানোর আশঙ্কা ছিল, ‘সমাবেশের অনুমতির আশ্বাস পাওয়া গেছে’—দলের পক্ষ থেকে এমন তথ্য জানানোর পরিপ্রেক্ষিতে সেই উত্তাপ কিছুটা হলেও প্রশমিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে রাজনীতির মাঠে ক্ষমতাসীনদের অনেক বেশি সংযত মনে হচ্ছে। তেমনি ৭ নভেম্বর সংসদ ভবনে চলমান সিপিএ সম্মেলন উপলক্ষে নিরাপত্তার কারণে বিএনপিকে জিয়ার মাজারে যেতে না দেওয়া হলেও দলের পক্ষ থেকে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়নি। এর আগে গত ২ নভেম্বর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ বলেছেন, যত প্রতিকূল পরিবেশই আসুক না কেন, বিএনপি আগামী নির্বাচনে যাবে। এমনকি এই সরকার বিএনপির সঙ্গে সমঝোতায় আসতে বাধ্য হবে বলেও জোর দিয়েছেন তিনি। এর প্রত্যুত্তরে পরদিন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিএনপিকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, আগামী নির্বাচনে যদি না আসে, তাহলে তাদের অস্তিত্ব হারিয়ে যাবে। এমনকি খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার ঘটনায় এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রতিহিংসামূলক কোনো কর্র্মসূচিতে যায়নি। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়ার যে সিদ্ধান্ত, তা রাজনীতির ভাষায় ‘সংযত আচরণ’ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
অন্যদিকে গত এক সপ্তাহে দেশি-বিদেশি কূটনীতিতেও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রসঙ্গ এসেছে। গত ২ নভেম্বর ‘জাতিসংঘ সবার অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চায়’ বলে মন্তব্য করেছেন সংঘের বিদায়ী আবাসিক সমন্বয়কারী রবার্ট ওয়াটকিন্স। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে এখন নির্বাচনের সুবাতাস বইছে। জাতিসংঘ প্রত্যাশা করে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি কেবল অংশগ্রহণমূলক নয়, এটি অবাধ এবং সুষ্ঠু হবে। এরপর গত সোমবার খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনীতিবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি টমাস শ্যাননের কাছেও বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তবে শর্ত হিসেবে বিদ্যমান সংসদ ভেঙে দিয়ে একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীন সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলেছেন দলের নেতারা।
চলমান রাজনীতির এমন প্রেক্ষাপটকে আগামী নির্বাচনের জন্য ইতিবাচক আভাস বলে মনে করছেন নির্বাচন ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, নির্বাচন নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সাম্প্রতিক রাজনীতিতে কিছুটা হলেও আশা জেগেছে। সরকার বলছে, তারা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়। বিএনপিও যেতে চাইছে নির্বাচনে। এখন প্রশ্ন হলো নির্বাচন ঘিরে দেখা দেওয়া বিতর্কের সমাধান কীভাবে হবে। সেটা ভাবতে হবে সবাইকে। সংকট সমাধানে সরকারের সদিচ্ছা প্রয়োজন।
প্রশ্ন উঠেছে-নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মূল দুই ইস্যুতে দেখা দেওয়া সংকটের সমাধান হবে কী করে? একদিকে আওয়ামী লীগ বলছে, বর্তমান সরকারের অধীনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচন হবে। সংবিধান অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই নির্বাচন করবে নির্বাচন কমিশন। অন্যদিকে বিএনপির দাবি, বিদ্যমান সংসদ ভেঙে দিয়ে সহায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। ফলে নির্বাচনের জন্য চলমান রাজনীতিতে যে ইতিবাচক আভাস মিলছে, সেটি শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখবে তো?—এমন প্রশ্নও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে।
এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন বলেন, সংকট সমাধানে প্রয়োজন সমঝোতা। আলোচনা দরকার। এখন যে প্রেক্ষাপট তাতে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন সম্ভব এবং সেটিই হবে। কিন্তু সব দলকে নির্বাচনে আনতে হলে আলোচনা দরকার। এ ক্ষেত্রে সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে। তবে বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলেরও ভূমিকা নিতে হবে।
অবশ্য গত ১৪ অক্টোবর শনিবার সরকারি বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনিবাহী সংসদ ও উপদেষ্টা পরিষদের যৌথসভার শুরুতেই দেওয়া প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার বক্তব্যে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারের সদিচ্ছার প্রমাণ মিলেছে। সেদিন তিনি বলেন, ‘নির্বাচন যাতে অবাধ ও সুষ্ঠু হয়, আমরা সেটাই চাই। আগামীতে নির্বাচন হবে, সুষ্ঠু নির্বাচন যাতে হয় আলোচনা করে তার একটা পথ বের করব। আমরা চাই, মানুষ মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ করবে। যার যার প্রতিনিধি সে সে বেছে নেবে।’
বর্তমান রাজনীতিকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য ইতিবাচক বলে মনে করছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন। তিনি বলেন, কিছু নেতিবাচক ঘটনা থাকলেও রাজনীতিতে সমঝোতার একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে; যা আমাদেরকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি সব দলের অংশগ্রহণমূলক হওয়ার বিষয়ে আশাবাদী করে তুলছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ করে মনে হচ্ছে, সরকার ও বিরোধী দল সবাই চাচ্ছে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে ও সমঝোতার মধ্যে অনুষ্ঠিত হোক। সরকার থেকেও এ বিষয়ে বলা হয়েছে ও পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বিএনপিও নির্বাচনে অংশ নেবে বলেই দলটির বিভিন্ন নেতার বক্তব্যে মনে হচ্ছে। নির্বাচন হতেই হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার জন্য সরকারের কাছ থেকে অনুমতি পাবে বলে বিএনপি একটা আশ্বাস পেয়েছে, যা অবশ্যই রাজনীতিতে ইতিবাচক। আমিও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আগামী নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণে হওয়া উচিত। এই নির্বাচন বিশ্লেষক আরো বলেন, নির্বাচনী রাজনীতিতে বর্তমানে যে সমঝোতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, তা ধরে রাখতে প্রয়োজন সব রাজনৈতিক দলের সদিচ্ছা। গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখতে রাজনীতিবিদদের আন্তরিক সদিচ্ছা থাকতে হবে।
নির্বাচন বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপির প্রধান তিন দাবি অসাংবিধানিক। এর মধ্যে নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে সংবিধানের ৫৫(১) অনুচ্ছেদে ও ৫৬ অনুচ্ছেদের (২) উপ-অনুচ্ছেদের শর্তাংশে বলা হয়েছে-বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানে সহায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো কাঠামো নেই। পঞ্চদশ সংশোধনীর পর নির্বাচনকালীন সরকারের রূপ কী হবে, কারা মন্ত্রিসভায় থাকবেন বা থাকবেন না; তা নির্ধারণের একমাত্র অধিকার প্রধানমন্ত্রীর।
একইভাবে সংবিধানের ১২৩(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মেয়াদ অবসানের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়ার এখতিয়ার কারো নেই বলেও জানিয়েছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞরা। এই বিধানের কারণে সংসদ বহাল রেখেই নির্বাচন কমিশনকে আরেকটি সংসদ নির্বাচন করতে হবে। তবে ওই সময় সংসদের অধিবেশন বসবে না।
এমনকি নির্বাচনের আগে বিএনপি প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের যে দাবি করেছে, সংবিধানে এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা নেই বলেও জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ব্যাপারে সংবিধানে বলা আছে, বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সংসদের মেয়াদ শেষের ৯০ দিনের মধ্যে। ফলে সরকারের পদত্যাগের প্রশ্ন ওঠে না। কোনো কারণে যদি প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগও করেন তাহলেও সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আস্থাভাজন কাউকে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেবেন।
তবে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচনী পরিবেশকে সমঝোতামূলক করতে দরকার রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছা। সংসদের বাইরের দল বিএনপি দুর্বল অবস্থানে আছে। তারা নির্বাচনের ব্যাপারে সমঝোতা চাইছে বলে মনে হচ্ছে। সরকারি দলকেও চাইতে হবে। বর্তমানের পরিবেশকে আরো সুন্দর করতেও তা দরকার। রাজনীতিবিদরা চাইলে পরিবেশ আরো সুন্দর হবে, তারা না চাইলে পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হবে বলে আমি মনে করি। তখন আমরা আরো সংকটের দিকে এগিয়ে যাব। আশা করি, সব দলের রাজনীতিবিদের মধ্যে এ বোধোদয় ঘটবে।
লেখকঃ প্রতীক ইজাজ 

Saturday, November 4, 2017


সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে আশ্রয়শিবিরের দিকে চলেছে একদল রোহিঙ্গা। গতকাল কক্সবাজারের পালংখালীতে lবর্তমানে সরকারি ২৫টি, সেনাবাহিনীর ১০টি এবং বেসরকারি ৫৩টি হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা, পরিবার পরিকল্পনা ও পুষ্টিসেবা দিচ্ছে। উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলা হাসপাতাল এবং কক্সবাজার সদর হাসপাতালকে এই হিসাবের মধ্যে ধরা হয়েছে। নতুন সবচেয়ে বড় হাসপাতালটি আন্তর্জাতিক রেডক্রস ফেডারেশন তৈরি করেছে। ৬০ শয্যার এই হাসপাতালে অত্যাধুনিক অস্ত্রোপচারব্যবস্থা আছে, নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রও (আইসিইউ) থাকবে।ছোট-বড় ৮৮টি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা দিচ্ছে। আরও নতুন হাসপাতাল স্থাপনের প্রস্তাব সরকারের কাছে আসছে। রোহিঙ্গাদের নতুন দুটি টিকা দেওয়ার কথা ভাবছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কক্সবাজার জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র এ তথ্য দিয়েছে।
কক্সবাজারের বিভিন্ন শিবিরে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা আছে। গতকাল শুক্রবার রোহিঙ্গাবিষয়ক স্থানীয় টাস্কফোর্সের একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিদিন মিয়ানমার থেকে দেড় থেকে দুই হাজার রোহিঙ্গা আসছে। আঞ্জুমানপাড়া সীমান্ত এলাকায় বহু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢোকার অপেক্ষায় আছে।
কক্সবাজার জেলা সিভিল সার্জন মো. আবদুস সামাদ প্রথম আলোকে বলেন, রোহিঙ্গারা স্বাস্থ্যসেবাবঞ্চিত ছিল। তাদের মধ্য ডায়রিয়া, হামসহ নানা সংক্রামক রোগের প্রকোপ বেশি। মালয়েশিয়া সরকার ১০০ শয্যার একটি হাসপাতাল নির্মাণ ও তা পরিচালনার সব খরচ বহন করবে। ইরান সরকারও একটি হাসপাতাল করার জন্য সরকারের কাছে অনুমতি চেয়েছে।
রোহিঙ্গাদের জন্য ২০০৯ সাল থেকে ৫০ শয্যার একটি হাসপাতাল কুতুপালংয়ে চালু রেখেছে সীমান্তবিহীন চিকিৎসক দল বা এমএসএফ। প্রতিষ্ঠানের প্রধান মেডিকেল কর্মকর্তা ডা. মো. সজীব হোসেন প্রথম আলোকে জানান, এমএসএফ ৫০ শয্যার আরও তিনটি নতুন হাসপাতাল বালুখালী, মাইন্যাঘোনা ও জামতলীতে তৈরি করবে।
সংক্রমণের আশঙ্কা
রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে কলেরা ছড়িয়ে পড়তে পারে, সেই আশঙ্কায় আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের পরামর্শে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় রোহিঙ্গাদের কলেরার টিকা খাওয়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। গত ১০ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ৭ লাখ ৪৮৭ জনকে কলেরার টিকা খাওয়ানো হয়েছে। এ ছাড়া ৭২ হাজার ৩৩৪টি রোহিঙ্গা শিশুকে পোলিও টিকা দেওয়া হয়েছে। ভিটামিন-এ ক্যাপসুল খাওয়ানো হয়েছে ৭২ হাজার ৬৪ শিশুকে। ৩৫ হাজার ৫১৯টি শিশুকে হাম-রুবেলার টিকা দেওয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেন, শীতকাল আসছে। এই সময় রোটা ভাইরাসের সংক্রমণ (এতে ডায়রিয়া হয়) বেশি হয়। তাই রোটা ভাইরাস প্রতিরোধে টিকা ব্যবহারের কথা ভাবা হচ্ছে। তা ছাড়া রোহিঙ্গাদের নিউমোনিয়ার টিকাও দেওয়া হবে। এ ছাড়া উখিয়া ও টেকনাফ এলাকায় স্বাস্থ্যসেবাকে জোরদার করার জন্য বিশ্বব্যাংকের সঙ্গেও আলাপ-আলোচনা চলছে।
ন্যাশনাল লিভার ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের একটি চিকিৎসক দল ২১ অক্টোবর ৩০০ গর্ভবতী রোহিঙ্গার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে। তাতে ২৪ জনের শরীরে হেপাটাইটিস-সি শনাক্ত হয় (৮ শতাংশ)। ওই দলের সঙ্গে ছিলেন ডা. জুনায়েদ পাইকার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের মধ্যে হেপাটাইটিসে সংক্রমণের হার খুব বেশি (বাংলাদেশে ৩ শতাংশ)। প্রতিরোধ ব্যবস্থা না নিলে দ্রুত তা শিবির অতিক্রম করে বৃহত্তর সমাজে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে।’

Monday, October 30, 2017

বাসের রাস্তাতেই ‘স্মার্ট ট্রেন’ চলবে

বাসের রাস্তাতেই চলতে সক্ষম হাই-টেক স্মার্ট ট্রেন তৈরি করা হয়েছে চীনে। চীনের জুঝৌ প্রদেশে ট্রায়াল রান করেও দেখা হয়েছে এর। এই নতুন যাতায়াত ব্যবস্থা বাসের থেকে বেশি কার্যকরী এবং ট্রাম ব্যবস্থার চেয়ে খরচ অনেক কম। আগামী বসন্ত থেকেই চীনের রাস্তায় চলতে শুরু করবে নতুন এই ট্র্যাকহীন রেল। ভবিষ্যতে ট্রেনটি চালকহীন অবস্থাতেই চলবে বলেও জানানো হয়েছে।
চীনা শহর জুঝৌতে পরীক্ষামূলকভাবে চালানো হচ্ছে ভবিষ্যতের অত্যাধুনিক ট্রেন। এটির ট্র্যাক নেই। নির্দিষ্টি লাইনে যাতায়াত করে না। নিজের মতো করে জায়গা দিয়ে যেতে পারে। জুঝৌয়ের ব্যস্ত রাস্তায় এই ট্রেন চালানো হয়েছে। ব্যস্ত রাস্তায় লাইনহীন ট্রেন দেখে অবাক সবাই। দেখতে অনেকটা ট্রামের মতো হলেও এর কোনো নির্দিষ্ট ট্র্যাক নেই। নিজের মতো করে রাস্তায় চলছে।
নতুন এই স্মার্ট ট্রেনে একসঙ্গে ৩০০ যাত্রী যাতায়াত করতে পারবে। এই ট্রেনের সর্বোচ্চ গতি থাকবে ৭০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা। শহরের মধ্যে এই গতি যথেষ্টই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ ছাড়াও নতুন এই স্মার্ট ট্রেনটিতে সেন্সরের মাধ্যমে থামবে, চালু হবে। যার ফলে যাতায়াতকে সহজ করার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রী পরিবহনে খরচও কমবে বলে জানিয়েছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি।

Saturday, October 28, 2017

রোহিঙ্গাদের ওপর নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ  

নিরাপত্তা ঝুঁকির শঙ্কা 


শুরুতেই মিয়ানমার থেকে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ওপর সতর্ক নজর রাখছে বাংলাদেশ। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে মানবিক সহায়তার পাশাপাশি এসব শরণার্থীকে কঠোর নজরদারিতে রাখা হয়েছে। বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের অধিকার লড়াইয়ে থাকার দাবিদার আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিসহ (এআরএসএ) মিয়ানমারের সশস্ত্র গেরিলা সদস্যরা যাতে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে সেদিকে নজর রাখা হয়েছে। তেমনি এসব রোহিঙ্গা যাতে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে না পড়ে ও তাদের উসকে দিয়ে বা রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে কেউ কোনো ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করতে না পারে, সেজন্য নেওয়া হয়েছে বিশেষ সতর্ক ব্যবস্থা। এজন্য ত্রাণ দিতে আসা এনজিওসহ বেসরকারি সংস্থাগুলোর কার্যক্রমের ওপর নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। নিরাপত্তা ইস্যুকে কেন্দ্র করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যেই গঠন করেছে রোহিঙ্গা সেল। স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে এ সেল কাজ করছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ ও বিজিবি সদর দফতর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এমন অবস্থার মধ্যে গত শুক্রবার রাতে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার বালুখালী ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের হামলায় চার বাংলাদেশি আহত ও আটক দুই রোহিঙ্গার কাছে অস্ত্র পাওয়া গেছে। গতকাল কক্সবাজারের রামুতে এক রোহিঙ্গা যুবকের হামলায় এক বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এই রোহিঙ্গা যুবক তার ফুফুকে সঙ্গে নিয়ে দেড় মাস আগে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। এছাড়া আশ্রিত রোহিঙ্গাদের আরো কিছু বিচ্ছিন্ন বিশৃঙ্খল ঘটনায় দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তায় ঝুঁকির শঙ্কা দেখা দিয়েছে। আটক দুই রোহিঙ্গার কাছে থাকা একনলা বন্দুক, এলজি, চারটি কার্তুজ ও দুটি কার্তুজের খোলা খোসা কোথা থেকে এলো, কে বা কারা দিল—তা নিয়ে উদ্বিগ্ন প্রশাসনও। আটক রোহিঙ্গারা দুজনেই শিবিরে নতুন এসেছেন বলে জানিয়েছেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার চাইলাউ মারমা।
এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের রোহিঙ্গা গবেষক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তারা বলেছেন, এত সতর্ক অবস্থা ও কঠোর নজরদারির মধ্যেও রোহিঙ্গাদের হাতে অস্ত্র আসার বিষয়টি ভীষণ উদ্বেগের। এর একমাত্র সমাধান যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো। কিন্তু অবস্থা যেখানে দাঁড়িয়েছে, মনে হচ্ছে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে সময় লাগবে। সুতরাং এখনই সরকারকে রোহিঙ্গাদের ওপর আরো বেশি নজরদারি বাড়াতে হবে। ‘কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল’ পদ্ধতিতে রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নির্দিষ্ট কয়েকটি ক্যাম্প করে সেখানে রাখতে হবে। ক্যাম্পে সতর্ক পাহারা বসাতে হবে যাতে কেউ সহজেই সেখানে ঢুকতে ও সেখান থেকে বেরুতে না পারে। বাউন্ডারি দিতে হবে। প্রত্যেক ক্যাম্পের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে আলাদা কমিটি করতে হবে। আশ্রিত সব রোহিঙ্গার বায়োমেট্রিক নিবন্ধন নিশ্চিত করতে হবে। সরকারকে খুব সতর্কতার সঙ্গে এ ইস্যুকে মোকাবিলা করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়ে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে হবে। ‘নতুবা এসব রোহিঙ্গা ভবিষ্যতে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে’ বলেও মন্তব্য করেন তারা।
এ বিষয়ে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, রোহিঙ্গাদের ওপর আরো সতর্ক ও কঠোর নজর দেওয়া দরকার। গত দুই মাসে নতুন রোহিঙ্গারা এলেও রোহিঙ্গা সংকট বহু বছরের। এসব রোহিঙ্গা দুই ধরনের সংকটে রয়েছে। মিয়ানমারে নির্যাতন, বাংলাদেশে আশ্রিত। এরা বহু বছরের নির্যাতিত। চোখের সামনে স্বজনের নির্মম মৃত্যু ও নির্যাতন দেখেছে। বাড়িঘর পুড়তে দেখেছে। নিরুপায় হয়ে নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয় নিয়েছে। সুতরাং এদের ভেতর এক ধরনের ক্ষোভ থাকবেই। সেখান থেকে তারা এক দিন প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টাও করবে। এসব রোহিঙ্গা এই দেশ থেকে মিয়ানমারে গোপন হামলা চালালে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি ঘটবে। সীমান্তে শান্তি বিঘিœত হবে। উত্তেজনা দেখা দেবে। তখন এসব রোহিঙ্গা অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়বে। সুতরাং সেদিকটা এখনই ভাবা দরকার।
অবশ্য আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান ও অতিরিক্ত ডিএমপি কমিশনার মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে নির্যাতিত হয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কেউ যাতে তাদের জঙ্গিবাদের দিকে টানতে না পারে সে ব্যাপারে নজরদারি রাখছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সবাই আমরা সতর্ক রয়েছি। মিয়ানমারে যে মানবিক বিপর্যয় চলছে তার সুযোগ নিয়ে কোনো মহল যাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে।’
এমন পরিস্থিতিতে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে-জানতে কথা হয় দেশের কয়েকজন সাবেক কূটনীতিক, গবেষক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকের সঙ্গে। কক্সবাজারে বালুখালী ক্যাম্পে দুই দিন থাকার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, ক্যাম্পে দেখেছি উঠতি বয়সী রোহিঙ্গা ছেলেরা ভীষণ বেপরোয়া, উচ্ছৃঙ্খল ও সাহসী। তারা যা কিছু করতে পারে। স্থানীয় লোকজন আতঙ্কে আছে। এভাবে চলতে থাকলে সামাজিক অপরাধের পাশাপাশি দুর্বৃত্তায়ন বাড়বে। সুতরাং আশ্রিত রোহিঙ্গাদের নির্দিষ্ট ক্যাম্পে রাখতে হবে। ক্যাম্পে সতর্ক নজর রাখতে হবে যাতে কেউ সহজেই ঢুকতে বা বেরুতে না পারে। কঠিন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। তা না হলে বহু ধরনের অপরাধ সৃষ্টি হতে পারে। তারা একসময় টিকে থাকার কারণেই স্থানীয়দের সঙ্গে নানা ধরনের দ্বন্দ্বে লিপ্ত হবে। জমি দখল করবে। গরু-বাছুর কেড়ে নেবে। এ রকম অভিযোগ ইতোমধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে।
এই রোহিঙ্গাদের নানা গোষ্ঠী ব্যবহার করতে পারে উল্লেখ করে এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, উগ্র মৌলবাদী ধর্মীয় গোষ্ঠী বিপদের সুযোগ নিয়ে জিহাদি তন্ত্রে নেওয়ার চেষ্টা করবে। বিপথে নিতে উদ্বুদ্ধ করবে। তাদের তৎপরতা ও অপতৎপরতা বন্ধ করতে না পারলে নানামুখী বিপদ দেখা দেবে। স্থানীয়দের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখা দিতে পারে। রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার হতে পারেন। কারণ তাদের উসকানি বা ইন্ধনদাতার অভাব নেই। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ঝুঁকি তো বটেই, বহুমুখী বিপদের আশঙ্কাও রয়েছে। সুতরাং জরুরি ভিত্তিতে শতভাগ নিবন্ধন করে কঠোর নজরদারির মধ্যে রাখতে হবে। যে কয়েকটা ক্যাম্প প্রয়োজন সেখানে আলাদা করে রাখতে হবে। প্রত্যেক ক্যাম্পের জন্য আলাদা কমিটি করতে হবে। ‘কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল’ পদ্ধতিতে কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই।
মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর (অব.) ইমদাদুল ইসলাম বলেন, আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে, যত দিন না তাদের মিয়ানমারের ফেরত পাঠানো যায়। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমারকে ফেরত নিতে বাধ্য করতে হবে। এ ছাড়া এ সংকটের আর কোনো সমাধান নেই। এই কূটনীতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, সরকার যথেষ্ট সতর্ক। রোহিঙ্গাদের ওপর কড়া নজরদারিও রেখেছে। বড় কথা হলো সরকার এই রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে কোনো উসকানি, উৎসাহ বা ইন্ধন দিচ্ছে না। কারণ রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সরকার উত্তেজনা চায় না। শান্তিপূর্ণভাবেই সমাধান চায়। আশ্রিত রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে জড়াক, তা সরকার চায় না ও সে ব্যাপারে কোনো ইন্ধনও দিচ্ছে না। এর উদাহরণ হিসেবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়ানমারে গিয়ে জিরো টলারেন্স-সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছেন। এর মধ্য দিয়ে মিয়ানমারকে বার্তা দিয়েছে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের কোনো ধরনের ইন্ধন দিচ্ছে না। তারা যেন দ্রুত ফিরিয়ে নেয়। নতুবা ইন্ধন দেওয়ার লোকের অভাব হবে না।
এই বিশ্লেষক বলেন, ভূ-প্রাকৃতিক কৌশলগত কারণেই নানা মহল নিজ নিজ স্বার্থে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ব্যবহারের চেষ্টা চালাতে পারে। জাতিসংঘ আগেই বলেছে, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে দেরি হলে আরাকান রাজ্য মিলিট্যান্সির জন্য উর্বর ভূমি হবে। উগ্রবাদ জঙ্গিবাদ জন্ম নিতে পারে। রোহিঙ্গারা ব্যবহৃত হতে পারেন। কারণ ইয়ং জেনারেশনের মধ্যে তাদের ওপর নির্যাতনের কারণে এক ধরনের উগ্র চেতনাবোধের জন্ম নেবে। তারা নির্যাতিত। চোখের সামনে স্বজনদের হত্যা হতে দেখেছেন। ঘরবাড়ি পুড়েছে। ভেতরে এক ধরনের ক্ষোভ সৃষ্টি হচ্ছে। সেখানে ইন্ধন দেওয়ার লোকের অভাব হবে না।
‘তবে সরকার যতই সতর্ক বা নিরাপত্তাব্যবস্থা নেক না কেন-ভূকৌশলগত স্বার্থ যাদের আছে, তারা এই রোহিঙ্গাদের ব্যবহারের চেষ্টা করবেই। যদি রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে দেরি হয়, তাহলে এসব আশ্রিত রোহিঙ্গার মধ্যে এক ধরনের মিয়ানমারের বিরুদ্ধে উগ্রচেতনাবোধ আসবে। কেউ না কেউ তাদের উসকে দেবে। তারা সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে ঠেলে দেবে। বিপদে পড়বে বাংলাদেশ। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাঝুঁকির মুখে পড়বে। সুতরাং এই রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে হবে। সেটাই সমস্যার সমাধান’ উল্লেখ করেন মেজর (অব.) ইমদাদুল ইসলাম। তবে তিনি এ কথাও বলেন, রোহিঙ্গাদের কাছে এখন অস্ত্র থাকার কথা নয়। অস্ত্র নিয়ে প্রবেশও কঠিন। সুতরাং বালুখালীতে যে অস্ত্র পাওয়ার কথা বলা হচ্ছে, সেটি কোনো পক্ষের কোনো চক্রান্ত কি না-সেটিও খতিয়ে দেখতে হবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শরণার্থী গবেষক জাকির হোসেন বলেন, বাংলাদেশের পক্ষে এত বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার দীর্ঘদিনের জন্য আশ্রয় দেওয়া সম্ভব নয়। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা ইতোমধ্যেই দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে এই রোহিঙ্গাদের জড়িয়ে পড়ার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। ইয়াবাসহ সমুদ্রপথে আসা মাদকদ্রব্য পাচার বেড়েছে। এমনও হতে পারে, এই রোহিঙ্গারাই এই দেশে থেকে এক দিন মিয়ানমারে, এমনকি ভারতেও হামলা চালাতে পারে। সে ক্ষেত্রে ওই দুই দেশের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটবে। ফলে রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধান করতেই হবে।
লেখক: প্রতীক ইজাজ  

আশ্বাসেই বিশ্বাস 

আশ্বাসের ওপর বিশ্বাস করেই চলতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। আশ্বাসটা দিচ্ছে কে? জবাবে বলতে হয়, ‘মিয়ানমার সরকার’। জবাবকে ‘অর্ধসত্য’ বলা যেতে পারে, পুরোটা নয়। কেননা, পৃথিবীতে মিয়ানমার সরকার সম্ভবত একমাত্র ব্যতিক্রমী সরকার, যেখানে পার্লামেন্টের ক্ষমতা ব্যাপকভাবে সীমিত। এখানে সেনাবাহিনীই সর্বক্ষমতার উৎস।
গত ১২ অক্টোবর অং সান সু চি ও সে দেশের সেনাপ্রধান রোহিঙ্গা ইস্যুতে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন। সেদিন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সু চি বলেছেন, রাখাইন থেকে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা চলছে। কিন্তু সেনাপ্রধান ছিলেন বিপরীত মেরুতে। তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের বাসিন্দা নয়। এমনকি রোহিঙ্গা মুসলিমরা মিয়ানমারের জনগোষ্ঠীও নয়। তিনি গণমাধ্যমে প্রকাশিত দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের সংখ্যাকে অতিরঞ্জিত বলে অভিহিত করেছেন। এমনকি রোহিঙ্গাদের পরিচয়কে অস্বীকার করে বলেছেন, ‘ওরা বাঙালি’।
প্রথম দফা বৈঠকের তিন সপ্তাহ পর গত মঙ্গল ও বুধবার বৈঠকে একইভাবে আশ্বাস পাওয়া গেলেও সীমান্তের ওপার থেকে রোহিঙ্গাদের পালিয়ে আসা থেমে থাকেনি। তবে একই সময়ে অনুষ্ঠিত দুই পক্ষের বৈঠকে সু চি বলেছেন, বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের ফিরিয়ে নিতে তার সরকার কাজ শুরু করেছে। কফি আনান কমিশন বাস্তবায়নেও তার সরকার কাজ করছে। এ ধরনের আশ্বাস একবার নয়, একাধিকবার পাওয়া গেছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সু চির বক্তব্যের বিপরীত।
এদিকে কূটনৈতিক সূত্রমতে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ৩০ নভেম্বরের মধ্যে জয়েন্ট ওয়ার্কিং কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিলেও মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ ব্যাপারে কোনো দিনক্ষণ উল্লেখ করেননি। দুই দেশের সমানসংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে এ কমিটি গঠন হবে বলা হলেও প্রতিনিধিদের মধ্যে কারা থাকবেন, সে ব্যাপারে কিছুই বলেনি মিয়ানমার। মতবিরোধ দেখা দিয়েছে কফি আনান কমিশন রিপোর্ট বাস্তবায়ন নিয়েও। আসাদুজ্জামান খান রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধের দাবি জানালে মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, মিয়ানমারে কোনো নির্যাতন হচ্ছে না। রোহিঙ্গারা নিজেরাই চলে যাচ্ছে। আসাদুজ্জামান খান রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি স্বচক্ষে দেখতে চাইলে তাতে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি। এমনকি সীমান্তে মাইন পুঁতে রাখার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেছে, এ কাজ তারা করেনি। অন্য কেউ করেছে।
রোহিঙ্গা নির্যাতন প্রশ্নে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়লেও মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনী তাদের রোহিঙ্গা নির্মূল অভিযান থেকে এক পাও পিছিয়ে আসেনি। যদিও মুখে তারা আশ্বাসের বাণী প্রচার অব্যাহত রেখেছে। যে অশ্বাসের ওপর ভরসা করা বাংলাদেশের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। আর এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। এ বাস্তবতাকে সামনে রেখে আমাদের ভাবনাকে ঢেলে সাজাতে হবে।

Friday, October 27, 2017

কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা

স্পেন থেকে পুরোপুরি পৃথক হতে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে কাতালোনিয়া। শুক্রবার কাতালোনিয়ার আঞ্চলিক পার্লামেন্টে ভোটাভুটিতে স্বাধীনতা ঘোষণার সিদ্ধান্ত হয়।
স্পেনের প্রধানমন্ত্রী মারিয়ানো রাহয় যখন কাতালোনিয়ায় প্রত্যক্ষ শাসন জারির কথা বলছিলেন, তার কিছুক্ষণের মধ্যেই কাতালান পার্লামেন্ট স্বাধীনতা ঘোষণার পক্ষে রায় দিল। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, কাতালোনিয়া আঞ্চলিক পার্লামেন্টে স্বাধীনতার পক্ষে ৭০ ভাগ ভোট পড়ে। বিপক্ষে পড়ে ১০ ভোট। পার্লামেন্টের বিরোধী দল এই ভোট বর্জন করে। স্পেনের প্রধানমন্ত্রী রাহয় বলেন, গণতন্ত্র, স্থিতিশীলতা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে কাতালোনিয়ায় প্রত্যক্ষ শাসন চালু করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এর আগে কেন্দ্রের বাধা উপেক্ষা করে ১ অক্টোবর গণভোটের আয়োজন করা হয় কাতালোনিয়ায়। এতে ৯০ শতাংশ ভোটার কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার পক্ষে রায় দেন। স্পেন সরকার এই গণভোটকে বেআইনি ও অসাংবিধানিক হিসেবে অভিহিত করে এসেছে।
গত ২১ অক্টোবর কাতালোনিয়া সরকারকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী সরকার’ আখ্যা দিয়ে তা বাতিলের পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে স্পেন সরকার। আঞ্চলিক সরকার যাতে স্বাধীনতা ঘোষণা করতে না পরে, সে লক্ষ্যে স্পেনের মন্ত্রিসভা ওই সরকার বাতিলের পক্ষে মত দেয়। তখন স্পেনের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার প্রশ্নের আঞ্চলিক নেতা কার্লোস পুজেমন একপক্ষীয় এবং আইনবহির্ভূতভাবে গণভোটের আয়োজন করেছিলেন। এর পাশাপাশি ওই অঞ্চলে নতুন করে নির্বাচন আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়ার কথাও বলা হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় কাতালোনিয়া আঞ্চলিক সরকারের প্রধান কার্লোস পুজেমন এ সিদ্ধান্তকে রাজনৈতিক অভ্যুত্থান ও স্পেনের সাবেক স্বৈরাচার ফ্রাঙ্কো-পরবর্তী সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক অনাচার বলে উল্লেখ করেন।
স্পেনের সংবিধানে কোনো বিদ্রোহী অঞ্চলের কর্তৃত্ব নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া আছে কেন্দ্রকে। এর পর থেকেই কাতালোনিয়ায় প্রত্যক্ষ শাসন চালু করার কথা ভাবছিল স্পেনের সরকার। স্পেনের বিত্তশালী অঞ্চল কাতালোনিয়া। জনসংখ্যা ৭৫ লাখ। এর রাজধানী বার্সেলোনা। অঞ্চলটির নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে। পাঁচ বছর ধরেই স্বাধীনতার কথা উঠছে। তবে ২০১৫ সালে কাতালোনিয়ার প্রাদেশিক পার্লামেন্ট নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পান সেখানকার স্বাধীনতাকামীরা। নির্বাচনের ওই ফলের মধ্য দিয়ে স্পেন থেকে পৃথক হয়ে নতুন রাষ্ট্র গঠনের পথে এগিয়ে যায় কাতালোনিয়া।

Monday, October 23, 2017

‘মানুষকে পশুর মতো মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে সু চি’


মিয়ানমারে গণহত্যা ও সন্ত্রাস তদন্তে গঠিত নাগরিক কমিশন’র সদস্যরা বলেছেন- অং সান সু চি’র ভূমিকা মানবতাবিরোধী। সু চি মানুষকে পশুর মতো জবাই করে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিচ্ছে। জীব-জন্তু ও জানোয়ারদের যেভাবে ব্যবহার করা হয়, তার চেয়েও রোহিঙ্গাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছে তারা। আসলে তারাই জানে কেন এই মানুষগুলোর উপর নির্মম অত্যাচার করেছে। এই রকম নিষ্ঠুর অত্যাচার পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কমই হয়েছে। নাগরিক কমিশন দুই দিন ধরে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন শেষে রোববার সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন।
দুপুরে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন কমিশনের সদস্যসচিব ও সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। তিনি বলেন, আমরা চাই মিয়ানমারে হত্যাযজ্ঞের ব্যাপারে আনান কমিশনের রিপোর্ট দেয়ার পরও বিশ্ব দরবারে আমাদের প্রধানমন্ত্রী যে ৫ দফা দাবি পেশ করেছেন, সেই পাঁচ দফা দাবি যেন বাস্তবায়িত হয়। এবং সমস্যা সমাধানে আমরাও চেষ্টা করে যাবো। এক দেশের বিপদ এভাবে আমাদের বহন করা সম্ভব নয়। আমরা বিশ্ববাসীর মাধ্যমে অনুরোধ জানাবো মিয়ানমার যেন তাদের নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ফিরিয়ে নেয়। লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, বার্মায় গণহত্যা এবং সন্ত্রাস দমনে এই নাগরিক কমিশন গঠন করা হয়েছে। এই কমিশনের ৫১ জন সদস্য রয়েছে। কমিশনের সচিবালয়ে রয়েছে ১০১ জন সদস্য। এটি একান্ত তদন্ত কমিশন। এই কমিশন কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রিত ১০ হাজার রোহিঙ্গাদের জবানবন্দি রেকর্ড করবে।পরে এই জবানবন্দী, জাতীয় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ, জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার বক্তব্য, বাংলাদেশ ও বার্মার বিভিন্ন সরকারি দলিলপত্রের ভিত্তিতে প্রতিবেদন তৈরী করা হবে। সংবাদ সম্মেলনে আরও বক্তব্য রাখেন- কমিশনের চেয়ারম্যান আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শামসুল হুদা, বিচারপতি মো. নিজামুল হক নাসিম, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ নুরুল আনোয়ার, মেজর জেনারেল(অব.) এ কে মোহাম্মদ আলী সিকদার, মমতাজ লতিফ, সমাজকর্মী ও মানবাধিকার কর্মী জুলিয়ান ফ্রান্সিস। এছাড়াও শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরী ছেলে আসীফ মুনীর, শহীদ ডা. আলীম চৌধুরীর মেয়ে ডা. নুজহাত চৌধুরী চম্পা, মানবাধিকার কর্মী আরমা দত্ত, ব্যারিস্টার বিব বড়ুয়া, ব্যারিস্টার তাপস কুমার বল, শহীদ পরিবারের সন্তান তৌহিদ রেজা নূরসহ নাগরিক কমিশনের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে ৮ লাখ ৮৯ হাজার রোহিঙ্গা : মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর দেশটির সেনাবাহিনীর সদস্যদের সহিংসতার ঘটনায় বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে রোহিঙ্গাদের ঢল নেমেছে। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) মতে, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে মোট ৮ লাখ ৮৯ হাজার ৫০০ জন। মিয়ানমার সরকারের দাবি, গত ২৫ আগস্ট রাখাইন রাজ্যের অন্তত ৩০টি পুলিশ ও সেনাচৌকিতে হামলা চালায় আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)। এরপর সেখানে সেনা অভিযান শুরু হলে জীবন বাঁচাতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের পথে রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জায়গায় হাজারো রোহিঙ্গা আটকা পড়ে। তবে সুযোগ বুঝে তারা এখন বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। সহিংসতার পরে নতুন করে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে ৫ লাখ ৮২ হাজার রোহিঙ্গা। রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে আছে ৩ লাখ ৭ হাজার ৫০০ জন রোহিঙ্গা। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট ৮ লাখ ৮৯ হাজার ৫০০ জন রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে।
হাজার মাইল পথ পায়ে হেঁটে রোহিঙ্গারা টেকনাফ ও উখিয়ায় আশ্রয় নিয়েছেন। অনেক পথ হাঁটার কারণে অনেকে এখন নানা রোগে ভুগছেন। ইউএনএইচসিআর রোহিঙ্গাদের আবাসস্থল ও স্যানিটেশনের ব্যবস্থার জন্য সহায়তা করছে। সেই সঙ্গে বিশুদ্ধ পানি, খাবার ও ওষুধ সরবরাহও করছে তারা। এখন রোহিঙ্গাদের সহায়তায় ইউএনএইচসিআর-এর ১৮২ জন স্টাফ কাজ করছে।
শর্ত দিয়ে হলেও রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার দাবি যুক্তরাষ্ট্রের : যুক্তরাষ্ট্র চায়, রোহিঙ্গা মুসলিমদের ফেরাতে মিয়ানমার শর্ত নির্ধারণ করুক। রাখাইনে ধর্মীয় বিদ্বেষ ও সহিংসতা ছড়াতে ‘মানবিক বিপর্যয়’কে যাতে কেউ ব্যবহার করতে না পারে সেদিক বিবেচনা করেই এই শর্ত নির্ধারণের কথা বলছে দেশটি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্যাম্প প্রশাসনের জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা এই তথ্য জানিয়েছেন। ভারতীয় সরকারি সংবাদ সংস্থা প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়াকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে শর্ত আরোপ করে হলেও রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তনে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান জানিয়ে দেন তিনি। গত আগস্টের শেষের দিকে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে দেশটির সেনাবাহিনীর কঠোর অভিযানে অন্তত ছয় লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়েছে। মিয়ানমার এই রোহিঙ্গাদের দেশটির জাতিগত সংখ্যালঘু হিসাবে স্বীকার করে না। এর পরিবর্তে নেইপিদো বলছে, তারা বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী; যারা রাখাইনে বসবাস করছে।
‘এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মানবিক ও নিরাপত্তা উদ্বেগের বিষয়। কারণ সেখানে এমন মানুষ আছে যারা এই মানবিক বিপর্যয়কে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর উপায় হিসাবে ব্যবহার করতে পারে; তারপর সহিংসতা উসকে দিতে পারে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মার্কিন ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘সুতরাং শরণার্থীদের ফেরাতে শর্ত নির্ধারণ করাটা মিয়ানমারের জন্য আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’ ভয়াবহ মানবিক ভোগান্তি লাঘবে এবং শিশুদের শিক্ষা ও তাদের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করার জন্য সব ব্যবস্থা করা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। এদিকে, রোববার যুক্তরাষ্ট্র সরকার ২৫ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া রাখাইন সংকটে জীবন-রক্ষাকারী জরুরি সহায়তার জন্য প্রায় ৪ কোটি মার্কিন ডলার সরবরাহের ঘোষণা দিয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর বলছে, সর্বশেষ এ অর্থসহ চলতি বছরে মিয়ানমারের উদ্বাস্তুদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মানবিক সহায়তা ১০৪ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই সহায়তা রাখাইন সংকটে মানবিক ত্রাণ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর), জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ), আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) ও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) কাছে হস্তান্তর করা হয়। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর বলছে, আমরা মারাত্মক এ মানবিক সংকটে বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকার প্রশংসা করছি। মানুষের কাছে সহায়তা পৌঁছাতে যথাযথ ব্যবস্থা নিশ্চিত করায় বাংলাদেশ সরকারের ধারাবাহিক পদক্ষেপের প্রতি সম্মান জানাচ্ছি। রাখাইন প্রদেশে দীর্ঘমেয়াদি শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে মিয়ানমার সরকারের অঙ্গীকার শিগগিরই বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। রোহিঙ্গাদের নিরাপদে মর্যাদার সঙ্গে রাখাইনে ফেরার অনুমতি দিতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর।
রোহিঙ্গা সংকটের আলোচনায় মিয়ানমার গেলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : রোহিঙ্গা সংকটের মধ্যে ১২ সদস্যের প্রতিনিধিদল নিয়ে মিয়ানমারের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। গতকাল সোমবার বেলা পৌনে ১টায় বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে মিয়ানমারের উদ্দেশে প্রতিনিধিদলটি রওনা করে বলে বিমানবন্দরের আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের পরিদর্শক ইকবাল হোসেন জানিয়েছেন। এ সফরে রোহিঙ্গা সংকট অবসানের বিষয়ে প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে আলোচনা করার কথা রয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুই সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, বিজিবির মহাপরিচালক, কোস্টগার্ডের মহাপরিচালক, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থার মহাপরিচালকসহ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এই দলে থাকছেন।
মন্ত্রীর সফরে সীমান্তে নিরাপত্তা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে দুটি সমঝোতা স্মারক সই হবে বলে জানিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপু। আর রাখাইন থেকে নির্যাতিত রোহিঙ্গারা পালিয়ে আসার মধ্যে এ সফরে তাদের ফেরত নেওয়ার বিষয়ে দেশটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন বলে জানিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। মিয়ানমারের রাখাইনে সহিংসতা শুরুর পর গত দুমাসে ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের ফেরত নিতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের সমালোচনার মধ্যে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির বিশেষ দূত দেশটির দপ্তরবিষয়কমন্ত্রী উ কিয়া তিন্ত সোয়ে গত ১ অক্টোবর ঢাকায় এসেছিলেন।
বেসামরিক প্রশাসনের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক সমাধান চান সু চি : রাখাইন সংকট নিরসনে বেসামরিক প্রশাসনের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক সমাধান চান মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি। অন্তত এমনটাই মনে করছেন এ অঞ্চলে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের সাবেক বার্তা সম্পাদক মিয়ানমার বিশেষজ্ঞ ল্যারি জাগান। গতকাল সোমবার মিয়ানমার টাইমসে প্রকাশিত নিজের কলামেই এমন অভিমত ব্যক্ত করেছেন জাগান।
কলামে তিনি লিখেছেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান সংকট নিরসনে সরকারের নতুন কৌশলগত পরিকল্পনার রূপরেখা দিয়েছেন দেশটির রাষ্ট্রীয় পরামর্শক অং সান সু চি। এর পরিকল্পনার আওতায় ‘ন্যাশনাল এন্টারপ্রাইজ ফর হিউম্যানিটেরিয়োন অ্যাসিস্ট্যান্স, রিসেটেলমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টে ইন রাখাইন স্টেট’ নামে বেসামরিক নেতৃত্বাধীন একটি সংস্থা গঠন করা হয়েছে, যে সংস্থাকে সহায়তা দেবে বিদেশিরা। এই সংস্থা শরণার্থীদের ত্রাণ সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি তাদের প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসনের বিষয়টি দেখভাল করবে। গত ১২ অক্টোবর জাতির উদ্দেশ্যে টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে এ রূপরেখা ঘোষণা করেন সু চি।
জাগানের মতে, রাখাইন সংকট নিরসনে গত ২৪ আগস্ট দেওয়া কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদনকে ঘিরে সরকারের দীর্ঘ-প্রতিশ্রুত রোডম্যাপ অবশেষে প্রকাশ করলেন সু চি। তিনি যে সংস্থা গঠনের কথা বলেছেন সেই কমিটি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন তদারকি করবে, যা নেতৃত্বে থাকবে সু চি নিজেই। কলামে তিনি লিখেছেন, রাখাইন রাজ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর চেকপোস্টে হামলা পর সেখানে নতুন করে সৃষ্ট সহিংস পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে গত আট সপ্তাহে পাঁচ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা মুসলমান পালিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এই পরিস্থিতিকে জাতিসংঘ বর্ণনা করেছে সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট হিসেবে।
জাগানের মতে, ছয় সপ্তাহের বেশি আগে কফি আনান তার প্রতিবেদন দাখিল করার পর পশ্চিম রাখাইনের সংঘাত-জর্জরিত এলাকার সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও অবিশ্বাসের মূল কারণ দূর করা এবং সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা মুসলমানদের জন্য মানবিক সহায়তা প্রদানের পরিকল্পনা প্রণয়নে কাজ করছে মিয়ানমার সরকার।
কলামে উল্লেখ করা হয়েছে, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে যাওয়া শরণার্থীরা তাদের দুর্দশার জন্য দেশটির সেনাবাহিনীকে দায়ী করে বলছে, সেনাবাহিনীই ঘরবাড়ি ধ্বংস করে দিয়ে তাদের দেশত্যাগে বাধ্য করেছে এবং রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান চলাকালে শত শত মানুষের মৃত্যুর জন্য সেনাবাহিনীই দায়ী। এছাড়া পালিয়ে যাওয়া অনেক মুসলমান নারীর অভিযোগ মিয়ানমারের সেনা সদস্যরা তাদের ধর্ষণ করেছে। তবে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে সু চি অত্যন্ত সচেতনভাবে সেনাবাহিনীর সমালোচনা, এমনকি সেনা সদস্যদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ উল্লেখ করা থেকেও বিরত ছিলেন।
জাগান লিখেছেন, এ নিয়ে মিয়ানমারের বাইরে থেকে যেসব মতামত আসছে তার সারাংশ হচ্ছে সু চি সেনাবাহিনীর পটেকেই রয়েছেন। তবে এই মতামতের বিপরীতে বলা যায়, সু চির এই অবস্থানের অর্থ এই নয় যে তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে ভিড়ে গেছেন।

Saturday, October 21, 2017

জলবায়ু পরিবর্তনে বিরূপ প্রকৃতির বৈরী আবহাওয়ার কবলে দেশ !

খাদ্যশস্য উৎপাদন ৪০লখ টন কমার আশঙ্কা


বর্ষা ঋতু বিদায় নিয়েছে দুই মাস আগেই। শরৎ শেষ। এখন হেমন্ত চলছে। অথচ ভারী বৃষ্টিপাত এই হেমন্তে ভরা বর্ষাকেও হার মানিয়েছে। গত দুদিনে (শুক্র ও শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত) রাজধানীতে ২৭৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এরমধ্যে শনিবার হয়েছে ২২৩ মিলিমিটার। এরআগে বর্ষার শুরুতে গত ১২-১৩ জুন ২৪ ঘণ্টায় ১৩৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয় ঢাকায়। ১৩ জুলাই ১০৩ মিলিমিটারের রেকর্ড বৃষ্টি হয়। পরের মাস গত ৪ আগস্ট ঢাকায় তিন ঘণ্টায় ১২৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। ওই বৃষ্টি ছিল স্বল্প সময়ের বিবেচনায় গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ।
এরআগে ২০০৬ সালের জুলাই মাসে ঢাকায় তিন ঘণ্টায় ৯৬ মিলিমিটার বৃষ্টির রেকর্ড ছিল। কেবল ভারী বৃষ্টিপাত নয়, এ বছর এপ্রিল ও মে মাসে মারুথা ও মোরা নামে দুটি ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়েছে বঙ্গোপসাগরে। এর বাইরে নিম্নচাপ তৈরি হয়েছে বেশ কয়েকবার। তার মধ্যে দুই দফা নিম্নচাপে প্রবল বর্ষণে পাহাড়ে ভূমিধসে মৃত্যু হয় দেড় শতাধিক মানুষের। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আগাম বন্যায় বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে এবার। বর্ষা মৌসুমের শুরুতে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে উত্তর-পশ্চিমের মানুষকেও ভুগতে হয়েছে। বিশেষ করে গত জুলাই-আগস্টে হাওড় অঞ্চলে অকস্মাৎ বন্যা এবং ভারী বর্ষণে পানিতে তলিয়ে যায় ঢাকা ও চট্টগ্রাম। সেইসঙ্গে বজ্রপাতে মৃত্যুর খবর গত বছর তিনেক ধরেই বেড়ে গেছে।
এমনকি অক্টোবরের শুরুতেই টানা চার-পাঁচ দিন রাজধানীসহ দেশের বেশিরভাগ এলাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৪ থেকে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠানামা করেছে। সাধারণত গ্রীষ্মে এ ধরনের গরম অনুভূত হলেও এবার সেপ্টেম্বরের শরতে একটি বড় সময় ধরে প্রায় গ্রীষ্মের গরম অনুভূত হয়েছে।
কেবল এ বছরই নয়, দেশে হঠাৎ করেই বদলে যাওয়া আবহাওয়ার এমন বৈরী আচরণ চলছে গত ৩০ বছর ধরেই। ভারী বৃষ্টিপাত ও মাত্রাতিরিক্ত তাপমাত্রা তো বটেই, ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস, অস্বাভাবিক মাত্রায় বজ্রপাত, অতি ভারী বর্ষণ, আকস্মিক বন্যা, ভূমিধসের মতো একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেন পেয়ে বসেছে বাংলাদেশকে। এর ফলে দেশে খাদ্য উৎপাদন কমে যাচ্ছে, নতুন নতুন দুর্যোগ বাড়ছে, রোগবালাইয়ের প্রকোপ দেখা দিচ্ছে আর বিপুলসংখ্যক মানুষ বাস্তুচ্যুতও হচ্ছে।
কিন্তু আবহাওয়ার কেন এমন বদলে যাওয়া এবং এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগই বা কেন—জানতে চাইলে গবেষকরা একে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হিসেবে দেখছেন। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মনুষ্যসৃষ্ট আচরণ ও পরিবর্তিত জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খেয়ে চলতে না পারাকেও দায়ী করেছেন তারা।
এ ব্যাপারে নগর ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের জন্য অন্তত ৫০ বছরের তথ্য পর্যালোচনা করতে হবে। প্রকৃতির এই বৈরী আচরণকে হুট করেই ‘জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব’ বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে না। কিছু প্রভাব পড়তে শুরু করেছে ঠিকই, কিন্তু সবক্ষেত্রে নয়। সে সময় বাংলাদেশে ঠিক আসেনি এখনো। দেশে যেসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে, এর বেশিরভাগই মনুষ্যসৃষ্ট। ভারী বৃষ্টিপাত হবে। কিন্তু তা থেকে যে জলাবদ্ধতা, সেটা হচ্ছে পানি ও বর্জ্য নিষ্কাশন না থাকায়। শহর ডুবে যাচ্ছে। নভেম্বর ও ডিসেম্বরের শেষের দিকেও নি¤œচাপ দেখা দিতে পারে। তা থেকে বৃষ্টিপাত হবে। কিন্তু সে পানি কেন সরবে না? জলাবদ্ধতা কেন হবে? কারণ মিরপুর থেকে কল্যাণপুর পর্যন্ত যে খাল, সেটা দখল হয়ে গেছে। আমরা পরিবর্তিত জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে পারছি না। উন্নয়ন প্রকল্পের নামে অপরিকল্পিত আবাসন গড়ছি। সড়ক নির্মাণ করছি। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় জোর দিচ্ছি না। গ্রীষ্মে তাপমাত্রা থাকবে। কিন্তু উচ্চ তাপমাত্রা হচ্ছে গাছপালা কমে যাওয়ার কারণে। রাজধানীতে রমনা ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এবং হাতিরঝিল ছাড়া কোথাও খোলা জায়গা নেই, সবুজ নেই। গাছ লাগাচ্ছি না। কেটে ফেলছি। ফলে বদলে যাচ্ছে আবহাওয়া। এসবই হচ্ছে মানুষের কারণে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পরিবেশ ও উৎস ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও ভূগোল বিভাগ পৃথক পৃথক গবেষণায় বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কিছু প্রভাব বাংলাদেশে পড়তে শুরু করেছে বলে জানিয়েছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, গত ৩০ বছরে বাংলাদেশ ১৮৫ বার চরম বৈরী আবহাওয়ার কবলে পড়েছে, যা বিশ্বে তৃতীয় সর্বোচ্চ। দুই বছর আগেও বিশ্বে বিরূপ আবহাওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি আর্থিক ক্ষতির মুখে থাকা দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল চতুর্থ। আর বৈরী আবহাওয়ার কারণে মানুষের মৃত্যু হওয়ার দিক থেকে তৃতীয় দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ।
আন্তর্জাতিক ও দেশের বিভিন্ন গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে অসময়ের বৃষ্টির কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। একই কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও গড় তাপমাত্রা বাড়ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে এই শতকের মধ্যে তাপমাত্রা গড়ে দেড় থেকে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে। এর ফলে বছরে বোরো ও আমন ধানের উৎপাদন ১০ শতাংশ কমে যেতে পারে। প্রায় ৪০ লাখ টন খাদ্য উৎপাদন কমতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই শতকের মধ্যে দেশের ১৯টি জেলার প্রায় ৬০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা ডুবে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছে। এর ফলে প্রায় দুই কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে। লবণাক্ত এলাকা দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে শুষ্ক মৌসুমে বৃষ্টিপাত কমে যাচ্ছে। লবণাক্ততা আরো বাড়ছে। নতুন করে বজ্রপাতে মৃত্যু বাড়ছে। এ বছরের আগস্ট পর্যন্ত মারা গেছে ১৭০ জন। গত সাত বছরে মৃত্যু হয়েছে ১ হাজার ৭৬০ জনের। এ বছর ব্রহ্মপুত্র নদের উজানে ১০০ বছরের মধ্যে বড় বন্যার রেকর্ড বৃষ্টি হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে বেশি বেশি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হচ্ছে। আর তা সবচেয়ে বেশি আঘাত হানছে বাংলাদেশে। ১৯৭১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রতি চার থেকে পাঁচ বছর পরপর বড় ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানত। ২০০৭ সালের পর প্রতি দুই বছর পরপর দেশে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানছে।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক আখতার হোসেন খান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বব্যাপী। কিন্তু ঢাকায় আবহাওয়ার বৈরী আচরণের জন্য দায়ী অতিরিক্ত জনসংখ্যা ও যানবাহন। তা ছাড়া শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র (এসি) ব্যবহার বেড়ে গেছে। এসি ব্যবহারের ফলে কক্ষের ভেতর ঠান্ডা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু বাইরে তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। এটি কমাতে হবে। গাছপালা কমে যাচ্ছে। একটি আদর্শ নগরীতে ২৫ শতাংশ এলাকাজুড়ে গাছপালা, পার্ক, আদর্শ ছায়াযুক্ত স্থান থাকতে হবে। কিন্তু ঢাকায় পাঁচ শতাংশও ছায়াশীতল স্থান নেই। একই অবস্থা গোটা দেশে। আমরাই পরিবেশকে নষ্ট করছি। পরিবর্তিত জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাবের দিকে দেশকে ঠেলে দিচ্ছি। জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবিলা করতে হলে আমাদের আইনের শাসনের সঙ্গে বিজ্ঞান ও মানুষের হাজার বছরের অভিজ্ঞতাকে সঙ্গী করে পরিকল্পনা করতে হবে।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ব্রাজিল, ভারত, রাশিয়া তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কার্বন নিঃসরণ কমাচ্ছে না, বরং বাড়াচ্ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। তারা আরো বলছেন, প্রতিনিয়তই বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ছে। এর প্রভাবে আগে যেসব জায়গায় জোয়ারের পানি উঠত না, সেসব অঞ্চল এখন প্লাবিত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের নাম সবার শীর্ষে।
পরিবর্তিত জলবায়ু থেকে সৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশ কতটুকু প্রস্তুত এবং কেনই বা এমন দুর্যোগের মুখে বারবার পড়ছে বাংলাদেশ-জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ রিয়াজ আহম্মেদ বলেন, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দুর্যোগপ্রবণ দেশগুলোর মধ্যে দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। আমরা অনেক দেশের কাছেই এখন মডেল। তবে দুর্যোগ মোকাবেলায় আরো গবেষণা দরকার। কেন জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, কিন্তু কতটা, সেটার গবেষণা লাগবে। কারণ এবার হাওরে যে অকস্মাৎ বন্যা, সেটা গত ৫০-৬০ বছরের মধ্যে এবারই প্রথম এত আগে হলো। একই কারণে পাহাড় ধসছে। প্রাকৃতিক সবুজ কমে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের যেসব বহির্প্রকাশ, সেগুলো জানতে গবেষণা দরকার। তবে মানবসৃষ্ট দুর্যোগ বাড়ছে। এমনিতেই বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ দেশ। দুর্যোগের স্বরূপ জানতে হবে। দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুতি রাখতে হবে ব্যক্তি পর্যায় পর্যন্ত। তবেই দুর্যোগ থেকে রক্ষা সম্ভব।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আক্তার মাহমুদের মতে, প্রাকৃতিকভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রস্তুতি বাংলাদেশের নেই বললেই চলে। বাংলাদেশ ছোট দেশ। মানুষ বেশি। প্রত্যেক দুর্যোগ মোকাবিলায় আলাদা কাঠামো দরকার। নদী, পাহাড়, বনভূমিসহ যেসব প্রাকৃতিক অঞ্চল রয়েছে, সেগুলোর প্রাকৃতিক অবস্থা ধরে রাখতে হবে। জাতীয় ভৌত পরিকল্পনা ও কাঠামো দরকার। সে অনুযায়ী প্রাকৃতিকে সংরক্ষণ করতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে।