ভয়ংকর আত্মঘাতী নারী জঙ্গি

উগ্রবাদী জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছেন দেশের নারীরাও। মূলত স্বামীদের উৎসাহ ও নির্দেশেই ঝুঁকে পড়ছেন এই ধ্বংসাত্মক পথে। ধর্ম প্রচারের নামে এসব নারী জঙ্গি যেমন সংগঠিত করছেন অন্য নারীদের; তেমনি গোপনে দেশ ও দেশের বাইরে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেরাও পরিণত হচ্ছেন দুর্ধর্ষ জঙ্গিতে। নামে-বেনামে জঙ্গি সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কোমলমতি শিশু-কিশোরসহ নারীদের নিয়ে গোপন আস্তানা গড়ছেন। অপারেশনে অংশ নিচ্ছেন। এমনকি সুইসাইডাল স্কোয়াডে নাম লিখিয়ে বেছে নিচ্ছেন ভয়াবহ আত্মঘাতীর পথ। মরছেন নিজে। ধ্বংস হচ্ছে পরিবার। প্রাণ যাচ্ছে শিশুসন্তানদেরও।
র্যাব ও পুলিশ বলছে, সারাদেশেই জেএমবিসহ বিভিন্ন উগ্রবাদী জঙ্গি সংগঠনে এখন নারীদের রিক্রুট করা হচ্ছে। তাদের কাছে এর একটা তালিকাও আছে। তাতে দেড় সহস্রাধিক সক্রিয় সদস্য থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে হামলা চালানোর জন্য এই নারীদের ব্যবহারের পরিকল্পনা আছে উগ্রবাদীদের। নারী জঙ্গিরা জেলাপর্যায়ে পাড়া-মহল্লায় ধর্ম প্রচারের নামে ও ছোট ছোট সাপ্তাহিক ধর্মসভার আড়ালে কাজ করছে। নারীদের এই জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার কারণ হিসেবে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জঙ্গিবাদী তৎপরতায় নারীদের ব্যবহারের কিছু সুবিধা আছে। পর্দা করার কারণে তাদের শনাক্ত করা কঠিন এবং অস্ত্র-বিস্ফোরক বহনও তাদের জন্য সহজ। বিশেষ করে আত্মঘাতী হামলায় তাদের ব্যবহারে বাড়তি সুবিধা পেতে পারেন জঙ্গিরা।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নারী জঙ্গি বিষয়ে কথা বলেছেন। গত ২৫ জুলাই মন্ত্রিসভার বৈঠকে তিনি সতর্ক করে বলেন, জামায়াত-শিবির আগে থেকেই মাঠে রয়েছে। এখন তারা লেডি সুইসাইডাল স্কোয়াড গঠন করেছে। প্রধানমন্ত্রীর সেই বক্তব্যের পর দেশের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর হয়ে ওঠে।
গত ২৩ জুলাই সিরাজগঞ্জের এক বাসা থেকে চার নারী জঙ্গিকে আটকের পরই নারী জঙ্গিবাদের বিষয়টি সামনে চলে আসে। অন্য জেলা থেকে সেখানে এসে গোপন আস্তানা গড়েছিলেন এই নারী জঙ্গিরা। তারা সেখান থেকে জেএমবির জন্য তহবিল সংগ্রহ, সদস্য সংগ্রহ, সাংগঠনিক ও নাশকতামূলক কর্মকা- পরিচালনা করে আসছিলেন। এরপর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু নারী জঙ্গিদের আটক ও আস্তানা উদ্ধার করে র্যাব ও পুলিশ। সর্বশেষ আরেক নারী জঙ্গিদের আস্তানার সন্ধান মেলে রাজধানীর আশকোনায়। গত শনিবার সেখানে ‘সূর্য ভিলা’ নামে এক বাসায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চালানো অভিযানে ভয়ংকর জঙ্গি সুমনের স্ত্রী আত্মঘাতী হয়ে মারা যান। নিহত হয় রাজধানীর অভিজাত একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ুয়া আফিফ কাদেরী আদর নামের এক কিশোর।
পুলিশ বলছে, জঙ্গি সুমনও পুলিশের একটি অভিযানে নিহত হয়েছেন। আর কিশোর আফিফের বাবা তানভীর কাদেরী ও ভাই তাহরীর কাদেরীও পুলিশের জঙ্গিবিরোধী অভিযানে আত্মঘাতী হয়ে মারা যান। তবে জঙ্গিবাদে আত্মঘাতী বিস্ফোরণে নারী ও কিশোরের নিহত হওয়ার ঘটনাটি একেবারেই নতুন। তাই বিষয়টি এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তে নতুন ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট (সিটি) সূত্র থেকে জঙ্গিদের নারী শাখার কঠোর সিদ্ধান্তের কথা জানা গেছে। তাদের তথ্য অনুযায়ী, একেক পুরুষ জঙ্গি তাদের স্ত্রীদের দীক্ষা দিয়ে বলেছেন, ‘জিহাদের’ জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। কোনোভাবেই পুলিশের কাছে ধরা পড়া যাবে না। লড়াই করে ধরা পড়ে যাওয়ার আগে প্রয়োজনে আত্মাহুতী দিতে হবে। এরই অংশ হিসেবে আজিমপুরের অভিযানের সময় এক নারী জঙ্গি ক্ষুদ্রাস্ত্র ব্যবহার করে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। তবে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় পুলিশ তাকে ধরতে সমর্থ হয়। আজিমপুরের রাস্তায় ওই নারীর দুর্ধর্ষ আচরণ প্রত্যক্ষ করেছে সেখানকার মানুষ। অপর দুই নারী আস্তানা থেকে বের হতে না পেরে সেখানেই আত্মাহুতী দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। সর্বশেষ গত শনিবার রাজধানীর আশকোনায় রিপল-২৪ অভিযানে আত্মঘাতী বিস্ফোরণে নিহত হন জঙ্গি সুমনের স্ত্রী। কল্যাণপুর অভিযানে নিহত আরেক জঙ্গি মেজর জাহিদের স্ত্রী জেবুন্নাহার শিলা ও পলাতক জঙ্গি নেতা মাঈনুল ইসলাম মুসার স্ত্রী তৃষ্ণা মনি তাদের কন্যাশিশুসহ আত্মসমর্পণ করেন।
সিটি সূত্র আরো জানায়, পুলিশের জঙ্গিবিরোধী শক্ত অভিযানের মুখে পালিয়ে থাকা জঙ্গিরা তাদের স্ত্রীদের কাছে বার্তা দিয়ে জানিয়েছেন, তাদের খুঁজে পাওয়া না গেলে বা নিহত হলে জিহাদের প্রয়োজনে তারা নতুন সঙ্গী (স্বামী) বেছে নিতে পারবেন। তারা মারা গেলে যোগ্যতার বিচার না করে সংগঠনের সদস্যদের মধ্য থেকে যে কাউকেও বিয়ে করার নির্দেশনা রয়েছে নারী জঙ্গিদের প্রতি। নিজেদের আত্মরক্ষায় প্রশিক্ষণ নেওয়ার পাশাপাশি সন্তানদের জঙ্গি দীক্ষা দেওয়া এবং সংগঠনে নতুন ‘সিস্টার’ (বোন) বাড়ানোরও নির্দেশনা রয়েছে এসব জঙ্গি স্বামীর।
গত ১০ সেপ্টেম্বর পুরান ঢাকার আজিমপুরের আস্তানা থেকে গ্রেফতার হন তিন নারী জঙ্গি। তারা হলেন অভিযানে নিহত নব্য জেএমবির সংগঠক তানভীর কাদেরী ওরফে আবদুল করিমের স্ত্রী আবেদাতুল ফাতেমা ওরফে আশা, নব্য জেএমবির অপারেশনাল কমান্ডার পলাতক নুরুল ইসলাম মারজানের স্ত্রী শায়লা আফরিন প্রিয়তি ও পলাতক জঙ্গি বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেটের স্ত্রী ফেরদৌসী আফরিন। দুর্ধর্ষ এই তিন নারী জঙ্গি গত ১৭ অক্টোবর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তারা বলেছেন, স্বামীদের মাধ্যমেই তারা জঙ্গিবাদে জড়িয়েছেন। তাদের নির্দেশেই প্রশিক্ষণ নেওয়া থেকে শুরু করে হিজরতের মাধ্যমে নিজেদের ঘর ছেড়ে অনত্র (আজিমপুরের আস্তানায়) উঠেছিলেন। তাদের অন্যতম সমন্বয়ক নব্য জেএমবির প্রশিক্ষণ কমান্ডার নিহত মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলামের স্ত্রী জেবুন্নেসা শিলা। রূপনগরের আস্তানায় শিলার স্বামী নিহত হওয়ার পর তিনি আজিমপুরে তাদের কাছে আশ্রয় নেন। তবে পুলিশের অভিযানের আগেই শিলা আজিমপুরের আস্তানা ছেড়ে চলে যান।
র্যাবের একজন কর্মকর্তা বলেন, গত ৬ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানীর ফার্মগেট ও নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থেকে নারী জঙ্গি মারজিয়া আক্তার ওরফে সুমি, তার স্বামী শরিফুল ইসলাম, নাহিদা সুলতানা ও তার স্বামী আমিনুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদেও নারী জঙ্গি কার্যক্রমের চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। জঙ্গি মারজিয়া ওই সময় জানিয়েছিলেন, তিনি ফেসবুকের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে সংযুক্ত হন। পরে অন্তর্ভুক্ত হন জেএমবির থ্রিমা ও টেলিগ্রাম অ্যাপের বিশেষ দলে। পরে তাকে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের বিভিন্ন দৃশ্য, আহত শিশুদের ছবি, মেয়েদের ছবি, অসহায় মানুষের ছবি, কিছু হাদিস, যুদ্ধের বিভিন্ন ভিডিও ও খিলাফত-সংক্রান্ত তথ্য দিয়ে দীক্ষা দেওয়া হয়। এরপর তিনি গত ২০ আগস্ট ‘জিহাদে’র জন্য বাড়ি ছাড়ে। পরে সে সংগঠনের সিদ্ধান্তে শরীফুলকে গাজীপুরের সাইনবোর্ড এলাকায় গিয়ে বিয়ে করেন।
ভয়ংকর চার জঙ্গি পরিবার : আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তালিকা থেকে চার জঙ্গি পরিবারের তথ্য পাওয়া গেছে—ব্যাংক কর্মকর্তা তানভীর কাদেরী, সাবেক সেনাকর্মকর্তা মেজর জাহিদুল ইসলাম, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার বাসারুজ্জামান ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নুরুল ইসলাম মারজানের পরিবার।
তানভীর কাদরী : আদালতে দেওয়া তানভীর কাদেরীর যমজ ছেলেদের একজন তাহরীম কাদেরীর জবানবন্দি থেকে জানা যায়, তানভীর কাদেরী একসময় মুঠোফোন অপারেটর কোম্পানির বড় পদে চাকরি করতেন। সর্বশেষ দেশের একটি ব্যাংকে বড় কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। তার স্ত্রী আবেদাতুল ফাতেমা আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার বড় কর্মকর্তা। যমজ দুই ছেলে তাহরীম কাদেরী আর আফিফ কাদেরী পড়ত উত্তরার একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে। উত্তরার মতো অভিজাত এলাকায় ছিল তাদের বাসা। গত ১০ সেপ্টেম্বর পুরান ঢাকার আজিমপুরে জঙ্গিদের একটি আস্তানায় পুলিশের অভিযানের মুখে তানভীর কাদেরী গলা কেটে আত্মহত্যা করেন। ওই আস্তানা থেকেই আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় তার স্ত্রী আবেদাতুল ফাতেমা ও তাদের যমজ ছেলেদের একজন তাহরীম কাদেরী ওরফে রাসেলকে। সর্বশেষ গত শনিবার আশকোনার আস্তানায় পাওয়া গেল ওই দম্পতির অপর ছেলে আফিফ কাদেরীর লাশ। ওই কিশোর নিজে শরীরে সুইসাইড ভেস্ট বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আত্মহত্যা করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সস্ত্রীক জঙ্গিবাদে সাবেক মেজর জাহিদ : মেজর জাহিদুল ইসলাম সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে জড়িয়েছিলেন নৃশংস জঙ্গিবাদে। হয়েছিল নব্য জেএমবির সামরিক কমান্ডার। গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলাকারী জঙ্গিদের প্রশিক্ষকও ছিলের তিনি। জাহিদ নিজের স্ত্রী জেবুন্নাহার শিলাকেও দীক্ষা দিয়েছেন জঙ্গিবাদে। অবশ্য গত ২ সেপ্টেম্বর রূপনগরে পুলিশের অভিযানে নিহত হন জাহিদুল ইসলাম। গত শনিবার আশকোনার জঙ্গি আস্তানা থেকে মা ও ভাইয়ের আহ্বানে সাড়া দিয়ে পুলিশের হাতে সন্তানসহ গ্রেফতার হন জেবুন্নাহার শিলা।
আইটি বিশেষজ্ঞ বাসারুজ্জামান ও স্ত্রী শারমিন : নব্য জেএমবির আইটি বিশেষজ্ঞ পলাতক বাসারুজ্জামান ওরফে চকলেট একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। নিজের পছন্দেই বিয়ে করেছিলেন ইডেন মহিলা কলেজের মাস্টার্সের ছাত্রী ফেরদৌসী আফরিন ওরফে শারমিনকে। এরপর দুজনই জড়িয়েছেন জঙ্গিবাদে। ১০ মাস বয়সী মেয়ে সাবিহা জামানকে নিয়ে এ দম্পতি মাসের পর মাস চালিয়েছেন জঙ্গিকার্যক্রম। তবে শারমিনকে ধরা গেলেও এখনো পলাতক বাসারুজ্জামান। গত ১০ সেপ্টেম্বর আজিমপুরের জঙ্গি আস্তানা থেকে শারমিন পুলিশকে গুলি করে পালানোর চেষ্টা করেন। তবে স্থানীয় মানুষের সহায়তায় তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছিল। তার ১০ মাস বয়সী মেয়ে নানার জিম্মায় রয়েছে।
মারজান-প্রিয়তি দম্পতি : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র নুরুল ইসলাম মারজান ছাত্র অবস্থাতেই প্রেম করে বিয়ে করেন খালাতো বোন আফরিন ওরফে প্রিয়তিকে। এর মধ্যে মারজান হোলি আর্টিজান রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন জঙ্গি হামলায় অংশ নিয়েছেন। নব্য জেএমবির ন্যাশনাল অপারেশন কমান্ডারও তিনি। তার স্ত্রী নব্য জেএমবির নারী শাখার অন্যতম সংগঠক। গত ১০ সেপ্টেম্বরে আজিমপুরের আস্তানায় অভিযানের সময় সন্তানসম্ভবা প্রিয়তি অস্ত্র হাতে পুলিশকে প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। অবশ্য তাকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিলে এ দম্পতির জঙ্গি কর্মকাণ্ডের ভয়ংকর সব তথ্য উঠে আসে। তবে মারজান এখনো পলাতক।
No comments:
Post a Comment