রুশ-মার্কিন সম্পর্ক কোনদিকে?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী দুনিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন দুটি প্রতাপশালী রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়। এ সময় বিশ্ব ব্যবস্থায় দুই দেশের প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা ঘটে। অন্যদিকে বিভিন্ন পরিক্রমায় সোভিয়েত রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভাঙন স্নায়ুযুদ্ধের অবসান করে। এতদসত্ত্বে সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরসূরি রাষ্ট্র আধুনিক রাশিয়ান ফেডারেশনের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমাদের সামগ্রিক লড়াই অব্যাহত থাকে। সর্বশেষ সিরিয়া ইস্যুতে দুই দেশ প্রায় যুদ্ধের মুখোমুখি, এ ছাড়া বৈশ্বিক বিভিন্ন ইস্যুতে দেশ দুটির মধ্যে উত্তেজনা চরমে। এমন পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ওয়াশিংটনের রুশ নীতি পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছেন। আকারে ইঙ্গিতে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ইতিবাচক পরিবর্তনের আভাস দিচ্ছেন পক্ষান্তরে রাশিয়ান ফেডারেশনও ইউরোপে রুশ স্বার্থ সংশ্লিষ্টতা অক্ষুণ্ন রাখতে ওয়াশিংটনের ওপর কৌশলগত চাপ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে।
বস্তুত ২০০৭ সালেই রাশিয়া কনভেনশনাল আর্মস ফোরসেস ইন ইউরোপ ট্রিটি একতরফাভাবে স্থগিত করে ইউরোপে তার সামরিক হস্তক্ষেপের পথ সুগম করে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। এই প্রেক্ষিতেই ইউরোপের চলমান সামরিক পরিস্থিতিতে রাশিয়ার কৌশলগত সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সমীকরণে মার্কিনিরা রাশিয়ার সঙ্গে বিবাদ এড়িয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে এটিই স্বাভাবিক। সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে ফোনালাপের সূত্র ধরে রুশ-মার্কিন সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানামুখী আলোচনার সূচনা হয়েছে। অবশ্য এর আগে মার্কিন নির্বাচনী প্রচারাভিযানে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনই ছিল আলোচিত ইস্যু। যদিও ওই সময় মার্কিন মিডিয়ার খবরা খবরের বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে ক্রেমলিন তীব্র আপত্তি জানায়। সব ছাপিয়ে নির্বাচন-পরবর্তী মার্কিন প্রশাসনের রুশনীতি কী হতে পারে সেটিই গুরুত্বপূর্ণ।
ধারণা করা হচ্ছে, রুশ-মার্কিন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের তীব্র উত্তেজনা কমিয়ে আনতে ট্রাম্প প্রশাসন কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন নিজের স্বার্থেই। বিশেষত সিরিয়া সঙ্কট সমাধানে দুই দেশ আরো ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন। প্রেসিডেন্ট আসাদকে ক্ষমতায় রেখেই সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধান টানতে ট্রাম্প ওবামা প্রশাসনেরই অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করতে দ্রুত কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেন। উল্লেখ্য, গত বছর ক্রেমলিনে এক ম্যারাথন বৈঠকে শেষে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ওবামার বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে সিরীয় সঙ্কট সমাধানের রুশ রূপরেখা প্রকাশ্যেই মেনে নেন। অন্যদিকে ইউক্রেন ও বাল্টিক অঞ্চলে সামরিক মোতায়েনকে কেন্দ্র করে দুই দেশের সামরিক উত্তেজনা কমানো রাশিয়ার জন্য অপরিহার্য। কিন্তু এখানে মার্কিনিদের ব্যাপক সামরিক স্বার্থ জড়িত।
কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প ন্যাটোতে মার্কিন অর্থায়নের মাধ্যমে ইউরোপীয় মিত্রদের নিরাপত্তা দিতে অনীহা প্রকাশ করেন। ট্রাম্প এই নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করলে ন্যাটোর ভবিষ্যৎ স্পষ্টত হুমকির মুখে পড়বে। পক্ষান্তরে ন্যাটোর কাঠামোগত দুর্বলতা রাশিয়ার শক্তি বৃদ্ধি করবে। এটি উপলব্ধি করেই মার্কিন প্রশাসনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে রুশ-মার্কিন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে সর্বোচ্চ পর্যায়ে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। এর আগে ন্যাটোর কৌশলগত সঙ্কোচন ইউরোপে একচেটিয়া রুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করবে। এমনটি হলে ওয়াশিংটনের পক্ষে বৈশ্বিক স্বার্থ সংশ্লিষ্টতা অক্ষুণ্ন রাখা প্রায় অসম্ভব। যে কারণে ন্যাটোকে গুরুত্বহীন করার আগে ওয়াশিংটন সর্বপ্রথম মস্কো ও ওয়াশিংটনকে পরস্পরের মধ্যে সর্বোচ্চ আস্থা অর্জন করতে হবে। এই আস্থা অর্জনের প্রক্রিয়ায় দুই দেশের দীর্ঘ বিরোধ, শত্রুতা, জয়-পরাজয়ের হিসাবনিকাশ জড়িত। এক্ষেত্রে ক্রমাগত পরমাণু অস্ত্রের ভয়ে ভিত দুনিয়ার পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে রুশ-মার্কিন সম্পর্কের ঐতিহাসিক পরিবর্তন অত্যাসন্ন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এমনটি হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইউরোপীয় মিত্ররা এমনিতেই গুরুত্বহীন হয়ে পড়বেন।
রুশ-মার্কিন যেকোনো সমঝোতার প্রভাব বিশ্ব ব্যবস্থার গতিপথ দেবে পাল্টে। কিন্তু এসব কিছুই ধারণা। এই ধারণার পেছনে শক্ত যুক্তি হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সঙ্কট। এই সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যত বিকল্প আছে তার মধ্যে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নই অগ্রাধিকার পাবে। সঙ্গত কারণেই দেশ দুটির মধ্যে শত্রুতা কমে আসার প্রবল সম্ভাবনা বাস্তবায়ন করতে ডোনাল্ড ট্রাম্প কী করেন তা আগ্রহভরে পর্যবেক্ষণ করছে দুনিয়া। এক্ষেত্রে মার্কিন থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ট্রাম্প প্রশাসনকে উৎসাহ জোগাবে নিঃসন্দেহে। তবে এই পথটি এত মসৃণ হবে না। একটি গ্রহণযোগ্য মাত্রার স্থিতিশীল আস্থাপূরণ সম্পর্ক বিনির্মাণে উভয় পক্ষের আন্তরিক আগ্রহ থাকতে হবে সর্বপ্রথম। যেখানে দ্রুত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কিছু বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে হবে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—পূর্ব ইউরোপের দেশসমূহের সঙ্গে মার্কিনিদের সামরিক ঘনিষ্ঠতার মাত্রা কমিয়ে এনে রাশিয়াকে আশ্বস্ত করা। কিন্তু জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে মারাত্মকভাবে সম্পৃক্ত প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সমূহ কঠিন। সঙ্গত কারণেই অনুমান করা হচ্ছে সমগ্র ইউরোপে দুই দেশের অভিন্ন স্বার্থ সংশ্লিষ্টতা অক্ষুণ্ন রাখতে সমন্বিতভাবে কাজ করার পথ বের করতে হবে। পাশাপাশি বাল্টিক সাগরীয় এলাকায় অতিরিক্ত মার্কিন সামরিক মোতায়েন বন্ধ করাও প্রাসঙ্গিক। একই সঙ্গে ওই অঞ্চলে বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রুশ জাতীয় আকাক্সক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে ন্যাটো সম্প্রসারণে সব ধরনের তৎপরতা বন্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্র কতটা আগ্রহী হবে তা নিয়ে সংশয় থাকছেই। বিশেষত ইউক্রেন সঙ্কট সমাধানে রুশ ফরমুলা অনুসরণ করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ক্ষতির সম্ভাবনা প্রবল। অন্যদিকে এই প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করতে গিয়ে মার্কিন স্বার্থ কতটা বিসর্জন দিতে হবে, তাও ওয়াশিংটনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা। এদিকে রুশ মার্কিন সম্পর্কের ইতিবাচক অগ্রগতি একশ’ বছরের পুরনো শত্রুতা যদি সত্যি সত্যিই মিত্রতায় রূপান্তরিত হয়, তাহলে বিশ্ব ব্যবস্থায় বহুমাত্রিক প্রতিক্রিয়া ছড়াবে।
বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নব্বই দশক থেকে বিশ্ব ব্যবস্থায় আধিপত্য বিস্তার করতে যে সামরিক ত্রাসের সূচনা করেছে এর অবসান ঘটতে পারে। বিভিন্ন যুদ্ধে জড়িয়ে দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থার শোচনীয়তা থেকে মুক্তি পেতে দুনিয়ার সামরিক ঝুঁকি কমানো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বহুল প্রত্যাশিত। কিন্তু নতুন পরাশক্তি চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনীভূত রাজনৈতিক বিরোধ আরো প্রসারিত হতে পারে। এক্ষেত্রে চীনকে টেক্কা দিয়ে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার জ্বালানি সম্পদ কুক্ষিগত করার পরিকল্পনায় রুশ-চীন সম্পর্কও ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। চীনের সুদৃঢ় প্রতিরক্ষাব্যূহ, সামরিক আকক্সক্ষার বিস্তার, প্রসারিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন কৌশলগত শক্তি সঞ্চয়ের প্রক্রিয়ায় রাশিয়াকে ছাড় দিতেই পারে ওয়াশিংটন। যা চীন- রাশিয়া সম্পর্কের কার্যকারিতা ধীরে ধীরে নস্যাৎ করে দিতে পারে।
রাশিয়া সম্পূর্ণ প্রস্তুতি সম্পন্ন করার আগেই সিরিয়া সঙ্কটে সামরিক হস্তক্ষেপ করে মধ্যপ্রাচ্যের সমীকরণ পাল্টে দিয়েছে। অন্যদিকে পূর্ব ইউরোপে সামরিক উত্তাপ রাশিয়ার সামনে চরম হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়। এই পরিস্থিতি উত্তরণে সামরিক সংঘর্ষের প্রবল শঙ্কা বৈশ্বিক পরমাণু নিরাপত্তা স্থিতিশীলতাকে চরম অস্থির করে তোলে। এসব বিবেচনা করে রাশিয়া মার্কিনিদের সঙ্গে পরমাণু নিরাপত্তা সংক্রান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্থগিত করে নিজের অবস্থান জানিয়ে দিতে সক্ষম হয়। এই পরস্থিতিতে দুই পক্ষ নিজেদের মধ্যে উত্তেজনা কমানোর অংশ হিসেবে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে আসতেই পারে। তবে সবকিছুর জন্যই আমাদের আরো একটু সময় অপেক্ষা করতে হবে।
লেখক : বিশ্লেষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা
No comments:
Post a Comment