Thursday, February 2, 2017

শব্দদূষণ:আমি এবং আমরা

আমরা রাগ-অনুরাগ, আদর-আবদার, উপদেশ-নির্দেশ প্রকাশ করি শব্দের মাধ্যমে, যা মানুষের স্বাভাবিক জীবনের জন্য শরীরে রক্ত সঞ্চালনের মতোই প্রয়োজনীয়। শব্দের এই প্রয়োজনীয়, নিরীহ, সহনীয় ও রোমান্টিক রূপ সব সময় বজায় থাকলে কোনো সমস্যা হতো না। কিন্তু দিনের বেশিরভাগ সময়ই আমরা এক অসহনীয় শব্দের সঙ্গে বসবাস করছি।
পরিবেশবিজ্ঞানের ভাষায়, ভৌত পরিবেশে সহনক্ষমতা বহির্ভূত অপেক্ষাকৃত উচ্চ-তীব্রতাসম্পন্ন শব্দের উপস্থিতিতে জীব-পরিবেশ তথা মানুষের ওপর যে অসংশোধনযোগ্য ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি হয়, সেই পরিবেশ সংক্রান্ত ঘটনাকে ‘শব্দ দূষণ’ বলে। মানুষ বাড়ছে। রাস্তায় নামছে নতুন গাড়ি। গাড়ির চাহিদার জোগান দিতে বেড়েছে শব্দদূষণের মাত্রাও। শব্দদূষণ এক মহামারী আকার ধারণ করেছে। শব্দদূষণ রোধে আইন থাকলেও তা যেন ‘কাজীর গরু, কেতাবে আছে গোয়ালে নেই’। ২০০২ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সংস্থা (বেলা) শব্দদূষণ বন্ধে আদালতে একটি রিট পিটিশন দায়ের করে। উচ্চ আদালত হাইড্রোলিক হর্ন এবং বিকট শব্দ সৃষ্টিকারী যেকোনো ধরনের হর্ন সংযোজনের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন এবং গাড়িতে বাল্ব-হর্ন সংযোজনের নির্দেশ দেন। এরপরও আইন থাকলেও এর যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে।
রাজধানীসহ দেশের প্রায় সব শহরই এখন নীরব ঘাতক শব্দদূষণের কবলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ৬০ ডেসিবল শব্দে মানুষের সাময়িক শ্রবণশক্তি নষ্ট হতে পারে এবং ১০০ ডেসিবল শব্দে চিরতরে শ্রবণশক্তি হারাতে পারে। অথচ রাজধানী ঢাকায় ১০৭ ডেসিবল পর্যন্ত শব্দ সৃষ্টি হচ্ছে। আসলে দেশে অসংখ্য দৃশ্যমান সমস্যা আছে। স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে আমরা এখনো পড়ে আছি। তাই নীরব ঘাতক শব্দদূষণ নিয়ে কে চিন্তা করবে? আবার বেশিরভাগ লোকই না বুঝে, অসচেতনভাবেই অমন কাজ করে। রাস্তায় হর্ন, অযথা মাইক বাজিয়ে ক্যাম্পেইন, ভিক্ষা, জোরে আওয়াজ দিয়ে গান শোনা, শব্দ করে হাঁটা এবং অতি বিশেষ ব্যক্তিদের জন্মদিনে মাইকে তাদের জন্য গান, বক্তৃতার রেকর্ড বাজানো—এমন ছোটখাটো কিছু দূষণ, যা আমরা সহজেই ত্যাগ করতে পারি। কিন্তু আমরা নিজেরাই এ ব্যাপারে সচেতন নই। যেসব আইন আছে, সেসব আইন প্রয়োগ করি না এবং কখনো কখনো নিজেও ভঙ্গ করে বসি।
উচ্চমাত্রার শব্দের মধ্যে বাস করতে করতে মানুষের স্বভাবও খিটখিটে হযে যায়। এ নিয়ে অনেক সময় পারিবারিক বিপর্যয়ও নেমে আসে। একজন অস্ট্রেলীয় ভদ্রলোক প্রায়ই তার পাশের বাড়ির টিভি থেকে ভেসে আসা অস্ট্রেলিয়ান অপেরার ‘থিম সং’-এর উচ্চ শব্দে বিরক্ত হতেন। ক্রমেই সেই সঙ্গীত তার কাছে এমনই যন্ত্রণায় রূপান্তরিত হলো যে, একদিন তা সহ্য করতে না পেরে তিনি তার প্রতিবেশীকে খুন করে বসলেন। ১৯৯২ সালে ঘটা ওই ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা যাচ্ছে না। কারণ, ‘রাইট টু পিস অ্যান্ড কোয়ায়েট ক্যাম্পেইন’-এর মতে, এই নয়েজকে কেন্দ্র করে ব্রিটেনে প্রতি বছরই অন্তত পাঁচজন খুন হয়। ভারতের কানপুরে এ ধরনের আরেকটি হত্যার ঘটনায় রেল কলোনির ছাদের ওপর কয়েকটি ক্রীড়ারত শিশুর কোলাহলে দ্বিপ্রাহরিক ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায় একজন কনস্টেবল দুটি বাচ্চাকে ছাদ থেকে ছুড়ে ফেলে। এতে একজনের মৃত্যু হয় এবং আরেকজন গুরুতর আহত হয়। আমেরিকায় এমন এক ঘটনায় ক্রীড়ারত শিশুর ওপর বিরক্ত হয়ে গুলি করে বসেন একজন প্রতিবেশী। আসলে সহনীয় মাত্রার অতিরিক্ত শব্দ যদি আমরা দিনের পর দিন শুনতে বাধ্য হই, তাহলে সেই শব্দের দূষণও অন্যান্য পরিবেশ দূষণের মতো মারাত্মক হয়ে ওঠে। আমাদের শরীর ও মনের মাঝে দূষণ যে তীব্র প্রভাব ফেলে, এসব ঘটনাই তার সাক্ষ্য বহন করে।
শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশে রয়েছে বেশ কিছু আইন ও নীতিমালা। কিন্তু নাগরিক এবং কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে সেগুলো প্রয়োগ হচ্ছে না। শব্দদূষণের গুরুত্ব বিবেচনায় রেখে ১৯৯৭ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে শহরকে ৫ ভাগে ভাগ করা হয়েছে—নীরব এলাকা, আবাসিক এলাকা, মিশ্র এলাকা, শিল্প এলাকা এবং বাণিজ্যিক এলাকা। এসব এলাকায় দিন ও রাত ভেদে শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ঢাকা মহানগরীর পুলিশ অর্ডিন্যান্স-১৯৭৮-এর ২৫ অনুচ্ছেদের ‘ছ’ উপানুচ্ছেদে বলা আছে, ‘রাস্তায় বা জনসাধারণের ব্যবহার্য স্থানে হর্ন, উচ্চৈঃস্বরে সঙ্গীত, বাদযন্ত্র, ঢাক পেটানো ইত্যাদির মাধ্যমে জনসাধারণের অথবা নিকটবর্তী বাসিন্দাদের প্রতিবন্ধকতা ও বিরক্তি সৃষ্টি করতে পারেÑ এমন কাজের জন্য পুলিশ কমিশনার তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেফতারসহ যেকোনো শাস্তি প্রদান করতে পারেন।’
এরপর ২০০৬ সালে বাংলাদেশ শব্দদূষণ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। এই নীতিমালা অনুযায়ী, আবাসিক এলাকায় ভোর ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সর্বোচ্চ শব্দসীমা হলো ৫৫ ডেসিবল এবং রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত ৪৫ ডেসিবল। এই বিধির আওতায় স্কুল-কলেজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল এবং অফিস-আদালতকে নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের চতুর্দিকে ১০০ গজের ভেতরে কোনো ধরনের হর্ন বাজানো যাবে না। আরো বলা হয়েছে, কোনো উৎসব কিংবা সামাজিক বা রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে লাউড স্পিকার অথবা কোনো যান্ত্রিক কৌশল ব্যবহার করতে হলে কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি লাগবে। এসব কার্যক্রম সর্বোচ্চ পাঁচ ঘণ্টার বেশি হবে না। এর পাশাপাশি রাত ১০টার পর কোনোভাবেই শব্দদূষণকারী যন্ত্র ব্যবহার করা যাবে না। এছাড়া মোটরযান অধ্যাদেশ-১৯৮৩-এর ১৪০ নম্বর ধারায় অপ্রয়োজনে হর্ন বাজালে ২০০ টাকা জরিমানা করা হয়।
দেশে এসব বিধি মানা হচ্ছে না। বেসরকারি সংস্থা ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশের এক জরিপ অনুযায়ী, ঢাকার কোনো পাবলিক বা জনসমাগমস্থলেই শব্দের মাত্রা ৬০ ডেসিবলের নিচে নয়। একটি বেসরকারি সংগঠন রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে শব্দদূষণের মাত্রা মেপে জানায়, রাজধানীর নীরব এলাকায় দিনেরবেলায় শব্দের মাত্রা ৭৫ থেকে ৯৭ ডেসিবল, যা সহনীয় মাত্রার চেয়ে দেড়-দুই গুণ বেশি। আবাসিক এলাকায়ও এটা সহনীয় মাত্রার চেয়ে দুই গুণ বেশি। বাণিজ্যিক এলাকায় দিনেরবেলায় শব্দের মাত্রা মান মাত্রার চেয়ে দেড় গুণ বেশি।
বর্তমানে প্রচলিত আইনগুলো বিধিমালা বা নীতিমালা পর্যায়ের, যার আইনি মর্যাদা বেশ কম। সুতরাং সংসদ কর্তৃক একটি সুনির্দিষ্ট আইন প্রয়োজন। এতে শব্দদূষণের বিষয়টিকে যথাযথভাবে আমলে নেয়া হবে এবং প্রণীত আইনটি আগের চেয়ে বেশি গুরুত্বসহকারে প্রয়োগ করা সম্ভব হবে। সামাজিক অনুষ্ঠানে ব্যান্ডসঙ্গীতের আয়োজন করা হয়ে থাকে। এর ফলে ওই সময় অনাকাক্সিক্ষত শব্দদূষণ সৃষ্টি হয়ে আশপাশে থাকা শিশু, বৃদ্ধ এবং অসুস্থ রোগীসহ প্রায় প্রত্যেকেরই সমস্যা সৃষ্টি হয়। এসব বিষয়ও আমাদের খেয়াল রাখা উচিত। দূষণের প্রকোপ কমাতে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পর্যায়ে আমাদের প্রত্যেককেই শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সংযমী হতে হবে।
‘সুস্বাস্থ্যের জন্য শ্রবণশক্তি রক্ষা’—এই স্লোগানকে সামনে রেখে প্রতি বছর শব্দ সচেতনতা দিবস উদযাপন করা হয়। এই দিবসটি পালন উপলক্ষে লীগ ফর দ্য হার্ড অব হিয়ারিং বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে। তারা এই দিনে এক মিনিট নিঃশব্দে থাকে। এছাড়া বিনা মূল্যে কানের পরীক্ষা এবং শোনার যন্ত্রও দিয়ে থাকে।
‘আগে মোবাইল কোর্ট আইন-২০০৯-এর আওতায় শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালাটি অন্তর্ভুক্ত ছিল না বিধায় এ বিষয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ ছিল না।’—এমন প্রেক্ষাপটে গত ৩ এপ্রিল এক প্রজ্ঞাপনে সরকার বিধিমালাটিকে মাঠ পর্যায়ে প্রয়োগের সুবিধার্থে মোবাইল কোর্ট আইনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। ইতোমধ্যে মোবাইল কোর্ট ৫০০ যানবাহনকে ৫ লাখ টাকা জরিমানা করেছে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালিত এনফোর্সমেন্ট অভিযানে ১০৩টি শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ১ কোটি ৮৯ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ ধার্য করা হয়। এর মধ্যে ১ কোটি ৭৭ লাখ টাকা আদায় হয়েছে।
ফিসফিস করে কথা বলার মধ্যে যে মাধুর্য ছিল, তা আমরা হারাতে বসেছি। অন্তরঙ্গ আলাপ হয়তো ভবিষ্যতে হবে বিরাট হাঁকডাক করে। উৎকট শব্দে আমরা আজ পরিশ্রান্ত। আমরা যারা শব্দদূষণের স্রষ্টা এবং যারা শিকার, সবাই-ই কিন্তু এই দেশেরই নাগরিক। মহামারী রূপ ধারণ করার পর নকল তুলে দেয়া সম্ভব হয়েছে, পলিথিন বন্ধ হয়েছে, রাজধানী থেকে থ্রি হুইলার তুলে দেয়া সম্ভব হয়েছে। শুধু সরকারের দিকে না তাকিয়ে থেকে আসুন, আমরা সবাই মিলে সচেতন হই। আমি আপনি মিলেই আমরা। সব আমি দায়িত্বশীল হলে শব্দদূষণও প্রতিরোধ সম্ভব।
লেখক: ড. আহমদ কামরুজ্জামান; চেয়ারম্যান, পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments:

Post a Comment