১ জুন ২০১৭ জাতীয় সংসদে উত্থাপিত ২০১৭-১৮ বিশাল বাজেটে টাকার সংস্থান করতে গিয়ে সরকার নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের ব্যাংকে জমানো টাকার ওপর চড়াও হয়েছে। সংগত কারণে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের নবম বাজেট নিয়ে দেশব্যাপী এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে সমালোচনা হচ্ছে এরআগে এমন সমালোচনা শেখ হাসিনা সরকারের আমলে নজরে পড়েনি। অর্থমন্ত্রীর সমালোচনা মানে সরকারের তীব্র সমালোচনা। দেশব্যাপী সর্বত্র যে সমালোচনাটি তীব্র থেকে তীব্রতর সেটি হচ্ছে নিম্নমধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্তদের ব্যাংকে জমানো টাকায় হাত দেওয়ার বিষয়টি। সবচেয়ে বেশি চটেছেন গৃহিণীরা। তাদের মধ্যে টাকা জমানোর আগ্রহটা বেশি।
এতদিন ব্যাংকে জমানো টাকার লভ্যাংশের ওপর সরকার যে ১০ শতাংশ আবগারি শুল্ক কেটে নিত তা নিয়ে কারো তেমন আপত্তি ছিল না। আপত্তি ছিল না আমানতের ওপর ৫০০ টাকার আবগারি শুল্কেও। কিন্তু এবারের বাজেটে অর্থমন্ত্রী আবগারি শুল্কের জন্য হাত আরো লম্বা করেছেন। ব্যাংকে এক লাখ টাকার ওপর যত বেশি আমানত থাকবে তত বেশি আবগারি শুল্ক দিতে হবে আমানতকারীকে। অর্থাৎ এক লাখ টাকা যে ব্যাংক হিসাবে থাকবে সে টাকা থেকে আটশ’ টাকা কেটে নেওয়া হবে। তা ছাড়া অর্জিত লভ্যাংশের ওপর আগের ১০ শতাংশ আদায় তো বহাল আছেই। এতে নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের ওপর যে খড়গ চালানো হলো তাদের সিংহভাগই কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের ভোটার।
এই আবগারি শুল্ক ১৯৯৩-৯৪ অর্থবছর অর্থাৎ বিএনপি সকারের আমলে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান ব্যাংকে গচ্ছিত টাকার ওপর ৫ শতাংশ হারে আবগারি শুল্ক হিসেবে ধার্য করেন। সেই থেকে প্রত্যেক অ্যাকাউন্ট হোল্ডারের অ্যাকাউন্ট থেকে প্রতিবছর একবার আবগারি শুল্ক কাটা হয়ে আসছে। তখন শুল্ক পরিমাণ কম ছিল তাই কারো গায়ে লাগেনি। কিন্তু বর্তমান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে আবগারি শুল্ক ৫০০ টাকার স্থলে ৮০০ টাকা করার পরিপ্রেক্ষিতে সারা দেশে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের মধ্যে সমালোচনা ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। আসলে প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যার অভাবেই মানুষ তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। তবু পাঠকদের জন্য বিষয়টির ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি।
এই আবগারি শুল্ক প্রত্যেকের অ্যাকাউন্ট থেকে কাটা হয় প্রতি বছরের শেষ দিনে মানে ৩১ ডিসেম্বর বা অনেক ব্যাংকে ১ জানুয়ারি। যে কেউ ব্যাংক থেকে তার অ্যাকাউন্টের স্টেটমেন্ট বা বিবরণী নিলেই বিষয়টি খোলাসা হবে। এবারের বাজেট প্রস্তাবনা তিনশ টাকা বাড়িয়েছেন অর্থমন্ত্রী। যে হিসেবে বছরের শেষ দিনে একবারই শুল্ক কাটা হয়, তা নিম্নে আলোচনা করা হলো। একজন অ্যাকাউন্ট হোল্ডারের সারা বছর লেনদেন ওপর ভিত্তি করে এই আবগারি শুল্ক কাটা হয়! বর্তমান বাজেট প্রস্তাবনায় যে হিসেবে বা হারে আবগারি শুল্ক কাটার প্রস্তাব করা হয়েছে তা নিম্নরূপ :
১. সারা বছর একজন হিসাবধারীর অ্যাকাউন্টের সমাপনী স্থিতি যদি এক লাখ টাকার নিচে থাকে, তাহলে কোনো আবগারি শুল্ক দিতে হবে না। ২. সমাপনী স্থিতি যদি এক লাখ টাকা থেকে ১০ লাখ টাকার মাঝে থাকে তাহলে, ৮০০ টাকা আবগারি শুল্ক দিতে হবে, যা পূর্বে ছিল ৫০০ টাকা। এ ক্ষেত্রে ৩০০ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। ৩. কারো সমাপনী স্থিতি যদি ১০ লাখ টাকা থেকে এক কোটির মাঝে থাকে তাহলে, ২,৫০০ টাকা দিতে হবে, যা পূর্বে ছিল ১,৫০০ টাকা। এখানে ১০০০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। ৪. সমাপনী স্থিতি যদি এক কোটি থেকে পাঁচ কোটির মাঝে থাকে তাহলে ১২,০০০ টাকা দিতে হবে, যাহা পূর্বে ছিল ৭,৫০০ টাকা। এ ক্ষেত্রে ৫০০০ টাকা বেড়েছে। ৫. কারো সমাপনী স্থিতি পাঁচ কোটির ঊর্ধ্বে হলে ২৫,০০০ টাকা দিতে হবে, যা পূর্বে ছিল ১৫,০০০ টাকা। এক্ষেত্রে ১০০০০ টাকা বেড়েছে।
এই নিয়ে প্রবাসীদের মধ্যে উৎকন্ঠা দেখো দিয়েছে। তাদের জ্ঞাতার্থে বলা প্রয়োজন যে, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর আবগারি শুল্ক আরোপ করা হয়নি। তাই এই নিয়ে প্রবাসীদের উৎকণ্ঠিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। প্রস্তাবিত বাজেটে, বছরের যেকোনো সময় ব্যাংক হিসাবে এক লাখ টাকার বেশি লেনদেনের ওপর আবগারি শুল্ক বিদ্যমান ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০০ টাকা করা হয়েছে। নতুন বাজেটে আবগারি শুল্ক আরোপের সীমা ২০ হাজার থেকে বাড়িয়ে এক লাখ টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ আগে বছরের যেকোনো সময় ২০ হাজার টাকা লেনদেনে শুল্ক আরোপ করা হতো, এখন এক লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেনে শুল্ক আরোপ করা হবে না।
নতুন বাজেট প্রস্তাবে ২০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেনে বিদ্যমান ১৫০ টাকা আবগারি শুল্ক মওকুফ করা হয়েছে বলে এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান জানান। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ১ লাখ টাকার লেনদেনে এখন ১৫০ টাকা আবগারি শুল্ক আরোপ করা আছে, এখন সেটা আর দিতে হবে না। তবে এখানে কথা হলো আজকাল গরিব বা ভিক্ষুকও এক লাখ ও তারও বেশি টাকা ব্যাংকে রাখে। সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিভাবকদের টাকা পাঠাতে হয়। মধ্যবিত্ত ও গরিব অভিভাবকদের কতটা কষ্ট করে এই টাকা পাঠাতে হয় ভুক্তভোগীরা জানেন। এবারের বাজেটে এসব সাধারণ মানুষের মাথায় বাজ পড়ার উপক্রম। ব্যাংকে সঞ্চয় হিসাবে সুদের হার তো কমানো আছেই। নানা খাতে অর্থ কর্তন অব্যাহত রয়েছে। এবার মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো আরো চাপল বাড়তি করের বোঝা।
সামনে যেখানে ভোট সেখানে সমাজ ও রাষ্ট্রের এ নিরীহ শ্রেণির ওপর যে খড়গটি চালানো হলো তা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? আগামী নির্বাচনে যদি এ শ্রেণিটি বেঁকে বসে, তাহলে পরিণতি কী হতে পারে সরকারের, আমলা বা মন্ত্রীরা হিসাব-নিকাশ করে দেখেছেন কি? এ প্রশ্ন আজ সবার। নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি ক্ষেপেছে আরো কয়েকটি কারণে। বাজেট ঘোষণার মাত্র দু’দিন আগে বাড়ানো হয়ে গ্যাসের দাম, এর আগে বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। তাই ঊর্ধ্বমূল্যের এ বাজারে সংসার চালাতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। আর বর্তমান বাজেটে বিভিন্ন খাতে বিপুল পরিমাণ কর বাড়ানোর কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আরো বেড়ে যাবে। ফলে আলোচ্য শ্রেণিটি ভীষণ অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে পড়ে যাবে।
মন্দের ভালো : প্রথমটি হলো-ব্যাংক হিসাবে আবগারি শুল্ক বাড়ানোর যে প্রস্তাব অর্থমন্ত্রী বাজেটে তুলে ধরেছেন তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় ১৪ দল। এছাড়া সারচার্জসহ জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলে এমন অংশটুকু প্রত্যাহার করতে অর্থমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। গত রোববার ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে কেন্দ্রীয় ১৪ দলের এক বৈঠক থেকে এ দাবি জানানো হয়। বৈঠক শেষে জাতীয় পার্টির (জেপি) সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী শেখ শহীদুল ইসলাম এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, জনগণের সুবিধার কথা চিন্তা করে আমরা ১৪ দল মনে করি, বাজেটের উল্লেখিত বিষয় প্রত্যাহার করা উচিত। তারা যেহেতু ক্ষমতায় তাই তাদের এ দাবির যথেষ্ট গুরুত্ব আছে।
দ্বিতীয় সুখবরটি হলো, ব্যাংক আমানতের ওপর প্রস্তাবিত আবগারি শুল্ক প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়। জনস্বার্থ এবং ব্যাংকিং খাতের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা অটুট রাখতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুরোধে প্রস্তাবিত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট পাসের দিন ব্যাংক আমানতের ওপর প্রস্তাবিত আবগারি শুল্ক প্রত্যাহার করা হতে পারে। আগামী ২৯ জুন জাতীয় সংসদে বাজেট পাস হওয়ার কথা রয়েছে। আমরা প্রতীক্ষায় থাকলাম।
লেখক: মাহবুবুল আলম
No comments:
Post a Comment