রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক নেতাদের সতর্কতা
চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জানুয়ারি-মে) ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ নিজেদের মধ্যে অর্ধশতাধিক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটিয়েছে। এসব ঘটনা ঘটেছে ছাত্রলীগের সঙ্গে যুবলীগ, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ-ছাত্রলীগের মধ্যে। এতে আহত হয়েছেন নিজেদের ৬৬ নেতাকর্মী ও প্রাণ হারিয়েছেন তিনজন। আইন ও সালিশ কেন্দ্র তাদের ই-বুলেটিনে এ তথ্য জানিয়েছে। এর বাইরে শুধু চলতি মাসেই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ১০টি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছেন। বিশেষ করে গত এক সপ্তাহে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সিলেট, রাজশাহী, পাবনাসহ বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, সরকারি সম্পদ ধ্বংসসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপক বিতর্কের মুখে পড়েছে সংগঠনটি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র আরো বলছে, গত বছর নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ২১ নেতাকর্মী-সমর্থক মারা গেছেন। এর মধ্যে ছাত্রলীগের নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষেই মারা গেছেন ছয়জন। এ সময় নিজেদের মধ্যে ১১৫টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ৮২টি, ছাত্রলীগ-ছাত্রলীগের মধ্যে ২২টি, যুবলীগ-যুবলীগের মধ্যে তিনটি, ছাত্রলীগ-যুবলীগের মধ্যে দুটি, আওয়ামী লীগ-যুবলীগের মধ্যে পাঁচটি ও আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের মধ্যে একটি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
এসব ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, একদিকে যেমন অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে নিজেদের মধ্যে ঘটছে সংঘর্ষ-সংঘাত ও প্রাণহানির এসব ঘটনা; তেমনি ক্ষমতার দাপটে কারণে-অকারণে হামলা করছে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য থেকে শুরু করে সংগঠনের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার ও ছোটখাটো ছিনতাইয়ের অভিযোগও যেমন আসছে; তেমনি পাড়ামহল্লায় অলিগলিতে তুচ্ছ ঘটনার জেরে ঘটছে তুলকালাম। রাস্তাঘাট বন্ধ করে মানুষকে যানজটে ফেলে পালন করছে বিভিন্ন অনুষ্ঠান। শাসক দলের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের এখন কিছুটা সমীহ করেই চলতে হয় স্থানীয়দের।
ক্ষমতার একেবারে শেষ দিকে এসে হঠাৎ করে ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনটির এমন কর্মকান্ড কিছুটা হলেও চিন্তায় ফেলেছে ক্ষমতাসীনদের। বিব্রত সরকারও। নানা প্রশ্নের মুখে পড়েছে সরকারের বিভিন্ন অর্জন। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের এমন আচরণ ভাবিয়ে তুলেছে আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডকে।
এ নিয়ে শঙ্কিত ছাত্রলীগের সাবেক নেতারাও। তাদের মতে, পাওয়া-না পাওয়ার দ্বন্দ্ব, নিজেদের মধ্যে অবিশ্বাস ও লোভ-লালসার পাশাপাশি সামাজিক নানা অস্থিরতার কারণেই এমনটি ঘটছে। আবার শুভ রাজনীতির বিরুদ্ধে অশুভ শক্তির যোগসাজশও দেখছেন কেউ কেউ। তবে তারা সবাই কঠোর হাতে ছাত্রলীগের এসব ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করতে বলেছেন। নতুবা এসব ঘটনার রেশ আগামী নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের বেকায়দায় ফেলতে পারে। ছাত্রলীগের ব্যাপারে ক্ষমতাসীনদের এখনই সতর্ক পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও। তাদের মতে, ছাত্রলীগকে এখনই নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড প্রশ্নের মুখে পড়বে। নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দলের নির্বাচনী রাজনীতিতে।
বিতর্কিত কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখতে ছাত্রলীগকে বরাবরই সতর্ক করে আসছেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। মূলত সরকারের আগের মেয়াদের সন্ত্রাস-চাঁদাবাজিসহ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে সমালোচিত ছিল ছাত্রলীগ। ওই সময় প্রধানমন্ত্রীর নানা পদক্ষেপের পরও লাগাম টানা সম্ভব হয়নি। তাদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংগঠনটি দেখাশোনা করার জন্য ছাত্রলীগের এক সময়ের সভাপতি ও আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে দায়িত্ব দেন। তিনিও সংশোধিত না হলে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে বলে অপকর্ম সংগঠনকারী নেতাকর্মীদের একাধিকবার সতর্ক করে দিয়েছেন। কিন্তু তাতেও কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। বর্তমানে নির্বাচনের শেষ সময়ে আওয়ামী লীগকে বিপদে ফেলতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট-এমন আলোচনা দলের মধ্যেই হচ্ছে। তাই সময় থাকতে ছাত্রলীগের দড়ি টেনে ধরতে না পারলে সরকারকে চরম মাশুল দিতে হবে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকেই। এ ব্যাপারে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় এমন কোনো কাজ হলে সাংগঠনিকভাবে, প্রশাসনিকভাবে আমরা কাউকে রেহাই দেব না। আমাদের এত উন্নয়ন, এত অর্জন, এত কীর্তি, এত খ্যাতি বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কীর্তিকে গুটিকয়েক অপকর্মকারীর হাতে জিম্মি হতে দিতে পারি না।’
কিন্তু কে বা কারা সামলাবে ছাত্রলীগকে, দায়িত্বইবা নেবে কে-এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে দলের ভেতরও। ছাত্রলীগের সূত্রগুলো বলছে, গুটিকয়েক নেতার ইশারায় চলছে সংগঠনটি। দীর্ঘদিন ধরে কাক্সিক্ষত কমিটি আসছে না। ফলে সংগঠনে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কাউন্সিলের আগে পর্যন্ত ছাত্রলীগকে দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল সংগঠনের সাবেক সভাপতি ওবায়দুল কাদেরের ওপর। কাউন্সিলে তিনি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে যাওয়ার পর সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের ভালো-মন্দ দেখাশোনার ভার কারো ওপর ন্যস্ত হয়নি। যদিও প্রধানমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকেই অলিখিতভাবে দেখতে বলেছেন, কিন্তু তিনি আবার দেখভালের দায়িত্ব দিয়েছেন সাবেক পাঁচ নেতার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের ওপর।
ছাত্রলীগের সাবেক নেতারা বলছেন, সংগঠনটি অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীন। বৃহৎ সংগঠন হওয়ায় কেন্দ্রীয় নেতাদের পক্ষে সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। পাশাপাশি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রভাবের কারণেও স্থানীয় পর্যায়ের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের নানা সমালোচিত কাজে জড়ানোর ঘটনা ঘটছে। এমনকি ছাত্রলীগের এসব কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ বাধা বলে দাবি করেন সংগঠনের সাবেক কেন্দ্রীয় এক সভাপতি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, এত বড় সংগঠন নিয়ন্ত্রণ করা সহজ কিছু নয়। জেলা-উপজেলা কমিটিগুলো চাইলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কারণ এসব জেলা-উপজেলার কমিটিগুলো নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা। কমিটিগুলো দেওয়ার সময় স্থানীয় নেতাদের অনেক আবদার থাকে। তাই চাইলে এসব কমিটি কেন্দ্র থেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
ছাত্রলীগের এমন কমর্কাণ্ড প্রসঙ্গে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও আওয়ামী লীগের বর্তমান সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীম বলেন, ছাত্রলীগের এমন কর্মকান্ড অবশ্যই কাম্য নয়। নিঃসন্দেহে নিন্দনীয়। ভালো না। কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলছি। কিন্তু কেন এমনটি হচ্ছে জানতে চাইলে এই সাবেক ছাত্রনেতা বলেন, ‘বর্তমান ছাত্রলীগের সঙ্গে আমাদের এক বিরাট জেনারেশন গ্যাপ রয়েছে। আমরা এরশাদের সময় ছাত্ররাজনীতি করেছি। ভিপি হয়েছি। ছাত্রলীগ জনপ্রিয় সংগঠন ছিল তখন। সেই আদর্শ থেকে ব্যত্যয় হওয়ার কারণেই এমনটি ঘটছে। সামাজিক কিছু অস্থিরতাও দায়ী। নেতাকর্মীদের বিভ্রান্ত করছে। তাদের কাউন্সিলিং করতে হবে। কঠোরভাবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়, তাহলে অন্যরাও ভয় পাবে।’ তবে এ অবস্থা চলবে না এবং কিছুতেই এর নেতিবাচক প্রভাব আগামী নির্বাচনে ফেলতে দেওয়া হবে না বলে দাবি করেন এই সাবেক ছাত্রলীগ নেতা।
স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ছাত্রলীগের আরেক সাবেক নেতা পঙ্কজ দেবনাথ বলেন, দেশে শুদ্ধধারার রাজনীতির বিপরীতে হীন রাজনীতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা বরাবরই আছে। বারবার শুদ্ধ ছাত্ররাজনীতি ব্যাহত করার ষড়যন্ত্র হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে। এবারও সুস্থধারার রাজনীতির জয় হবে। শুধু ছাত্রলীগই নয়, ইতিবাচক রাজনীতি ছাড়া দেশ চলে না। আশা করছি, ছাত্রলীগকে নিয়ে যে বিতর্ক ও সমালোচনা, সেটার সমাধান হবে। শুভ শক্তির জয় হবে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে ঘটনার সঙ্গে জড়িতের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রিয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ। পাশাপাশি তিনি ‘ছাত্রলীগকে নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে’ বলেও দাবি করেন। তিনি বলেন, ছাত্রলীগকে নিয়ে ষড়যন্ত্র চলছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে এহিত্যবাহী এই সংগঠনকে বিতর্কিত করার ষড়যন্ত্রের বহি:প্রকাশ ঘটছে সাম্প্রতিক এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে। গণমাধ্যমে প্রায়ক্ষেত্রে ছাত্রলীগ সঠিকভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে না। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক এক ঘটনার দায় ছাত্রলীগের কাঁধে চাপানোর ষড়যন্ত্র হচ্ছে। অথচ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন মাস ধরে ছাত্রলীগের কোনো কমিটিই নেই। তাই সেখানে কোনো কর্মসূচিও নেই। তিনি আরও বলেন, ছাত্রলীগের কোনো নেতা অনৈতিক কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের বিষয়ে সতর্ক থাকার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কী না জানতে চাইলে তিনি বলেন, অবশ্যই দেশের সব শাখার নেতাকর্মীকে সতর্ক করা আছে।
তবে ছাত্রলীগকে এখনই সামাল দেওয়া না গেলে সংগঠনটির এমন কর্মকাণ্ড জাতীয় নির্বাচনে দলকে বেকায়দায় ফেলবে বলে মনে করছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, ছাত্রলীগের এমন আচরণ দলের ভেতরকার শৈথিল্য থেকেই হয়েছে। ক্ষমতাসীনরা দলকে গোছানোর পরিবর্তে নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ব্যস্ত। রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠন ও সহযোগি সংগঠনগুলোর বিতর্তিক কর্মকাণ্ড ভোটারদের ওই দলের প্রতি কিছুটা হলেও অনাস্থা সৃষ্টি করে। ভোটে সেটার প্রভাব পড়ে।
লেখক: প্রতীক ইজাজ , রাজনৈতিক বিশ্লষক।
No comments:
Post a Comment