
বড়দিনের আমেজটা ঠিক জমছিল না। এই গানটা বাজালে কেমন হয়, ভাবতে ভাবতে একুশ বছরের পুরনো একটা অ্যালবাম তুলে নিলেন রেডিও জকি জো। এক বার চালিয়ে মনে হলো, বেশ অন্য রকম তো, আর এক বার চালালে হয় না? দু’বার... তিন বার... দশ বার, একই গান বেজে চলেছে অস্ট্রিয়ার এফএম চ্যানেলে। হতভম্ব রেডিও স্টেশনের বাকি কর্মীরা। ফোনের পর ফোন শ্রোতাদের— হচ্ছেটা কী! কিন্তু জো-কে থামানোই মুশকিল। চব্বিশ বার বাজানোর সময় ফোন এলো জো-এর চার বছরের মেয়ের কাছ থেকে— ‘‘বাবা, এ বার তো থামো!’’
সেটা গত বছর বড়দিনের কথা। সেই ‘অন্য রকম’ গান ‘দ্য লাস্ট ক্রিস্টমাস’-এর স্রষ্টা, জর্জ মাইকেল, মারা গেলেন এই বড়দিনে। গতকাল অক্সফোর্ডশায়ারের বাড়িতে ঘুমের মধ্যে মারা গিয়েছেন এই ব্রিটিশ পপ তারকা। বয়স হয়েছিল ৫৩। প্রচণ্ড নেশা করতেন। অনেক দিন ধরে ভুগছিলেন ফুসফুসের নানা রোগে। তবে কয়েক দিন আগেই তাঁকে ‘দিব্যি সুস্থ’ সার্টিফিকেট দিয়ে যান জর্জের ব্যক্তিগত চিকিৎসক। তারকার মৃত্যুকে ‘‘রহস্যপূর্ণ, কিন্তু সন্দেহজনক নয়’’ বলে দেহ ময়না-তদন্তে পাঠিয়েছে ব্রিটিশ পুলিশ।
‘‘অসাধারণ গায়ক, তবে যখন বেশি সিগারেট খেতেন না।’’ ‘‘খুবই সুপুরুষ, যদিও পাশ থেকে কেমন যেন একটা দেখতে।’’ ‘‘অসামান্য লিরিসিস্ট, কিন্তু সে তো কবেকার কথা!’’ ‘‘ভীষণ ভাল এক জন মানুষ, যখন নেশায় বুঁদ হয়ে নেই।’’ বৈপরীত্যে ভরা এ রকম নানা বিশেষণে আজ ঠাসা ব্রিটিশ সংবাদপত্র আর ট্যাবলয়েডগুলো। তবে সবাই এক বাক্যে স্বীকার করেছে — আশির দশকে ব্রিটিশ পপ সঙ্গীতের জনপ্রিয়তা যে তুঙ্গে পৌঁছেছিল, তার অন্যতম ভাস্কর ছিলেন গ্রিক বংশোদ্ভূত জর্জিয়াস কিরিয়াকোস পানাইয়োতু।
জন্ম ১৯৬৩-র ২৫ জুন, লন্ডনে। স্কুলে ভর্তি করানোর সময়ে নামটা পাল্টে দিয়েছিলেন বাবা নিজেই। স্কুলে পড়ার সময়ে আলাপ হয় অ্যান্ড্রু রিজলে-র সঙ্গে। ১৯৮১ সালে আঠারো বছর বয়সী দু’টো ছেলে তৈরি করল পপ দল ‘হোয়্যাম!’। দলের নামেই একটা বিস্ময়বোধক চিহ্ণ! আশির দশক জুড়ে একটার পর একটা হিটের জনক এই ‘হোয়্যাম!’। ‘ওয়েক মি আপ বিফোর ইউ গো গো’, ‘লাস্ট ক্রিস্টমাস’, ‘ফ্রিডম’, ‘কেয়ারলেস হুইসপার’— প্রতিটা গানই ব্রিটেন, আমেরিকা ও কানাডায় জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছয়। বেশির ভাগ গানেরই রচয়িতা জর্জ, গেয়েছেনও তিনি। আশির দশকে পৃথিবী জুড়ে গানের অনুষ্ঠান করেছে ‘হোয়্যাম!’। এমনকী বেজিংয়েও। ১৯৮৫-র এপ্রিলে সেই প্রথম কোনও পশ্চিমী পপ দল মাও-এর দেশে ঢোকার ছাড়পত্র পেল।
১৯৮৭তে ভেঙে যায় ‘হোয়্যাম!’। তবে অ্যান্ড্রু-জর্জের বন্ধুত্ব অটুট ছিল। দল ভেঙে যাওয়ার পরে জর্জের প্রথম গান ‘ফেথ’। ৩০ অক্টোবর ব্রিটেন ও আমেরিকায় প্রকাশিত হওয়ার পরে দু’দেশেই টানা ৫১ সপ্তাহ ‘জনপ্রিয়তম ১০টি গান’-এর তালিকায় ছিল ‘ফেথ’। কিন্তু ‘ইঙ্গিতপূর্ণ’ ও ‘প্রাপ্তবয়স্ক’ হওয়ার সুবাদে গানটি বাজাতে আপত্তি জানিয়েছিল ব্রিটেনের বেশ কয়েকটি রেডিও স্টেশন!
রাখঢাক কখনওই পছন্দ করতেন না জর্জ। নিজের গানে। নিজের জীবনেও। সমকামী পরিচয়কে কখনও লুকিয়ে রাখেননি। নেশার জাল থেকে কিছুতেই বার হতে পারছেন না, মেনে নিয়েছিলেন সে কথাও। মাদকাসক্ত হয়ে গাড়ি চালানোর জন্য চার সপ্তাহ জেল খেটেছেন, পাবলিক টয়লেটে ‘অশালীন আচরণে’র জন্য জরিমানাও দিয়েছেন কয়েক হাজার পাউন্ড।
২০১১ সালে অস্ট্রিয়া-সফরে গান গাইতে গাইতে স্টেজে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে সে বার প্রায় মারাই যাচ্ছিলেন। পরে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘‘মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। সে যে কী ভয়ঙ্কর, কথায় প্রকাশ করতে পারব না, গানেও না!’’
No comments:
Post a Comment