Thursday, February 2, 2017

নদী বাঁচলেই বাঁচবে বাংলাদেশ

দেশ যদি মা হয়, তবে নদী হচ্ছে তার দেহে বয়ে যাওয়া রক্তের মতো। এ দেশে আমাদের বেঁচে থাকার প্রধান উৎসের নাম নদী। অথচ কৃত্রিম কারণে এবং সময়ের বিবর্তনে আজ নদীগুলো বিপর্যয়ের সম্মুখীন। বাংলাদেশের টিকে থাকার স্বার্থে কিংবা টেকসই উন্নয়নের জন্য আমাদের নদীগুলোকে বাঁচাতে হবে। এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে কোনো ধরনের তর্ক-বিতর্ক নেই এবং থাকতেও পারে না। তর্ক-বিতর্ক যা আছে বা হয়েছে, তা পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে। বাংলাদেশের নদীগুলোর মধ্যে ৫৭টি নদী অভিন্ন। এর মধ্যে ৫৪টি নদীরই উৎপত্তিস্থল ভারতে। তাই ১৯৪৭ সালের দেশভাগ, পরবর্তীকালে বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে আমাদের এই অভিন্ন নদীগুলো মারা যাবে এবং যাচ্ছে—এটাই যেন স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে।
মায়ের যেমন রক্তের প্রবাহ আছে, ঠিক তেমনি নদীরও পানির প্রবাহ আছে। আর এই পানির প্রবাহ, যাকে আমরা নদীর জীবন বলি—এই জীবনের স্পন্দন হারিয়ে গেলে নদীও মারা যাবে। আমাদের নদীগুলোর প্রবাহকে রুদ্ধ করে প্রতিনিয়তই যেন হত্যা করা হচ্ছে। ফলে বিস্তৃত অঞ্চল মরুকরণ, লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও সুন্দরবন বিনাশ, কৃষিক্ষেত্র ধ্বংস, মৎস্যসম্পদ নির্মূল, পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক দূষণ, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস ও পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বেকারত্ব, উপকূল তথা সাগর ভাঙন এবং অকাল বন্যার মতো উপসর্গগুলো দেখা দিচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যত যে আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে, এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়।
টিপাইমুখে বাঁধ দেওয়ার বিষয়ে ইউরোপীয় বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ওই প্রকল্পের ফলে হিমালয় থেকে নিঃসৃত নদীগুলোর ৩৫ ভাগ পানি বাষ্পাকারে আকাশে উড়ে যাবে। সর্বতোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভারত, যেমনটি হয়েছিল রাশিয়ার গৃহীত নদীশাসন বিষয়ক উচ্চাভিলাষী প্রকল্পগুলোর কারণে। এ ধরনের বাঁধ প্রকল্পে দীর্ঘ মেয়াদে ভারতের জাতীয় স্বার্থের চেয়ে প্রভাবশালী ভারতীয় উগ্র জাতীয়তাবাদীদের স্বার্থই রক্ষা করছে। আর বৈষম্যের শিকার হচ্ছে ভারতের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য। এ ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলোকেও নানা সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। আর ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে একই সঙ্গে নিজ দেশের নদীদস্যু এবং প্রভাবশালী তথাকথিত ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে বাংলাদেশের নদীগুলোকে বাঁচানোর চেতনা অনেকটাই সঙ্গতিপূর্ণ। ১৯৪৭ সাল-পরবর্তী পাকিস্তান অনেকটাই এ দেশের বহু মানুষের প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের অল্প দিনের শাসন আমাদের অর্থনৈতিকভাবে শোষণ, সাংস্কৃতিকভাবে ধ্বংস এবং রাজনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দিয়েছিল। এমনই এক কঠিন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি। পাকিস্তান শাসনামলে আমরা যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলাম, ঠিক তেমনি নদীগুলো মরে যাওয়ায় বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে, সাংস্কৃতিকভাবে ও রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা ৫৭টি নদীই অভিন্ন এবং আন্তর্জাতিক। এসব নদীর পানি কোনো দেশের একক সম্পদ নয়; এবং এসব নদীর পানি প্রবাহ সব দেশের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সুষম বণ্টনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইন ও কঠোর নীতিমালা রয়েছে। কিন্তু ভারত নিজেদের স্বার্থে আন্তর্জাতিক নদী আইনের তোয়াক্কা না করে অন্যায়ভাবে উজান থেকে নদীর পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। বর্তমান সরকারের যথেষ্ট সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সুষ্ঠু নদীব্যবস্থাপনার অভাবে আমরা নিজেরাও আমাদের নদীগুলোর ক্ষতি করছি। বাংলাদেশ সরকারও নদীদস্যুদের নিয়ন্ত্রণ করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। নদী খনন প্রকল্পগুলো সরকারের ব্যর্থতম প্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম। আর আমরা ইচ্ছা করলেও ১৯৪৭ সালে ফিরে যেতে পারব না। পার্শ্ববর্তী দেশের উগ্র জাতীয়তাবাদীরা ইতোমধ্যে অনেকটা পথ হেঁটে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশীদার হয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করছে। কার্যত তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করাও অনেক কঠিন। এই অশুভ শক্তিকে মোকাবিলা করে ভারতের সঙ্গে আমাদের নদীর পানি বণ্টনের ন্যায্য হিস্যা বুঝে পেতে হলে রাজনৈতিক ঐক্য দরকার। আর তার জন্য দরকার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একটি প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। এটি একটি যুদ্ধ। সনাতনী অস্ত্র ব্যবহার করে এই যুদ্ধে জয়লাভ করা যাবে না। এই যুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার হতে পারে আমাদের সমুদ্রবন্দর, ট্রানজিট এবং ভৌগোলিক অবস্থানের মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একটি প্রধান বিরোধী দলের অভাবে সৃষ্ট রাজনৈতিক অনৈক্য ও দেউলিয়াপনার কারণে ভারত ইতোমধ্যে প্রায় বিনাশর্তে আমাদের সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের এবং ট্রানজিট সুবিধা নিয়েছে। একই কারণে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থানের সুবিধাও আমরা নিতে পারিনি।
১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ পর্যন্ত আমাদের চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমেছে প্রায় ২৫ শতাংশ। অথচ আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। আমরা যদি নদী মরে যাওয়ায় দেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাব্য ভয়াবহ ক্ষতি অনুধাবন করতে না পারি, তাহলে সেটা আমাদের জাতির জন্য হবে বড় দুর্ভাগ্যের ব্যাপার। তাই নদী রক্ষা এবং একে বাঁচানোর প্রক্রিয়ায় জনসাধারণকে সঙ্গে নিয়ে সরকার এবং একটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রধান বিরোধী দলকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে; এবং গড়ে তুলতে হবে বাংলাদেশ নদীমুক্তির আন্দোলন।
লেখক: আলতাফ হোসেন রাসেল

No comments:

Post a Comment