১৫ শতাংশ ভ্যাট
দুর্ভোগ পোহাবে মানুষ, চাপে পড়বে অর্থনীতি
সব ধরনের পণ্য ও সেবার ওপর সরকারের ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশে বিতর্ক চলছে। এ নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে সরকার ও ব্যবসায়ীরা। উভয় পক্ষের মধ্যে দেখা দিয়েছে দ্বন্দ্ব। দেশজুড়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। একদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) আইন বাস্তবায়ন হলে ভোক্তাপর্যায়ে পণ্যের দাম বাড়বে। কিন্তু সরকারের দাবি, ব্যবসায়ীরা সঠিকভাবে হিসাব রাখতে পারলে পণ্যের দাম বাড়বে না; বরং কমবে।
নতুন ভ্যাট আইন নিয়ে উত্তপ্ত দেশের অর্থনৈতিক অঙ্গন। শীর্ষ মহল থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের ব্যবসায়ীরাও প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। তারা ১৫ শতাংশ ভ্যাট কমিয়ে ৭ অথবা ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছেন। অর্থনীতিবিদ ও উন্নয়ন গবেষকরাও ১০ শতাংশের মধ্যে ভ্যাট রাখার পক্ষে। নানাভাবে বিষয়টি সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন। প্রয়োজনে আন্দোলনের জন্য রাজপথে নামার হুমকিও দিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকার অনড়। স্বয়ং অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, ‘আন্দোলন করেন, কিচ্ছু হবে না, যদি আপনারা আন্দোলন করেন, আমরা আন্দোলন দমন করব। শেষ পর্যন্ত বিষয়টিতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন ব্যবসায়ীরা।’
এ ব্যাপারে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন দ্য ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) উপদেষ্টা মঞ্জুর আহমেদ বলেন, ইউরোপের দেশগুলো কোনো পণ্যের চূড়ান্ত বিক্রেতা পর্যায়ে দশমিক ৮ শতাংশ হারে ভ্যাট নেয়। অর্থাৎ প্রতি ১০০ টাকার পণ্যে ৮০ পয়সা ভ্যাট। আমরা ৫০ পয়সা নিতে প্রস্তাব করেছি। এতে মূল্যস্ফীতি বাড়বে না, ভোক্তার ওপর চাপও বাড়বে না। সরকার নতুন ভ্যাট আইন করেছে। কিন্তু এই আইনের প্রভাব দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা ও ভোক্তার ওপর কতটা পড়বে, সে বিষয়ে কোনো গবেষণা করেনি। পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ নেই, যেখানে সব পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করা হয়। অর্থমন্ত্রী ও এনবিআর এ সমস্যার সমাধান না করলে আমরা অবশ্যই প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাব।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো অবশ্য ভ্যাট আইন সংশোধনের একটি প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দিয়েছেন। সূত্র জানায়, শেষ অবধি ১৫ শতাংশের পরিবর্তে ১২ শতাংশ ভ্যাট নির্ধারণ করা হতে পারে। কারণ হিসেবে ওই কর্মকর্তা বলেন, ১৫ শতাংশ ভ্যাটের কারণে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। মূল্যস্ফীতি উসকে দেবে। সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হতে পারে। এর প্রভাব পড়বে আগামী নির্বাচনে। ফলে সরকার আইন সংশোধনের কথা ভাবছে।
ভ্যাটের হার নির্ধারণ বাস্তবসম্মত করতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামীকাল বৃহস্পতিবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এবং ১৪ মে ভ্যাট আহরণকারী প্রতিষ্ঠান জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে বৈঠকে বসবেন বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো জানিয়েছে। এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, জনগণের কষ্টের কথা মাথায় রেখে যদি এ হার কিছুটা কমানো হয় তাহলেও তা ১২ শতাংশ কমের সুযোগ নেই। কারণ বাজেট বাস্তবায়নে ব্যয়ের সঙ্গে আয় বাড়াতে হবে। বাজেট ঘোষণার সময় প্রধানমন্ত্রী নিজেই সংসদে ভ্যাট কমানোর ঘোষণা দিতে পারেন। আগামী ১ জুলাই থেকে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর করতে বদ্ধপরিকর সরকার। ১৫ শতাংশ ভ্যাট নির্ধারণ কতটুকু যুক্তিযুক্ত জানতে গতকাল কথা হয় দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতা ও অর্থনীতিবিদ-উন্নয়ন গবেষকদের সঙ্গে। তাদের মতে, ভ্যাট ১৫ শতাংশ হলে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বাড়বে। পণ্য ও সেবার দাম বাড়বে, চাহিদা কমবে। শিল্পের উৎপাদনও কমে আসবে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের ওপর। নতুন ভ্যাট আইন অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের দাম কমবে। দেশীয় পণ্যের বিদেশি পণ্যের কাছে বাজার হারানোর শঙ্কা রয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, সরকার জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশে নিয়ে যেতে চায়। এজন্য বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ জিডিপির ২৯ শতাংশ থেকে ৩৩ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। সেজন্যই ১৫ শতাংশ ভ্যাট নির্ধারণ করতে চাইছে। কিন্তু ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট কার্যকর সরকারের জিডিপি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের পর পণ্যমূল্য বেড়ে যাবে। এতে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ চাপের মধ্যে পড়বে। ব্যবসাব্যয় কমবে না। পাশাপাশি ভ্যাট আদায় পদ্ধতি নিয়েও ঝামেলা তৈরি হতে পারে। এ ছাড়া নতুন ভ্যাট আইনের ৮৩, ৯০, ৯১ ও ৯৯ ধারায় রাজস্ব কর্মকর্তাদের সীমাহীন জুডিশিয়াল ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এগুলো সংশোধন না হলে ব্যবসায়ীরা হয়রানির শিকার হতে পারেন বলেও আশঙ্কা তাদের।
নতুন ভ্যাট আইনের ১৫(৩) ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইনে ভিন্নতর কিছু না থাকিলে, করযোগ্য সরবরাহ বা করযোগ্য আমদানির ক্ষেত্রে মূসক (ভ্যাট) হার হইবে ১৫ (পনেরো) শতাংশ।’ অর্থাৎ অল্পকিছু পণ্য বাদে দেশের সব পণ্যে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায় করবে সরকার। কিন্তু পৃথিবীর অনেক দেশেই এমন ঢালাও ভ্যাট হার নেই বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, দেশের বিভিন্ন শিল্প ও সেবা খাতে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যে উৎপাদক ও বিক্রেতা সব পর্যায় মিলিয়েও ১৫ শতাংশ মুনাফা হয় না। সে ক্ষেত্রে সরকার ঢালাওভাবে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট অনেক শিল্প ও সেবা খাত সংকটে পড়বে। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের জীবনযাত্রায় বাড়তি আর্থিক চাপ সৃষ্টি হবে। এই ভ্যাট ব্যবসায়ী বা পণ্য বিক্রেতার জন্য কোনো সমস্যা নয়। কিন্তু কয়েক হাত ঘুরে যখন পণ্যটি ভোক্তার কাছে পৌঁছাবে তখন সেই করের বোঝা তাকেই পরিশোধ করতে হবে।
কিন্তু বিশেষজ্ঞদের এমন অভিমত মানতে নারাজ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বোর্ডের ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তা বলেন, ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করার ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে না। বর্তমান ভ্যাট আইনেও অধিকাংশ আইটেমের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট রয়েছে। শুধু ১৫টি সেবার ক্ষেত্রে ভ্যাট আরোপিত আছে ১ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে। কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে প্রকৃত বিক্রয়মূল্যের চেয়ে কম মূল্যের ওপর ভ্যাট পরিশোধ করতে হয়, যা ট্যারিফ মূল্য নামে পরিচিত। বর্তমানে যেসব প্রতিষ্ঠান ১৫ শতাংশ ভ্যাট দেয় এবং উপকরণ কর রেয়াত নেয় তাদের নিজ স্তরে ভ্যাট দেওয়ার পরিমাণ ২ বা ৩ শতাংশের বেশি নয়। তাই বর্তমানে যেসব ক্ষেত্রে হ্রাসকৃত মূল্য বা ট্যারিফ মূল্য রয়েছে, নতুন ভ্যাট-ব্যবস্থায় সেসব ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ ভ্যাট পরিশোধ করে উপকরণ কর রেয়াত নিলে ওই স্তরে ভ্যাটের প্রকৃত ভার ২ বা ৩ শতাংশের বেশি হবে না। ফলে মূল্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা নেই। ঠিকভাবে হিসাবপত্র সংরক্ষণ করে উপকরণ কর রেয়াত নিয়ে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট প্রদানে কোনো ক্ষেত্রে মূল্য কিছুটা বৃদ্ধি পেতে পারে; কোনো ক্ষেত্রে মূল্য অপরিবর্তিত থাকবে; আবার কোনো ক্ষেত্রে মূল্য কমতে পারে। তা ছাড়া নতুন ভ্যাট আইনে বার্ষিক ৩০ লাখ টাকা বিক্রয়কারী সব প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাটমুক্ত রাখা হয়েছে। তাই নতুন ভ্যাট ব্যবস্থায় ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাট-সংক্রান্ত হিসাবপত্র রাখতে হবে না।
এনবিআরের এমন বক্তব্য সঠিক নয় বলে জানিয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, নতুন মূসক আইন বাস্তবায়িত হলে পণ্যের দাম শুরুতেই বেড়ে যাবে, যা ভোক্তাকে বেশ ভোগাবে। মূসকের জন্য বাড়তি টাকা দিতে হবে। এতে মূল্যস্ফীতি হবে। ১৫ শতাংশ মূসক একটু বেশি। এটা ১০ শতাংশ করা উচিত। একটি দেশের উন্নয়ন এবং সবদিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হলে মূসক অবশ্যই জনগণ দেবে। এ ক্ষেত্রে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু মূসক বাড়ানোর একটা যুক্তিসংগত কারণ থাকতে হবে। যতটা সহনীয় মাত্রায় ধাপে ধাপে সেটা বাড়ানো যায় ততই মঙ্গল। তা না করে যদি এক লাফে ১৫ শতাংশে বৃদ্ধি করা হয়, তাহলে সেটি অবিবেচনাপ্রসূত হবে। সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে অবশ্যই সরকারকে বিষয়টি ভেবে দেখতে হবে।
একইভাবে অর্থনীতিবিদ ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী বলেন, ১৫ শতাংশ ভ্যাট আদায় করা হলে পণ্যমূল্য ও মূল্যস্ফীতি দুই-ই বাড়বে। ভোক্তাদের মধ্যে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে এবং এতে খুচরা বিতরণ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে এখনি বিকল্প চিন্তা জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আর সর্বজনীন ভোগ্যপণ্যে ভ্যাট থাকা উচিত নয় বলে মত দিয়েছেন ভোক্তা সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি অধ্যাপক গোলাম রহমান। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ, জ্বালানিসহ সর্বজনীন ভোগ্যপণ্যে ভ্যাট থাকা উচিত নয়। এসব পণ্যে ভ্যাট নেওয়া কষ্টকর। যৌক্তিকভাবে এসব পণ্যে ভ্যাট থাকার কথা নয়। ১৫ শতাংশ হারে যদি ভ্যাট সব পণ্য বা সেবার ওপরে আরোপ করা হয় তাহলে জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে যাবে। ভোক্তাদের জীবনযাত্রার ব্যয়ও বাড়বে। ফলে সরকারের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
সব ধরনের পণ্য ও সেবার ওপর সরকারের ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশে বিতর্ক চলছে। এ নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে সরকার ও ব্যবসায়ীরা। উভয় পক্ষের মধ্যে দেখা দিয়েছে দ্বন্দ্ব। দেশজুড়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। একদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) আইন বাস্তবায়ন হলে ভোক্তাপর্যায়ে পণ্যের দাম বাড়বে। কিন্তু সরকারের দাবি, ব্যবসায়ীরা সঠিকভাবে হিসাব রাখতে পারলে পণ্যের দাম বাড়বে না; বরং কমবে।
নতুন ভ্যাট আইন নিয়ে উত্তপ্ত দেশের অর্থনৈতিক অঙ্গন। শীর্ষ মহল থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের ব্যবসায়ীরাও প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। তারা ১৫ শতাংশ ভ্যাট কমিয়ে ৭ অথবা ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছেন। অর্থনীতিবিদ ও উন্নয়ন গবেষকরাও ১০ শতাংশের মধ্যে ভ্যাট রাখার পক্ষে। নানাভাবে বিষয়টি সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন। প্রয়োজনে আন্দোলনের জন্য রাজপথে নামার হুমকিও দিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকার অনড়। স্বয়ং অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, ‘আন্দোলন করেন, কিচ্ছু হবে না, যদি আপনারা আন্দোলন করেন, আমরা আন্দোলন দমন করব। শেষ পর্যন্ত বিষয়টিতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন ব্যবসায়ীরা।’
এ ব্যাপারে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন দ্য ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) উপদেষ্টা মঞ্জুর আহমেদ বলেন, ইউরোপের দেশগুলো কোনো পণ্যের চূড়ান্ত বিক্রেতা পর্যায়ে দশমিক ৮ শতাংশ হারে ভ্যাট নেয়। অর্থাৎ প্রতি ১০০ টাকার পণ্যে ৮০ পয়সা ভ্যাট। আমরা ৫০ পয়সা নিতে প্রস্তাব করেছি। এতে মূল্যস্ফীতি বাড়বে না, ভোক্তার ওপর চাপও বাড়বে না। সরকার নতুন ভ্যাট আইন করেছে। কিন্তু এই আইনের প্রভাব দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা ও ভোক্তার ওপর কতটা পড়বে, সে বিষয়ে কোনো গবেষণা করেনি। পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ নেই, যেখানে সব পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করা হয়। অর্থমন্ত্রী ও এনবিআর এ সমস্যার সমাধান না করলে আমরা অবশ্যই প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাব।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো অবশ্য ভ্যাট আইন সংশোধনের একটি প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দিয়েছেন। সূত্র জানায়, শেষ অবধি ১৫ শতাংশের পরিবর্তে ১২ শতাংশ ভ্যাট নির্ধারণ করা হতে পারে। কারণ হিসেবে ওই কর্মকর্তা বলেন, ১৫ শতাংশ ভ্যাটের কারণে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। মূল্যস্ফীতি উসকে দেবে। সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হতে পারে। এর প্রভাব পড়বে আগামী নির্বাচনে। ফলে সরকার আইন সংশোধনের কথা ভাবছে।
ভ্যাটের হার নির্ধারণ বাস্তবসম্মত করতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামীকাল বৃহস্পতিবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এবং ১৪ মে ভ্যাট আহরণকারী প্রতিষ্ঠান জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে বৈঠকে বসবেন বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো জানিয়েছে। এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, জনগণের কষ্টের কথা মাথায় রেখে যদি এ হার কিছুটা কমানো হয় তাহলেও তা ১২ শতাংশ কমের সুযোগ নেই। কারণ বাজেট বাস্তবায়নে ব্যয়ের সঙ্গে আয় বাড়াতে হবে। বাজেট ঘোষণার সময় প্রধানমন্ত্রী নিজেই সংসদে ভ্যাট কমানোর ঘোষণা দিতে পারেন। আগামী ১ জুলাই থেকে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর করতে বদ্ধপরিকর সরকার। ১৫ শতাংশ ভ্যাট নির্ধারণ কতটুকু যুক্তিযুক্ত জানতে গতকাল কথা হয় দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতা ও অর্থনীতিবিদ-উন্নয়ন গবেষকদের সঙ্গে। তাদের মতে, ভ্যাট ১৫ শতাংশ হলে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বাড়বে। পণ্য ও সেবার দাম বাড়বে, চাহিদা কমবে। শিল্পের উৎপাদনও কমে আসবে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের ওপর। নতুন ভ্যাট আইন অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের দাম কমবে। দেশীয় পণ্যের বিদেশি পণ্যের কাছে বাজার হারানোর শঙ্কা রয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, সরকার জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশে নিয়ে যেতে চায়। এজন্য বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ জিডিপির ২৯ শতাংশ থেকে ৩৩ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। সেজন্যই ১৫ শতাংশ ভ্যাট নির্ধারণ করতে চাইছে। কিন্তু ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট কার্যকর সরকারের জিডিপি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের পর পণ্যমূল্য বেড়ে যাবে। এতে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ চাপের মধ্যে পড়বে। ব্যবসাব্যয় কমবে না। পাশাপাশি ভ্যাট আদায় পদ্ধতি নিয়েও ঝামেলা তৈরি হতে পারে। এ ছাড়া নতুন ভ্যাট আইনের ৮৩, ৯০, ৯১ ও ৯৯ ধারায় রাজস্ব কর্মকর্তাদের সীমাহীন জুডিশিয়াল ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এগুলো সংশোধন না হলে ব্যবসায়ীরা হয়রানির শিকার হতে পারেন বলেও আশঙ্কা তাদের।
নতুন ভ্যাট আইনের ১৫(৩) ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইনে ভিন্নতর কিছু না থাকিলে, করযোগ্য সরবরাহ বা করযোগ্য আমদানির ক্ষেত্রে মূসক (ভ্যাট) হার হইবে ১৫ (পনেরো) শতাংশ।’ অর্থাৎ অল্পকিছু পণ্য বাদে দেশের সব পণ্যে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায় করবে সরকার। কিন্তু পৃথিবীর অনেক দেশেই এমন ঢালাও ভ্যাট হার নেই বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, দেশের বিভিন্ন শিল্প ও সেবা খাতে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যে উৎপাদক ও বিক্রেতা সব পর্যায় মিলিয়েও ১৫ শতাংশ মুনাফা হয় না। সে ক্ষেত্রে সরকার ঢালাওভাবে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট অনেক শিল্প ও সেবা খাত সংকটে পড়বে। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের জীবনযাত্রায় বাড়তি আর্থিক চাপ সৃষ্টি হবে। এই ভ্যাট ব্যবসায়ী বা পণ্য বিক্রেতার জন্য কোনো সমস্যা নয়। কিন্তু কয়েক হাত ঘুরে যখন পণ্যটি ভোক্তার কাছে পৌঁছাবে তখন সেই করের বোঝা তাকেই পরিশোধ করতে হবে।
কিন্তু বিশেষজ্ঞদের এমন অভিমত মানতে নারাজ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বোর্ডের ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তা বলেন, ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করার ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে না। বর্তমান ভ্যাট আইনেও অধিকাংশ আইটেমের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট রয়েছে। শুধু ১৫টি সেবার ক্ষেত্রে ভ্যাট আরোপিত আছে ১ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে। কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে প্রকৃত বিক্রয়মূল্যের চেয়ে কম মূল্যের ওপর ভ্যাট পরিশোধ করতে হয়, যা ট্যারিফ মূল্য নামে পরিচিত। বর্তমানে যেসব প্রতিষ্ঠান ১৫ শতাংশ ভ্যাট দেয় এবং উপকরণ কর রেয়াত নেয় তাদের নিজ স্তরে ভ্যাট দেওয়ার পরিমাণ ২ বা ৩ শতাংশের বেশি নয়। তাই বর্তমানে যেসব ক্ষেত্রে হ্রাসকৃত মূল্য বা ট্যারিফ মূল্য রয়েছে, নতুন ভ্যাট-ব্যবস্থায় সেসব ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ ভ্যাট পরিশোধ করে উপকরণ কর রেয়াত নিলে ওই স্তরে ভ্যাটের প্রকৃত ভার ২ বা ৩ শতাংশের বেশি হবে না। ফলে মূল্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা নেই। ঠিকভাবে হিসাবপত্র সংরক্ষণ করে উপকরণ কর রেয়াত নিয়ে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট প্রদানে কোনো ক্ষেত্রে মূল্য কিছুটা বৃদ্ধি পেতে পারে; কোনো ক্ষেত্রে মূল্য অপরিবর্তিত থাকবে; আবার কোনো ক্ষেত্রে মূল্য কমতে পারে। তা ছাড়া নতুন ভ্যাট আইনে বার্ষিক ৩০ লাখ টাকা বিক্রয়কারী সব প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাটমুক্ত রাখা হয়েছে। তাই নতুন ভ্যাট ব্যবস্থায় ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাট-সংক্রান্ত হিসাবপত্র রাখতে হবে না।
এনবিআরের এমন বক্তব্য সঠিক নয় বলে জানিয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, নতুন মূসক আইন বাস্তবায়িত হলে পণ্যের দাম শুরুতেই বেড়ে যাবে, যা ভোক্তাকে বেশ ভোগাবে। মূসকের জন্য বাড়তি টাকা দিতে হবে। এতে মূল্যস্ফীতি হবে। ১৫ শতাংশ মূসক একটু বেশি। এটা ১০ শতাংশ করা উচিত। একটি দেশের উন্নয়ন এবং সবদিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হলে মূসক অবশ্যই জনগণ দেবে। এ ক্ষেত্রে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু মূসক বাড়ানোর একটা যুক্তিসংগত কারণ থাকতে হবে। যতটা সহনীয় মাত্রায় ধাপে ধাপে সেটা বাড়ানো যায় ততই মঙ্গল। তা না করে যদি এক লাফে ১৫ শতাংশে বৃদ্ধি করা হয়, তাহলে সেটি অবিবেচনাপ্রসূত হবে। সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে অবশ্যই সরকারকে বিষয়টি ভেবে দেখতে হবে।
একইভাবে অর্থনীতিবিদ ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী বলেন, ১৫ শতাংশ ভ্যাট আদায় করা হলে পণ্যমূল্য ও মূল্যস্ফীতি দুই-ই বাড়বে। ভোক্তাদের মধ্যে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে এবং এতে খুচরা বিতরণ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে এখনি বিকল্প চিন্তা জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আর সর্বজনীন ভোগ্যপণ্যে ভ্যাট থাকা উচিত নয় বলে মত দিয়েছেন ভোক্তা সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি অধ্যাপক গোলাম রহমান। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ, জ্বালানিসহ সর্বজনীন ভোগ্যপণ্যে ভ্যাট থাকা উচিত নয়। এসব পণ্যে ভ্যাট নেওয়া কষ্টকর। যৌক্তিকভাবে এসব পণ্যে ভ্যাট থাকার কথা নয়। ১৫ শতাংশ হারে যদি ভ্যাট সব পণ্য বা সেবার ওপরে আরোপ করা হয় তাহলে জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে যাবে। ভোক্তাদের জীবনযাত্রার ব্যয়ও বাড়বে। ফলে সরকারের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
লেখকঃ প্রতীক ইজাজ
No comments:
Post a Comment