Wednesday, December 21, 2016

উন্নয়নের সারথি কৃষি এবং কৃষক

কৃষি ক্ষেত্রে বাংলাদেশে দীর্ঘ বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে প্রকৃতি ও জনসংখ্যার সঙ্গে সমন্বয় রাখতে যুদ্ধ করে এগিয়ে চলেছে। স্বাধীনতার পূর্বে যেখানে সাড়ে সাত কোটি মানুষের খাদ্য উৎপাদন চাহিদায় হিমশিম খেতে হতো, কাল পরিক্রমায় স্বাধীনতার চার দশক পর ষোল কোটি মানুষের খাদ্যের চাহিদা মেটানো সংগ্রামে নিয়োজিত বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থা। সময়ের বিবর্তনে এসেছে নতুন নতুন ফসল, প্রসারিত হচ্ছে নব নব প্রযুক্তি। ১৯৭০ সালে দেশে চাল উৎপাদন হতো প্রায় এক কোটি টন। কৃষিকে বহুমুখীকরণে বাংলাদেশ এখন অনেক অগ্রগামী। কৃষি সেক্টরে ধান, পাটের পাশাপাশি মৎস্য ও পশু পালন, দুগ্ধ উৎপাদন, হাঁস-মুরগি পালন, নার্সারি, বনায়ন এবং কৃষিভিত্তিক ক্ষুদ্র শিল্পের দ্রুত প্রসার ঘটছে বাংলাদেশে। কাজেই কৃষি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সম্ভাবনা বেড়েছে।
কৃষি আমাদের সমৃদ্ধির অন্যতম উৎস। এই কৃষিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন গ্রাম বাংলার কৃষক। বন্যা, খরা কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ই দমাতে পারেনি বাংলার কৃষকদের। নিঃস্ব, শূন্য অবস্থান থেকেও বারবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলার কৃষক। ফলিয়েছে সোনার ফসল। কৃষকরা প্রকৃতি ও স্বভাবগতভাবে উদ্ভাবক, সৃজনীক্ষমতার অধিকারী ও প্রকৃতি বিজ্ঞানী। গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা তাত্ত্বিক সূত্র না জানলেও নিবিষ্ট চিন্তা-চর্চা ও প্রকৃতির গতিবিধির সঙ্গে সখ্যের খেলায় উদ্ভাবন করেন নতুন পদ্ধতি-প্রক্রিয়া। প্রাকৃতিক চর্চায় নতুন জাতের ‘হরি ধান’ উদ্ভাবন করে আমাদের চোখ খুলে দিয়েছেন কৃষক হরিপদ কাপালি। তিনি পেয়েছেন চ্যানেল আইয়ের স্বীকৃতি—কৃষি পদক। ফলন ভালো, চাল চিকন, স্বাদও চমৎকার তাই সম্প্রতি যশোরের কৃষকরা ঝুঁকছেন ‘হাবু ধান’ চাষে। এই ধানের সুনাম ছড়িয়ে পড়ায় দূরের কৃষকরাও আসছেন বীজ নিতে। দেশে নতুন এই ধানের প্রবর্তক যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার পাইকপাড়া এলাকার কৃষক সত্যজিৎ বিশ্বাস হাবু। তার নামেই এটি পরিচিতি পেয়েছে ‘হাবু ধান’ হিসেবে। এ রকম অনেক কৃষক নিবিষ্ট মনে কাজ করে যাচ্ছেন। উদ্ভাবন করছেন নতুন নতুন জাতের ফসল এবং কৃষিবান্ধব প্রযুক্তি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বাস করতেন, গ্রামের উন্নতির মধ্যেই সামগ্রিক উন্নয়ন নির্ভরশীল। কেননা, আমাদের শহুরে জীবনের উপভোগ্য অধিকাংশই গ্রাম থেকে আসে। তাহলে গ্রামের কৃষকদের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারলেই সার্বিকভাবে দেশের উন্নয়ন ঘটবে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের জন্য কৃষিকে বহুমুখী করার বিকল্প নেই। তাই তিনি কী করে কৃষককে আত্মশক্তিতে বলীয়ান করা যায়, উৎপাদন বাড়াতে কীভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো যায়, কৃষকের সন্তানকে কী করে শিক্ষা দেওয়া যায়—এসব নিয়ে ভেবেছেন এবং কাজ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ তার নোবেল পুরস্কারের ১০ লাখ ৮০ হাজার জমা দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন কৃষি ব্যাংক। কৃষির উন্নয়নে তিনি নিজের সন্তান, জামাতা এবং বন্ধু পুত্রকে অক্সফোর্ড বা ক্যামব্রিজে না পাঠিয়ে ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষিবিজ্ঞান বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য পাঠান। উচ্চশিক্ষায় উন্নত ভদ্রলোক হওয়ার চেয়ে উন্নত কৃষক হওয়ার প্রয়োজনীয়তা তিনি বহু আগেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।
বোরো মৌসুমে দেশে প্রায় বিশ লাখ একর চাষযোগ্য জমিতে ১৬ লাখ ৩০ হাজার সেচ পাম্প ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে ১৬ লাখ একর জমি চাষে ব্যবহার হয় ১০ লাখ ৮০ হাজার বিদ্যুতচালিত সেচপাম্প। বাকি ১১ লাখ ৫৮ হাজার সেচপাম্প ব্যবহৃত হয় ডিজেলে। সারা দেশে বিদ্যুৎ ও ডিজেলচালিত সেচপাম্পগুলোকে সৌরবিদ্যুতের আওতায় আনা সম্ভব হলে বছরে ৭৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ও ৮০ কোটি লিটার ডিজেল সাশ্রয় হবে। যার ফলে ডিজেল ও বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে সরকারের ৮৫৩ কোটি টাকা ভর্তুকি বেঁচে যাবে। এই ভর্তুকির টাকাটি পরপর তিন থেকে চার বছর সৌরবিদ্যুতের পেছনে ভর্তুকি হিসেবে ব্যয় করলে সরকার পরবর্তী ২০ বছরের জন্য ভর্তুকি প্রদান থেকে বেঁচে যাবে। পাশাপাশি জাতীয় বিদ্যুৎ তো সাশ্রয় হবেই। দেশে বছরে প্রায় ৩০ লাখ টন ইউরিয়া সারের চাহিদা। এর মধ্যে ভর্তুকি দিয়ে উৎপাদন হবে ১৭ লাখ টন। বাকি ১৩ লাখ টন বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। ইউরিয়া সাশ্রয়ের জন্য ডাল, তেল, শিম জাতীয় ফসল ও ধানে ইউরিয়ার পরিবর্তে জীবাণু সার ব্যবহার করা গেলে ২০০০ কোটি টাকার ইউরিয়া সাশ্রয় হবে। বাংলাদেশে জীবাণু সারের চাহিদা হবে এক হাজার টন। এর প্রধান কাঁচামাল বাতাসের নাইট্রোজেন ও পিটমাটি বলে এটি ব্যাপক পরিমাণে উৎপাদন সম্ভব। এ দুটি আমাদের দেশে প্রচুর আছে। পিটমাটি আছে ছয় লাখ হেক্টর জায়গায়।
এখন অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগ। চীনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট সংযোগ-সুবিধাসহ তথ্যকেন্দ্র স্থাপনের ফলে কৃষকরা অনলাইনের মাধ্যমে পণ্য বিক্রিতে ছয় গুণ বেশি লাভ করতে পারছে। অবাধ তথ্যপ্রবাহের এ সুযোগটি ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার মাধ্যমে সম্ভব। এর ফলে কৃষক ন্যায্যমূল্যের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় তথ্য পেয়ে সমৃদ্ধ ও সচেতন হবে। বাংলাদেশে কৃষি জমি ব্যবহার করে বানানো হচ্ছে কলকারখানা, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, ইটখোলা প্রভৃতি। ফলে প্রতিবছর হারিয়ে যাচ্ছে প্রায় ৮০ হাজার হেক্টর কৃষি জমি। এশিয়ার প্রতিটি কৃষিভিত্তিক দেশই কৃষিজমি সংরক্ষণে কঠোর আইন প্রণয়ন করেছে। পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গুরে টাটা কোম্পানি কারখানা করতে চাইলে তা লাভজনক হওয়া সত্ত্বেও দেওয়া হয়নি। চীন ও ভিয়েতনামে কৃষি আইন অনুসরণ করা হয় কঠোরভাবে। আশার কথা হলো, কৃষি আইন কার্যকরণে সরকার উদ্যোগী ও মনোযোগী হয়েছে। কৃষিজমিতে স্থাপনা নিষিদ্ধ হচ্ছে। লক্ষ্য রাখতে হবে, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে কৃষিজমি যেন নষ্ট না হয়।
কৃষি শুমারির প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী দেশে মোট কৃষিজমির পরিমাণ ১ কোটি ৯০ লাখ ৯৮ হাজার একর। পরিত্যক্ত জমির পরিমাণ ৩ হাজার ৮৭ দশমিক ৪০ একর। এর মধ্যে ইজারার মাধ্যমে ১ হাজার ১৪৫ দশমিক ৫৩ একর সরকারের দখলে এবং ১ হাজার ৯৪১ দশমিক ৮৭ একর বেদখলে রয়েছে। অনাবাদি পতিত জমি ভূমিহীন ও বর্গাচাষিদের মাঝে বন্দোবস্ত করে দিলে উৎপাদনের পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। ব্যবহারের সুযোগ না থাকা, ক্ষেত্র না জানা এবং সচেতনতার অভাবে প্রচুর মূল্যবান অর্থনৈতিক সম্পদ নষ্ট হচ্ছে। সেসব জমিকে উপযোগী করে ফসল, সবজি, ফল বাগান, নার্সারি প্রভৃতি ও পাশাপাশি ক্ষুদ্র এবং কুটির শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে পল্লী উন্নয়ন সম্ভব। পল্লী উন্নয়নের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন আবশ্যক। কৃষক সমবায় সমিতিভিত্তিক উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ ও তথ্যপ্রাপ্তির সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। গ্রামের শিক্ষিত ব্যক্তি ও শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে কৃষকের জন্য কৃষি পাঠাগার স্থাপন করে সান্ধ্যকালীন পাঠচক্র করা যেতে পারে। কৃষি কর্মীদের উন্নত ও প্রযুক্তিভিত্তিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কৃষি কর্মকর্তাদের বাধ্যতামূলকভাবে মাঠ ও কৃষকের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন জোরদার করতে হবে। দেশে ১৩ হাজার নার্সারি উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে উন্নত ও মানসম্মত জাতে বীজ তৈরিতে দক্ষতা বাড়াতে হবে। কৃষক পরিবারের সদস্যদের কুটির শিল্প স্থাপনে ব্যাংকঋণ সুবিধা সহজীকরণ করতে হবে। সরকারের একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প, কৃষি ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক, যুব উন্নয়ন অধিদফতর, বিসিক, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, বেসরকারি উদ্যোক্তা সবাই মিলে একযোগে টার্গেটভিত্তিক সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণ করলে সুফল আসবে। কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। আসুন আমরা কৃষি ও কৃষকের কথা বলি। আমাদের নাড়ির টান গ্রাম বাংলার কৃষি ও কৃষকের সঙ্গে। কৃষকের কথা ভাবুন, কৃষককে যথাযথ সম্মান করুন। আসুন, সবাই এক কণ্ঠে বলি, বাংলার কৃষক তোমাদের জানাই লাল সালাম।
লেখক: এস এম মুকুল; অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক

No comments:

Post a Comment