Thursday, December 15, 2016

পতাকা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শকতি

গাইবান্ধার ছাপাতন বেওয়ার সরকারি সহায়তা পাওয়ার খবর পত্রিকায় পড়লাম। ৭২ বছর বয়সী ছাপাতন বেওয়া হলো আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নির্যাতনের শিকার অসংখ্য দুর্ভাগা নারীর একজন। বীরাঙ্গনা। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর তিনি তার স্বীকৃতি পেলেন। ছাপাতন বেওয়াকে হানাদাররা তার এক মাস বয়সী শিশুকে তার কোল থেকে ছুড়ে ফেলে তার ওপর নির্যাতন চালিয়েছিল। পরিসংখ্যান শুধু সংখ্যার হিসাব করে। ভয়াবহতার হিসাব করে না। নৃশংস ও নির্মমতার দিক থেকে পৃথিবীর যেকোনো গণহত্যার চেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল পাকিস্তানিদের গণহত্যা। যেখানে এক রাতেই রক্তের নদী বানিয়ে ফেলেছিল ঢাকা শহরে। ছাপাতন বেওয়ার মতো অনেক বীরাঙ্গনাকেই খুঁজে বের করে তাদের অবদানের প্রতি সম্মাননা দেওয়া হচ্ছে। যদিও অনেক আগেই তাদের এই পাওনা ছিল দেশের কাছে। তবে শেষ পর্যন্ত আমরা পারছি, সেটাও ইতিবাচক।
বাংলাদেশে গণহত্যা বইতে সিডনির শৈল চিকিৎসক ড. জিওফ্রে ডেভিস তার মতামতে বলেছেন, ধর্ষিতা মহিলাদের সংখ্যা সরকারি কর্মচারীদের হিসাবে আনুমানিক দুই লাখ হলেও তার মতে, এ সংখ্যা অনেক কম করে অনুমান করা হয়েছে। তিনি মনে করেন, এই সংখ্যা চার থেকে চার লাখ ত্রিশ হাজারের মতো হতে পারে। তিনি আরো বলেন, অন্তঃসত্তা মহিলার সংখ্যাই দুই লাখ। এসব মহিলার অনেকেই যৌন রোগে আক্রান্ত হয়েছেন আবার অনেকেই বন্ধ্যত্ব বরণ করেছেন। অনেক মহিলাকেই যুদ্ধের পর স্বামী ছেড়ে গেছে। অনেকেই মানবেতর জীবনযাপন করেছেন। সুতরাং পরিবার-পরিজনহীন একাকী জীবন সংগ্রাম করে বেঁচে থাকা এসব বীরাঙ্গনাকে মর্যাদার আসনে বসাতে হবে। তাদের প্রাপ্য নিশ্চিত করতে হবে।
শুধু বীরাঙ্গনা নয়, আজো অনেক মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি পায়নি তাদের উৎসর্গের। যেসব মানুষ আমাদের একটি স্বাধীন দেশ এনে দিতে জীবনবাজি রেখেছেন তাদের কেউ কেউ আজো অবহেলিত। দেশকে ভালোবেসে যাওয়াই তাদের একমাত্র সান্ত¦না। কিন্তু তাদের জন্য কিছু না করতে পারাটা আমাদের ব্যর্থতা। আমরা চাই, একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যিনি এ দেশের জন্য রণাঙ্গনে জীবনবাজি রেখেছিলেন তিনি তার কর্মের স্বীকৃতি পাবেন। এসব মুক্তিযোদ্ধাকে খুঁজে বের করে তাদের প্রাপ্য সম্মান দেওয়া হোক। একজন মুক্তিযোদ্ধা যদি আজো রিকশার প্যাডেলে জীবন চালান তাও আমাদের জন্য লজ্জার। তাদের ঋণের শোধ না হলেও সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা করাই যায়। আবার মুক্তিযুদ্ধ না করেও যারা এর সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন তারা দেশ ও জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। তাদের অবশ্যই চিহ্নিত করতে হবে। আমরা দেশের সূর্য সন্তানদের সঙ্গে কোনো প্রতারককে দেখতে চাই না। ডিসেম্বর মাস আমাদের স্বাধীনতার মাস। আমাদের অস্তিত্বের স্বীকৃতির মাস।
পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণী জন্ম থেকেই স্বাধীনতামুখী। প্রতিটি প্রাণী নিজ স্বাধীনতা অর্জনে বদ্ধপরিকর। আবার একশ্রেণির প্রাণী থাকে যারা অন্যের স্বাধীনতা হরণ করেই শান্তি পায়। একশ্রেণি শোষণকারী অপরদিকে থাকে শোষিত শ্রেণি। যারা অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে চলে। যুগ যুগ ধরে এটা হয়ে আসছে। শোষিত শ্রেণি যখনই অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে রাস্তায় নামে, সংগ্রাম করে তখনই তাদের ওপর নেমে আসে জুলুমকারীদের খড়গ। কিন্তু এ কথা ঠিক যে, স্বাধীনতা বঞ্চিত মানুষের ক্ষোভ হয় তীব্র এবং তা সব বাধা ভেঙে দেয়। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা। বাঙালি জাতির মরণপণ সংগ্রামের ফলেই এ স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। এটা আমাদের চূড়ান্ত ত্যাগের প্রতীক। আমরা যারা এ প্রজন্মের তারা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। কিন্তু আমরা যতটুকু জেনেছি, তাতে শ্রদ্ধায় আমাদের মাথা নত হয়ে আসে।
সত্যিকার অর্থে দেশকে এগিয়ে নিতে আজকের প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন করতে হবে। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে জন্ম গ্রহণ করাটা যে কতটা সৌভাগ্যের তা কেবল স্বাধীন দেশে জন্ম নেওয়া, বেড়ে ওঠা একটি শিশুই বলতে পারবে। যার একটি সুন্দর শৈশব থাকবে, যে নির্ভয়ে খেলা করবে, লেখাপড়া শিখবে। কারণ পৃথিবীতে আজ যারা স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছে তাদের নির্মম পরিণতি চোখের সামনে দেখছি। আমরা ফিলিস্তিনের সংগ্রাম দেখছি। এমনকি একটু বেঁচে থাকার স্বাধীনতার জন্য মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের সংগ্রামকে দেখছি। বহু জাতি বহু সংগ্রাম, যুদ্ধ, রক্ত, ইজ্জত, সম্পদ হারিয়েছে কেবল স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়ার জন্য। আমরাও করেছি। দীর্ঘ নয় মাস করেছি। রক্ত দিয়েছি, সম্পদ দিয়েছি, ইজ্জত দিয়েছি। সব দিয়েছি শুধু দেশ স্বাধীন করার জন্য। দেশ স্বাধীন মানে আমাদের নিজস্বতা অর্জন করা। বাংলাদেশে জন্ম গ্রহণ করা প্রতিটি মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করে।

দেশ তোমাকে কি দিয়েছে তা বড় কথা নয়, তুমি দেশকে কী দিতে পেরেছ সেটাই বড় কথা। সত্যি তো, স্বাধীনতার তো বহু বছর পার হয়ে গেল। কী দিতে পেরেছি আমরা দেশটাকে। কতটুকুই বা দিতে পেরেছি। দেশের কাছে এটা চাই ওটা চাই, কিন্তু আমি কী দিচ্ছি। দেশটাতো আমাদের। আমরা ছাড়া কেইবা দেশের জন্য ভাববে? আজ আমরা গর্ব করে বলতে পারি, আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক

ছোটবেলায় ব্যাকরণ বইয়ের ভাব সম্প্রসারণে পড়েছি, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন। কিন্তু তখন এর অর্থ পুরোপুরি বুঝতে পারিনি। কথাটির গভীরতা এখন বুঝতে পারি। স্বাধীনতা বলতে যা বোঝায় তা ধরে রাখা এবং মুক্তিকামী মানুষের স্বপ্নের দেশে পরিণত করাটাই চ্যালেঞ্জের বিষয়। কতটা চ্যালেঞ্জের তা আমরা বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে বুঝতে পারি। কারণ প্রতি পদক্ষেপে বাধা আসবে। একটি রাষ্ট্র গঠনের জন্য দরকার ভূখ-, সার্বভৌমত্ব, জনগণ ও সরকার। কিন্তু সেই রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিতে প্রয়োজন ঘুষ, দুর্নীতিমুক্ত হওয়া। আমাদের স্বাধীনতার উদ্দেশ্য আজ বাধাগ্রস্ত করছে অসৎ মানুষদের অসৎ মনোভাব। একশ্রেণির অসাধু মানুষ ঘুষ নামক শব্দটিকে তাদের জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ফেলেছে। যার জাল ছিঁড়ে মুক্ত হওয়া যাচ্ছে না। সেই জাল ছিঁড়ে মুক্ত করার দায়িত্ব নিতে হবে আজকের তরুণ প্রজন্মকে। যারা এই দেশটাকে ভালোবাসে। দেশের জন্য কাঁদে। জাতীয় সঙ্গীতে যাদের কণ্ঠ সুর মেলায় তাদের হাত ধরেই আসবে প্রকৃত স্বাধীনতা।
একসময় এই দেশটা দুর্নীতিতে প্রথম হয়েছে। অত্যন্ত লজ্জাজনক সে সময়টা আমরা পেছনে ফেলে এসেছি। আজ আর সেকথা মনে করতে চাই না। কিন্তু আর যেন বিশ্বের দরবারে আমাদের লজ্জা না পেতে হয় সে শপথ নিতে হবে। দুর্নীতি এখনো সমাজটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। সে অবস্থা থেকে বের হতে হবে। না হলে সেই স্বাধীনতার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে। যে লাল সবুজ পতাকা আমরা পেয়েছি তা যেন সবার ওপরে নিয়ে ওড়াতে পারি সে দায়িত্ব কিন্তু আমাদেরই। কারণ যখনই কোন কারণে এই সোনার দেশটার দিকে বিশ্ব আঙুল তুলে অভিযোগ করে আমাদের বুঝতে হবে তার দায় আমাদেরই। কারণ এই মানুষগুলোর জন্যই দেশটার দিকে অভিযোগ ওঠে। ধর্মীয় সম্প্রীতির এক অনন্য উদাহরণের নাম বাংলাদেশ। সেই আদিকাল থেকেই এদেশে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান পাশাপাশি হাত ধরে বসবাস করে আসছে। স্বাধীনতার পর থেকেও একই পতাকার নিচে আমরা সবাই আজ বসবাস করছি। আমরা চাই না এদেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ঘিরে ফেলুক। সব ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী যেন শান্তিতে বসবাস করতে পারে। স্বাধীনতার এটাও উদ্দেশ্য।
দেশ নিয়ে একটি কথা আমাকে খুব টানে। সেটা হলো দেশ তোমাকে কি দিয়েছে তা বড় কথা নয়, তুমি দেশকে কী দিতে পেরেছ সেটাই বড় কথা। সত্যি তো, স্বাধীনতার তো বহু বছর পার হয়ে গেল। কী দিতে পেরেছি আমরা দেশটাকে। কতটুকুই বা দিতে পেরেছি। দেশের কাছে এটা চাই ওটা চাই, কিন্তু আমি কী দিচ্ছি। দেশটাতো আমাদের। আমরা ছাড়া কেইবা দেশের জন্য ভাববে? আজ আমরা গর্ব করে বলতে পারি, আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। আমাদের একটি লাল সবুজ পতাকা আছে। সেই পতাকা আমাদের অহংকার।
লেখা শুরু করেছিলাম গাইবান্ধার ছাপাতন বেওয়ার বীরাঙ্গনা স্বীকৃতি পাওয়া নিয়ে। আমরা চাই, দেশটাকে স্বাধীন করার জন্য যারা সর্বস্ব বাজি রেখেছিলেন তারা যেন তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু পান। তারা বেঁচে থাক আমাদের মধ্যে, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে। কবির ভাষায়, ‘তোমার পতাকা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শকতি।’ এই লাল সবুজ পতাকা যেন আমরা মর্যাদার সঙ্গে, গৌরবের সঙ্গে চিরকাল, আত্মর্মাদার সঙ্গে ধরে রাখতে পারি সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা আমাদের করতে হবে।
লেখক :অলোক আচার্য্য; সাংবাদিক ও কলামিস্ট

No comments:

Post a Comment