বস্তুর আজব চালের ব্যাখ্যা তিন দশক আগেই
ডেভিড থুলেস, ডানকান এম হ্যালডেন ও মাইকেল কস্টারলিৎজ
স্বীকৃতি এল তিন দশক পর। বিশেষ অবস্থায় পদার্থের কিছু আশ্চর্য আচরণের যে ব্যাখ্যা তাঁরা দিয়েছিলেন গত শতকের ’৭০-’৮০-র দশকে, তারই পথ বেয়ে এত দিন এগিয়েছে ফলিত পদার্থবিদ্যা ও প্রযুক্তি। এখনও এগোচ্ছে। ২০১৬-তে এসে সেই গবেষণার জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হল ডেভিভ জে থুলেস, এফ ডানকান এম হ্যালডেন এবং জে মাইকেল কস্টারলিৎজ-কে। প্রত্যেকেরই জন্ম ব্রিটেনে। কর্মসূত্রে তিন জনেই আমেরিকায়।
কঠিন-তরল-গ্যাস, সাধারণ ভাবে পদার্থের এই তিনটি অবস্থা ও তার ধরন-ধারনের সঙ্গে আমরা পরিচিত। কিন্তু চরম অবস্থায়, যেমন তাপমাত্রা যখন খুবই কম, কিংবা কোনও বস্তু যখন খুবই সূক্ষ্ম পাতে পরিণত হয়, তখন তার মধ্যে আশ্চর্য কিছু আচরণ নজরে আসে। ওই রকম বিশেষ পরিস্থিতিতে বস্তুর নানা রূপ ও রূপান্তর নিয়ে তাত্ত্বিক গবেষণার জন্যই পুরস্কৃত করা হল এই তিন বিজ্ঞানীকে। নোবেল কমিটির মতে, ‘‘অজানা জগতের দরজা খুলে দিয়েছিলেন এঁরা।’’
সাধারণ তাপমাত্রায় যে বস্তু মোটামুটি বিদ্যুৎ পরিবাহী, অতি কম তাপমাত্রায় সেটিই অতি-সুপরিবাহী হয়ে ওঠে বিদ্যুতের। কিংবা খুবই পাতলা ম্যাগনেটিক ফিল্মে পাওয়া যায় বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য। কেন? ৭০-এর দশকে বিজ্ঞানীরা মনে করছিলেন খুবই কম তাপমাত্রার মতো চরম কোনও পরিস্থিতিতে পদার্থের ধর্মের শৃঙ্খলা বুঝি নষ্ট হয়ে যায়। বিজ্ঞানীদের সামনে প্রশ্ন ছিল, পদার্থের ওই আপাত অস্বাভাবিক আচরণেরও নিশ্চয়ই কোনও সুনির্দিষ্ট ধরন আছে। সেটাই খুঁজতে গিয়ে থুলেস-হ্যালডেন-কস্টারলিৎজ— তিন জনেই আশ্রয় নেন অঙ্কের এক বিশেষ ধারার। টপোলজি। তারই সূত্র ধরে বস্তুর অজানা চরিত্রের হদিস জানান তাঁরা।
ধরা যাক, নরম নিরেট একটা রবারের বল বা খোলা ছাড়ানো সেদ্ধ ডিম। আঙুলের সামান্য চাপে এগুলির আকার বদলে দেওয়া যায়। কিংবা রবারের একটা ফিতে। টানলে লম্বা হয়। বাঁকানো ও মোচড়ানোও যায় একে। জলের ঘূর্ণির মাঝে যেমন গোল গর্ত (ভর্টেক্স) তৈরি হয়, তেমনই অণুগুলির মাঝে থাকে অনেক গর্ত বা ভর্টিসেস। বস্তুকে বাঁকানো বা মোচড়ানো হলে ওই গর্তগুলির আকার, আয়তন ও বিন্যাসে ধারাবাহিক কিছু বদল ঘটে। অবশ্যই বস্তুটি ভেঙে বা ছিঁড়ে না যাওয়া পর্যন্ত। ভিতরের ওই গর্তগুলি বা ভর্টিসেসের বিন্যাস বদলের ধরন ব্যাখ্যা করা হয় অঙ্কের টপোলজি ধারা দিয়ে। থুলেসরা একেই ব্যবহার করেন নিজেদের প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে।
তাপমাত্রা বাড়লে বস্তুর ভিতরে গর্ত বা ফোকরগুলি দূরে সরে যায়। উষ্ণতা কমলে কাছে আসে। এতে দশা পাল্টায় বস্তুর। ১৯৮০ দশকে থুলেস ও হ্যালডেন পদার্থের বিভিন্ন অবস্থায় বিদ্যুৎ পরিবহণ নিয়ে কাজ করছিলেন। অতি শীতল অবস্থায় বা খুব শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্রের মধ্যে থাকা পদার্থের বিদ্যুৎ পরিবহণের মাত্রা কেন বদলে যায়, তারই ব্যাখ্যা তাঁরা দেন টপোলজির মাধ্যমে। দেখান, আপাত ভাবে এলেমোলো বদলের মধ্যেও একটা শৃঙ্খলা আছে। আছে নির্দিষ্ট ছন্দ। পদার্থবিদ্যার নতুন পথ খুলে দেয় তাঁদের তত্ত্ব।
এই তাত্ত্বিক গবেষণাই এখনকার যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে কোয়ান্টাম কম্পিউটার বা সুপার-কম্পিউটারের হাল-হকিকত বদলে দেওয়ার পথ খুলে দিয়েছে। তিন দশক পরে মিলল নোবেল-স্বীকৃতি।
এ বছরের পুরস্কারমূল্য ৮০ লক্ষ সুইডিশ ক্রোনা (প্রায় ৬.২ কোটি টাকা)। সিয়াট্ল ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের ‘প্রফেসর এমেরিটাস’, ৮২ বছর বয়সি থুলেস পাবেন এর অর্ধেক। বাকি অর্ধেক ভাগ করে দেওয়া হবে হ্যালডেন ও কস্টারলিৎজের মধ্যে। ৬৫ বছর বয়সি হ্যালডেন বর্তমানে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির ‘ইউজিন হিগিনস প্রফেসর’। আর ৭৪ বছরের কস্টারলিৎজ বর্তমানে ব্রাউন ইউনিভার্সিটি, প্রভিডেন্স-এর ‘হ্যারিসন ই ফার্নসওয়ার্থ প্রফেসর’।
নোবেল পুরস্কার পাওয়ার কথা জেনে বেশ অবাক কস্টারলিৎজ। তাঁর সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া, ‘‘কিছুটা চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার মতো। এখনও পুরো বিশ্বাস হচ্ছে না।’’ তিন জনের মধ্যে সবচেয়ে প্রবীণ থুলেস। নোবেল কমিটি যখন এই ঘোষণা করে, আমেরিকায় তখন বেশ রাত। ফলে তাঁর কোনও প্রতিক্রিয়া এখনও পাওয়া যায়নি। তুলনায় নবীন হ্যালডেন প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বললেন, ‘‘আমি বিস্মিত ও কৃতজ্ঞ।’’
কেন এত দিন পরে এল তাঁদের কাজের স্বীকৃতি?
এরও একটা ব্যাখ্যা মিলল হ্যালডেনের কাছ থেকে। তাঁর কথায়, ‘‘কাজটা হয়েছিল বহু দিন আগে। কিন্তু সেই মূল কাজটিকে ভিত্তি করে সাম্প্রতিক কালে বেশ কিছু দারুণ আবিষ্কার হয়েছে। মূল কাজটিকেও এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে এই
সব আবিষ্কার।’’
সব আবিষ্কার।’’
No comments:
Post a Comment