বাধ্য হয়েই নির্বাচনী ট্রেনে বিএনপি

সরকারের নির্বাচনী ট্রেনে পা দিয়েছে বিএনপি। একদিকে যেমন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা, অন্যদিকে দলের অস্তিত্ব রক্ষা- এই দুই বিষয়কে গুরুত্ব দিতে গিয়ে অনেকটা বাধ্য হয়েই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে দলটি। কারণ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুসারে ওই নির্বাচনে অংশ না নিলে বাতিল হয়ে যাবে দলটির নিবন্ধন। একইভাবে দশম সংসদ নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকারের বেশির ভাগ নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় দলের ভেতর ও বাইরে প্রচন্ড চাপের মুখে পড়েছে দলটি। বিমুখ হচ্ছেন ভোটার ও সমর্থকরা। দল পড়েছে নাজুক অবস্থায়। এ কারণেই রাজপথের আন্দোলনের পরিবর্তে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবিকে প্রাধান্য দিয়ে নির্বাচনমুখী রাজনীতির দিকেই এগোচ্ছে দলটি।
সরকারও চাইছে আগামী একাদশ জাতীয় নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণে প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ পরিবেশেই অনুষ্ঠিত হোক। সে জন্য বিশেষ রাজনৈতিক কৌশল নিয়েই এগোচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট। একদিকে যেমন এ কৌশলের মূল লক্ষ্য পুনরায় ক্ষমতায় আসা; তেমনি সংসদের বাইরে থাকা বিএনপিকে নির্বাচনে এনে নির্বাচনকেন্দ্রিক বিতর্ক এড়ানো। এরই অংশ হিসেবে সর্বশেষ নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে রাজনৈতিক দলের সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সে উদ্যোগে প্রাথমিক সফলতা এসেছে বিএনপির অংশগ্রহণে। এখন বাকি ইসি গঠন ও নির্বাচনের আগে বিএনপিকে কিছুতেই কোনো ইস্যুতে রাজপথে নামতে না দেওয়া। সে জন্য খুব সতর্কভাবে পা ফেলছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
এমনকি বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে অংশ নিতে আহ্বানও জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৃহস্পতিবার সরকারের তৃতীয় বর্ষপূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী আশা ব্যক্ত করেন যেসব দল সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনে অংশ নেবে এবং দেশে গণতান্ত্রিক ধারা সমুন্নত রাখতে সহায়তা করবে। এ সময় তিনি বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করতে দশম নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার বিএনপির রাজনৈতিক ক্ষতির বিষয়টিও তুলে ধরেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুসারে নিবন্ধিত কোনো রাজনৈতিক দল পরপর দুবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিলে ওই দলের নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে। যেহেতু বিএনপি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি, সেহেতু নিবন্ধন ঠেকাতে হলে বিএনপিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতেই হবে। এর আর কোনো বিকল্প নেই। একইভাবে দশম জাতীয় নির্বাচনের প্রথম বর্ষপূতিতে সরকারবিরোধী তিন মাসের জ্বালাও-পোড়াও ও প্রাণহানির আন্দোলনের ফলে এখন বিপর্যস্ত বিএনপি। গত তিন বছরেও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচন ব্যতিরেকে অন্য কোনো স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় তৃণমূলেও ভীষণ বেকায়দায় দলটি।
এর ফলে বিএনপি যে আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে- তা অনেকটাই নিশ্চিত। গত কয়েক দিনে দলের নেতাদের নির্বাচনমুখী বক্তব্য ও সরকারের কাছে ইসি গঠন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিসহ নির্বাচনকেন্দ্রিক বিভিন্ন দাবি-দাওয়াও তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে। একই সঙ্গে সবার অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও অবাধ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে আন্দোলনের জন্য দলটি ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নিচ্ছে। কাজ চলছে তিনশ আসনে দলীয় প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করার। এমনকি বৃহস্পতিবারের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনে অংশ নিতে দলের পক্ষ থেকে ছয়টি শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এই শর্তারোপও নির্বাচনে অংশ নেওয়ারই অংশ বলে মনে করছেন দলের নীতিনির্ধারণী মহল।
বিএনপির নির্বাচনে যাওয়ার ব্যাপারে একমত হলেও যাওয়ার কারণ হিসেবে ভিন্নমত পোষণ করেছেন দুই রাজনৈতিক বিশ্লেষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের মতে, বিএনপি সব কমিটি এখনো করতে পারেনি। দলটি বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে পড়েছে, সেখান থেকে উত্তরণের কোনো লক্ষণ নেই। তাই বিপুল জনসমর্থন থাকলেও তাদের সংগঠিত করার মতো শক্তি দলের নেই। আর এ অবস্থার সুযোগ সরকার নেবে। বিএনপিও নানা কারণেই অসুবিধার মধ্যে রয়েছে। সুতরাং এ নির্বাচনে অংশ নিয়ে সে সংকট কাটিয়ে ওঠার একটি সুযোগ হিসেবে দেখবে। আর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, বিএনপি নিশ্চিত এ নির্বাচনে যাবে। কারণ নির্বাচনের যে আবহ তৈরি হবে, নির্বাচন না করে থাকতে পারবে না। কারণ এ নির্বাচনে বহু রাজনৈতিক দল অংশ নেবে এবং প্রধানমন্ত্রী সে ঘোষণাও দিয়েছেন। আওয়ামী লীগেরও সে প্রস্তুতি রয়েছে। সরকার নির্বাচনকে যে কোনো উপায়ে গ্রহণযোগ্য করতে চাইবে। সুতরাং বিএনপি এ নির্বাচন বয়কট করলে নিজেরাই দোষের মধ্যে পড়বে। নিশ্চয় দলটি আর সে দুর্নাম নেবে না।
বিশেষ কৌশলে আওয়ামী লীগ : বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নেওয়াতে বিশেষ রাজনৈতিক কৌশল প্রয়োগের পাশাপাশি নিজেরাও নির্বাচনী প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সর্বশেষ গতকাল দলের নেতাদের সঙ্গে এক মতবিনিময় অনুষ্ঠানের সূচনা বক্তব্যে দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, আগামী নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগের ইশতেহার তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। নির্বাচনের জন্য দলের নেতাকর্মীকে প্রস্তুতি নেওয়ারও নির্দেশ দেন তিনি।অবশ্য আওয়ামী লীগও বিশেষ নির্বাচনী কৌশল নিয়েই এগোচ্ছে। ইতোমধ্যেই ক্ষমসতাসীন দলের রাজনৈতিক কৌশলের কাছে প্রায় বিপর্যস্ত বিএনপি। মাঠে দাঁড়াতেই পারছে না দলটি। যুদ্ধাপরাধের দায়ে নিবন্ধন বাতিল হয়েছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতের ইসলামীর। অন্যান্য শরিক দলগুলোর অবস্থাও নাজুক। মামলার ভয়েভীতি বিএনপির চেয়ারপারসন। নির্বাচনে অংশ নিতে দলের ভেতর ও বাইরে থেকে চাপ রয়েছে। এমন অবস্থায় নিরুপায় হয়েই নির্বাচনী ট্রেনে পা দিয়েছে বিএনপি।
আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, অক্টোবরে অনুষ্ঠিত ২০তম জাতীয় সম্মেলনই মূলত দলের নির্বাচনী প্রস্তুতি আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু। সেখান থেকেই দলীয় সাংসদদের চলমান উন্নয়নমূলক প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নে তদারক করার এবং নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। এর আগে গত জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভায় প্রধানমন্ত্রী দলের সংসদ সদস্যদের নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
দলীয় একটি সূত্র জানায়, নির্বাচনে সম্ভাব্য দলীয় প্রার্থীদের তালিকা করার জন্য মাঠপর্যায়ে খোঁজখবর নিতে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সংস্থাগুলোর মাধ্যমে বর্তমান সাংসদদের জনপ্রিয়তা, নেতাকর্মীদের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ, নানা অভিযোগ এবং দলে অবস্থান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। প্রতিটি আসনে অন্তত পাঁচজনের নাম দিয়ে তালিকা তৈরি করা হবে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া বিদেশি একটি জরিপ প্রতিষ্ঠানকেও মাঠের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন তৈরি করতে বলা হয়েছে।
দলীয় সূত্রগুলো বলছে, আওয়ামী লীগ মনে করছে আগামী জাতীয় নির্বাচন বয়কট করে টিকে থাকার মতো সাংগঠনিক অবস্থা বিএনপির নেই। এ অবস্থায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অধীনেই বিএনপি পরবর্তী নির্বাচনে আসতে পারে। এ ক্ষেত্রে তাদের দরকষাকষির মূল জায়গা হয়ে উঠতে পারে নির্বাচন কমিশনের সংস্কার এবং অন্তর্র্বতীকালীন সরকারে কার কী অবস্থান হবে সেটাই। এর মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দাবি থেকে সরে এসেছে বিএনপি। বাকি ইসি গঠন নিয়েও এক ধরনের সমঝোতার পথেই যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
বাধ্য হয়েই নির্বাচনে বিএনপি : এ মুহূর্তে বিএনপির সবকিছুই আগামী নির্বাচনকেন্দ্রিক। সর্বশেষ বৃহস্পতিবারও দলের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলা হয়েছে, জাতীয় নির্বাচনে যেতে চাই, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করুন। এর জন্য অবশ্য দলের পক্ষ থেকে ছয়টি শর্তও জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এগুলো হলো- নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন, বিরোধী দল নির্মূলের যে প্রক্রিয়া চলছে তা বন্ধ করা, সব রাজনৈতিক নেতাকে মুক্তি, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, সভা, মিছিল, সমাবেশ করার সমান সুযোগ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা।
দলের নীতিনির্ধারণী মহল মনে করছে, বড় ধরনের জটিলতা সৃষ্টি না হলে বিএনপি আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নেয়ার মতো ভুল দ্বিতীয়বার করবে না। জাতীয় নির্বাচন যখনই হবে বিএনপি তাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেবে। এজন্য শুধু নির্বাচনী প্রস্তুতি ছাড়া ভিন্ন কোনো এজেন্ডা নিয়ে বিএনপি আর সময় ব্যয় করবে না। হাইকমান্ডের এমন মনোভাবের কথা দলের সব ধাপকে জানিয়ে দিতে বলা হয়েছে।
দলের নেতারা মনে করছেন, পরবর্তী নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হলেই কেবল তা বিএনপির জন্য ভালো ফল বয়ে আনতে পারে। নির্বাচনকালীন সরকার কাঠামো কেমন হবে, তা নিয়ে বিএনপি যদিও ভাবছে, তবে এ ভাবনায় কট্টর কোনো অবস্থান নেই। বিদ্যমান ব্যবস্থায় অর্থাৎ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রশ্নে দলের মধ্যে কোন ভিন্নমত নেই। পাশাপাশি জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনমুখী মানসিকতায় পরিবর্তন এনে নতুন স্ট্র্যাটেজির দিকে এগোচ্ছে বিএনপি।এক্ষেত্রে সাংগঠনিক ও কূটনৈতিক তৎপরতার পরিধি বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। বারবার চেষ্টা করেও আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ায় এখন সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে তুলতে তৎপর দলের হাইকমান্ড। এজন্য অতীতের ভুলত্রুটি সংশোধন করে এবার সর্বস্তরে দল গুছিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। ৫৯২ সদস্যের বিএনপির নতুন নির্বাহী কমিটি গঠনের পর ইতোমধ্যেই সারাদেশের মহানগর, জেলা, উপজেলা ও এর অধীন অন্যান্য ইউনিটকে নতুন নেতৃত্বে ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।বিএনপি পুনর্গঠনের পাশাপাশি দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোকেও ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।বিএনপিপন্থি কয়েকজন বুদ্ধিজীবী দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে চিঠি লিখে দল গোছানো এবং পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
No comments:
Post a Comment