Monday, December 19, 2016

উন্নতর প্রযুক্তি মানেই কিন্তু নয় দীর্ঘতর আয়ু :
তথ্য প্রযুক্তির বাড়বাড়ন্তকে আজ আর অস্বীকার করবার উপায় নেই,এড়িয়ে চলবারও পরামর্শ আমরা দিই না।কিন্তু এটাও মনে রাখবার বিষয় যে এটি একটি পুঁজিবাদী বাস্তবতা। সেই বাস্তবতাতে আমরা আমজনতা অধিকাংশ সময়েই  নিতান্তই গ্রাহক কিম্বাশ্রমিকএই সম্পর্কে আমরাঅন্যত্র লিখেছিলাম,এর মর্মবস্তুকিম্বা গতিপ্রকৃতির উপরে সৃজনশীল হস্তক্ষেপ কিম্বা অন্তর্ঘাতকরবার যোগ্যতা আমরা অর্জন করিনি বিশেষ।পুঁজিবাদীব্যবস্থার এক মৌলিক সমস্যা  যে বস্তুটি গ্রাহকহিসেবে ব্যবহার করছি,সেটি আমি তৈরি করিনি বাউৎপাদন করিনি।আর যদি উৎপাদন করেছি তবে সেটিআর আমি ব্যবহার করছি না বড়ো সে আমার দখলেথাকে না। কে নিয়ে যায়,কই নিয়ে যায় কেউ জানি না।এইবিচ্ছিন্নতার ব্যামোতে পণ্যের বাজারে তাই ব্যক্তির সৃজনশীলতা বলে বিশেষ কিছু থাকে না।যদি না সেই ব্যক্তির মুনাফাকিছু অর্জনের পথ না থাকে।নতুন কোনো কাজে হাত দিলেই আমাদের প্রথম প্রশ্ন---লাভটা কী হবে?লাভ ছাড়া এখানে মেঘওবৃষ্টি হারিয়ে ফেলে।বৃষ্টি হওয়া না হওয়াটাও এখন আর নিছক প্রাকৃতিক নয়,অর্থনৈতিক পরিঘটনাওশ্রমিক কী করবেঠিক করে দেয় প্রত্যক্ষ ভাবেই মালিকগ্রাহক কী করবে তাও ঠিক করে দেয় মালিক।পরোক্ষে,বিজ্ঞাপনে অথবা বাজারথেকে আপনার পছন্দের পণ্য তুলে দিয়ে।আমাদের হাতের পণ্যটির সঙ্গে আমাদের বিচ্ছিন্নতা বুঝিবা ব্রহ্মারই কপালে লিখন।তাই,হাওয়া যেদিকে ছোটে এবং ছোটায় আমরা সেদিকেই ছুটতে থাকব,নান্য পন্থা। সৃজনশীলতার বিপরীতে ‘ব্র্যান্ড’ এবংট্র্যাণ্ড এখানে শেষ কথা  এই কথাগুলো সাধারণ যন্ত্রব্যবস্থা সম্পর্কে সত্য।কিন্তু আন্তর্জালীয় যে বাণিজ্য সেখানে আমরা আর শুধু গ্রাহক বা শ্রমিক নই, কাঁচামালও। আমাদের মনন মেধাকে ব্যবহার করেই ফেসবুক, গোগোল, ইয়াহু আদির কোটি কোটি ডলারের বাণিজ্য।পুঁজিবাদী প্রতিযোগিতা বিষয়টি এতোই তীব্র যে সে পুঁজিবাদীদেরকেও শান্তিতে শ্বাস ফেলতে দেয় না। সেগতকাল যে পণ্য এবং সম্পর্কগুলো তৈরি করে আজ তাকে ধ্বংস করেআগামীকাল আবার কোন নতুন বিষয়কে সামনে এনেআজকের দিনটিকেও বারোটা বাজাবে সেই সিদ্ধান্তও নিয়ে রাখে১০ সুতরাং কোনো অত্যুৎসাহেরই এখানে আয়ু বেশি নয়। আর তথ্য-প্রযুক্তির জমানাতে সেই আয়ু ফুরোবার দ্রুতি তো এখন আরো অনেক বেশি।আলঙ্কারিক ভাষা ব্যবহার করে দাবি করা যেতেই
সম্প্রতি একটি সংবাদে দেখেছিলাম ১৯৩৫ এ মুক্তি পাওয়া প্রমথেশ বড়ুয়া পরিচালিত-অভিনীত ‘দেবদাস’ ছায়াছবির একটিই  প্রিন্ট বাংলাদেশ সরকার ভারতকে দিচ্ছে।ভারতে তার কোনো প্রতিলিপি নেই। এর হিন্দি –অসমিয়া সংস্করণও ছিল। সেগুলো কোথাও নেই। প্রমথেশ বড়ুয়ার আগেও ১৯২৮শে নরেশ মিত্র একখানা নির্বাক ‘দেবদাস’ করেছিলেন,সেটি আর এখন দেখাই যাবে না,এর প্রিন্ট নষ্ট। নষ্ট তো পুথি সাহিত্যও হয়েছিল। ষোড়শ শতকের আগে কোনো বাংলা পুথি মেলে না বলে সুকুমার সেন দাবি করেছিলেন। সেগুলোরও খুব কমই ছাপা প্রযুক্তিতে বইতে রূপান্তরিত হয়েছিল। তবু যেগুলো মিলেছিল সেগুলো যে কয়েক শতক টিকেছিল,সে সত্য। ছাপা বইগুলো সেই আয়ু স্পর্শ করবে কি না,এখনো দেখার বাকি।কারণ,বাংলা বইয়ের বয়স এখনো তিন শতক পার করে নি।সামাজিক দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এমন কিছু বই তবুও এই সময় পার করে টিকে আছে,কিন্তু সেগুলো অধিকাংশই আছে সরকারি বেসরকারি গ্রন্থাগারে। বাজার থেকে অধিকাংশ প্রাচীন বইই উধাও।‘দেবদাস’ ছাপাবই নিশ্চয় বাজারে মেলে।আগামী বছরে শতবর্ষ পার করেও আরো বহুদিন মিলবে।কিন্তু তার প্রাচীন চলচ্চিত্রে রূপান্তরগুলো কিন্তু এক শতক আয়ু নিয়েও জন্মাল না। প্রযুক্তি উন্নতর হয়েও আমাদেরকে তার নিজের এবং তার উৎপাদের কোনো আয়ুর গ্যারেণ্টি কিন্তু দিতে পারল না। উন্নতর প্রযুক্তি মানেই কিন্তু নয় দীর্ঘতর আয়ু।এখন কম্প্যুটার প্রযুক্তি এক দশক আয়ুরও কোনো নিশ্চয়তা দিচ্ছে না। আমরা নিশ্চিত যারা উইন্ডোজ নাইনটি এইটে অভ্যস্ত ছিলেন,তারা আর নিজেদের পুরোনো লেখা উদ্ধার করতে পারছেন না।সিডিতে যদি ব্যাকআপ রেখেছিলেন,সেগুলোরও অধিকাংশেরই পাঠোদ্ধার করতে পারছেন না।অতি সম্প্রতি গোগোল তাদের ছবি তুলে রাখবার ‘পিকাসা’ সাইট বন্ধ করে দিয়েছে। গোগোলের সেবা ব্লগগুলোকে ছবি দিয়ে সাজাবার জন্যে ‘পিকাসা’ খুবই ব্যবহার বান্ধব ওয়েবসাইট ছিল।আমাদের অনেকেরই গোগোলের সেবা ব্লগারে,যা ব্লগস্পট বলেই সুপরিচিত,লেখালেখি করবার অভ্যাস আছে। বহু বাংলা ওয়েব ম্যাগাজিনও ব্লগারে আছে। সেগুলো না অচিরে বন্ধ করতে বাধ্য হয় গোগোল সেই আশঙ্কাতে আমরা দিন গুনছি।
           
আমরা এই সংকটের কথা  আলোচনা করছি ঠিক তখন যখন বিশ্বের সবচাইতে উন্নত বিশটি দেশের ৭৫ % মানুষের কাছে আন্তর্জাল সেবা পৌঁছে গেছে। কিন্তু  বাকি বিশ্বের মাত্র ২৫%এর মধ্যে  সেটি পৌঁছুতে পেরেছে। তার মধ্যে চীন-ভারতের মানুষও রয়েছেন।যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি ইত্যাদি দেশের ৮০% জনতা আন্তর্জাল ব্যবহার করবার বিপরীতে দু’বছর আগেও ভারতের জনসংখ্যার ২০%-এর কাছেও ভালো করে পৌঁছোয় নি আন্তর্জাল এর মানে হচ্ছে  ভারতের মতো দেশগুলোতে আন্তর্জাল বাণিজ্যের জন্যে সম্ভাবনা ব্যাপক। সেই বাজার দখলের জন্যে গোগোলে-ফেসবুকে এবং অন্যান্য সংস্থার মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও প্রায় যুদ্ধের চেহারা নিয়েছে বললে অত্যুক্তি হয় না।এই যুদ্ধে বিভিন্ন হার্ড-ওয়ার,সফটওয়ার নির্মাতা এবং আন্তর্জাল সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোও নানা সম্পর্কে জড়িয়ে আছে।কম্প্যুটারকে পেছনে ঠেলে এগুচ্ছে মোবাইল কোম্পানিগুলো। এখনই ভারতে আন্তর্জাল ব্যবহারকারীদের ৬০%ই মোবাইল ব্যবহার করছেন। ফেসবুকের প্রায় দেড়কোটি ব্যবহারকারীদের ৯০%ই আসছেন মোবাইল থেকে।১১   মোবাইলেও ব্লগে লেখা পড়া করা যাচ্ছে, এবং ভারতীয় ভাষাগুলোতেই করা যাচ্ছে। সে যেমন একটি সুসংবাদ, সেরকমই এও সত্য যে সেগুলোতে ফেসবুক-হোয়াটসআপের মতোই  টুকরো কথার সমাহারই বেশি হওয়া সম্ভব। মোবাইলে একটি ব্লগে লেখা,ছবিতে, চলচ্চিত্রের সাজানো তত সহজ নয়। মোবাইলে তৈরি কোনো ব্লগের সন্ধান আমরা এই অব্দি পাই নি। ফলে সেখানে ‘কপি-পেস্ট-শেয়ার’ সংস্কৃতির বেশি এগোনো সম্ভব বলে মনে হয় না। মাঝে মধ্যে সেখানেও সাধারণ ব্যবহারকারীর প্রতিভা দেখে চমকে যেতে হয় নিশ্চয়। যেমন বর্তমান ‘মুদ্রাবদল’ সংকট নিয়ে একটি বিদ্রূপাত্মক পদ্যের প্রথম কয়েকটি কলি এরকম: হকের টাকা আমি তারেই বলি/ কালো তারে বলে মোদীর লোক/ রেখেছিলেম লেপ তোষকের ফাঁকে/ খুঁজে পেল আই টি-র ঝানু চোখ/বেশি টাকা ছিল না তো মোটে/লাখ বিশেক,সব হাজারের নোটে/ কালো? তা সে কালো টাকা হোক/ ঘরের লক্ষ্মী,কালো টাকার থোক...” দুই দশক আগেও এরকম যেকোনো মানবিক সংকটে আমরা বহু মৌলিক কবিতা পড়তে পেতাম। এখন সেই সব প্রায় দুর্লভ হচ্ছে বললেই চলে। অথবা এই সব নকল পদ্যের ভিড়ে কবিতা খুঁজে মেলা ভার হয়েছে। সেরকম ঘটনা ছাপা জমানাতেও হয়েছিল,বা এখনো হচ্ছে।বাংলাতে ‘বটতলা সাহিত্য’ বলে একরকমের সাহিত্যকে ব্রাত্য করে দেবার প্রয়াস ছিল অভিজাতদের মধ্যে।আমরা সেরকম আভিজাত্যের সংকীর্ণ গলিতে প্রবেশ করতে চাইছি না। এরকম গদ্য পদ্যও বাংলা ভাষার ব্যবহারের পরিমাণ  বাড়াতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে।পরিমাণ একটা স্তর অতিক্রম না করা অব্দি মানের কথা কল্পনাই করা যায় না।বটতলা সাহিত্য না হলে বাংলা বইবাজার টিকে থাকত এবং বিকশিত হত কিনা আমরা সন্দিহান,এবং সেই বাজার না থাকলে বাজার বিরোধী ‘লিটল ম্যাগাজিন’ আন্দোলনও গড়ে উঠবার কোনো কারণ কিংবা বাস্তবতার কিছুই থাকত না।এই সব দ্বন্দ্ব এবং  বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্যের কথা মনে রেখেই আমরা সমস্যাটিকে বুঝবার চেষ্টা করছি।

No comments:

Post a Comment