Friday, December 2, 2016

গ্রামের গল্প বলি

রাজশাহী অঞ্চলের নাটোরে খোলাবাড়িয়া একটি গ্রামের নাম। গ্রাম তো গ্রামই। গ্রামের নামও তো নামই। নামের কোনো পরিবর্তন হয় না বলেই জেনে এসেছি। কিন্তু এবারের গল্পে ঘটেছে তার ব্যতিক্রম। গ্রামের এক বৃক্ষপ্রেমিক আফাজ পাগলা বাড়ির পাশে ৫টি ঘৃতকুমারীর গাছ রোপণ করেন। এই ঘৃতকুমারীর গাছই বদলে দিয়েছে গ্রামটির নাম। বদলে দিয়েছে গ্রামের আর্থিক অবস্থা। খোলাবাড়িয়া এখন ‘ঔষধিগ্রাম’ নামেই অধিক পরিচিত। আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে সেই আফাজ পাগলার ঘৃতকুমারীর চারা বদলে দিয়েছে গ্রামবাসীর দৃষ্টিভঙ্গি। ঔষধিগুণসম্পন্ন গাছের বদৌলতে বদলে গেছে পুরো গ্রামবাসীর জীবনযাত্রা। বদলে গেছে তাদের চিন্তা-চেতনা ও কর্ম। গ্রামের ১৬শ পরিবার এখন ঔষধিগাছের ওপর জীবিকা নির্বাহ করে।
গ্রামের চারপাশে বিঘার পর বিঘা জমিতে ঘৃতকুমারীর চাষাবাদ। যাদের জমিজমা নেই, তারাও বাড়ির আঙিনায় যেখানে সুযোগ আছে সেখানেই চাষ করছেন ঘৃতকুমারীর। এই গ্রামে মোট ২৫ হেক্টর জমিতে ঔষধিগাছের চাষাবাদ হয়। আশ্চর্য! এই ঔষধিগ্রামের মোড়ে মোড়ে গড়ে উঠেছে ভেষজ উদ্ভিদ বিক্রির দোকান। শুধু নামে ঔষধিগ্রাম নয়, গ্রামের মানুষের জীবন-জীবিকার একমাত্র মাধ্যম এখন ভেষজ চাষাবাদ।
বাণিজ্যিক সুবিধার জন্য সেখানে গড়ে উঠেছে ‘ভেষজ বহুমুখী সমবায় সমিতি’। সমিতির মাধ্যমে ক্রেতা-বিক্রেতা আর উৎপাদনকারীর সমন্বয়ে জমে উঠেছে ভেষজ বিপ্লব। আফাজ পাগলার ভেষজ প্রেমের অনুসারী হয়ে গ্রামের সবাই এখন ভেষজ চাষি। গ্রামের নারীরা এ কাজে অনেক এগিয়ে। ঔষধি চাষাবাদের জন্য এ গ্রামের নারীদের বলা হয় ‘বনজরানী’। গ্রামের মাটিরও নাম দেওয়া হয়েছে ‘ভেষজমাটি’। আফাজ পাগলের ১৭ কাঠার চাষের জমিতে ৪৫০ প্রজাতির ভেষজ নার্সারি গড়ে তোলা হয়েছে। গ্রামে এ রকম আরো আছে ৮টি নার্সারি। এসব নার্সারিতে আছে বাসক, সাদা তুলসী, উলটকম্বল, চিরতা, নিম, কৃষ্ণতুলসী, রামতুলসী, ক্যাকটাস, সর্পগন্ধা, মিশ্রিদানা, হরীতকী, লজ্জাবতীসহ হরেক রকমের ঔষধিগাছ। গ্রামটিতে ৫০০ কৃষক সব সময় ভেষজ চাষাবাদ করেন। কৃষকদের স্বার্থে সেখানে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘ভেষজ গাছগাছড়া উৎপাদন সমবায় সমিতি’। জানা গেছে, দেশে প্রায় ১০০ কোটি টাকার ঔষধি কাঁচামালের স্থানীয় বাজার রয়েছে। এই ঔষধিগ্রাম এ চাহিদার অধিকাংশের জোগান দেয়। ঔষধিগ্রামের এই ভেষজ চাষাবাদ এখন ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিবেশী গ্রামগুলোতেও। এ যেন এক ভেষজ বিপ্লব কাহিনি। ভেষজ গাছগাছড়ার চাষাবাদে আফাজ পাগলের এই দৃষ্টান্ত সবার জন্য অনুসরণীয় হোক।
ঔষধিগ্রামের পর শুনুন একটি মুড়িগ্রামের গল্প। কুড়কুড়ে মুড়মুড়ে মুড়ি বাঙালির প্রাচীন মুখরোচক খাবার। মুড়ি ভাজাকে উপজীব্য করে জীবিকা নির্বাহ করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ। এদের মাঝে নারীরাই উল্লেখযোগ্য। দেশের প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে মুড়ি ভাজা পেশাদার বিছিন্নভাবে পাওয়া যায়। কিন্তু গ্রামের অধিকাংশ মানুষ এমন পেশার ওপর নির্ভরশীল, এমন গ্রাম খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। একটি নয় দুটি নয়, ঝালকাঠির দপদপিয়া ইউনিয়নের রাজাখালি, দপদপিয়া, তিমিরকাঠি, ভরতকাঠি ও জুরাকাঠি—এই পাঁচটি গ্রামের অধিকাংশ মানুষ মুড়ি তৈরির ওপর জীবিকা নির্বাহ করে। এই গ্রামগুলোতে রাত-দিন চলে মুড়ি তৈরির ব্যস্ততা। এই দপদপিয়ায় নাকি বছরে প্রায় দুই কোটি টাকার মুড়ি উৎপাদন হয়। তথ্যে জানা গেছে, একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ দৈনিক ২ মণ মুড়ি ভাজতে পারেন। এই গ্রামগুলোতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পালাক্রমে মুড়ি ভাজার কাজ করেন। মুড়ি তৈরিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে অনেক পরিবার দেখেছে সচ্ছলতার মুখ। তাই মুড়ি ভাজা এখন গ্রামে একটি শিল্পে পরিণত হয়েছে। একই স্থানে সমজাতীয় পেশা জনপ্রিয় হলে সে পেশাকে কেন্দ্র করেই শিল্পের জন্ম হয়। আমাদের জীবন-জীবিকাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এসব শিল্প দেশজ স্বনির্ভরতার প্রতীক। তবে এ শিল্পেরও অনেক সমস্যা আছে। মেশিনের মাধ্যমে সারমিশ্রিত মুড়ি অপেক্ষাকৃত কম খরচে তৈরি করে কম মূল্যে বাজারজাত করার কারণে এই গ্রামবাসীর রোজগারের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব মুড়ি সহজ উপায়ে সার মিশিয়ে তৈরি হয়। স্বাস্থ্যের জন্য এগুলো খুবই ক্ষতিকর। সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে এই মুড়ি গ্রামকে বাণিজ্যিক মুড়ি উৎপাদনকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার কথা ভাবা যেতে পারে। আমরা প্রত্যাশা করব মুড়িগ্রামগুলোকে বাণিজ্যিকীকরণ করে আরো অধিক উৎপাদন এবং এ পেশায় ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসবেন।
এবার শুনুন বৃক্ষপেমিক অলির স্বপ্নভুবনের গল্প। তিনি ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জের আলাউল হক অলি। এই বৃক্ষপ্রেমিকের নেশায়-পেশায় জড়িয়ে আছে গাছ। প্রায় ৬০ বিঘা জায়গাজুড়ে বিশাল এলাকায় তার বৃক্ষ উদ্যান। তার এই উদ্যানই এখন হাজার মানুষের কর্মক্ষেত্র। ফুল, ফল আর ঔষধি—সব রকমের গাছই আছে তার সংগ্রহে। তার উদ্যানের আছে বিশাল রেকর্ড। তার বাগানে ফলেছে ৮-১০ কেজি ওজনের বেল, ৫০০ গ্রাম ওজনের কামরাঙা, প্রমাণ সাইজের লেবু, বিশালাকৃতির জাম, জামরুল, আতা, কদবেলসহ নানান রকমের দুষ্প্রাপ্য আম, কাঁঠাল আর পেয়ারা। দোফলা, ত্রিফলা, বারোমাসি বিভিন্ন ধরনের আমের সংগ্রহ আছে তার কাছে। স্বাদে, গন্ধে, বর্ণে সব ভিন্ন ভিন্ন। আছে খাজাভোগ, কনেচাহনি, রাজদেশি, চিনিচমক, গোলাপবাস, মোহনভোগ, গোপালভোগ, ল্যাংড়া, ফজলিসহ নানা বিরল প্রজাতির আমগাছ। ফলের মৌ মৌ গন্ধে ভরপুর তার বৃক্ষ উদ্যান। অলি দেশ-বিদেশ থেকে নানান প্রজাতির ফলদ, বনজ আর ঔষধি বৃক্ষ সংগ্রহ করেছেন বিভিন্ন উপায়ে। এজন্য কারো কাছে মাথা নত করতে তার যেন কোনো আপত্তি নেই। বিচিত্র চিন্তার এই সৃজনশীল কৃষক বৃক্ষের সঙ্গে ভালোবাসায় নিমগ্ন অহর্নিশ। তার উদ্যানে আছে দেশিজাতের দারুচিনি, তেজপাতা, আমলা, খয়ের, হরিতকী, গোলমরিচ, চন্দন, কাঠবাদাম, কাউফল, পেস্তা, চালতা, আতা, লুকলুকি, সফেদা, জলপাই, আমলক, জাম্বুরাসহ বিদেশি জাতের বেদানা, কফি, রিটা, লবঙ্গ ও মাল্টাসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। তার এই উদ্যান যেন পাখিদের অভয়ারণ্য। এত খাবার কোথায় পাবে বনের পাখি। কোথায় পাবে অমৃতস্বাদ, গন্ধসুধা। তাই শুধু পাখি নয়, মৌমাছি আর প্রজাপতির এক বিচিত্র ভুবন এই উদ্যান। এখানে নাকি প্রায় হাজার দুয়েক বনো কবুতর বাস করে নির্ভয়ে। তার সঙ্গে আছে পেঁচা, চড়ুই, ফিঙে, কোকিল, চিল, বকসহ কত রকমের পাখি! অলি সাহেব আবার ওদের খাদ্য আর নিরাপত্তার বিষয়ে খুবই যত্নশীল। ওরা যেন তার মেহমান। তাই বাসা বাধার সুবিধার্থে তিনি গাছের উঁচু ডালে মাটির হাঁড়িপাতিল বেঁধে রাখেন। তা ছাড়া এত বড় উদ্যানের খাবার তো ফ্রি-ই থাকছে। এসবের পাশাপাশি অলি সাহেবের রয়েছে বেশ কয়েকটি পুকুর। ওখানে চলছে রকমারি মাছের চাষ। পাশাপাশি গবাদিপশুর খামারে আছে গরু, ছাগল, ভেড়া আর মহিষ। আলাউল অলি শুধু নিজের বাগানের যত্ন করেই ক্ষান্ত নন। রকমারি গাছের চারা বিনামূল্যে বিতরণ করেন আত্মীয়স্বজন আর পাড়া-প্রতিবেশীর মাঝে। একজন অলির একান্ত চেষ্টায় গড়ে ওঠা উদ্যান হতে পারে আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস। কমবেশি আমাদের প্রত্যেকের বাড়ির আঙিনাজুড়ে বৃক্ষ রোপণের সুযোগ নিতে পারি। বৃহৎ উদ্যান না হলেও নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে পারলেই তো লাভ। আমরা প্রত্যকে যেন কমপক্ষে ৩টি করে গাছ লাগাই। কেননা আমাদের পরিবেশ রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদেরই।
লেখক : উন্নয়ন গবেষক

No comments:

Post a Comment