Sunday, January 1, 2017

নিশ্চয় ভালো কিছু পাব

নববর্ষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কটি যেন নান্দনিক। এ দিনটি আসার আগে থেকে সবাই এক রঙিন স্বপ্ন জগতে প্রবেশ করে। তারা ছবি আঁকে আগামী দিনের বা বর্ষের। বছরের শেষ সময়ে অনেককেই বলতে শোনা যায়, সামনের বছরে নিশ্চয় ভালো কিছু পাব। কিন্তু, তারা কি তা পায়?
না পেলেও কল্পনার শেষ নেই। আশা নিয়ে ঘুড়ি হয়ে আকাশে উড়তে বাধা কোথায়! আকাশকে কাছে পেতে কার না ভালো লাগে। ক্ষণিক সময়ের জন্য হলেও এ আনন্দের দাম কম নয়। বিশেষ করে যেখানে আনন্দের ঘাটতি রয়েছে। আমাদের দেশে এ ঘাটতির ওজনও অনেক।
যে দেশ ও সমাজ দুর্নীতির চাদরে ঢাকা, আনন্দ সেখানে বাক্সবন্দি হয়ে পড়ে থাকে কতিপয় মানুষের বাগান বিলাসে। বেশিরভাগ মানুষ আর সেই আনন্দকে খুঁজে পায় না। সমাজের নিরাপত্তা ভেঙে পড়ে। লুট, খুন, গুম, দখল, রাহাজানিসহ সব অনৈতিক কাজের প্রবৃদ্ধি যেন বেড়ে চলে চক্রবৃদ্ধি হারে। আমাদের দেশকে সে রকম একটি দেশ হিসেবে চিহ্নিত করলে ভুল হবে না। তবুও এখানে ভোর হয়, মানুষ স্বপ্ন দেখে আগামীর। মানুষ আনন্দে পালন করে নববর্ষ, তা ইংরেজিই হোক অথবা বাংলা। আজ ইংরেজি নববর্ষ ২০১৭।
ঐতিহাসিক রোমান ক্যালেন্ডার বা বর্ষপঞ্জির বছর শুরু হতো ১ মার্চ। সে সময় রোমান সরকারের নতুন অধিবেশন শুরু হতো জানুয়ারি থেকে। জুলিয়ান জিসার খ্রিষ্টপূর্ব ৪৭-এ ক্যালেন্ডারে পরিবর্তন আনেন। এরপর আবারও পরিবর্তন আসে খ্রিষ্টপূর্ব ৪৪-এ। মার্ক অ্যান্টোনির এক দফা পরিবর্তনের পর খ্রিষ্টপূর্ব ৮-এ সম্রাট অপাসটাস সিজার আরেক দফা পরিবর্তন করেন। সর্বশেষ পোপ ১৩তম গ্রেগরি ১৫৮২ সালে এই ক্যালেন্ডারে পরিবর্তন ঘটিয়ে বর্তমান কাঠামোতে নিয়ে আসেন। পরিবর্তিত এই বর্ষপঞ্জিতে নতুন বছরের শুরু ১ জানুয়ারি। জানুয়ারির সেই প্রথম দিনই আজ নববর্ষ। পৃথিবীর প্রায় সব দেশে উৎসবের মেজাজে সাড়ম্বরে পালিত হচ্ছে এই দিনটি। তবে চীনা, ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকেরা নিজ নিজ ক্যালেন্ডার অনুসারে নববর্ষ পালন করে থাকে। বাংলাদেশে ১ বৈশাখের কথাতো আমাদের জানা।
বর্ষপঞ্জি নিয়ে অনেক গবেষণা হযেছে। ভাংচুর হয়েছে। অবশেষে বিশ্বব্যাপী গ্রেগরিয়ান পদ্ধতির পঞ্জি সবার কাছে সমাদৃত হয়। সমাদৃত হয়েছে বলেই ১ জানুয়ারি আজ এক উৎসবের নাম। বাংলাদেশও তার অংশীদার। এখানেও উৎসব পালিত হচ্ছে। প্রতিবারই হয়ে থাকে। তবে কেন জানি গড্ডলিকা প্রবাহের মধ্যদিয়ে চলেছি আমরা। পুরনো কোর্তা ফেলে দিয়ে তার দিকে আর ফিরেও তাকাই না। সে কারণেই বোধ হয় আমাদের এত দুঃখ-কষ্ট এবং অবক্ষয়। গেল বছরে আমরা কতটা ভালো কাজ করেছি, কতটা মন্দ, কতটা নৈতিক বা অনৈতিক তার কোনো হিসাব রাখার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করি না। অথচ হিসাব করলে দেখা যাবে, গোটা সমাজ ব্যবস্থায় অনৈতিক কাজের ওজন নৈতিক কাজের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়।
ভালো কাজের মধ্যে যেমন আমরা কঠোর হাতে জঙ্গিবাদ দমনে সচেষ্ট হয়েছি এবং সফলতা পেয়েছি। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ আমাদের মর্যাদাকে অনেক বেশি সম্মানজনক অবস্থানে এগিয়ে দিয়েছে। একইভাবে রিজার্ভ ব্যাংক থেকে কোটি কোটি ডলার পাচার আমাদের কালিমালিপ্ত করেছে। খুন, গুম, ধর্ষণ, শিশু ও নারী নির্যাতনের পাশাপাশি সর্বগ্রাসী দুর্নীতি ম্লান করেছে আমাদের সব অর্জন।
মধ্য আমেরিকার ম্যাক্সিকোতে এক বিস্ময়কর সভ্যতার উদয় হয়েছিল। খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী থেকে এ সভ্যতার বিকাশ। মায়া সভ্যতা নামেই আজ তার পরিচিতি। মায়াদের সংখ্যাতত্ত্বের জ্ঞান, গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি ও পর্যবেক্ষণের দক্ষতা, স্থাপত্য শিল্পকলার ব্যুৎপত্তি প্রকৃত অর্থেই ছিল বিস্ময়কর। এই মায়ারাই আবিষ্কার করেছিল সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে পৃথিবীর সময় লাগে ৩৬৫ দিন। যা আজও বলবৎ আছে। এই দিনকে ১২ ভাগ করে মাসে আনা হয়েছে। তবে সব মাস সমান-সমান দিনের মালিক হতে পারেনি। ফেব্রুয়ারির ভাগে পড়েছে ২৮ দিন। তবে মাসটির জন্য একটি বোনাস আছে। চার বছর পর পর তার জন্য আছে বাড়তি একদিন। তখন ২৮ দিনের এর বদলে ফেব্রুয়ারি মাস হয় ২৯ দিনে। ওই বছরের শরীরেও যুক্ত হয় একটি বিশেষণ—‘লিপ’। এই লিপ অর্থাৎ ঠোঁটের সঙ্গে ইয়ার যুক্ত হয়ে হয়েছে লিপইয়ার।
এক সময় মানুষ সূর্য দেখে সময় মাপত। আরও আগে সময়ের ব্যাপারে মানুষের কোনো ধারণাই ছিল না। প্রথম ধারণা পাওয়া যায় চাঁদের কাছে। উদয় ও অস্তের মধ্য দিয়ে। যাকে শুক্ল ও কৃষ্ণপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে মিসরীয়রা প্রথম সূর্যকে সামনে রেখে বছরের হিসাব করতে শেখে। বছরকে তারা সৌরবর্ষ নামে চিহ্নিত করে।
মানুষ যদি সততা এবং আন্তরিকতার সঙ্গে কোনো কাজ করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয় তখন তা কার্যকর করা কখনও কঠিন হয় না। ইতিহাস তার সাক্ষ্য। বিশেষ করে দেশ যারা পরিচালনা করেন, তাদের ভূমিকাই এখানে মুখ্য। নতুন বছরের শুরুতেই আমরা বলতে পারি, নববর্ষ আমাদের জন্য বয়ে আনুক এক দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ। যেখানে খুন, গুম, লুটসহ সব অনৈতিক কর্মকাণ্ড নির্বাসনে যাবে। এবং গণতন্ত্র মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে বলবে, পৃথিবীতে আমরাই সেরা সভ্য জাতি।
ভূপৃষ্ঠে এ যাবৎ যত উৎসব পালন করা হয়, তার মাঝে আদি হিসেবে উঠে আসে ইংরেজি বর্ষবরণের নাম। আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগে মেসোপটেমীয় সভ্যতায় প্রথম বর্ষবরণ উৎসব চালু হয়েছিল। বর্তমানের ইরাককে সে সময় বলা হতো মেসোপটেমিয়া। জাঁকজমকের সঙ্গে পালন করা হতো এই বর্ষবরণ। তবে এখনকার মতো জানুয়ারির ১ তারিখে নয়। নিউইয়ার পালন করা হতো ঋতুরাজ বসন্তের প্রথম দিনে। শীতের সব রুক্ষতা শুষ্কতাকে ঝেড়ে ফেলে প্রকৃতির এই নতুন করে জেগে ওঠাকেই তারা নতুন বছরের শুরু বলে চিহ্নিত করে। উৎসবের শুরু হতো চাঁদ দেখে। বসন্তের প্রথম চাঁদ দেখার মধ্য দিয়ে শুরু হতো বর্ষবরণ উৎসব। চলত টানা ১১ দিন।
নতুন বছরে নতুন করে নতুন স্বপ্নের কথা ভাবা হচ্ছে। বলা হচ্ছে এবং হয়েছে বাগাড়ম্বরপূর্ণ অনেক কথা। পেছনের দিকে তাকিয়ে একবারও ভাবিনি গোটা সমাজ ব্যবস্থায় যে অবক্ষয় শেকড় গেড়ে বসেছে তা অপসারণের উপায় কী? কোন পথে হাঁটলে তা সমূলে উৎপাটিত হবে। এখানে বলতে হয়, তরতাজা বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যা যখন আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে, শত চেষ্টায়ও যখন তা দূষণমুক্ত করতে পারিনি—তখন গোটা সমাজ থেকে অবক্ষয়ের মতো এক ভয়ঙ্কর দানবকে কীভাবে নির্মূল করব?
এ প্রশ্নের জবাবে বলতে হয়, নতুন বছরে যদি দুর্নীতিকে কঠোর হাতে দমন করা যায় তাহলে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো অসম্ভব নয়। সরকার যদি প্রতিশ্রুতি দেয়, জাতি হিসেবে আমরা তা পারব।
লেখক: কামার ফরিদ, কবি ও সাংবাদিক;

No comments:

Post a Comment