জীয়াঢল নদীর পাড়ে গড়ে উঠা এক শহরের নাম ধেমাজি। জীয়াঢল-ধেমাজিবাসীর জন্যে আয়ুরেখা। জীয়াঢল নির্ণয় করে সেই উপত্যকার জনতার ঠিকানা আর জীবন পরিক্রমা। জীয়াঢল বহু গ্রামে সংহারলীলা চালায়, বহু গ্রামে আবার সভ্যতার নতুন রূপ দেয়। জীয়াঢল নদীটি সেজন্যেই হয়তো ধেমাজীবাসীর জন্যে সুহৃদ বন্ধু, আবার বিষাদের আধার। বর্ষাকালের জীয়াঢল ধেমাজিবাসীর শত্রু, শীতকালের জীয়াঢল সেই বৃহৎ সবুজ ভূমির জনগণের পরম বন্ধু। ...
কিন্তু সেই দুঃখসুখের জীয়াঢলের পাড়ে ১৯৮৩র ফেব্রুয়ারিতে ঘটেছিল এমন এক নৃশংস ঘটনা---যা দেখে হয়তো শীর্ণ নদীর নিজেরই বুক কেঁপে উঠেছিল। কী ঘটেছিল সেই নদীর পাড়ে?...
জীয়াঢলের পাড়ে বৃহত্তর বিষ্ণুপুর, শান্তিপুর এলাকাতে বাস করা বাঙালিদের উপরে ১৯৮৩-র ফেব্রুয়ারিতে চলেছিল নৃশংস আক্রমণ। উগ্র-অসমীয়ারা করেছিল সেই আক্রমণ। বাঙলাতে কথা বললেই, বা বাঙালি হলেই যেন বাংলাদেশী---এমন এক মনোভাব সে সময়ে প্রবল হয়ে উঠেছিল। ‘আসু’ , সারা আসাম গণ সংগ্রাম পরিষদ’ ইত্যাদি সংগঠনের নেতৃত্বে পরিচালিত বিদেশী বহিষ্কার আন্দোলন এমন এক পর্যায় গিয়ে পেয়েছিল যে সেটি আর কোনো আন্দোলন হয়ে রইল না। সে ছিল বাঙালিদের উপর অসমিয়া বা খিলঞ্জিয়াদের চালানো পরিকল্পিত আক্রমণ।
ধেমাজি শহরের উত্তর দিকে অবস্থিত বিষ্ণুপুর , শান্তিপুর এলাকাগুলোতে হাজার হাজার অসমিয়া মানুষ গিয়ে নির্মম আক্রমণ চালিয়েছিল। বহু গ্রামে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল, মেরে ফেলেছিল ৪০এর থেকেও বেশি মানুষ।
৪ নং বিষ্ণুপুর গ্রামের ভুক্তভোগী মহিলা বকুলি দেবনাথ সেই দুঃসহ দিনের বর্ণনা করেছিলেন এইভাবে, “সকালে প্রায় নটার সময় টেকজুরি অঞ্চল থেকে এসে বহু মানুষ আমাদের গ্রামে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। মানুষজনকে খুন করেছিল। কচি কাচা শিশুদের নিয়ে আমরা পালিয়েছিলাম। উত্তর দিকের অরুণাচল পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমার সামনে দীনেশ দেবনাথ বলে একজন মানুষকে কুপিয়ে মেরে ফেলেছিল। পাহাড়ে আশ্রয় নিতে গেছিল যারা তাদেরকেও সেখানে গিয়ে মেরেছিল। বাড়ি ঘর সব পুড়ে গেছিল। পরে এসে আবার সব তৈরি করেছি।”
একই কথা বললেন ২নং বিষ্ণুপুর গ্রামের মুক্তা রায় । তিনি বললেন, “ পাহাড়ে আশ্রয় নিলে অরুণাচলের আদি জনগোষ্ঠীর মানুষজন আমাদের সাহায্য করেছিলেন। ভাত দিয়েছিলেন, জল দিয়েছিলেন, থাকবার ঠাই দিয়েছিলেন। অনেক পরে আসাম সরকারের পুলিশ এসে শিবির পেতেছিল।”
সেরকমই বললেন ৫ নং টেকজুরি বিষ্ণুপুর গ্রামের মাতব্বর মানুষ হরেন্দ্র বিশ্বাস, “ এখানে ৪০জনকে মেরেছে। আক্রমণ করতে এলে আমাদের গ্রামের মানুষজন জীয়াঢল নদীর পাড়ের ঝোঁপেঝাড়ে গিয়ে লুকিয়ে প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করেছিলেন। আসলে ১৩ ফেব্রুয়ারিতেই প্রথম উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল। টেকজুরি, পাঁচআলি এসব জায়গাতে মারপিট হয়েছিল। ১৩ তারিখে সেরকমই কিছু মানুষ আক্রমণ করতে এলে বিষ্ণুপুরের কিছু বাঙালি বাধা দিয়েছিলেন। পরদিন ১৪ তারিখে পুরো এলাকাতে এতো বড় আক্রমণ নামলো যে হাজার হাজার আক্রমণকারীতে গোটা এলাকা ঘিরে ফেলল। সবারই হাতে দা-বর্শা –বল্লম –মশাল। কিছু মানুষের হাতে হাতে তৈরি বন্দুকও ছিল। পরে সেদিন জীয়াঢলের পাড়ের জঙ্গলেও যে কিছু মানুষ লুকিয়ে আছে তারা জেনে যায়। সেই জঙ্গলের চারদিকে আগুন ধরিয়ে দিল। তার ভেতরেই কিছু মানুষ জ্যান্ত পুড়ে গেলেন। কেউ কেউ প্রাণ বাঁচাতে নদীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। পরে জীয়াঢলের পাড়ে বহু মানুষের মৃতদেহের অবশেষ উদ্ধার করা হয়েছিল। আরো কিছু মানুষকে পরদিন ১৫ ফেব্রুয়ারিতেও হত্যা করেছিল এরা।”
হরেন্দ্র বিশ্বাস যখন বিষ্ণুপুরের বাড়িতে বসে ঘটনার বর্ণনা করছিলেন কাছে তখন বসেছিলেন এক মহিলা। তিনি বললেন, “আমার নাম কামনা মণ্ডল। আমার পরিবারের আটজনকে (৮) সেদিন হত্যা করেছিল ওরা।” হরেন্দ্র বিশ্বাস জানালেন, ৫ নং বিষ্ণুপুর গ্রামের কণকবালা সরকার (৬০), রেণুবালা বিশ্বাস (৪৫), রেণুর দুই কন্যা বিচু বিশ্বাস (১২), শল্কী বিশ্বাস (১১), ছাড়াও মারা যান লক্ষ্মীবালা মণ্ডল (৮০), ক্ষেপী বিশ্বাস ( ৪) । পুরুষদের মধ্যে ছিলেন, দীনেশ দেবনাথ (৫৫), কাশী রায় (৭০), যাদব রায় (৬০), যদু রায় (৫৪), পরেশ ঘোষ (৪০), রমা রায় ( ২৫), রমেশ রায় (৬৫) , ধীরেন বিশ্বাস (৩০) ।
ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামগুলো ছিল—১নং বিষ্ণুপুর, ২নং বিষ্ণুপুর, ৩নং বিষ্ণুপুর, ৪ নং বিষ্ণুপুর, ৫নং বিষ্ণুপুর, ধরণী বস্তি, মাজর বস্তি, রথ বস্তি, দেউলদি বস্তি, দুলিয়া বস্তি, মিলন গাওঁ, শিলালি গাওঁ, শান্তিপুর, আর্যবস্তি, দাস বস্তি ইত্যাদি।
তা জীয়াঢলের পাড়ের ঝোপ জঙ্গলে যত লোককে হত্যা করা হয়েছিল, বা তার বাইরেও বিদেশী খেদার নামে যত মানুষকে হত্যা করা হলো---তাদের পরিবারের কেউ আজ অব্দি ন্যায় বিচার পেলেন না।
উল্লেখ করা ভালো যে বিষ্ণুপুর শান্তিপুরের এই আক্রমণের পেছনে ছিল পুরোনো কিছু ভূমি-বিবাদের ঘটনাও। এ অঞ্চলে বাস করা বাঙালিরা ছিলেন অন্যান্য এলাকার থেকে প্রব্রজিত মানুষ। স্থানীয় কিছু অসমিয়া মানুষের সঙ্গে তাদের ভূমি বিবাদ শুরু থেকেই ছিল। অসম আন্দোলনে বিদেশী বহিষ্কারের নামে যখন ফ্যাসিবাদী রূপ লাভ করল তখন ‘ভূমি বিবাদ’ হিংস্র রূপ নিল। সে যাই হোক, শিলাপাথারের আর্নে চরাঞ্চল, চিমেন চাপরির নৃশংস ঘটনারও আগে এই ঘটনা ঘটেছিল। এবং সেটি পরবর্তী ঘটনাক্রমকে ইন্ধন যুগিয়েছিল বলেই তাৎপর্যপূর্ণ।
দুঃখের কথা এই যে এই ঘটনা রোধ করতে প্রশাসন যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছিল। পরিণতিতে অজস্র নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। জীয়াঢলের পাড়ে মানবতার অপমৃত্যু হয়েছিল। মোদ্দা কথা আর্নে চরাঞ্চল, বিষ্ণুপুর, শান্তিপুর, চিমেন চাপরি ইত্যাদি অঞ্চলে প্রায় পাঁচ শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।
No comments:
Post a Comment