আশাজাগানিয়া উদ্ভাবকের বাংলাদেশ

বাংলা মায়ের সন্তানেরা বিদেশ বিভুঁইয়ে দেশের নাম আলোকোজ্জ্বল করার এমন খবর হামেশাই শোনা যায়। এবার শুনুন নিভৃত গ্রাম বাংলার কতিপয় উদ্ভাবকের গল্প। ঠাকুরগাঁও শহর থেকে ২০ কিলোমিটার পশ্চিমে মোলানি গ্রামে সোলেমান আলীর জন্ম। বাবা ছিলেন সাইকেল মেকার। বাবার মৃত্যুর পর সোলেমানকেই পরিবারের হাল ধরতে হয়। অভাবে পীড়িত সোলেমান বাবার পেশার সঙ্গেই নিজেকে জড়িয়ে নেয়। নিখুঁতভাবে সাইকেল মেরামতের খ্যাতিও ছড়িয়ে পড়ে এলাকায়। নিষ্ঠাবান সোলেমান নিজের একান্ত চেষ্টায় মোটরসাইকেল, স্যালোমেশিন, টর্চলাইট মেরামতেও সুনাম অর্জন করেন। উদ্ভাবনী চিন্তা পেয়ে বসে সোলেমানকে। কাজ শুরু করেন ব্যাটারি তৈরি কাজ। স্থায়ী টেকসই ও মানসম্মত ব্যাটারি তৈরি করে বিক্রি করে খুলে যায় স্বাবলম্বনের দ্বার। তারপর কম পয়সায় পুরনো সোলার প্লেট কিনে সূর্যের আলোয় অবিরাম তাপধারণ করে বিদ্যুৎ তৈরির সূত্র উদ্ভাবন করেন সোলেমান। দেশীয় প্রযুক্তিতে ড্রামের পাত্রে জারকিন ডুবিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি হয় তাপবিদ্যুৎ। সূর্যের দিকে তাক করে সারাদিন তাপ সংগ্রহ করে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয়। স্বল্প খরচে সোলার প্লেটটিকে নিজের উদ্ভাবিত বিশেষ ব্যবস্থায় সূর্যের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরিয়ে এ তাপ উৎপাদনপ্রক্রিয়া আবিষ্কার করেন সোলেমান। পাঁচ বছর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তৈরি করেছেন বিশেষ মানের ‘আইপিএস’। পড়াশোনা না জেনেও কী অসাধ্য সাধন করলেন সোলেমান!
সিমসন সাহা শিমু। গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলায় নারিকেলবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা তিনি। নিজ গ্রামে মেশিন মেকানিক হিসেবে কাজের পাশাপাশি শুরু করেন কৃষিকাজ। কৃষিকাজের জন্য সেচযন্ত্র আবিষ্কারের নেশা পেয়ে বসে তাকে। এসব কাজের পেছনে খরচও হয় লাখ দেড়েক টাকা। ৫ বছরের অক্লান্ত শ্রমের ফসল প্যাডেলচালিত সেচযন্ত্রের উদ্ভাবকের খ্যাতিতে সাফল্যে ও সুনামে মানুষের মুখে মুখে তার নাম। তিনি উদ্ভাবন করলেন প্যাডেলচালিত পানিসেচ মেশিন। এ প্রযুক্তিতে ডিজেল বা বিদ্যুৎ ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। শুধু বাইসাইকেলের মতো প্যাডেল ঘোরালেই অল্প পরিশ্রমের মাধ্যমে খাল, নদী বা পুকুর থেকে ইরি, বোরো জমিতে পানিসেচ দেওয়া সম্ভব। এমনকি গভীর নলকূপ থেকেও এ পদ্ধতিতে পানি উত্তোলন সম্ভব। এ সেচযন্ত্রে মাধ্যমে বায়ু বা শব্দদূষণের কোনো সম্ভাবনাও নেই। এ যন্ত্র দিয়ে দুজন অদক্ষ শ্রমিকের মাধ্যমে দৈনিক ২০ থেকে ২৫ একর জমিতে সেচ দেওয়া সম্ভব। তার সেচযন্ত্রটি তৈরির মূল্য মাত্র ১৫ হাজার টাকা। ফাই হুইল, গিয়ার বক্স, প্যাডেল, কানেকটিং, পিস্টন, কাঠ ও পাইপ ব্যবহার করে সিমসন সাহা তৈরি করলেন প্যাডেলচালিত সেচযন্ত্র।
যশোরের শার্শার নিভৃত পল্লী ট্যাঙর গ্রামের পল্লীচিকিৎসক আবুবকর সিদ্দিক উদ্ভাবন করলেন ওয়াটার ওয়েট পাওয়ার মেশিন। জ্বালানি বিদ্যুৎ ছাড়াই সেচ সুবিধা পাওয়া যাবে এ মেশিনের সাহায্যে। ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন আবুবকর। পেশায় কৃষক। নিজের দুটো শ্যালোমেশিন ও পাওয়ার পাম্পও চালাতেন। এসব পরিচালনায় দৈনিক ২ হাজার টাকার ডিজেল খরচ করতে হতো। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির দায় টানতে একপর্যায়ে হাঁপিয়ে উঠলেন তিনি। মাথায় প্রতিনিয়ত ঘুরপাক খাচ্ছিল বিকল্প ভাবনা। সেচ খরচ কী করে বাঁচানো যায়। যেই ভাবনা সেই কাজ। উদ্ভাবনের নেশায় কাজে নামলেন। টানা ৮ বছর নিরলস সাধনার পর সফল হলেন তিনি। তার উদ্ভাবিত ওয়াটার ওয়েট পাওয়ার মেশিন কৃষির সেচকাজে আশার আলো দেখাল। তার উদ্ভাবিত সেচযন্ত্র দিয়ে সিজনে ৫০ বিঘা জমি চাষ করা সম্ভব। এ মেশিন ব্যবহারে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের ব্যবহার কমবে। বিদ্যুতের সংকট ও জ্বালানি তেল সংকট লাঘব হবে। কৃষিখাতে সেচ খরচ সাশ্রয় হবে। আবুবকর যন্ত্রটি তৈরি করতে ৩৩ ফুট পরিধির স্টিল ও কাঠের তৈরি চাকা ব্যবহার করেছেন। চাকার ৮ থেকে ১০ ফুট ওপরে বসিয়েছেন একটি পানির ট্যাংক। ট্যাংকের পানি বড় চাকাটির ওপর ভাগে থাকা খাদে এসে পড়লে পানির চাপে চাকাটি ঘোরে। এ যন্ত্র তৈরি করতে খরচ পড়বে প্রায় দেড় লাখ টাকা। তবে যন্ত্র বসানোর পর আর খরচ নেই। আমাদের দেশের বিদ্যুৎ ও ডিজেল সংকটের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আবুবকর সিদ্দিকের এ যন্ত্রটি কৃষিকাজকে সহজে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
যশোরের হান্টু একজন দরিদ্র মানুষ। হান্টুর শিক্ষাজ্ঞান অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। মাছের পোনা উৎপাদনের কাজ করতেন। দেশের প্রচলিত পোনা উৎপাদন পদ্ধতি অনুযায়ী পুকুরে অক্সিজেন সরবরাহের জন্য শ্যালোমেশিনের সাহায্যে পুকুরের পানি আবার পুকুরেই ফেলা হয়। এ ব্যবস্থায় শ্যালোমেশিনের সাহায্যে পুকুরের উপরস্থ বায়ুমন্ডলের সংস্পর্শে থেকে অক্সিজেন মিশ্রিত হয়ে সেই পানি আবার পুকুরে পড়ে। এভাবে আড়াই ফুট গভীর ৫০ শতক আয়তনের জলাশয়ে চাহিদা অনুযায়ী আট মিলিগ্রাম অক্সিজেন সরবরাহের জন্য ২৪ ঘণ্টা মেশিন চালাতে হয়। এতে প্রায় ৫০০ টাকার ডিজেল অথবা ১০০ টাকার বিদ্যুৎ খরচ হয়। এ খরচের হাত থেকে বাঁচার জন্য তিনি নতুন পথ খুঁজতে থাকেন। অবশেষে ৬ বছর একক প্রচেষ্টায় সাফল্যের মুখ দেখেন। মাছের নার্সারি পুকুরে সাশ্রয়ী খরচে অক্সিজেন সরবরাহের যন্ত্র আবিষ্কার করে ব্যাপক আলোচিত হন। তার আবিষ্কৃত যন্ত্রে প্রচলিত ব্যবস্থার চেয়ে ৯২ শতাংশ কম সময়ে সমপরিমাণ অক্সিজেন সরবরাহ সম্ভব। প্রচলিত ব্যবস্থার চেয়ে ৮৫ শতাংশ কম ডিজেল বা বিদ্যুৎ খরচ বাঁচিয়ে এ যন্ত্রের মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ করা যাবে। মাছচাষি বা পোনা উৎপাদনকারী নার্সারি ব্যবসার ক্ষেত্রে এ যন্ত্র নতুন দিগন্তের উন্মোচন করল। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট বায়ুসঞ্চালক এ যন্ত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এর সাশ্রয়ীগুণের কথা স্বীকৃতি দিয়েছে। হান্টুর বায়ুসঞ্চালক যন্ত্রটি যশোরের চাঁচড়ার সোনালী মৎস্য হ্যাচারিতে ব্যবহার করা হচ্ছে।
শরীয়তপুরের কৃষক পিতার ছেলে মো. শওকত হোসেন। আর্থিক অনটনের কারণে দশম শ্রেণির পর জীবিকা নির্বাহের জন্য ঢাকায় একটি গ্যারেজে কাজ করে শওকত পুরোদস্থর মোটর মেকানিক। কিন্তু মেকানিক হলে হবে কী; কৃষকের ছেলে শওকতের গায়ে মিশে আছে গ্রামের মাটির গন্ধসুধা। তার ভাবনাজুড়ে শুধুই কৃষিকাজ। তার ভাবনার সঙ্গে মিলে গেল আরেক সৃজনশীল ভাবুক কামাল আহমেদ রতন। রতন মুন্সীগঞ্জের ছেলে। দুই কৃষকের সেচ খরচ কমাতে ডিজেলের বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে ডিজেলচালিত সেচপাম্প কিনে গ্যারেজেই তাদের গবেষণা ও রূপান্তর কাজ করলেন। ডিজেলচালিত পাম্পকে সিএনজিচালিত পাম্পে রূপান্তর করলেন। তাদের উদ্ভাবিত নতুন প্রযুক্তিতে গ্যাসচালিত পাওয়ার পাম্পে জ্বালানি খরচ এক-চতুর্থাংশ কমে আসবে। সঙ্গে সাশ্রয় হয়ে বিদেশি মুদ্রার। উদ্ভাবিত গ্যাসচালিত পাওয়ার পাম্প চালাতে এখন আর ডিজেল বা বিদ্যুতের প্রয়োজন হবে না। এ উদ্ভাবকদের পদ্ধতিতে একটি ডিজেলচালিত পাওয়ার পাম্পকে সিএনজিতে রূপান্তর করতে খরচ হবে দুই হাজার টাকা।
কুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মাসুম বিল্লাহ ও লাবিব এবং যন্ত্রকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী জি এম সুলতান মাহমুদ রানা প্রায় দুই বছরের চেষ্টায় প্রথম ইউনিভার্সাল স্মার্ট এনার্জি মিটার উদ্ভাবন করেন। তাদের এ মিটার উদ্ভাবনের ফলে মোবাইল ফোনের এসএমএসের মাধ্যমেই বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। দরকার হবে না আইপিএস, জেনারেটর ও ব্যাটারির। মিটারটি ব্যবহার করলে ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সুবিধা পাবেন গ্রাহকরা। দেশের আবাসিক অঞ্চলের জন্য মিটারটি অভাবনীয় সাফল্য ধরে রাখবে বলে দাবি উদ্ভাবক টিমের। চীনা প্রযুক্তির আদলে চুয়াডাঙ্গার পল্লী গোকুলখালীতে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী একাধিক রিচার্জেবল লাইট কারখানা গড়ে উঠেছে। ইলেকট্রনিকস মিস্ত্রি আলাউদ্দিন প্রথম বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী চার্জার লাইট তৈরি শুরু করেন। এসব কারখানায় তৈরি হচ্ছে স্বল্পমূল্যের হারিকেনের বিকল্প লাইট। এরই মধ্যে লোডশেডিংয়ের কবলে পড়া এ জেলার চাহিদা ছাপিয়ে রিচার্জেবল লাইট বিভিন্ন জেলায়ও সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে স্থানীয় কয়েক হাজার বেকার যুবকের কর্মসংস্থানের সুযোগের পাশাপাশি এ ব্যবসাটি পরিবেশবান্ধব হিসেবেও পেয়েছে পরিচিতি।
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। এ দেশের সিংহভাগ জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যপীড়িত। অভাবের কারণে এ দেশের অনেক পরিবারের সদস্যরা কাক্সিক্ষত শিক্ষা পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। এমন দেশে স্বল্প শিক্ষিত নাগরিকদের সাশ্রয়ী এসব উদ্ভাবন সমৃদ্ধ সম্ভাবনার হাতছানি দেয়। দেশের মানুষের মেধাকে ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারলে স্বনির্ভরতার সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো খুব সম্ভব। চীনের তৈরি জিনিসে ছেয়ে গেছে দেশ- তবে মেড ইন জিঞ্জিরা কেন নয়। ধোলাইখালের যন্ত্রকারিগরেরা কেন অবহেলিত। আমাদের এ আশাজাগানিয়া সম্ভাবনাময় উদ্ভাবকদের মেধাকে কাজে লাগাবার কথা সরকারকে ভাবতে হবে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় দেশীয় প্রযুক্তির প্রয়োগ ঘটাতে পারলেই সফলতা অনিবার্য। সরকার প্রয়োজনে বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরকেও এসব প্রযুক্তিকে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন ও বাজারজাত করার জন্য উৎসাহ দিতে পারে। এর ফলে গড়ে উঠবে প্রযুক্তির কারখানা। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। সাশ্রয় হবে বৈদেশিক মুদ্রা।
লেখক :এস এম মুকুল; প্রাবন্ধিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
No comments:
Post a Comment