Friday, May 18, 2018

আদর্শ চকোলেট তৈরির রহস্য 

চকোলেট খেতে কে না ভালোবাসে? কিন্তু চকোলেট তৈরি করা মোটেই সহজ নয়। প্রক্রিয়ায় ত্রুটি থাকলে রূপ ও স্বাদ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। একমাত্র বৈজ্ঞানিক জ্ঞান প্রয়োগ করেই আদর্শ চকোলেট তৈরি করা সম্ভব। আদর্শ টফি তৈরির কৌশল আয়ত্ত করা মোটেই সহজ নয়। নানারকম রাসায়নিক, প্রাকৃতিক ও কাঠামোগত সমস্যা চকোলেটের মধ্যে ঘটতে পাওে, যেমন ‘ফ্যাট ব্লুম’। খাদ্য ও বায়োটেকনোলজি ইনস্টিটিউটের লিলিয়া আর্নে বলেন, ‘ফ্যাট ব্লুম হলো টফির ওপর ধূসর বা সাদা স্তর। অন্য চকোলেটের সঙ্গে তুলনা করলেই চোখে পড়বে। টফির মধ্য থেকে ফ্যাট উপরে বেরিয়ে এলে এমনটা হয়। ভেতর থেকে সারফেসের ওপর এসে সেই ফ্যাট ঘনীভূত হয়।’ ডার্ক চকোলেট : প্রতিদিন এক টুকরো ডার্ক চকোলেট খেলে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বাড়ে। অল্প পরিমাণে ডার্ক চকোলেট খাওয়ার অভ্যাস স্ট্রোক এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে, বলছেন বিজ্ঞানীরা। ‘ফ্যাট ব্লুম’ সমস্যার সমাধান করতে লিলিয়া ‘প্রো-প্রালিন’ নামের এক ইউরোপীয় প্রকল্পের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সেই বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ছোট চকোলেট প্রস্তুতকারকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
যেমন হাঙ্গেরির সামোস মারসিপান কোম্পানি। রফতানি সহকারী এডিনা রোসা বলেন, ‘ইঞ্জিনিয়াররা আমাদের চকোলেটের নমুনা পরীক্ষা করে ল্যাবে বিশ্লেষণ করেছেন, যাতে সত্যিকারের ভালো চকোলেট তৈরি করতে তারা সঠিক প্রক্রিয়া বাতলে দিতে পারেন।’
সেই বিশ্লেষণের পর সামোস কোম্পানি চকোলেট তৈরির প্রক্রিয়ায় নতুন যন্ত্রে বিনিয়োগ করেছেন। টফি তৈরির প্রক্রিয়ায় ‘ফ্যাট ব্লুম’ এড়ানোর চাবিকাঠি হলো সঠিক তাপমাত্রা। এডিনা রোসা বলেন, ‘টেম্পারিং শব্দটির অর্থ হলো, চকোলেট ৪২ ডিগ্রি পর্যন্ত তাপমাত্রায় গরম করে তারপর ২৭ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ঠান্ডা করতে হবে। তারপর মিশ্রণের আগে আবার ৩২ ডিগ্রিতে গরম করতে হবে। ঠিকমতো টেম্পারিং প্রক্রিয়া করলে চকোলেট বেশ চকচকে ও মচমচে হবে।’
টফি উৎপাদন প্রক্রিয়া রপ্ত করতে পারলে স্বাদের ক্ষেত্রে আরো নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে যাবে।

Sunday, May 13, 2018

জয়তু মাহাথির মোহাম্মদ 

মালয়েশিয়ার ১৪তম সাধারণ নির্বাচনে জয় পেয়ে আবারও ক্ষমতার মসনদে বসতে যাচ্ছেন ৯২ বছর বয়সী মাহাথির মোহাম্মদ। আমরা জানি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এ নির্বাচন অনেক কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৮১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত মালয়েশিয়াকে নেতৃত্ব দেওয়া মাহাথির মোহাম্মদ অবসর নেওয়ার দেড় দশক পর রাজনীতিতে ফিরেছেন তার একসময়ের অনুসারী নাজিব রাজাককে ক্ষমতাচ্যুত করতে। গুরু-শিষ্যের লড়াইয়ে নবতিপর মাহাথির চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন তারই দীর্ঘদিনের দল ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনকে (ইউএমএনও)। ১৯৫৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত মালয়েশিয়া ছিল দারিদ্র্যপীড়িত বৃক্ষমানব দেশ। দারিদ্র্যের সঙ্গে ছিল নিরক্ষরতা আর পশ্চাৎ-মুখিতা। টেংকু আবদুর রহমান প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বহুধাবিভক্ত দেশটিতে রোপণ করেন ঐক্যের বীজ। তিনি যে ধারার সূচনা করেছিলেন, তা থেকে বিচ্যুত হননি তার উত্তরসূরি আবদুল রাজ্জাক, টোয়াংকু ইসমাইল এবং ড. মাহাথির বিন মোহাম্মদ। শেষোক্তজন আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি ও রূপকার হিসেবে পৃথিবীতে নন্দিত এবং প্রশংসিত। তার হাত ধরে মালয়েশিয়া পৌঁছে যায় স্বপ্নলোকে






















১৯৮১ সালে ড. মাহাথির মোহাম্মদ মালয়েশিয়ার চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। নেতা হিসেবে তিনি নির্ভুলভাবে বুঝতে পেরেছিলেন জাতির সাইকি সম্পর্কে। সম্পদের ছড়াছড়িই যে শুধু একটি দেশের উন্নয়নের চাবিকাঠি, এমন বিশ্বাস করেননি তিনি। কেননা, তার চোখের সামনেই ছিল অনেক সম্পদশালী দেশের নিঃস্ব হওয়ার উদাহরণ। সে সময় মাহাথির পেয়েছিলেন অর্থনৈতিকভাবে অনুন্নত কৃষিনির্ভর একটি দেশ, যা ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি দ্বারা বহু বছর লুণ্ঠনের কেন্দ্রভূমি। তার নেতৃত্বে ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হয় সরকারি জমি। জমি বিতরণের পর যখন বিতরণযোগ্য জমি আর রইল না, আহ্বান জানানো হলো বিদেশি পুঁজির। বারবির মতো বিখ্যাত রাবারের পুতুল, ডানলপের মতো বিশ্বখ্যাত রাবার পণ্য প্রস্তুতকারক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান প্রথমেই বিশাল পুঁজি নিয়ে আসে জনমানুষবিহীন দুর্গম রাবারবনাঞ্চলে। বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগকারীরা বিভিন্ন দেশে যে কঠোর শর্ত আরোপ করে উৎপাদন আর ব্যবসার নামে, মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রে তা দেখা গেল না। কারণ মাহাথিরের ভাষায় মালয়েশিয়ার টেবিলের ওপর দুর্নীতির মাত্রা কম। তাহলে দুর্নীতি কি মালয়েশিয়ায় নেই? অবশ্যই আছে। দুর্নীতিমুক্ত রাজ্য পৃথিবীতে আছে! তবে মালয়েশিয়ার দুর্নীতি ন্যূনতম পর্যায়ের। সেই শক্তিতে বলীয়ান হয়েই তো মাহাথির মোহাম্মদ মালয়েশিয়ার দুর্নীতি সম্পর্কে অস্ট্রেলিয়ান প্রধানমন্ত্রী জন হাওয়ার্ডকে বাধ্য করেছিলেন তার মন্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে।

রাজনৈতিক সহযোগিতা নিশ্চিত করে মালয়েশিয়ার জোট সরকার দেশের উন্নয়নের দিকে নজর দেয়। শুরুতে একমাত্র সম্পদ ছিল কৃষিজমি। সে সময় মালয়েশিয়ায় উৎপাদন খাতের কোনো বিশেষজ্ঞ, পুঁজি ব্যবস্থাপনার দক্ষতা ও বাজার বিষয়ে জ্ঞান ছিল না। সে ক্ষেত্রে শিল্পায়নের একমাত্র উপায় ছিল বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আমন্ত্রণ জানানো। এই বিদেশি বিনিয়োগ থেকে সরকার যদি আর্থিকভাবে লাভবান নাও হয়, তাহলে তারা কিছু মনে করবে না যদি শ্রমিকরা কাজ পায়। এ জন্য সরকার বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিরাপত্তা দিয়েছে। একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে। এ বিনিয়োগের ফলে মালয়েশিয়া অনেক ক্ষেত্রেই লাভবান হয়েছে। শ্রমিকরা দক্ষ হয়েছে। ব্যবস্থাপনার মান বেড়েছে। অনেকে এখন নতুন পণ্য প্রস্তুত করতে শিখেছে। মালয়েশিয়া এখন উৎপাদিত পণ্য রফতানি করে শতাধিক বিলিয়ন ডলার আয় করে। মাহাথির মোহাম্মদ মন্ত্রীদের কাছে ব্যবসায়ী সমাজের সহজ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করেন। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিয়মিত সংলাপ চলমান থাকে। তাদের অভিযোগ ও প্রস্তাব শুনে সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করতে হয়। মালয়েশিয়া যখন স্বাধীন হয়, তখন তাদের উচ্চপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন না। এ জন্য ব্রিটিশ জনপ্রশাসককে তিন-পাঁচ বছর রেখে দিয়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দেশীয় দক্ষ কর্মকর্তা তৈরি করেন।
মালয়েশিয়ার জনসংখ্যা কত বিচিত্র, কত স্বতন্ত্র। ২ কোটি ৪০ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগ মালয়ি মুসলমান, ২৪ ভাগ চৈনিক, ৭ ভাগ ভারতীয় এবং ৯ ভাগ বিভিন্ন উপজাতীয় গোষ্ঠীর। মালয়েশিয়া এভাবে হাজারো প্রকরণে ছিল বিভক্ত, খ-চ্ছিন্ন। সম্পদের নিরিখেও জনসমষ্টি বিভিন্ন মানের। শিক্ষার ক্ষেত্রেও ভিন্নতা ছিল অত্যন্ত প্রকট। সব মিলিয়ে মালয়েশিয়ায় জাতীয় ঐক্যের ক্ষেত্র ছিল সংকুচিত। সেই সংকুচিত ক্ষেত্রকে প্রসারিত করে মাত্র সাড়ে চার বা পাঁচ দশকে মালয়েশিয়ার নেতৃত্ব জাতীয় জীবনের সব স্রোতধারাকে সম্মিলিত করে রূপান্তরিত করেছে স্রোতস্বিনীতে। কিন্তু মাহাথির মোহাম্মদ এবং তার পূর্বসূরিদের রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল, জাতির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। মাহাথির অতীতকে স্মরণে রেখে বর্তমানকে সাজিয়েছেন এবং বর্তমানকে সাজানোর সময় ভবিষ্যৎকে সুস্পষ্টভাবে মনে রেখেছেন। ১৯৭৮ সালে শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করে তিনি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেশের প্রত্যেকের জন্য যেন কর্মসংস্থান সৃষ্টির ব্যাপারে মনোযোগী হন। এ লক্ষ্যে বাস্তবায়নে প্রথম পদক্ষেপ ছিল প্রধানত দুটিÑ এক. আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা। দুই. বিনিয়োগকারীদের সর্বাধিক সহায়তা নিশ্চিত করা। তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল আইনশৃঙ্খলার অস্বাভাবিকতায় কেউ যেন ভীতসন্ত্রস্ত না হয়। বিনিয়োগকারী যেন আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় না পড়েন। প্রত্যেকে যেন বিনিয়োগকৃত সম্পদ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেন। তা তিনি দেশি হোন অথবা বিদেশি। কর্মীদের উচ্ছৃঙ্খলতায় যেন কোনোভাবে উৎপাদন বিঘিœত না হয়। দুর্নীতির কালো থাবা যেন উৎপাদন ক্ষেত্রে কোনো বাধা সৃষ্টি না করে। তার এই বলিষ্ঠ পদক্ষেপ মালয়েশিয়াকে বাণিজ্যবান্ধব রাষ্ট্রে পরিণত করে। ফলে দেখা যায়, শুধু টিন ও রাবার রফতানিকারক পশ্চাৎপদ দেশ যে মালয়েশিয়া মাত্র দুই দশকের মধ্যে ইলেকট্রনিকস, ইস্পাত, বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি, এমনকি মোটরগাড়ি রফতানিকারক রাষ্ট্রে পরিণত হলো। স্বাধীনতার সময় যে মালয়েশিয়ার অধিকাংশ জনসমষ্টি ছিল বেকার অথবা অর্ধবেকার। মাত্র দুই দশকে সেই মালয়েশিয়ায় কর্মরত রয়েছেন বিদেশের লাখ লাখ কর্মী। স্বাধীনতার সময় এমনকি পরবর্তী সময়েও যে মালয়েশিয়া প্রায় প্রকম্পিত হয়েছে নিম্নস্তরের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়। সেই মালয়েশিয়া আজ রূপান্তরিত হয়েছে একটি সুস্থ, নিরাপদ, উদার, কল্যাণমুখী জনপদে। শুধু একজনের উদার, আদর্শিক যোগ্য ভিশনারি নেতৃত্ব আর ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছে মালয়েশিয়ানদের জীবনচিত্র। রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই তার দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর মাহাথিরের আগ্রহ ছিল সুগভীর। তাই একটি জাতির উন্নয়নে শিক্ষার ভূমিকা তার কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পায়। সরকারি নীতি এবং বেসরকারি বিনিয়োগের মধ্যে তিনি একটি সমঝোতা এবং সখ্য গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। সরকারি মালিকানাধীন সংস্থাগুলোর বেসরকারীকরণ মালয়েশিয়ার দ্রুত শিল্পায়নের সহায়ক হয়েছে। 

তিনি সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ আর সহযোগিতায় বেসরকারি খাতকে লাভজনক পর্যায়ে করতে মালয়েশিয়ান বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করেছেন। কিন্তু কীভাবে দেশকে এ তো সমৃদ্ধিশালী করলেন? সেটা অনেকের কাছেই প্রশ্ন। জাতির উন্নয়ন রেনেসাঁর প্রতীক হয়ে তিনি মালয়িদের মনে স্বপ্নসমৃদ্ধির বীজ বুনে দিলেন। চোখে এঁকে দিলেন ভবিষ্যৎ মালয়েশিয়ার ছবি। বিশ্বব্যাংক আইএমএফ বা দাতা সংস্থার পরামর্শ এড়িয়ে নিজের চিন্তা-চেতনায় দেশের জন্য যা মঙ্গলকর তাই করেছেন। মালয়েশিয়া মাত্র দুই দশকে অনগ্রসরতার পাতাল থেকে সগর্বে আরোহণ করছে অগ্রগতির পাহাড়ের চূড়ায়। ডা. মাহাথির এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন তার জাতীয় অগ্রগতির স্বপ্ন মালয়েশিয়ার জনগণের চোখে এঁকে দিয়ে। তার আকাশচারিতার স্বপ্নসমগ্র মালয়েশিয়ায় ছড়িয়ে দিয়ে। বাইশ বছরের শাসনকালে মালয়েশিয়াকে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য পুরোদস্তুর তৈরি করে ভিশন ২০২০-এর দ্বারপ্রান্তে দেশকে রেখে তিনি স্বেচ্ছায় অবসর নিলেন। একটি সুখী সমৃদ্ধিশালী দেশের প্রধানমন্ত্রিত্ব স্বেচ্ছায় ছেড়ে দেওয়ার মতো যোগ্য ব্যক্তি যে তিনিই শুধু, পরে ইতিহাস তা গভীর আগ্রহভরে লক্ষ করবে। কিন্তু এবার ক্ষমতাসীন হয়ে মাহাথির মোহাম্মদ কোন মিশন নিয়ে বিশ্বকে তথা মুসলিম বিশ্বকে কী চমক দেখাবেনÑসেটাই এখন দেখার বিষয়। 
লেখক:এস এম মুকুল;

Wednesday, May 9, 2018

যেভাবে ফেসওয়াশ ব্যবহার করবেন 

সারা দিনের ধূলাবালি আর ময়লা থেকে নিজেদের মুখের ত্বককে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে আমরা ফেসওয়াশ দিয়ে মুখ ধুয়ে থাকি। এতে করে আমাদের ত্বক ভাল থাকে। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে কেমিক্যালসমৃদ্ধ পণ্য ব্যবহারে আপনার ত্বকের ক্ষতিও হতে পারে। একনজরে দেখে নিন সুন্দর ও সুস্থ ত্বকের জন্য ফেসওয়াশ কীভাবে ব্যবহার করবেন। 
► সব সময় ত্বকের সঙ্গে মিলিয়ে সঠিক ফেসওয়াশ ব্যবহার করুন। সম্ভব হলে মাইল্ড ফেসওয়াশ ব্যবহার করুন। এর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই।
► যাদের ত্বকে অ্যালার্জির সমস্যা রয়েছে, তাঁরা সুগন্ধিযুক্ত ফেসওয়াশ এড়িয়ে চলুন।
► মুখ ধোয়ার সময় খুব বেশি ঠান্ডা পানি বা খুব গরম পানি ব্যবহার করবেন না। সামঞ্জস্য বজায় থাকে এমন তাপমাত্রার পানি ব্যবহার করুন।
► গরমে অন্তত তিনবার ফেসওয়াশ দিয়ে মুখ পরিষ্কার করুন এবং একই ফেসওয়াশ ব্যবহারের চেষ্টা করুন। বারবার ফেসওয়াশের ব্র্যান্ড পরিবর্তন করেবেন না। এটি ত্বকের জন্য খুবই ক্ষতিকর। মুখ ধোয়ার পর পরই রোদে না যাওয়াই ভালো। সানস্ক্রিন লাগিয়ে ২০ মিনিট পর রোদে বের হওয়ার চেষ্টা করুন।
► মুখ ধোয়ার সময় খুব বেশি ঘষাঘষি করবেন না। নরম তোয়ালে দিয়ে হালকাভাবে মুখ মুছে নিন। মুখ ধোয়ার তিন মিনিট পর মুখে ময়েশ্চারাইজার লাগান। শুষ্ক ত্বকে ক্রিমসমৃদ্ধ ময়েশ্চারাইজার ও তৈলাক্ত ত্বকে অয়েল ফ্রি ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করুন।
► মেকআপ তুলতে কখনোই ফেসওয়াশ ব্যবহার করবেন না। প্রথমে মেকআপ রিমুভার অথবা অলিভ অয়েল দিয়ে মেকআপ তুলে নিন। এরপর ফেসওয়াশ দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলুন।
►  ফেসওয়াশের পরিবর্তে দুধ অথবা টক দই ব্যবহার করেন অনেকে। কিন্তু এটি মুখ পরিষ্কারে ততটা কার্যকর নয়। এমনকি সাবানও মুখ তেমন পরিষ্কার করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে ফেসওয়াশ বেছে নেওয়াই ভালো। 

Monday, May 7, 2018

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ ১০ মে  

বাংলাদেশের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের জন্য আগামী ১০ মে বৃহস্পতিবার নতুন তারিখ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। এর আগে ছয়বার উৎক্ষেপণের তারিখ পরিবর্তন হয়েছে। নতুন তারিখ ঘোষণা হলেও উৎক্ষেপণের ব্যাপারে এখনো শতভাগ নিশ্চিত নয় বিটিআরসি। শুধু উৎক্ষেপণের দিন সকালে এ বিষয়টি চূড়ান্ত হয়ে থাকে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
বিটিআরসির মিডিয়া উইং জানিয়েছে, ১০ মে যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় বিকাল ৪টায় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের উৎক্ষেপণ হবে। এ ব্যাপারে বিটিআরসি চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ নিউইয়র্কে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ১০ মে চূড়ান্ত তারিখ তা এই মুহূর্তে বলা যাবে না। সাধারণত যেদিন উৎক্ষেপণ হয় সেদিন সকাল বেলা বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়ে থাকে। এদিকে উৎক্ষেপণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রায় ৩০ সদস্যের প্রতিনিধিদল যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের প্রতিমন্ত্রী এবং বর্তমান তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমান। এ প্রসঙ্গে তিনি জানান, বিভিন্ন রাজ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও উৎক্ষেপণ অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন।

Friday, May 4, 2018

কার্ল মার্ক্সঃ মার্ক্সবাদঃ ঊনবিংশ শতকের দর্শন

আজ মহান দার্শনিক কার্ল মার্ক্সের জন্মদিন। কার্ল হাইনরিশ মার্ক্স একজন প্রভাবশালী জার্মান সমাজ বিজ্ঞানী ও মার্ক্সবাদের প্রবক্তা (৫ই মে, ১৮১৮ – ১৪ই মার্চ, ১৮৮৩)। জীবিত অবস্থায় সেভাবে পরিচিত না হলেও মৃত্যুর পর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীদের কাছে তিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। বিংশ শতাব্দীতে সমগ্র মানব সভ্যতা মার্ক্সের তত্ত্ব দ্বারা প্রবলভাবে আলোড়িত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের পতনের পর এ তত্ত্বের জনপ্রিয়তা কমে গেলেও তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে মার্ক্সবাদ এখনও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর আগ্রহের বিষয় ছিল রাজনীতি, অর্থনীতি, শ্রেণী সংগ্রাম।

অবদানঃ  
মার্কসবাদ; যৌথ প্রবক্তা (এঙ্গেলসের সাথে), বিচ্ছিন্নতা ও শ্রমিকের ব্যাখ্যা, কমিউনিস্ট ইস্তেহার, ডাস কাপিটাল, ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। কার্ল মার্ক্স প্রুশিয়া সাম্রাজ্যের নিম্ন রাইন প্রদেশের অন্তর্গত Trier নামক স্থানে এক ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারের নয় সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। বাবা হাইনরিশ মার্ক্স এমন এক বংশের লোক যে বংশের পূর্বপুরুষেরা রাব্বি ছিলেন। অবশ্য তাদের মধ্যে অতিবর্তী ঈশ্বরবাদ এবং আলোকময়তার যুগের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তাদের অনেকেই ভলতেয়ার ও রুসোর মত দার্শনিকদের প্রশংসা করতেন। জন্মের সময় হাইনরিশ মার্ক্সের নাম ছিল Herschel Mordechai, তার বাবার নাম Levy Mordechai (১৭৪৩-১৮০৪) এবং মা'র নাম Eva Lwow (১৭৫৩-১৮২৩)। ইহুদি পরিবারেই হাইনরিশের জন্ম, কিন্তু ধর্মের কারণে আইন অনুশীলনে বাধাগ্রস্ত হওয়ায় তিনি ইহুদি ধর্ম ত্যাগ করে লুথারীয় মতবাদে দীক্ষা নেন। লুথারীয় ধর্ম তখন প্রুশীয় সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রীয় প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম ছিল, তাই সেই রোমান ক্যাথলিক সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে লুথারীয় সংখ্যালঘু হিসেবে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা লাভের আশায়ই তিনি এভাবে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন।

শিক্ষাঃ
কার্ল মার্ক্স ১৩ বছর বয়স পর্যন্ত বাড়িতেই পড়াশোনা করেন। বাল্যপাঠ শেষে Trier Gymnasium এ ভর্তি হন, ১৭ বছর বয়সে সেখান থেকে স্নাতক হন। এরপর ইউনিভার্সিটি অফ বন-এ আইন বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। তার ইচ্ছা ছিল সাহিত্য ও দর্শন নিয়ে পড়া, কিন্তু তার বাবা মনে করতেন কার্ল স্কলার হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করতে পারবে না। কিছুদিনের মধ্যেই তার বাবা তাকে বার্লিনের Humboldt-Universität এ বদলি করিয়ে দেন। সে সময় মার্ক্স জীবন নিয়ে কবিতা ও প্রবন্ধ লিখতেন, তার লেখার ভাষা ছিল বাবার কাছ থেকে পাওয়া ধর্মতাত্ত্বিক তথা অতিবর্তী ঈশ্বরবাদের ভাষা। এ সময়ই তরুণ হেগেলিয়ানদের নাস্তিকতাবাদ গ্রহণ করেন। ১৮৪১ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তার পিএইচডি অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিল "The Difference Between the Democritean and Epicurean Philosophy of Nature" (প্রকৃতি সম্বন্ধে দেমোক্রিতোসীয় ও এপিকুরোসীয় দর্শনের মধ্যে পার্থক্য)। উল্লেখ্য, পিএইচডি অভিসন্দর্ভ তিনি বার্লিনের বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা না দিয়ে ইউনিভার্সিটি অফ জেনা-তে জমা দেন। কারণ তরুণ হেগেলিয়ান র‌্যাডিকেল হওয়ার কারণে বার্লিনে তার ভাবমূর্তি ভাল ছিল না।

তরুণ হেগেলিয়ান মার্ক্সঃ
বার্লিনের বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি ভাগ ছিল। তরুণ হেগেলিয়ান, দার্শনিক ছাত্র এবং লুডউইগ ফয়েরবাক ও ব্রুনো বাউয়ার-কে কেন্দ্র করে গঠিত সাংবাদিক সমাজ ছিল বামপন্থী। আর শিক্ষক সমাজ ছিল জি ডব্লিউ এফ হেগেল। এই দুটি ভাগ ছিল পরস্পরবিরোধী। হেগেলের অধিবিদ্যাগত অনুমিতিগুলোর সমালোচনা করলেও বামপন্থীরা প্রতিষ্ঠিত ধর্ম ও রাজনীতির কঠোর সমালোচনার জন্য হেগেলের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিই অনুসরণ করতো। কিছু তরুণ হেগেলিয়ান এরিস্টটল-উত্তর দর্শনের সাথে হেগেল-উত্তর দর্শনের সাদৃশ্য তুলে ধরেন। যেমন, মাক্স স্টির্নার তার Der Einzige und sein Eigenthum (১৮৪৪) বইয়ে ফয়ারবাখ ও বাউয়ারের সমালোচনা করেন, বিমূর্ত ধারণাগুলোর দ্ব্যর্থতাবোধক হেত্বাভাস (reification) চর্চার জন্য তাদেরকে ধার্মিক ব্যক্তি বলে আখ্যায়িত করেন। মার্ক্স এই বই পড়ে মুগ্ধ হয়ে ফয়ারবাখের বস্তুবাদ ত্যাগ করেন। এই রূপতাত্ত্বিক বিরতি (epistemological break) ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বিষয়ে তার ধারণার ভিত্তি রচনায় যথেষ্ট সাহায্য করে। এই নতুন ধারণার মাধ্যমে তিনি স্টির্নারেরও বিরোধিতা করেন। এ বিষয়ে একটি বইও লিখেন যার নাম Die Deutsche Ideologie (১৮৪৫)। অবশ্য ১৯৩২ সালের আগে এই বই প্রকাশের মুখ দেখেনি।

প্যারিস ও ব্রাসেল্‌সঃ
১৮৪৩ সালের অক্টোবর মাসের শেষের দিকে মার্ক্স প্যারিসে আসেন। এ শহর তখন জার্মান, ব্রিটিশ, পোলীয় ও ইতালীয় বিপ্লবীদের সদর দফতর হয়ে উঠেছিল। তিনি প্যারিসে গিয়েছিলেন মূলত জার্মান বিপ্লবী Arnold Ruge এর সাথে Deutsch-Französische Jahrbücher-এর উপর কাজ করতে। সে সময় ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস প্যারিসে গিয়েছিলেন মার্ক্সকে ১৮৪৪ সালের বাস্তবতায় ইংল্যান্ডে কর্মজীবী মানুষের অবস্থা অবহিত করতে। এর আগে ১৮৪২ সালে মার্ক্সের সাথে এঙ্গেল্‌সের এ নিয়ে কথা হয়েছিল। সে পরিচয়ের ভিত্তিতেই এঙ্গেল্‌স এ ধরণের উদ্যোগ নেন। এভাবেই ১৮৪৪ সালের ২৮শে অক্টোবর মার্ক্স ও এঙ্গেল্‌স প্যারিসের Café de la Régence-তে তাদের বন্ধুত্ব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা ঘটান। এটা ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক বন্ধুত্বের একটি। জার্মান-ফরাসি বার্ষিকী বা Deutsch-Französische Jahrbücher-এর পতন হওয়ার পর মার্ক্স প্যারিসের সবচেয়ে প্রগতিশীল জার্মান পত্রিকায় ("লিগ অফ দ্য জাস্ট" নামক গোপনীয় সমাজ এটা প্রকাশ করতো) একটি প্রবন্ধ লিখেন। এই প্রবন্ধের বিষয় ছিল "ইহুদি প্রশ্ন" এবং হেগেল। লেখালেখির বাইরে মার্ক্সের সময় কাটতো ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাস, Pierre-Joseph Proudhon এর রচনা এবং গ্রাম্য প্রোলেতারিয়াদের কথা পড়ে। এ সময় প্রোলেতারিয়াদের অবস্থা নিয়ে তার বিশেষ আগ্রহ সম্পর্কে উইলিয়াম এইচ সিউয়েল জুনিয়র তার ওয়ার্ক অ্যান্ড রিভলিউশন ইন ফ্রান্স গ্রন্থে বলেন, মার্ক্সের হঠাৎ করে প্রোলেতারীয় কারণ সম্বন্ধীয় মতবাদের প্রতি সমর্থনের সাথে এর আগে ফ্রান্সের সমাজতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবী সমাজের সাথে তার নিবিঢ় যোগাযোগের সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করা যায়। মার্ক্স তরুণ হেগেলিয়ানদের সাথে তার সম্পর্কের পূনর্মূল্যায়ন করেন। ১৮৪৩ সালে বাউয়ারের নাস্তিকতার জবাবে রচিত "অন দ্য জিউইশ কোয়েশ্চ্‌ন" এই পুনর্মূল্যায়নেরই অংশ। এ সময়ই আরেকটি প্রবন্ধ লিখেন যার বিষয় ছিল রাজনৈতিক মুক্তি, ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্ম কিভাবে মানুষের মুক্তির বিরোধিতা করে এবং বেসামরিক ও মানবাধিকার বিষয়ে সমকালীন দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা। প্রত্যয়ী সাম্যবাদী এঙ্গেল্‌স মার্ক্সের অর্থনৈতিক গবেষণাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যান এবং কর্মজীবী শ্রেণীর অবস্থার প্রতি তার উৎসাহ সৃষ্টি করেন। এভাবেই মার্ক্স সাম্যবাদী হয়ে উঠেন, ইকোনমিক অ্যান্ড ফিলোসফিক্যাল মেনুস্ক্রিপ্ট‌্‌স অফ ১৮৪৪ (১৯৩০-এর দশকের আগে প্রকাশিত হয়নি) রচনার মাধ্যমে সাম্যবাদ বিষয়ে তার মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেন, পুঁজিবাদী সমাজে বিচ্ছিন্ন (এলিয়েনেটেড) কর্মজীবী শ্রেণীর বিপরীতে সাম্যবাদী সমাজে সম্পৃক্ত (আন-এলিয়েনেটেড) কর্মজীবী শ্রেণীর কথা বলেন। তার মতে, এ ধরণের সাম্যবাদী সমাজে সবাই নিজেদের স্বাধীনভাবে গড়ে তুলতে পারে এবং পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে উৎপাদন ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে পারে। ১৮৪৫ সালের জানুয়ারিতে যখন Vorwärts প্রুশিয়ার রাজা ফ্রিডরিক উইলিয়াম ৪-কে হত্যার প্রচেষ্টাকে অনুমোদন দেয় তখন প্যারিস থেকে কার্ল মার্ক্স সহ সব বিপ্লবীকে বহিষ্কার করা হয়। তিনি এঙ্গেল্‌সের সাথে ব্রাসেল্‌স চলে যান। এখানেই ঐতিহাসিক বস্তুবাদকে সম্পূর্ণ করার জন্য ইতিহাস অধ্যয়ন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় তার দ্য জার্মান আইডিওলজি-তে (১৮৪৫) বলেন, প্রতিটি ব্যক্তির স্বভাব-প্রকৃতি তাদের উৎপাদন নির্ধারণকারী বস্তুর শর্তের উপর নির্ভর করে। এর মাধ্যমেই উৎপাদনের নকশা প্রণয়ন করেন এবং শিল্পকেন্দ্রিক পুঁজিবাদের পতন ও তার বদলে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার ভবিষ্যদ্বাণী করেন। এর পরই ফরাসি সমাজতন্ত্রের সমালোচনা প্রকাশ করেন যার নাম ছিল দ্য পোভার্টি অফ ফিলোসফি (১৮৪৭)। এটা ছিল Pierre-Joseph Proudhon রচিত "দ্য ফিলোসফি অফ পোভার্টি"-র (১৮৪৭) প্রত্যুত্তর। বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে চিন্তা করলে মার্ক্সের দ্য জার্মান আইডিওলজি এবং দ্য পোভার্টি অফ ফিলোসফি-ই পরবর্তীকালে প্রকাশিত দ্য কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোর মূল ভিত্তি। এই ইশতেহার ছিল কমিউনিস্ট লিগ-এর মূলনীতি।

প্যারিসে প্রত্যাবর্তনঃ
১৮৪৮ সালে ইউরোপ জুড়ে প্রচুর বিপ্লব সংঘটিত হয়। অনেক কিছুই বদলে যায়। মার্ক্সকে বন্দী করা হয় এবং পরবর্তীতে বেলজিয়াম থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরই মধ্যে বিপ্লবীরা ফ্রান্সের রাজা লুই-ফিলিপ কে রাজি করিয়ে মার্ক্সকে প্যারিসে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করে। রাজার আমন্ত্রণেই তিনি প্যারিসে প্রত্যাবর্তন করেন। এ সময় প্যারিসে জুন ডেইস আপরাইজিং নামে পরিচিত বিপ্লবটি সংঘটিত হয় যা মার্ক্স প্রত্যক্ষ করেন।

জার্মানিতে প্রত্যাবর্তন ও পুনরায় নির্বাসনঃ
প্যারিসে জুন ডেইস আপরাইজিং শেষ হওয়ার পর ১৮৪৯ সালে মার্ক্স জার্মানির Cologne শহরে ফিরে যান এবং Neue Rheinische Zeitung পত্রিকাটি প্রকাশ করতে শুরু করেন। এই পত্রিকা প্রকাশকালীন সময়েই তাকে দুই বার অভিযুক্ত করা হয়। প্রথম বার ১৮৪৯ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারি press mis-demeanour crime প্রকাশের জন্য এবং পরের বার একই বছরের ৮ই ফেব্রুয়ারি incitement to armed rebellion প্রকাশের জন্য। দুই বারই তিনি অব্যাহতি পেয়ে যান। কিন্তু এই ধারাবাহিকতায় আরও বাঁধা আসতে থাকে। একসময় পত্রিকাটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় এবং তাকে প্যারিসে ফিরে যেতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু প্যারিস তাকে শরণার্থী হিসেবে গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়, অগত্যা লন্ডনে চলে যান। লন্ডন তাকে ইউরোপ মহাদেশের একজন শরণার্থী হিসেবে গ্রহণ করে।

লন্ডনে বসবাসঃ
১৮৪৯ সালের মে মাসে কার্ল মার্ক্স লন্ডনে যান এবং ব্রিটেনে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। ১৮৫১ সালে নিউ ইয়র্ক ট্রিবিউন-এর স্থানীয় সংবাদদাতা হিসেবে কাজ শুরু করেন, এতে তার জীবিকা অর্জনেও সুবিধা হয়। ১৮৫৫ সালে মার্ক্স পরিবারের সন্তান এডগার যক্ষ্ণায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এসব কারণে কয়েক বছর রাজনৈতিক অর্থনীতির কাজ বেশ ধীরগতিতে চলে। ১৮৫৭ সালে ৮০০ পৃষ্ঠার একটি পাণ্ডুলিপির কাজ শেষ করেন। এই ৮০০পৃষ্ঠায় মূলধন, ল্যান্ডেড প্রোপার্টি, মজুরি শ্রম, রাষ্ট্র, বৈদেশিক বাণিজ্য এবং বিশ্ব বাজার বিষয়গুলো স্থান পায়। এই পাণ্ডুলিপিটি ১৯৪১ সালে Grundrisse der Kritik der Politischen Ökonomie (রাজনৈতিক অর্থনীতির সমালোচনার সাধারণ পরিচিতি) নামে প্রকাশিত হয়। বইটির সংক্ষিপ্ত নাম ছিল Grundrisse। ১৮৫৯ সালে প্রকাশ করেন কন্ট্রিবিউশন টু দ্য ক্রিটিক অফ পলিটিক্যাল ইকোনমি যা তার অর্থনীতি বিষয়ক পরিপক্ক প্রকাশনাগুলোর মধ্যে প্রথম হিসেবে বিবেচিত হয়। একইসাথে সংবাদ প্রতিবেদক হিসেবে মার্ক্স মার্কিন গৃহযুদ্ধের (১৮৬১-১৯৬৫) ইউনিয়ন কারণ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেন। ১৮৬০-এর দশকের প্রথম দিকে মার্ক্স তিনটি খণ্ড রচনা শেষ করেন। প্রথম খণ্ডের নাম থিওরিস অফ সারপ্লাস ভ্যালু। এর প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল কয়েকজন রাজনৈতিক অর্থনীতি তাত্ত্বিকদের (বিশেষত অ্যাডাম স্মিথ ও ডেভিড রিকার্ডো) মতবাদ। সম্পাদক Karl Kautsky মার্ক্সের মৃত্যুর পর এটা প্রকাশ করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত না হলেও এই খণ্ডকে ডাস কাপিটাল-এর "চতুর্থ পুস্তক" হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। অর্থনৈতিক চিন্তাধারার ইতিহাস নিয়ে জ্ঞানগর্ভ রচনাগুলোর এটাই প্রথম। ১৮৬৭ সালে তিন খণ্ডে ডাস কাপিটাল প্রকাশিত হয়। প্রথম খণ্ড ডেভিড রিকার্ডো প্রণীত মূল্যের শ্রম নীতি-কে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে এবং সে দৃষ্টিকোণ থেকে উদ্বৃত্ত মূল্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শ্রমিকদের শোষণকারী পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার বিশ্লেষণ করে। মার্ক্স এতে বলেন, এই উদ্বৃত্ত মূল্য ও শোষণের কারণে একসময় পুঁজিবাদীদের লাভের হার একেবারে কমে যাবে এবং যথারীতি শিল্পকেন্দ্রিক পুঁজিবাদের পতন ঘটবে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড মার্ক্সের জীবদ্দশায় পাণ্ডুলিপি পর্যায়েই থেকে যায়, তিনি এ দুটোর আরও উন্নয়ন ঘটান। তার মৃত্যুর পর এঙ্গেলস এগুলো সমাপ্ত করেন এবং প্রকাশ করেন। ডাস কাপিটাল প্রকাশে একটু দেরী হয়, কারণ মার্ক্স তখন প্রথম আন্তর্জাতিক এর কাজ নিয়ে ব্যস্ত। ১৮৬৪ সালে মূল জেনারেল কাউন্সিলে নির্বাচিত হন। কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল-এর প্রথম বার্ষিক সভার প্রস্তুতি গ্রহণ এবং মিখাইল বাকুনিন (১৮১৪-১৮৬৭) এর অ্যানার্কিস্ট দলের সাথে অন্তর্ঘাতী বিরোধে নেতৃত্ব দানের দায়িত্ব তার উপরই পড়ে। এই বিরোধে তিনি জয়ী হন, কিন্তু ১৮৭২ সালে তারই সমর্থনে জেনারেল কাউন্সিলের সভাস্থল লন্ডন থেকে নিউ ইয়র্কে সরিয়ে নেয়ার কারণে ইন্টারন্যাশনালের পতন ত্বরান্বিত হয়। ইন্টারন্যাশনালের সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল ১৮৭১ সালের প্যারিস কমিউন। এই কমিউনের মাধ্যমে প্যারিসের বিপ্লবীরা ফরাসি সরকারের বিরোধিতা করে দুই মাস শহরের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখে, অবশেষে রক্তাক্ত সংঘর্ষের মাধ্যমে সরকার পুনরায় নেতৃত্ব নিয়ে নেয়। মার্ক্স তার দ্য সিভিল ওয়ার ইন ফ্রান্স রচনায় কমিউনকে সমর্থন করেছিলেন। জীবনের শেষ দশকে তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে, আগের মত প্রত্যয়ী বুদ্ধবৃত্তিক আন্দোলন পরিচালনায় অক্ষম হয়ে পড়েন। অবশ্য সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে বক্তব্য প্রদান থেকে কখনই বিরত ছিলেন না, বিশেষত জার্মানি ও রাশিয়ার রাজনীতি নিয়ে কথা বলতেন। Critique of the Gotha Programme-এ তিনি Wilhelm Liebknecht (১৮২৬-১৯০০) এবং August Bebel (১৮৪০-১৯১৩) নামক দু'জন জার্মান অনুসারীর প্রবণতার বিরোধিতা করেন। এই দুজন ফের্দিনান্দ লাসালের রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রের সাথে সমঝোতা করার মাধ্যমে একটি ঐক্যবদ্ধ সমাজতান্ত্রিক দলের স্বার্থের পক্ষাবলম্বন করেছিল। সে সময় রাশিয়ার মির গ্রামে জমির উপর সাধারণ মালিকানা প্রবর্তন করা হয়েছিল। এসব দেখে মার্ক্স গভীরভাবে প্রত্যাশা করেছিলেন যে, অচিরেই রাশিয়ায় পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পতনের মাধ্যমে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে।

পারিবারিক জীবনঃ
মার্ক্স জেনি ফন ভেস্টফালেন-কে বিয়ে করেন। জেনি ছিলেন এক প্রুশীয় ব্যারনের শিক্ষিত কন্যা। তাদের সম্পর্কের বিষয়টি গোপন রাখতে হয়েছিল, কারণ এই বিয়েতে মার্ক্স পরিবারের সম্মতি ছিল না। ১৮৪৩ সালের ১৯শে জুন Bad Kreuznach-এর Kreuznacher Pauluskirche-এ তাদের বিয়ে হয়।
১৮৫০-এর দশকের প্রথমার্ধে মার্ক্স পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভাল ছিল না। তখন তারা লন্ডনের সোহো'র ডিন স্ট্রিটে একটি তিন রুমের ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকতেন। এরই মধ্যে তাদের চার সন্তানের জন্ম হয়। লন্ডনে বসবাস শুরু করার পর আরও তিন সন্তান হয়। এই সাত জনের মধ্যে কেবল তিনজন প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত বেঁচে ছিল। মার্ক্সের আয়ের উত্স ছিল কেবল এঙ্গেল্‌সের দেয়া ভর্তুকি ও নিউ ইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউন-এর বিদেশী সংবাদদাতা হিসেবে পাওয়া বেতন। জেনি এক কাকা ও মা'র কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্র কিছু অর্থ পায়। এই অর্থই মার্ক্স পরিবারকে কেন্টিশ টাউনের ৯ গ্র্যাফ্টন টেরেস এ অপেক্ষাকৃত ভাল ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাসা নিতে সাহায্য করে। আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভাল না হলেও মার্ক্স তার স্ত্রী ও সন্তানদের বুর্জোয়া সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য আবশ্যক সব উপকরণ সরবরাহ করতেন।
জেনির গর্ভে মার্ক্সের যেসব সন্তান হয়েছিল তারা হল: জেনি ক্যারোলিন (১৮৪৪-১৮৮৩), জেনি লরা (১৮৪৫-১৯১১), এডগার (১৯৪৭-১৮৫৫), হেনরি এডওয়ার্ড গাই (১৮৪৯-১৮৫০), জেনি এভেলিন ফ্রান্সেস (১৮৫১-১৮৫২), জেনি জুলিয়া এলিনর (১৮৫৫-১৮৯৮) এবং আরও কয়েকজন যারা নাম রাখার আগেই মারা যায়। বিপুল জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও কার্ল মার্ক্সের মধ্যে মানবিক চাহিদা ছিল না, এমনটা বলা যাবে না।

মৃত্যুঃ লন্ডনের হাইগেট সেমিটারিতে কার্ল মার্ক্সের সমাধি স্তম্ভ
১৮৮১ সালের ডিসেম্বরে জেনি মারা যাওয়ার পর মার্ক্স এক ধরণের catarrh-এ আক্রান্ত হন। এই রোগ তাকে জীবনের শেষ ১৫ মাস অসুস্থ করে রাখে। এই রোগ পরবর্তীতে ব্রঙ্কাইটিস ও সব শেষে pleurisy তে পরিণত হয়। এই pleurisy-র কারণেই ১৮৮৩ সালের ১৪ই মার্চ তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর সময় মার্ক্সের কোন জাতীয়তা তথা দেশ ছিল না, তাকে ১৭ই মার্চ লন্ডনের হাইগেট সেমিটারি-তে সমাহিত করা হয়। তার সমাধি ফলকে দুটি বাক্য লেখা আছে। প্রথমে লেখা, কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোর শেষ লাইন "দুনিয়ার মজদুর এক হও" (Workers of all land unite), এরপরে লেখা ১১তম থিসিস অন ফয়ারবাখ-এর এঙ্গেলীয় সংস্করণের বিখ্যাত উক্তি, "এতোদিন দার্শনিকেরা কেবল বিশ্বকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যাই করে গেছেন, কিন্তু আসল কাজ হল তা পরিবর্তন করা।" (The Philowophers have only interpreted the world in various ways - The point however is to change it) ১৯৫৪ সালে গ্রেট ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টি কার্ল মার্ক্সের সমাধিতে একটি সৌধ স্থাপন করে যার শীর্ষে আছে মার্ক্সের মুখমণ্ডলের ভাস্কর্য। লরেন্স ব্র্যাডশ এই মুখাবয়বটির স্থপতি। প্রকৃত সমাধিটি সমতল। মার্ক্সের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে মাত্র ১১ জন ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন।