Monday, December 19, 2016

ব্লগ, মাইক্রোব্লগ, সামাজিক মাধ্যমের জটিল কথা :
 আমরা ব্লগ নিয়ে কথা বলছি এমন একটা সময়,যখন তার ‘স্বর্ণযুগ’টি বলতে গেলে বিদায় নিয়েছে বছর পাঁচ ছয় হয়েই গেলবাংলা ভাষাতে সেই ‘স্বর্ণযুগে’র নেতৃত্বে আর ছিল না কলকাতা বা পশ্চিম বাংলা,ছিল বাংলাদেশ।এটি একটি চিত্তাকর্ষক বৈপরীত্য যে বাংলা ব্লগের স্বর্ণযুগটি ঠিক সেই সময় বিদেয় নিয়েছে যখন কিনা ভারতবর্ষে আন্তর্জালে বাংলার ব্যবহারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে ফেসবুক।বাংলাদেশে সেই কাজ বহুদূর আগেই এগিয়ে রেখেছিল বাংলা ব্লগ,সংবাদ পত্র ইত্যাদির ওয়েবসাইট।তার জন্যেই ফেসবুকের জনপ্রিয়তার বহু আগেই আমরা সেই দেশ থেকেই আরো বহু বাংলা লেখার কি-বোর্ডের পাশাপাশি পেয়েছিলাম অভ্র-কি-বোর্ড’পশ্চিম বাংলার বৈশাখী কি-বোর্ডের বয়স কিন্তু সেরকম প্রাচীন নয়,সেরকম জনপ্রিয়ও হতে পারে নি। ভারতে আমরা আন্তর্জাল বললে আর ব্লগ চিনিনা,চিনি ফেসবুক আমরা অনেকে ই-মেইলকেও ভুলতে বসেছি,মাঝে মধ্যে ব্যবহার করলেও,ইমেলকে ব্যবহার করেও যে কত বিচিত্র কাজ এককালে করা যেত,আজকের তথ্য-প্রযুক্তিতে উচ্ছ্বসিত অনেকেই সেসব জানেনও না,বোঝেনও না। তাঁদের আন্তর্জালে নিয়েই এসেছে ফেসবুক।তাহলে আমরা ‘ব্লগ’ নিয়ে বলছি কেন? সেই প্রশ্নেই আমরা আসছি।
এমন নয় যে ‘কৌরব’,‘অন্য নিষাদ’,‘ঈশানের পুঞ্জমেঘ’-এর মতো আন্তর্জালীয় অন্তর্বস্তুকেই ব্লগ বলে। আনন্দবাজার পত্রিকার ওয়েবসাইটে গেলেও ঐ সেদিনও দেখা যেত ‘ব্লগ’ বলে একটি অংশ রয়েছে। আন্তর্জালে অধিকাংশ বিষয়ই আসে ওয়েবসাইটের রূপেই। কিন্তু মোটা দাগে যেগুলোর অন্তর্বস্তু চরিত্রগতভাবে স্থির,নিয়মিত হালনাগাদ করা হয় না সেগুলোকেই ওয়েবসাইট বলে। যেমন সরকারি –বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়েবসাইট। কিন্তু যেগুলো নিয়মিত হালনাগাদ করা হয় সেগুলোকেই ব্লগ বলে। সেগুলোর অধিকাংশই বৌদ্ধিক চর্চার মঞ্চ। সেই চর্চা হতে পারে সাহিত্য,বিজ্ঞান,কৃষি-অর্থনীতি যাই হোক। সেদিক থেকে যে কোনো দৈনিক কাগজের সাইটকেও ব্লগ বলাই যেতে পারে। মূলে কথাটা ওয়েবলগএরও যাত্রা শুরু পশ্চিমে,সেই ১৯৯৭তে।মূলত আন্তর্জালে দিনলিপি লেখার প্রয়াস দিয়ে দেড় দশক আগে যে সংস্কৃতি যাত্রা শুরু করেছিল,তার এখন বৈচিত্র্য এবং ভাণ্ডার বিশাল।দশ বছরের মাথায় উইকিপেডিয়া জানিয়েছিল ডিসেম্বর২০০৭-এ ব্লগ খোঁজারু ইঞ্জিন টেকনোরাতি প্রায় এগারো কোটি বার লাখেরও বেশি ব্লগের হদিশ পেয়েছিল ফেসবুক বাণিজ্যের ধাক্কাতে তার বৃদ্ধিতে ভাটা পড়লেও সংখ্যাটা এখন আরো কয়েক কোটি তো হবেই।ভারতেই তখন হিন্দি-ইংরাজি-তামিল ইত্যাদি কিছু ভাষাতে ব্লগের সংখ্যা চল্লিশ লক্ষের বেশি ছিল,এটা টেকনোরাতির হিসেব।এখনও সেই সংখ্যা কমে গিয়েও চার-পাঁচলক্ষ তো হবেই। যদিও তার অধিকাংশেরই ভাষা ইংরেজি, হিন্দি বা তামিল। ব্লগ হতে পারে ব্যক্তিগত,হতে পারে সম্মিলিত যেখানে অগুনতি লেখক নিয়মিত লেখেন,অথবা সম্পাদিত পত্রিকা। উইকিপেডিয়া নিজেকে ব্লগ বলেই দাবি করে।বাংলা উইকিপেডিয়া যদিও যাত্রা শুরু করেছিল বাংলাদেশে,গত বছরে তার দশম বর্ষ পূর্তিতে ৯ ও ১০ জানুয়ারি  যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েও আয়োজিত হয়েছে উৎসব অনুষ্ঠান সেসব তথ্য আমরা জানি
কিন্তু বহু  প্রতিষ্ঠান বিরোধী’ লেখকও ফেসবুক’ বাণিজ্য মোহে বাঁধা পড়ে ফেসবুক গ্রুপকেই বলে বসেন ব্লগফেসবুকের জনপ্রিয়তা যতই থাক,আমাদের প্রায়োগিক জিজ্ঞাসা রয়েছে অতি অল্পই। ফেসবুক,টুইটারকে বলে ‘মাইক্রোব্লগ’ স্বল্প সময়ে,স্বল্প কথা বলবার জায়গা সেগুলো।সময় নিয়ে গুরুগম্ভীর মনন-চিন্তন-সৃজনের জায়গা নয়। টুইটারতো নয়ই।তাই বাংলা কবিতার ছড়াছড়ি ফেসবুকে দেখা গেলেও টুইটারে দেখা যায় না মোটেও। গল্প উপন্যাস, প্রবন্ধ টুইটারে তো কল্পনাই করতে পারি না। সেগুলো ফেসবুকেও তারাই লেখেন যারা তাৎক্ষণিক নিন্দে প্রশংসার জন্যে মুখিয়ে থাকেন ফেসবুক বাণিজ্যের একটি একটি বড় মন্ত্রই হচ্ছে তার ‘লাইক’ বোতাম।অনেকেই একটা লাইক পাবার জন্যে নির্লজ্জের মতো চাপাচাপিও করেন। লাইক না পেলে সংসার ভেঙ্গে যাবার গল্প,খুনোখুনির গল্পও আমরা প্রায়ই কাগজে পড়ে থাকি। সেখানে যারা লেখেন,নিজের লেখার স্থানান্তরের সুবিধেটি তারা নেন,কিন্তু কালান্তরে পৌছে দেবার কোনো ভাবনাই তাদের নেই। সেসব ভাবনা ফেসবুকের নিজেরও নেই।সুতরাং আক্ষরিক অর্থেই দাবি করতে পারি ফেসবুকের বৌদ্ধিক সম্পদগুলো ঝরাপালকের মতোই হালকা।আসল পাখিরা ব্লগে-ওয়েবসাইটে ঘোরাফেরা করেন।এবং ফেসবুকেও ব্যবহারকারীরা বিষয়ের গভীরে যেতে গেলে সেই সব ব্লগ-সাইটেই নির্ভর করেন। দেদার ছড়িয়ে থাকেন,ফেসবুকের পরিভাষাতে যাকে বলে ‘শেয়ার করা’। সুতরাং ভারি এবং দীর্ঘজীবী সম্পদের জন্যে ব্লগের উপরে ভরসা করা ছাড়া এখনো আমাদের কোনো বিকল্প নেই। যদিও ফেসবুকের আগ্রাসী বাণিজ্য নীতি সেগুলোকে কতটা টিকতে দেবে সেই সম্পর্কে আমরা শঙ্কিত
আন্তর্জালে দু’বছর আগেও জনপ্রিয় ছিল এমন বহু ব্যক্তিগত ব্লগের সন্ধান করলে সাম্প্রতিক পোষ্ট মেলে না বললেই চলে। পূর্বোত্তরভারতের ‘ঈশানের পুঞ্জমেঘ’,‘ও কলকাতা’,‘গুরুচণ্ডালী’র মতো কিছু সম্মিলিত ব্লগ বাদ দিলে ভারতে বাংলাতে সম্মিলিত ব্লগের কোনো ধারণাই বিকশিত হল না। তার মূল কারণ, তৎক্ষণাৎ সেগুলো পাঠকের নজরে পড়ে না বা নিন্দে প্রশংসা কিছুই জোটে না। যা কিনা বাংলাদেশের ব্লগগুলোতে এককালে অন্তত কোনো সমস্যাই ছিল না, এখনো সেরকম বড় সমস্যা বলে মনে হয় না।আন্তর্জাল যে স্তরভেদের পুরোনো সংস্কৃতি ভেঙ্গে দিচ্ছে,বা দেবে সেই সত্য এখনো অনুমান করতেই পারেন না বহুলেখক লেখিকা। তাদের কাছে এখনো সম্পাদকের বাছাই পর্ব পার করে ছাপাটাই সম্মানের ব্যাপার। সেই সম্মানের জন্যে মুখিয়ে থাকেন। সেই তারাই আবার ফেসবুকের খোলা আসরে ভিড় জমান। নিশ্চয়ই ‘লাইকে মোহে। কিন্তু সেখানে ভাবগম্ভীরবিষয়ে যেমন বিস্তৃত বেশি কিছু লেখা যাবে নালিখলেও কাগজ বা বইয়ের মতো সাজাতে পারবেন না।পারলেও সেগুলোতলিয়ে গিয়ে ফেসবুকের ভাণ্ডারে জমা হবেদরকারে খুঁজে পাওয়া সত্যিই কঠিন আর পেলেও গোগোল বা বিং সার্চ ইঞ্জিনেএগুলো দেখাবে না।তাতে ফেসবুক বাণিজ্য মার খায়। ফেসবুকের বাণিজ্য বাঁচিয়ে আমরা ভারতীয় বিশেষ করে পূর্বোত্তরেরবাঙালি নিজেদের মেধাকে মার দিতে প্রস্তুত!এটা ঠিক যে খুচরো সংলাপে উৎসাহী করিয়ে ফেসবুক তার জন্মের বহুপরে,মূলত ২০১০এর থেকে বাংলা,অসমিয়া ইত্যাদি ভারতীয় ভাষা প্রচারে প্রসারে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। তখন থেকে ফেসবুকের যেকোনো বার্তা ই-মেলে চলে যেতে শুরু করে।এবং তখন অব্দি জনপ্রিয় ই-মেলের আধিপত্য খসিয়ে নিজের দিকে লোক টানতে শুরু করে।ফলে অরকুটের মতো জনপ্রিয় মাধ্যমও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে থাকতে ব্যর্থ হয়। গেল বছর অরকুট চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।
এই আশংকা করবার যথেষ্ট সংগত কারণ রয়েছে যে ফেসবুকের দাপটে একদিন ব্লগগুলোও হারিয়ে যেতে পারেঅথচ,আন্তর্জাল জমানাতে ব্লগগুলো বাংলা লিটল ম্যাগাজিনের মতো। সেগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার অথবা উন্নতর বিকল্পের সন্ধানের দায় আমাদের সবার।এই কাজে এখনই নামা উচিত,যারা বাংলা ভাষা সাহিত্য তথা সৃজন-মনন-চিন্তনের তৈরি বৌদ্ধিক সম্পদগুলোর সমৃদ্ধি,সংরক্ষণে আগ্রহী।প্রযুক্তি তার  স্বাভাবিক নিয়মেই আমাদের পথ দেখাবে,এরকম আশ্বস্ত হয়ে বসে থাকবার মানসিকতাটি ঔপনিবেশিক দেশগুলোর মনস্তত্ত্ব নয়।হলে তাদের দেশ থেকেই গোগোল,ফেসবুক ইত্যাদি জন্মই নিত না। এগুলো আমাদের মতো উপনিবেশ তথা নয়া-উপনিবেশের মনস্তত্ত্ব।এই প্রসঙ্গে বিনয় ঘোষের উপলব্ধি আমাদের ভালো কাজে আসতে পারে।

No comments:

Post a Comment