Friday, December 2, 2016

বাঙালি জাতীয়তায় অবিচল মধুসূদন দত্ত

মধুসূদনের বাঙালিত্বটি স্পষ্ট। এর খবর বিদ্যাসাগর যেমন রাখতেন, তেমনি রাখতেন বঙ্কিমচন্দ্র। অজ্ঞাত ছিল না মধুসূদনের নিজেরও। কবির মৃত্যুর পরে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন, ‘আজ বঙ্গভূমির উন্নতি সম্বন্ধে আর আমরা সংশয় করি না; এই ভূমণ্ডলে বাঙালি জাতির গৌরব হইবে। কেননা বঙ্গদেশ রোদন করিতে শিখিয়াছে, অকপটে বাঙালি, বাঙালি কবির জন্য রোদন করিতেছে।’ আরো বলেছেন, ‘ভিন্ন ভিন্ন দেশে জাতীয় উন্নতির ভিন্ন ভিন্ন সোপান। বিদ্যালোচনার কারণেই প্রাচীন ভারত উন্নত হইয়াছিল, আবার উন্নত হইবে। কাল প্রসন্ন—ইউরোপ সহায়—সুপবন বহিতেছে। জাতীয় পতাকা উড়াইয়া দাও—তাহাতে নাম লেখা শ্রী মধুসূদন।’
বঙ্কিমের এই জয়ঘোষণা তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু এখানেও পূর্বসূরী মধুসূদনের সঙ্গে উত্তরসূরী বঙ্কিমের একটা দূরত্ব চোখে পড়বার মতো। বঙ্কিম অবশ্যই বাঙালি, কিন্তু তিনি আবার ভারতীয়ও। যে-কারণে তিনি বাংলার উন্নতিকে ভারতের উন্নতি থেকে আলাদা করে নয়, সংলগ্ন করেই দেখেছেন, এবং তাঁর ভারতীয় পরিচয় হিন্দু পরিচয়ের সঙ্গে অভিন্ন হয়ে গেছে। অপরদিকে মধুসূদন নিজের ভারতীয় পরিচয় সম্পর্কে যে অসচেতন ছিলেন তা নয়, কিন্তু বাঙালিত্বই ছিল তাঁর কাছে প্রধান।
মধুসূদন হিন্দুত্ব বিষয়ে মোটেই উৎসাহী ছিলেন না। তাঁকে কেবল অসাম্প্রদায়িক নয়, ধর্মনিরপেক্ষই বলতে হয়। এর মূল কারণ এটা নয় যে, তিনি হিন্দু ধর্ম পরিত্যাগ করে খ্রিস্টান হয়ে গিয়েছিলেন; মূল কারণ তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ইহজাগতিক ও অসাম্প্রদায়িক। তাঁর মহাকাব্যে রাম প্রধান চরিত্র নয়, প্রধান চরিত্র হচ্ছে রাক্ষসকূলের রাবণ ও মেঘনাদ। বাল্মীকির রামায়ণে রামের যে সাহসী ও ধীসম্পন্ন চরিত্র পাওয়া যায়, মেঘনাদবধ কাব্যে সেটি অনুপস্থিত। তবে যতই যা হোক রাবণ একজন রাক্ষসই, তার সে-পরিচয় নাকচ করে দেওয়া সম্ভব নয়। রাবণের আছে দশটি মুখ ও বিশটি হাত। সীতাকে অপহরণ ও বন্দী করে সে দুরাচারী বলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এমন একটি চরিত্রকে মানুষের মূর্তিতে বীর হিসেবে দাঁড় করানোটা কঠিন; মধুসূদন চেষ্টা করেছেন তাকে কেবল মানবিক নয় রামের তুলনায় উন্নত হিসেবে তুলে ধরতে। রাম ও তার দলবলকে তিনি যে পছন্দ করেন না সে-কথা তিনি একটি চিঠিতে পরিষ্কার বলেছেন, এবং মেঘনাদবধ কাব্যে মোটেই সে-সত্যটি অবগুণ্ঠিত থাকে নি। রাম এখানে সুযোগ পেলেই নিজেকে ভিখারী বলে উল্লেখ করে এবং অসংশোধনীয়রূপে আত্মকরুণায় ভোগে। তার নির্ভরতা নিজের শক্তির ওপর নয়; দেবদেবীদের অনুগ্রহ, বানর সৈন্যদের সহায়তা এবং বিভীষণের দেশদ্রোহিতার ওপর।
মধুসূদনের লেখা সামাজিক প্রহসন বুড় শালিকের ঘাড়ে রোঁতে মুসলমান কৃষক হানিফ গাজী ও হিন্দু ব্রাহ্মণ পঞ্চানন বাচস্পতি জমিদার ভক্তপ্রসাদের দুরাচারের বিরুদ্ধে এক সঙ্গে দাঁড়ায় এবং জমিদারকে রীতিমত হেনস্তা করে। এমন ঐক্য বঙ্কিমচন্দ্রের অসহায় কৃষক পরাণ মণ্ডল ও হাসিম শেখের পক্ষে গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি, এবং বঙ্কিমচন্দ্র যে সেটা চেয়েছেন এমনও নয়; তিনি বরঞ্চ কৃষকের ঐক্যকে ভয় পেয়েছেন। বঙ্কিম-প্রচারিত হিন্দুত্বে প্রত্যাবর্তন কৃষকের ঐক্য ও মুক্তিকে সাহায্য করবে কি উল্টো কঠিন করে তুলেছে।
মাইকেল সম্পর্কে বঙ্কিমের উদ্ধৃতিটির দ্বিতীয় অংশে ইউরোপের সহায়তার প্রসঙ্গ এসেছে। ওই সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে, এবং সুপবন বইছে, কাজেই পতাকা উড়বে বলে বঙ্কিমচন্দ্র ভরসা করেছেন। ইউরোপের সহায়তার ব্যাপারে মধুসূদনের আগ্রহ ও উৎসাহ মোটেই কম ছিল না; দৃশ্যত সেটা বরঞ্চ ছিল ভীষণ উগ্র। তিনি ইংরেজি ভাষায় কবিখ্যাতি অর্জন করতে চেয়েছিলেন, চেষ্টাও করেছেন, কিন্তু তার শিল্পীসত্তা তাকে জানিয়ে দিয়েছে যে, ওই পথ ভ্রান্ত, তাকে বাংলাভাষার কবিই হতে হবে, এবং সেটাই তিনি হয়েছেন। বাঙালি কবি হওয়ার জন্য ইংরেজি তথা ইউরোপীয় সাহিত্য থেকে তিনি অনেক কিছু দু’হাতে গ্রহণ করেছেন। ইউরোপের বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য তিনি পড়েছেন। তার সামনে মিল্টন ছিলেন, যেখান থেকে অমিত্রাক্ষর ছন্দে মহাকাব্য লেখার ধারণাটা পেয়েছেন। আদর্শ হিসেবে ছিলেন স্বয়ং হোমার, যাকে তিনি ইউরোপের একাংশের বাল্মীকি মনে করতেন। মেঘনাদবধ কাব্যে হোমারের ইলিয়াড-এর প্রভাব মোটেই অস্পষ্ট নয়। হেক্টর বধ নামের একটি রচনায় ইলিয়াড-এর উপাখ্যানকে তিনি বাংলায় উপস্থিত করার উদ্যোগও নিয়েছিলেন। তার ওই উপস্থাপনায় উল্লেখ আছে যে, হেক্টরকে ট্রয়ের মেঘনাদ বলা যেতে পারে। মধুসূদনের নাট্যরচনায় শেকস্পীয়রের প্রভাব রয়েছে, সনেটে পেত্রার্কের। কিন্তু সবই সহায়তা, ঋণ নয়। এই সহায়তা তাকে মোটেই নত করে নি।
মধুসূদন যে মনেপ্রাণে বাঙালি ছিলেন সে-সম্পর্কে তার উক্তিগুলো স্বতঃস্ফূর্ত ও আন্তরিক। নিজের সমাধির জন্য যে-লিপিটি তিনি তৈরি করে রেখেছিলেন সেটি সুপরিচিত। তাতে তিনি মাইকেলের কথা বলেন নি, দত্তকুলোদ্ভব কবি মধুসূদন হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়েছেন, জন্ম যার যশোহরের সাগরদাঁড়িতে, জন্মদাতা রাজনারায়ণ, জননী জাহ্নবী। বিদেশে বসবাসরত অবস্থায় যে সনেটগুলো তিনি লিখেছিলেন তাদের ভেতর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বঙ্গভাষা-বিষয়ক রচনাটি; যেখানে তিনি বলছেন যে বাংলাভাষার ভাণ্ডারে আছে বিবিধ রতন, এবং সে-সব উপেক্ষা করে পরধন-লোভে মত্ত হয়ে পরদেশে ভ্রমণ করেছেন দেখে নিজেকে তিনি ধিক্কার দিচ্ছেন। তার চোখে তার নিজের আচরণ ছিল ভিক্ষুকের। এ যেন শৈবাল নিয়ে খেলা-করা, কমল-কাননকে উপেক্ষা করে। সৌভাগ্যক্রমে কুললক্ষ্মী তাকে উপেক্ষা করেননি, বরঞ্চ স্নেহ করেছেন, স্বপ্নে দেখা দিয়ে তাকে বলেছেন, ‘যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যারে ফিরি ঘরে।’ সে-আজ্ঞা তিনি পালন করেছেন, এবং বিনিময়ে যা লাভ করেছেন তা হলো মাতৃভাষারূপ খনি, ‘পূর্ণ মনিজালে।’ ভিক্ষাবৃত্তি তার কাছে গ্লানিকর ও দুঃসহ বোধ হয়েছে। প্রবাসে থাকাকালে তিনি তার গ্রামের নদী কপোতাক্ষের কথা স্মরণ করেছেন, এবং তার মনে হয়েছে যে বহুদেশ ও বহু নদী তো দেখলেন, কিন্তু স্নেহের তৃষ্ণা কি মেটে অন্য কারো জলে, ‘দুগ্ধস্তনরূপী’ ‘জন্ম-ভূমি-স্তন’ ভিন্ন? সনেট-সংগ্রহের শেষ কবিতাটিও বাংলাভাষাকে নিয়েই।
তার গীতিকবিতাগুলোর একটিতে প্রবাসী কবি বঙ্গভূমির কাছে যে নিবেদনটি জানিয়েছেন সেটা হৃদয়স্পর্শী; ‘রেখো, মা, দাসেরে মনে, এ মিনতি করি পদে।’ আসলে বাইরে যতই সাহেবী ও বিদেশী হোন না কেন ভেতরে, অর্থাৎ যেখানে তিনি শিল্পী সেখানে, তার দাঁড়াবার জায়গাটা ছিল দেশের ভেতরেই, সেখানে তিনি অসংশোধনীয়রূপে বাঙালি। এ বিষয়ে তার নিজেরই একটি সাহিত্য-বহির্ভূত উক্তি আছে, যেটি তিনি করেছিলেন ১৮৭১ সালে, ঢাকায়, একটি সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে। বলেছিলেন, “আমার সম্বন্ধে আপনাদের যে কোনো ভ্রমই হোক আমি সাহেব হইয়াছি এ ভ্রমটি হওয়া ভারি অন্যায়। আমার সাহেব হইবার পথ বিধাতা রোধ করিয়া রাখিয়াছেন। আমি আমার বসিবার ও শয়ন করিবার ঘরে একখানি আর্শি রাখিয়া দিয়াছি এবং আমার মনে সাহেব হইবার যেমনি লোভ হয় অমনি আর্শিতে মুখ দেখি।
আরো, আমি শুধু বাঙালি নহি, আমি বাঙ্গাল, আমার বাটি যশোহর।”
এই বাঙালির বঙ্গভূমি তার রচনার এমন স্থানেও পাওয়া যাবে যেখানে তা অপ্রত্যাশিত। যেমন তিলোত্তমাসম্ভব কাব্যে, যেখানে ঘটনার মূল হচ্ছে ধবলগিরি, হিমাদ্রীর শিখরে। সেখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্যের বর্ণনায় কবি উপস্থিত করেছেন বাংলার শাল তাল নারিকেল গুবাক চালিতা জাম তেঁতুল কাঁঠাল, এসব গাছকে। মেঘনাদবধ কাব্যেও বাংলার প্রকৃতি ও মানুষের জীবনযাপনের অনুষঙ্গ উপস্থিত রয়েছে। যেমন, স্বর্গের বর্ণনায় আছে, “ডাকিল ফিঙ্গা, আর পাখী যত”; রয়েছে বঙ্গে শারদ-পার্ব্বণের আনন্দ্যোৎসবের তুলনা। অপরদিকে লঙ্কায় প্রভাতবেলায় যে বাজনা শোনা যায় সে যেন বঙ্গগৃহে দেবদোলৎসব বাদ্য। প্রমীলা অসামান্যা নারী, রাক্ষসকূলবধূ, তার সিঁথিতে দেখা যায় সিঁদুর; সে মেয়ে যেমন পতিভক্ত তেমনি শ্বাশুড়ীর প্রতি দায়বদ্ধ। সুরমাকে দেখি সীতার কপালে সিঁদুর পরিয়ে দিচ্ছে। যোদ্ধাবেশে প্রমীলা যাবে স্বামীর কাছে, যাওয়াটা কঠিন, রামের বাহিনী লঙ্কাপুরী ঘিরে রেখেছে, কিন্তু প্রমীলা যাবেই, প্রয়োজনে শত্রু সেনাদের বধ করবে, বাহুবলে পরাজিত করবে রামকে। কিন্তু সেই সঙ্গে কটাক্ষ করে জানায় সে তার সঙ্গীদেরকে যে তার কৌতূহল আছে রামকে দেখার, “দেখিব যে রূপ দেখি সূর্পণখা পিসী/মাতিল মদন-মদে পঞ্চবটী-বনে।” প্রমীলার মহিলা দূত যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। সেও বৈরীপক্ষের দিকে কটাক্ষপাতের সুযোগ ছাড়ে না। লক্ষ্মণ যখন অন্যায় যুদ্ধে নিরস্ত্র, প্রার্থণারত মেঘনাদকে দৈববলে বলী হয়ে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছে এবং অসহায় মেঘনাদ হাতের কাছে যা পাচ্ছে—শঙ্খ, ঘণ্টা, উপহার সামগ্রী—সব লক্ষ্মণের দিকে ছুঁড়ে মারছে তখন লক্ষ্মণের কিছুই হচ্ছে না, কেননা অদৃশ্য অবস্থায় থেকে মায়াদেবী নিক্ষিপ্ত বস্তুগুলোকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে, ঠিক যে-ভাবে একজন বঙ্গবাসী মাতা “খেদায় মশকবৃন্দ সুপ্ত সূত হতে/করপদ্ম সঞ্চালনে।” এর পরে লক্ষ্মণের অস্ত্রাঘাতে মেঘনাদ দেবালয়ের মেঝেতে পড়ে গেছে; কবি বলছেন তার রুধির ‘বহে বরিষার কালে যথা জলধারা’। সমুদ্রের বর্ণনাতেও বর্ষার উপমা আছে, ‘বহিছে জলস্রোত কলরবে/স্রোতঃপথে জল যথা বরিষার কালে।’ মেঘনাদবধ কাব্যের সমাপ্তি মেঘনাদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। আর্দ্র অশ্রুনীরে রক্ষোদল লঙ্কায় ফিরে গেছে, এবং তার পরে, ‘বিসর্জ্জি প্রতিমা যেন দশমী দিবসে/সপ্ত দিবা-নিশি লঙ্কা কাঁদিলা বিপদে।’
অন্যত্র উপমা আছে জলশূন্য নদীর এবং বাঁধ-ভাঙা জলস্রোতের। খুবই অপ্রত্যাশিত একটি উপমা পাওয়া যায় প্রথম সর্গে। সেখানে পুত্রশোকে কাতর রাবণ বিলাপ করছে। অন্যসব কথার মধ্যে বলছে সে “বরজে সজারু পাশে যথা/ ছিন্ন ভিন্ন করে তারে, দশরথাত্মজ/ মজাইল লঙ্কা মোর।” তুলনাটি পানের খেতে সজারুর ধ্বংসলীলার। অনুমান করা হয় যে কবি অসতর্ক ছিলেন, নইলে স্বর্ণলঙ্কায় বাংলার পানচাষ এভাবে প্রবেশাধিকার পায় কী করে। কিন্তু সত্য এটাই যে মধুসূদনের পক্ষে বাংলাকে ভোলাটা সম্ভব ছিল না।
এই মহাকাব্যে মধুসূদনের অভিপ্রায় ‘বীর রসে ভাসি’ মহাগীত গাইবার। মহাগীত তিনি অবশ্যই গেয়েছেন, তবে বীর রসের নয়, করুণ রসের বটে। মেঘনাদবধ কাব্যের সমাপ্তি নয় শুধু, সূচনাও করুণ রসের ভেতর দিয়েই। এ কাব্যে বীরত্ব আছে অবশ্যই, কিন্তু কান্নাই প্রধান সত্য। শুরুতেই দেখি মহাবীর রাবণ পুত্র বীরবাহুর শোকে ক্রন্দনরত। সমাপ্তি রাবণসহ লঙ্কাবাসীর অবিরল অশ্রুপাতে। এ কাব্যে সীতা কাঁদে, রাম কাঁদে, কাঁদে প্রমীলা ও মন্দোদরী, কাঁদে বীরবাহুর মাতা চিত্রাঙ্গদা, কাঁদে লঙ্কাবাসী, এমন কি দেশদ্রোহী বিভীষণকেও দেখা যায় কাঁদতে। দেবরাজ ইন্দ্র কাঁপে ইন্দ্রজিতের ভয়ে।
এই যে বীররসের কাব্য তিনি রচনা করতে পারলেন না, এর কারণ যে কেবল ব্যক্তিগত তা বোধ হয় নয়; ধারণা করা অসঙ্গত নয় যে, এর সঙ্গে জাতিগত অপারগতাও জড়িত। বাঙালি তখন পরাজিত জাতি, মধুসূদনদের মতো অসাধারণ মানুষদের উচ্চাকাক্সক্ষাও তখন ইংল্যান্ডে যাওয়া ও ব্যারিস্টার হওয়ার সঙ্কীর্ণ বলয়ের বাইরে যেতে অপারগ। সেকালে মেধাবানদের পক্ষে জীবিকার সরল পথ ছিল একটাই, সরকারি চাকুরী। মধুসূদন সরকারি চাকুরীতে উৎসাহী ছিলেন না, যে জন্য তিনি বিলেতে আইসিএস হবার জন্য যান নি, গেছেন ব্যারিস্টার হওয়ার জন্য। কিন্তু উপনিবেশের বাস্তবতা এমনই যে তখন ট্র্যাজেডি রচনা করাটাই স্বাভাবিক ছিল, মধুসূদনও সেটাই করেছেন, মহাকাব্যের ভেতরে ট্র্যাজেডিকে স্থাপন করেছেন। রাবণের যে চরিত্র তিনি সৃষ্টি করেছেন, সেটি বাল্মীকির নয়, একান্তই তাঁর নিজস্ব। আর ওই চরিত্রের মহিমা এইখানে যে, সে একটি ট্র্যাজেডির নায়ক, যে-ট্র্যাজেডি একাধারে ব্যক্তিগত ও জাতীয়। রাম ও তার বানরবাহিনীর দ্বারা যারা পর্যুদস্ত হচ্ছে তারা কোনো একটি পরিবারের সদস্য মাত্র নয়, তারা সমগ্র লঙ্কার প্রতিনিধি। তাদের দুঃখে তাই সমস্ত লঙ্কা শোকাভিভূত হয়, তাদের বীরত্বে যেভাবে উদ্দীপ্ত হয় দেশের সমগ্র জনসাধারণ।
লক্ষণীয় যে কেবল মেঘনাদবধ নয়, তার অধিকাংশ রচনাই দুঃখে ভারাক্রান্ত, যদিও ব্যক্তিগত জীবনে মধুসূদন ছিলেন অত্যন্ত আশাবাদী ও অপরিমেয় দুঃসাহসী। জাতিগত অবস্থাটা ছিল বীরত্বহীন ও হতাশাগ্রস্ত। তার সময়ে খুব বড় একটা ঘটনা ঘটে, সেটা হলো ১৮৫৭ সালের সিপাহী অভ্যুত্থান। কিন্তু বাঙালি মধ্যবিত্তের মনে সে-অভ্যুত্থান কোনো ইতিবাচক সাড়া তৈরি করে নি। ওই মধ্যবিত্ত বরঞ্চ অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছিল, নিজেদের স্বার্থে।
মাদ্রাজে আট বছর খ্রিস্টান ও ইংরেজদের সংস্রবে কাটিয়ে মধুসূদন কলকাতায় ফেরেন ১৮৫৬ সালে, সেখানে ছিলেন ১৮৬২ সাল পর্যন্ত। কিন্তু তার কোনো রচনাতে তো নয়ই, চিঠিপত্রেও ১৮৫৭-এর সারা ভারতজুড়ে সিপাহী বিদ্রোহের উল্লেখ মাত্র নেই। তবে এটা মোটেই বিস্ময়কর নয়, বরঞ্চ খুবই স্বাভাবিক। কেননা যে-সমাজের সঙ্গে তার যোগাযোগ তারা সিপাহীদের কাজটাকে মোটেই শুভ বলে ধারণা করে নি। তবে মহাকাব্য রচনার জন্য আবশ্যকীয় বীরত্বপূর্ণ কল্পনা মধুসূদনের নিজের ভেতরই ছিল, মনীষার সঙ্গে সমাজবিদ্রোহ ও উচ্চাকাক্সক্ষার সংযোগেই সেটা তৈরি হয়েছে। অনেকদিক দিয়েই তিনি সে-কালের রক্ষণশীলদেরকে তো অবশ্যই, ইয়ং বেঙ্গলকেও ছাড়িয়ে গিয়েছেন। তার সমসাময়িক হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও নবীনচন্দ্র সেনও মহাকাব্য লিখেছেন, তারাও মনীষাসম্পন্ন ছিলেন, কিন্তু মধুসূদনের সাফল্য তারা অর্জন করতে পারেন নি। এর একটা কারণ, হয়তো-বা প্রধান কারণই, এই যে তাদের ভেতর মধুসূদনের বীরত্ববোধ ছিল না; সাহসী ছিলেন, কিন্তু দুঃসাহসী হওয়াটা তাদের জন্য ছিল সাধ্যাতীত। স্মরণীয় যে হেমচন্দ্র বড় হয়েছিলেন কঠিন দারিদ্র্যের ভেতর এবং নবীনচন্দ্র ছিলেন একজন সরকারি কর্মচারী।
যে-কবিকে মধুসূদন মূল আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন সেই জন মিল্টন ইংরেজি সাহিত্যের একমাত্র সার্থক মহাকাব্য প্যারাডাইজ লস্ট রচনা করতে পেরেছিলেন। আমরা লক্ষ্য করি যে, মিল্টনও ছিলেন বিদ্রোহী ও দুঃসাহসী। তার কালের পিউরিটান বিপ্লবে তিনি সরাসরি অংশ গ্রহণ করেন। বিপ্লবের নায়ক ক্রমওয়েল-প্রতিষ্ঠিত সরকারে তিনি সচিবদের একজন হিসাবে কাজ করেছেন। তার দায়িত্ব ছিল ইউরোপের বিভিন্ন রাজ্য থেকে উত্থিত আক্রমণের মুখে পিউরিটানদের বক্তব্যগুলো কূটনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যমে উপস্থাপন করা। কাজটি করতে হতো ল্যাটিন ভাষায়। এবং এটি তিনি মনেপ্রাণে করেছেন। তার দৃষ্টিশক্তি সবসময়েই ক্ষীণ ছিল, বিপ্লবের কাজে অত্যধিক পরিশ্রমের দরুন তিনি সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যান। প্যারাডাইজ লস্ট তিনি দৃষ্টিহীন অবস্থাতেই রচনা করেন; কলমে লিখে নয়, মুখে মুখে। এই কাব্য রচনার সময় মিল্টন চরম সঙ্কটে ছিলেন। বিপ্লবী উদ্যোগ পরাভূত হয়েছে, রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঘটেছে, পিউরিটানরা বিধ্বস্ত ও হতাশাগ্রস্ত; তিনি গ্রেফতার ও নিগৃহীত হয়েছেন, সম্পত্তি হারিয়েছেন, চোখে দেখেন না। কিন্তু পরাভব মানেন নি। প্যারাডাইজ লস্টে বীরত্ব আছে, কিন্তু সে-বীরত্ব কর্তৃত্বপরায়ণ ঈশ্বরের নয়, ঈশ্বরবিদ্রোহী স্যাটানের; যে-স্যাটানের জাগতিক প্রতিরূপ ছিলেন ক্রমওয়েল। সন্দেহ করা হয়, এবং সে-সন্দেহ মোটেই অমূলক নয় যে, মিল্টন ছিলেন স্যাটানের পক্ষে। মহাকাব্যটির কেন্দ্রে আছে এ্যাডাম ও ঈভের ঈশ্বরাদেশ অমান্য করার ঘটনা। সেও এক বিদ্রোহ বটে। সে-বিদ্রোহের পরিণতিটা করুণ; আদি পিতা-মাতা এ্যাডাম ও ঈভের স্বর্গচ্যুতি। মিল্টনকে জয়ের নয়, পরাজয়ের কাহিনীই লিখতে হয়েছিল।
লেখকঃ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

No comments:

Post a Comment