কৃষির উন্নয়নে তথ্যপ্রযুক্তির ভূমিকা

কৃষির টেকসই উন্নয়নের জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনেক তথ্যপ্রযুক্তি রয়েছে।এসব তথ্য প্রযুক্তি কৃষকের ব্যবহার উপযোগী ও সহজবোধ্য করে স্বল্পসময়ের মধ্যে তাদের দোড়গোয়ায় পোঁছে দিতে পারলে উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষকের আর্থসামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার ব্যাপক উন্নতি হবে। জীবনযাত্রার মান বাড়বে। কৃষি লাভজনক ও ঝুঁকিমুক্ত হবে। তরুণ উদ্যোক্তারা এ খাতে এগিয়ে আসবে। কৃষিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার হবে—এতে সংশয়ের কোনো অবকাশ নেই।
সারাদেশে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ১৩ হাজার কৃষি কর্মী আছেন। আর কৃষি পরিবার রয়েছে ১ কোটি ৬২ লাখ। এই বিপুল সংখ্যক কৃষি পরিবারেরর মধ্যে আধুনিক লাগসই প্রযুক্তি পৌঁছে দিতে তথ্যপ্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে ই-কৃষি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ই-কৃষি হলো-ইলেকট্রনিক প্রবাহের মাধ্যমে কৃষিবিষয়ক তথ্য সরবরাহের একটি আধুনিক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় ইন্টারনেট, রেডিও, টেলিভিশন ও মোবাইল ফোন ইত্যাদি ইলেকট্রকি যন্ত্রের মাধ্যমে দ্রুততার সঙ্গে কৃষির জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য নির্ভরযোগ্যভাবে কৃষক, কৃষি উপকরণ ও পণ্য ব্যবসায়ী, গবেষক, সম্প্রসারণ কর্মী, পরিকল্পনাবিদ এবং ভোক্তা ইত্যাদি গোষ্ঠির কাছে পৌঁছে দেয়া হয়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়—মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট কৃষকের জন্য বিনামূল্যে অনলাইন সার সুপারিশ সেবা চালু করেছে। বাংলাদেশের সব অঞ্চলের মাটি গবেষণা করে দীর্ঘ ৫ বছরের চেষ্টায় ফসলের অধিক উৎপাদন ও সুষম মাত্রার সার প্রয়োগের লক্ষ্যে একটি সফটওয়্যার উদ্ভাবন করে এই প্রতিষ্ঠানটি। সফটওয়্যারের মাধ্যমে জানা যাবে কৃষি জমিতে কোনো সার কী পরিমাণ প্রয়োগ করতে হবে? এই অনলাইন ফার্টিলাইজার রিকমেন্ডেশন সিস্টেম সফটওয়্যার ব্যবহার করে মাটির পুষ্টিমানের তথ্য, ফসলের পুষ্টি চাহিদা ও সারে পুষ্টি উপাদানের পরিামাণ বিশ্লেষণ করে সার প্রয়োগের নির্দেশনা পাবে কৃষক। এর ফলে ফসল ভেদে ২০ থেকে ৩০ ভাগ ফলন বাড়বে। গাছের স্বাস্থ্য ভাল থাকবে। রোগ-বালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ কম হবে। উৎপাদন খরচ হ্রাস পাবে। মাটির স্বাস্থ্য ভাল থাকবে। তাই এই সেবা কৃষকের কাছে দ্রুত পৌঁছে দেওয়া প্রয়োজন। ইউনিয়ন তথ্য সেবা কেন্দ্র, বাংলালিংকের ৭৬৭৬ নম্বরে ফোন করে অথবা গ্রামীণ সিআইসি থেকে যেকেউ এই সেবা গ্রহণ করতে পারেন।
বেসরকারি সংস্থাগুলোর চেয়ে সরকারি সংস্থাগুলোর প্রতি কৃষকের আস্থা ও বিশ্বাস বেশি । তাই প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারের স্বার্থে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলিকে একযোগে কাজ করতে হবে। আগে কৃষক পূর্বপূরুষের নিকট থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান ও নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে কাজ করতেন। এখন অনেক ধরনের প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়েছে। তাই অভিজ্ঞতার সঙ্গে প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটাতে হবে। দেশের চিনিকলগুলোতে এক সময় আখ চাষিরা সময় মতো পুর্জি না পেয়ে আখ বিক্রি করতে নানা হয়রানির সম্মুখীন হতেন। এখন ই-পুর্জি প্রবর্তনের ফলে সেই সমস্যা নেই। কৃষক মুঠোফোনের ক্ষুদে বার্তার মাধ্যমে আগাম পুর্জি প্রাপ্তির খবর পেয়ে আখ কর্তন করে সময় মতো মিলে আখ সরবরাহ করতে পারেন। এতে মিলগুলি দৈনিক মাড়াই ক্ষমতা মোতাবেক সতেজ ও টাটকা আখ পায় এবং আখ বিক্রিতে চাষির সমস্যায় পড়তে হয় না। আখের মতো ধান, গম ও ভূট্টাসহ অন্যান্য কৃষি পণ্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রে এধরনের প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষকের কষ্ট লাঘব করা যায় কিনা ,তা আমাদের ভেবে দেখতে হবে। কৃষকের পণ্য ভালোভাবে বাজারজাত করতে অনলাইনভিত্তিক কৃষি বাজার প্রতিষ্ঠা করার একটি পরিকল্পনা রয়েছে এ প্রতিষ্ঠানটি। অল্প সময়ের মধ্যেই হয়তো কৃষক বাংলালিংক থেকে কৃষিপণ্য বিক্রির ব্যাপারে এধরনের একটি ভাল সেবা পাবেন। গ্রামীণ ফোনের ২৭৬৭৬ নম্বরের কল করেও কৃষিবিষয়ক সেবা পাওয়া যায়। দেশে কৃষি পরিবারের সংখ্যা এক কোটি ৬২ লাখ হলেও এ তথ্য সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে গ্রামীণ ফোন হাজারের ঘরে আটকে আছে। গ্রামীণফোনের এই সেবা গ্রহণে কৃষককে পয়সা দিতে হয় এবং সেবার মানও প্রশ্ন সাপেক্ষ। দেশের সব কৃষকের কাছে তথ্যসেবা দিতে হলে কৃষকের প্রায়োগিক জ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির মধ্যে সমন্বয়ের ব্যবস্থা করতে হবে এবং সেবার মান হতে হবে অনেক উন্নত। দেশে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে কম্পিউটার ও ল্যাপটপের ব্যবহার কমছে, বাড়ছে, মোবাইল ফোন, স্মার্টফোন ও ট্যাবের ব্যবহার।
বর্তমানে প্রায় ১২ কোটি ১৮ লাখ মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করছেন। আর ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন ৪ কোটি ২৭ লাখ মানুষ। এর মধ্যে ৪ কোটি ১৩ লাখ মানুষ মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন। এ ছাড়া স্মার্ট ফোনের সংখ্যা বেড়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। ২০১২ সালে যেখানে ১% লোক স্মার্ট ফোন ব্যবহার করতেন, সেখানে ২০১৩ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৭%এ। ফলে সামনের দিনগুলোয় তথ্যসেবার বিস্তারে প্রযুক্তির ব্যবহার বদলের বিষয়টি মাথায় রেখে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও আইসিটি মাধ্যমে কৃষি সংশিষ্টদের কাছে সময়োপযোগী কৃষি তথ্য পৌঁছে দেওয়াই কৃষি তথ্য সার্ভিসর কাজ। এ লক্ষ্যে কৃষি তথ্য সার্ভিস থেকে পরিচালিত ‘কৃষিকল সেন্টার’ এ যেকোনো অপারেটর থেকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ১৬১২৩ নম্বরে ফোন করে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে যে কেউ কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিষয়ক সমস্যার সমাধান পেতে পারেন। শুক্রবার ও সরকারি ছুটির দিন ছাড়া সপ্তাহের অন্যান্য দিন সকাল ৯ টা থেকে ৫টা পর্যন্ত এই সেবা পাওয়া যায়। অন্যদিকে তৃণমূল পর্যায়ে তথ্য বিস্তারের জন্য কৃষি তথ্য সার্র্ভিস ২৪৫টি কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র (এআইসিসি) স্থাপন করেছে। এআইসিসি থেকে কৃষক ও কৃষি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তথ্য সেবা গ্রহণ করতে পারেন। এছাড়া কৃষি মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পেজ; কৃষি ভাবনা থেকেও কৃষিকার্যক্রমের বিভিন্ন তথ্য, সাফল্য ইত্যাদি জানা যায়। সরকারি সংস্থার পাশাপাশি রুরাল ইনফো বিডি, এগ্রো বাংলা, কৃষিবাংলা ও সিনজেন্টা প্রভৃতি বেসরকারি ওয়েবসাইট কৃষি তথ্য ও কৃষি প্রযুক্তি পসারে ভূমিকা রাখছে। এছাড়া কৃষি প্রযুক্তি পাঠাগার, কৃষি তথ্য নামের বিভিন্ন ফেসবুক পেজে কৃষিবিষয়ক বিভিন্ন তথ্য ও প্রযুক্তি সরবরাহ করা হচ্ছে।
সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কৃষকে যেসব তথ্যপ্রযুক্তি দিচ্ছে তা কৃষকরা কতটুকু মাঠে প্রয়োগ করছেন তার ওপরই নির্ভর করছে এর সফলতা। তাই তথ্যসেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে কৃষকের চাহিদার বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। দেশে কৃষির উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগ, প্রসার ও কৃষকের সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাটি ও মানুষ , চ্যানেল আইয়ের হৃদয়ে মাটি ও মানুষ, বাংলা ভিশনের শ্যামল বাংলা এবং বৈশাখী টেলিভিশন থেকে কৃষি ও জীবন নামে বেশ কিছু অনুষ্ঠান প্রচারিত হচ্ছে। এসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কৃষিবিষয়ক নতুন নতুন তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে অবগত হচ্ছেন এবং তা মাঠে প্রয়োগ করে উপকৃত হচ্ছেন অসংখ্য কৃষক। যেহেতু কৃষি এদেশের উন্নয়নের চাবিকাঠি এবং প্রায় ৫০ ভাগ মানুষের জীবন-জীবিকা এর সঙ্গে জড়িত, তাই গ্রামীণ অর্থনীতিকে বেগবান ও গতিশীল করার জন্য দেশে একাধিক পূর্ণাঙ্গ কৃষিভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল চালু করা প্রয়োজন।
এছাড়া প্রত্যেকটি টেলিভিশন চ্যানেলে কৃষকের অবসর সময়ে প্রতি সপ্তাতে কমপক্ষে একঘণ্টা কৃষিভিত্তিক অনুষ্ঠান প্রচারের বিষয়টি বাধ্যতামূলক করতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষক কীভাবে লাভবান হতে পারেন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো- নাবী ধ্বসা রোগ। নাবী ধ্বসা আলুর একটি মারাত্মক ছত্রাকবাহিত রোগ। এ রোগের কারণে প্রতি বছর আলু ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। শীতকালে ঘনকুয়াশা পড়লে বা আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে এই রোগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে এবং দু’এক দিনের মধ্যে আক্রান্ত ক্ষেত সম্পূর্ণভ বিনষ্ট হয়ে যায়। প্রতিষেধক ব্যবস্থা হিসেবে বিভিন্ন ছত্রাকনাশক স্প্রে করে এই রোগ থেকে আলু ফসলকে রক্ষা করা যায়। শীতকালে আলুর মৌসুমে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হলে বা ঘনকুয়াশা পড়া শুরু করলে নাবী ধ্বসা রোগ দমনের জন্য আলু চাষিদের মোবাইল ফোনের ক্ষুদে বার্তার মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করে এবং ছত্রাকনাশক স্প্রে করে মারাত্মক এই রোগ দমনের মাধ্যমে আলুর উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ান যেতে পারে। ঠিক একই রকমভাবে আম, লিচু ,কলা ও তরমুজসহ বিভিন্ন ফল, শাকসবজি ও দানা ফসল, মাছ , ডিম, মাংস ও দুধ উৎপাদন বৃদ্ধিতে আমরা ফেসবুক, টুইটার, ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন, স্মার্টফোন, ট্যাব, রেডিও এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলি ব্যবহার করে কৃষির টেকসই উন্নয়নে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি। এজন্য এসব ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি কৃষকের নিকট সহজলভ্য হতে হবে এবং ব্যবহার সম্পর্কে কৃষক ভাইদের যথেষ্ট জ্ঞান ও দক্ষতা থাকতে হবে।
লেখক: নিতাই চন্দ্র রায়, মহাব্যবস্থাপক (কৃষি), নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস্ লি., লালপুর, নাটোর
No comments:
Post a Comment