ভিন্ন চোখে
মার্কিন করপোরেট নারীবাদের চেহারা
প্রকৃত নারীবাদ ও করপোরেট নারীবাদের মাঝে বিস্তর ব্যবধান। পুঁজিবাদ যেমন শ্রমিকের মুক্তি চায় সব শৃঙ্খল থেকে শুধু নিজের শিকলে বেঁধে রেখে, তেমনি নারীরও মুক্তি চায় সব শৃঙ্খল থেকে শুধু নিজের শিকলে বেঁধে রেখে। আধুনিক পুঁজিবাদের প্রধান মাতবর যুক্তরাষ্ট্র নারীমুক্তির বাণী প্রচার করে বিশ্বব্যাপী। দেশে দেশে মার্কিন নারীবাদের বিস্তার ঘটানোর জন্য তাদের নানা উদ্যোগ রয়েছে। কিন্তু এবারকার মার্কিন নির্বাচনী দৌড়ে তাদের বিশেষ রকম নারীবাদের চেহারাটি একেবারে প্রকাশ হয়ে পড়েছে। একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, নারীস্বাধীনতার প্রচারক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ পর্যন্ত কোনো নারী রাষ্ট্রপ্রধান হতে পারেনি। যদিও যাদের কানে প্রতিদিন মার্কিন প্রচারক গোষ্ঠী নিয়মিত নারীস্বাধীনতার উপদেশ ঢালে, তৃতীয় বিশ্বের এমন সব দেশে অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন নারী নেতৃত্বে আসীন। কেবল এবারই প্রথম হিলারি ক্লিনটনের বরাতে একজন নারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদের সবচেয়ে নিকটবর্তী হতে পেরেছেন এবং সম্ভবত চালকের আসনে বসতেও যাচ্ছেন, যদি ট্রাম্পের পুরুষালি মাস্তানিকে তিনি ছুড়ে ফেলতে পারেন। তবে হিলারি ও ট্রাম্পের এই যুদ্ধে মার্কিন নারীবাদের চেহারাটাও যারপরনাই স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ছে।
ম্যানহাটনের শিক্ষিকা স্যাম মিলার ‘জ্যাকোবিন’ সাময়িকীতে এক লেখায় (ট্রাম্প অ্যান্ড উইমেন: এ মার্ক্সিস্ট ক্রিটিক, ১০.১৪.১৬) এই মার্কিন নারীবাদের রূপ তুলে ধরে বলেছেন, ‘ব্যবসায় ও রাজনীতিতে ওপরে ওঠার জন্য ভেতরে কঠিন, পাশবিক ও গলাকাটা রূপটি অক্ষুণ্ন রেখে বাইরে তুলতুলে কোমল যত্নশীল রূপ বজায় রাখতে নারীকে প্রয়োজন। ডোনাল্ড ট্রাম্প তার ব্যবসায় ও ব্যক্তিগত জীবনে নারীকে যেভাবে কাজে লাগিয়েছেন তা এক বৃহৎ চিত্রের ক্ষুদে রূপ। ট্রাম্পের মেয়ে ইভাঙ্কা ও তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক বন্ধু হিলারি—দুজনই সেই একই ধারার প্রতিভূ যার নাম করপোরেট নারীবাদ।’
ট্রাম্পের লাম্পট্যে অনেকেই আঁতকে উঠছেন। কিন্তু হিলারির স্বামী বিল ক্লিনটনও যে এ প্রতিযোগিতায় ট্রাম্পের খুব পিছনে পড়েননি, ট্রাম্পের এ অভিযোগ সবটা মিথ্যা নয়। ক্লিনটনের রাজনৈতিক বিপদের মাঝে হিলারি পূর্ণ সমর্থন দিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, ইভাঙ্কাও আজ তার বাবার রাজনৈতিক বিপদের দিনে পাশে দাঁড়িয়েছেন। ক্লিনটনের চারিত্রিক সনদপত্র দিচ্ছেন তার স্ত্রী ও ট্রাম্পের চারিত্রিক সনদপত্র দিচ্ছেন তার মেয়ে। এ রকম সনদপত্র স্বজনপ্রীতির দোষে দুষ্ট হওয়াই স্বাভাবিক। তবু ট্রাম্প ও ক্লিনটনের মধ্যে এ ব্যাপারে একটা পার্থক্য আছে বৈকি। ক্লিনটন যে দোষ লুকাতে চেষ্টা করতেন, ট্রাম্প তা নিয়ে গরিমা করেছেন। আরেকটা পার্থক্যও আছে—হিলারি যেখানে বলছেন ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্যই নয়, তার শরীর হাতানো স্বভাবের জন্য, সেখানে ট্রাম্প হিলারির কোন স্বভাবদোষ খুঁজে না পেয়ে তার স্বামীর চরিত্র নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করছেন।
চরিত্র হননের এই প্রতিযোগিতায় উভয় প্রার্থীই মার্কিন সামাজিক-রাজনৈতিক মূল প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। মার্কিন এস্টাবলিশমেন্টেরও এই চাই। তারা রাষ্ট্রীয় নীতিমালার মৌলিক বিষয় থেকে জনগণের দৃষ্টিকে চরিত্র হননের প্রতিযোগিতায় পর্যবসিত করেছে। নারীলোলুপতার বর্ণনা এমন চিত্রময় হয়ে উঠেছে যে, অনেক বাবা-মা বলেছেন ট্রাম্প ও হিলারির বিতর্ক ছেলেমেয়ের সঙ্গে একত্রে বসে শোনাও অস্বস্তিকর। মার্কিন পত্রপত্রিকায় ট্রাম্পকে নিয়ে যেসব কাহিনি বের হচ্ছে, আমাদের দেশে এসব কাহিনি ক্ষেত্রবিশেষে ‘অপ্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য নিষিদ্ধ’ বলে সিল মারা থাকে। ট্রাম্প দাবি করছেন বিল ক্লিনটনও তার সারথী। ট্রাম্পের অভিযোগ, পত্রপত্রিকা তার কথা যত লিখছে তার কথায় তত কান দিচ্ছে না।
দ্বিতীয় বিতর্কে হিলারি ও ট্রাম্প দুজনে এই পাঁকের মধ্যেই হাবুডুবু খেয়েছেন। তবে ট্রাম্পের লাম্পট্যকে পুঁজি করে হিলারি মঞ্চে যতটা ফায়দা লুটতে চেয়েছিলেন ততটা পারেননি। বিতর্কে প্রাথমিক ধাক্কা কিছুক্ষণ পরই তিনি কাটিয়ে ওঠেন। নারীদের সম্পর্কে তার অশ্লীল কথাবার্তার ভিডিওটেপ নিয়ে প্রশ্নগুলো থেকে লাফিয়ে তিনি মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা ক্ষেত্রে গিয়ে পড়েন। আর হিলারির ই-মেল ব্যবহারের বিবেচনাহীনতা যে কী মাত্রায় সে নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে তা নিয়ে খুব ঝাঁপাঝাঁপি করেন। হিলারির ইট খেয়ে ট্রাম্প যখন পাটকেল মারতে শুরু করলেন এই বলে যে, তার যেখানে কুকথা বিলের সেখানে কুকর্ম, হিলারি মিশেল ওবামার একটি উক্তিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে জয় ছিনিয়ে নিলেন। মিশেল বলেছিলেন, ওরা যত নিচে নামবে আমরা ততই উপরে উঠব।
হিলারি প্রায়ই অভিযোগ করেন যে, ট্রাম্প একটা ‘বিকল্প বাস্তবে’র মধ্যে বাস করেন। ট্রাম্পের বেতাল কথাবার্তা শুনে তাই মনে হয়। হিলারি যে এক ‘অবিকল্প বাস্তবে’ বাস করেন এ কথা সত্য। তবে এ কথা আরো বেশি সত্য যে, হিলারি মানুষের মনে তাকে নিয়ে একটা ‘বিকল্প বাস্তব’ তৈরি করেছেন। দুই নৌকায় পা দিয়ে চলতে যে তিনি খুব দক্ষ তার বহু প্রমাণ আছে। তিনি চৈত্র মাসে এক নসিহত আর মাঘ মাসে আরেক কথা বলেন, ঝোপ বুঝে কোপ মারেন। ৯ অক্টোবর বিতর্কমঞ্চে ভার্জিনিয়া থেকে আগত দুজন প্রশ্নকারী হিলারির এ স্বভাব নিয়ে জানতে চান, একজন রাজনীতিকের দুমুখো হওয়া কি শোভন? এ প্রশ্নের জবাবে হিলারি আব্রাহাম লিঙ্কনের দুক্ষেত্রে দুরকম যুক্তি উপস্থাপন করে রাজনৈতিক বিজয় অর্জনের প্রশংসা করেন ও নিজের স্বভাবকে তার সঙ্গে তুলনা করেন। ফলে ট্রাম্পের তোপের মুখে পড়েন। হিলারি তার দুই রূপের জন্য বিখ্যাতÑজনমনে নারীবাদী রূপ আর করপোরেট সমাজে তার নারীস্বার্থবিরোধী ভূমিকা।
বাকযুদ্ধে ট্রাম্প পরাজয়ের মুখে পড়ে মঞ্চজুড়ে পায়চারি করতে থাকেন। একসময় হিলারিকে তিনি জেলে ঢোকানোর হুমকি দেন। তাকে দেখতে ক্রুদ্ধ বাঘের মতো লাগছিল। তবে গার্ডিয়ানের সাংবাদিক ডেভিড স্মিথের চোখে তাকে মনে হয়েছে বরাহ। বাঘ বা বরাহ যাই হোক, ফোঁসফোঁস করে মঞ্চজুড়ে তার পায়চারি ও জেলে ঢোকানোর হুমকির মধ্যে যে পুরুষাধিপত্যের প্রকাশ ঘটেছে এতে সন্দেহ নেই। তাই বলে ক্লিনটন পরিবারকে নিখাদ নারীবাদী মনে করার কোনো কারণ নেই। হিলারির নির্বাচন যে কোনোভাবেই নারী অধিকারের ক্ষেত্রে কোনো অর্জন হবে না তা নিশ্চিত। ট্রাম্পরা হিলারিরই বন্ধু। যে নারীদের ভদ্রলোক অসম্মান করেছেন, তাদের কেউই ক্লিনটন পরিবারের বন্ধু নয়, শ্রেণি-পার্থক্যের কারণে তা হওয়া সম্ভবও নয়। ট্রাম্পের কেলেঙ্কারিমাখা ভিডিওটেপ বাজারে ছাড়া নির্বাচনী প্রচারযুদ্ধের অংশ মাত্র। সত্যিকার সমতাভিত্তিক নারীবাদ নয়, করপোরেট নারীবাদ উভয়েরই পূজ্য।
ট্রাম্প ও ক্লিনটনরা চিরদিনই বন্ধু। হঠাৎ জীবনের কোনো মুহূর্তে রাজনৈতিক বা ব্যবসায়িক স্বার্থে তারা একে অপরের শত্রু হতে পারেন। কিছুদিন এ শত্রুতা চলতে পারে। নির্বাচন শেষে তারা আবার বন্ধু হয়ে যাবেন। দ্বিতীয় বিতর্ক শুরু হয়েছিল একে অপরের সঙ্গে হাত না মিলিয়ে। বিতর্কটি শেষ হয়েছে হাত মিলিয়ে। করপোরেট নারীবাদ—প্রকৃত নারীস্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে নারীকে মুনাফা অর্জনের বা ক্ষমতা লাভের জন্য কাজে লাগানো ও তার মার্কিনি রূপ হিলারি-ট্রাম্পের হ্যান্ডশেকের মধ্য দিয়ে অব্যাহত থাকবে। ট্রাম্পের হাতে নারীর অসম্মান নিয়ে হিলারির কান্না নির্বাচন পর্যন্তই চলবে। অপদস্থ ওইসব নারী এখন হিলারি ক্যাম্পের হাতে অমূল্য সম্পদ। বিজয় অর্জিত হলে বিল ও হিলারি ক্লিনটন হেসে জগতকে সাবাস বলে বুড়া আঙুল দেখাবেন। নারী নিয়ে কেলেঙ্কারির অস্ত্রকে লক্ষ্য অনুযায়ী ছুড়ে মেরে প্রতিপক্ষকে কত ঘায়েল করতে পারছেন, তার ওপর এবারের মার্কিন নির্বাচনী ফল অনেকাংশে নির্ভর করছে। ট্রাম্প যে নাজেহাল তা দেখাই যাচ্ছে।
সৌজন্যে: সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট ইনোভেশন অ্যান্ড প্র্যাকটিসেস (সিদীপ)
No comments:
Post a Comment