বন্ধ হোক ভেজাল ও নকল ওষুধের অবৈধ ব্যবসা

আমরা এমন এক সমাজ ব্যবস্থায় বসবাস করছি, যে সমাজ ব্যবস্থার চারদিকের হালচাল দেখলে মনে হয়, চলমান সময়ের লোকজন যেন অন্যায়, মিথ্যাচারিতা অর্থাৎ চলমান সময়ের সব ধরনের দুর্নীতিকে দেখেও না দেখার ভান করে চলাকেই শ্রেয় মনে করে। আরো পরিষ্কার করে বলতে হয়, আমরা দেশবাসী অর্থাৎ দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী দুর্নীতিবাজদের দুর্নীতি করার ফ্রি লাইসেন্স দিয়ে দিয়েছি। দেশের সচেতন জনগোষ্ঠী ভালো করেই জানে কে কোথায়, কখন অন্যায়-অবিচারকে লালল-পালন করে নিজের লাভ-লোকসান ঘরে তুলছে। তারপরও কেউ অন্যায় অবিচারের কোনো প্রতিবাদ করছে না। বরং নিজেরাই অন্যায় অনাচারের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে সব ধরনের অন্যায়কে একটা শক্ত ভিতের মধ্যে দাঁড় করাচ্ছে।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, দেশের ওষুধ ব্যবসা অর্থাৎ দেশের ফার্মেসি ব্যবসা এখন সবার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। প্রকাশিত সংবাদে আরো বলা হয়, ওষুধের দোকানগুলো নিয়মের বাইরে কাজ করছে অর্থাৎ তাদের বেচাকেনা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা যে শর্ত মোতাবেক ফার্মেসি ব্যবসার লাইসেন্স পেয়ে থাকে, সেসব শর্ত একশ্রেণির অসাধু ফার্মেসি ব্যবসায়ী প্রতিনিয়তই লঙ্ঘন করে চলছে। অনেক অসাধু ফার্মেসি ব্যবসায়ীরা তাদের ওষুধের দোকানে বিক্রি করছে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ। এমনকি নিষিদ্ধ বেআইনি ওষুধগুলো ব্যবসায়ীরা বিক্রি করছে শুধুমাত্র অধিক মুনাফা লাভের আশায়। প্রকাশিত সংবাদে বলা হয় যে, এমন অনেক ওষুধ আছে, যা একটা নির্দিষ্ট তামপাত্রার মধ্যে সংরক্ষণ করতে হয়, তা না হলে অনেক সময় ওষুধগুলোর কার্যক্ষমতা হ্রাস পেয়ে যায়। তার মধ্যে আবার এমন ফার্মেসিও আছে, যাদের কোনো লাইসেন্স নেই। যার ফলে তারা আইনকানুনকে বা লাইসেন্সের শর্তগুলোকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে অনেক সময় মেয়াদোত্তীর্ণ, বেআইনি ওষুধ বিক্রি করে থাকে। এসব মেয়াদোত্তীর্ণ বেআইনি নিষিদ্ধ ওষুধ যেসব বেআইনি প্রতিষ্ঠান কিংবা লাইসেন্সবিহীন ওষুধের দোকান বিক্রি করছে, তাদের দেখার যেন কেউ নেই। ওষুধ প্রশাসন থেকে বলা হয়, তাদের জনবল এতই কম যে, যে জনবল দিয়ে সারা দেশে ওষুধ বিক্রির দোকানগুলো পরিদর্শন করা সম্ভব হয় না। প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরে ২০১৫ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনের উল্লেখিত তথ্য অনুযায়ী সারা দেশে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ১,২৩,৭৭৩টি ফার্মেসি রয়েছে। অভিযোগ করা হচ্ছে, যেসব বৈধ লাইসেন্সপ্রাপ্ত ফার্মেসি রয়েছে, সেসব লাইসেন্সপ্রাপ্ত দোকানগুলোতেও মেয়াদোত্তীর্ণ, নকল, ভেজাল ও অনুমোদনহীন ওষুধ বিক্রি হচ্ছে। সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হচ্ছে, আজকাল দেশের অনেক নামিদামি হাসপাতালেও অনুমোদনহীন, মেয়াদোত্তীর্ণ, নকল ও ভেজাল ওষুধ বিক্রি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে।
আমরা জানি, সবকিছুই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে হয়। কোনো কিছু যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখন নিয়ন্ত্রণহীন ব্যক্তিরা কোনো ধরনের আইন বিরুদ্ধ কাজ করতে দ্বিধাবোধ করবে না। বলা হচ্ছে, আমাদের দেশে যত বৈধ ওষুধের দোকান রয়েছে, তার মধ্যে অর্ধেক পরিমাণই থাকে পরিদর্শনের বাইরে। দেশের বৈধ ওষুধের দোকানের অর্ধেক পরিমাণ যদি পরিদর্শনের বাইরে থাকে, সেখানে কি না হতে পারে। অসাধু ব্যবসায়ীরা দিনকে রাত করতে পারে, রাতকে দিন বানাতে পারে। প্রশাসন তাদের লোকবলের অভাবের কথা প্রকাশ্যে বলে থাকে। তারা বলে, লোকবলের অভাবে সবকিছু ভালো করে দেখতে পারেন না কিংবা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পারেন না। এ কথা কিন্তু একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীও জানে। তারাও জানে লোকবলের অভাবে প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা তাদের ওষুধের দোকানের ভালোমন্দের কিংবা বৈধ-অবৈধের খোঁজখবর রাখতে পারেন না। তাই একশ্রেণির অসাধু ওষুধ ব্যবসায়ী সাহস পায় ভেজাল, নকল, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি করতে। অভিযোগ রয়েছে, কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে এমন ব্যক্তিও আছেন, যারা মনে করেন অবৈধ ওষুধের দোকান থাকলে ক্ষতি কী। তাতে তারাও অবৈধ লাভের অংক গুনতে পারেন। তবে কর্তাব্যক্তিরা সবাই যে মন্দ তা বলা যাবে না। তাদের মধ্যে হৃদয়বান ব্যক্তিও আছেন। যারা দুর্নীতিবাজদের সাগর চুরি দেখে নিজেরাও কষ্ট পান।
তারপরও কথা থাকে। প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা লোকবলের অভাব দেখিয়ে তাদের দায় এড়াতে পারেন না। কারণ এদেশের সাধারণ জনগণের পকেটের পয়সায় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের বেতন-ভাতা হয়ে থাকে। আর দেশের সাধারণ মানুষই হাটবাজারের ওষুধের দোকান থেকে অনেক সময় ভেজাল, মেয়াদোত্তীর্ণ, নকল অনুমোদনহীন ওষুধসামগ্রী ক্রয় করতে বাধ্য হয়। শহর অঞ্চলের শিক্ষিত সচেতন মানুষ না হয় দেখেশুনে ওষুধ ক্রয় করে থাকে। কিন্তু গ্রাম অঞ্চলের সাধারণ মানুষ গ্রামের হাটবাজার থেকেই ওষুধ থেকে শুরু করে জীবনযাপনের সবকিছু কিনে থাকে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আমাদের দেশের মধ্যে এমন কিছু প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল রয়েছে, যেখানে হাটবাজারে মূলা, আলুসহ অন্যান্য সামগ্রীর মতো ডালায় সাজিয়ে একশ্রেণির ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ওষুধ বিক্রয় করে থাকে। আবার এমন দৃশ্যও দেখা যায়, শহরের কোর্ট-কাচারিতে ডালায় সাজিয়ে একশ্রেণির লোক ওষুধ বিক্রি করে থাকে।
সচেতন মানুষজন জানেন, কেউ যদি ফার্মেসি ব্যবসার জন্য লাইসেন্স নিতে চায়, তবে তাকে কমপক্ষে একজন নিবন্ধিত গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগ দিতে হয়। তবে কথা হচ্ছে, যেখানে দেশের হাটবাজারে এবং শহরের কোর্ট-কাচারিতে ডালায় সাজিয়ে ওষুধ বিক্রি করা হয় এবং তা দেখেও কেউ দেখে না; সেখানে নিবন্ধিত গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগ দেওয়া অনেক দূরের কথা। বলা হচ্ছে, দেশের পান-সুপারির দোকানগুলোতে আজকাল ওষুধ বিক্রি হচ্ছে। দেশের মানুষ ভালো করে জানে, পান-সুপারির দোকানে কিংবা গ্রামের হাট-বাজারে কিংবা শহরের কোর্ট-কাচারিতে ডালায় সাজিয়ে ওষুধ বিক্রি হচ্ছে। অথচ সেই কথা প্রশাসনের লোকজন জানবে না, তা কি কেউ বিশ্বাস করবে। ওষুধ প্রশাসনে যারা চাকরি করেন, তারা তো এ দেশেরই সন্তান। তাদের তো কোনো কিছু অজানা থাকার কথা নয়।
নিয়ম অনুযায়ী কোনো ডাক্তার কিংবা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ফার্মাসিস্টের প্রেসক্রিপশন ছাড়া কোনো ওষুধের দোকান কোনো ওষুধ বিক্রি করতে পারে না। কিন্তু আমাদের দেশে যে কেউ যেকোনো ওষুধের দোকান থেকে (গ্রামের হাটবাজারের দোকান কিংবা শহরের পান-সুপারির দোকানের কথা না হয় বাদই দিলাম) ডাক্তার কিংবা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ফার্মাসিস্টের প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ কিনতে পারে। তাতে কেউ বাধা দেয় না। এমনকি প্রশাসনও বাধা দেয় না। অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ জানেও না ডাক্তার কিংবা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ফার্মাসিস্টের প্রেসক্রিপশন ছাড়া ফার্মেসি থেকে ওষুধ কেনা যায় না। এ ব্যাপারে সাধারণ মানুষকে দোষ দিয়েও লাভ নেই। কেননা প্রশাসন থেকে সাধারণ মানুষকে কখনো ওষুধ ক্রয় করার ব্যাপারে সচেতন করে তোলার জন্য কখনো পরামর্শ দেওয়া হয় না। এ বিষয়ে দেশের জনগণের এমনকি শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যেও সচেতনতার অভাব রয়েছে। অনেকেই শরীরে কোনো ব্যথা দেখা দিলে কিংবা শরীরে তাপমাত্রা দেখা দিলে কিংবা পেটের সমস্যা দেখা দিলে তাড়াতাড়ি আরোগ্য লাভের আশায় নিজেরাই ডাক্তার হয়ে যায় কিংবা ওষুধের দোকানের বিক্রেতার পরামর্শে ওষুধ ক্রয় করে থাকে। তাতে অনেক সময় বিপদ অনেক বিপদ দেখা দেয়। আমাদের শরীরে ব্যাধি যখন গাঢ় থেকে গাঢ় হয়, তখনই আমরা ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়ে থাকি। তাই ওষুধ ক্রয় এবং সেবন করার ব্যাপারে জনগণের যেমন সচেতন হওয়া উচিত, তেমনিভাবে ওষুধ প্রশাসনের কর্তব্য হল ওষুধ সেবন এবং ক্রয় করার ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করা তোলা।
শেষে এ কথাই বলতে চাই, ওষুধ আমাদের জীবন রক্ষা করে। তা নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার কারো নেই। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো, যারা মেয়াদোত্তীর্ণ, নকল, ভেজাল এবং অনুমোদনহীন ওষুধ বিক্রি করে দেশের মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে, তাদের ধরে এনে আইনের কাঠগড়ায় তোলা। এই প্রকার দুর্বৃত্তদের প্রতি কোনো ধরনের দুর্বলতা দেখালে দেশের জনস্বাস্থ্য হুমকির মধ্যে পড়তে বাধ্য হবে। আমরা তো জানি ভেজাল প্যারাসিটামল সিরাপ খেয়ে আমাদের দেশের শিশুরা কীভাবে মৃত্যুর মুখে পতিত হয়েছে। যারা কেবল মুনাফা লাভের আশায়, এদেশের মানুষকে জিম্মি করে অনুমোদনহীন, ভেজাল, নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি করে দেশের মানুষের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে নৈরাজ্যের দিকে নিয়ে যেতে চায়, তাদের অবশ্যই অর্থাৎ সেসব মুনাফালোভী হীনস্বার্থ উদ্ধারকারী নকল ভেজাল ওষুধ বিক্রেতাদের প্রচলিত আইনের আওতায় এনে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন করতে হবে। তা না হলে আমাদের দেশে ভেজাল ওষুধের কারখানা শুধু বৃদ্ধি পেতেই থাকবে। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো শাস্তি থেকে যেন রাঘববোয়লরা বাদ না যায়।
লেখক:শরদিন্দু ভট্টাচার্য্য টুটুল; কবি, গল্পকার ও আইনজীবী।
No comments:
Post a Comment