Thursday, January 26, 2017

মানবিক পুলিশ ভয়ংকর পুলিশ

২০১৬ সালে ১১ ডিসেম্বর দুপুরে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের রামু উপজেলার পানিরছড়া এলাকায় একটি বাস উল্টে ঘটনাস্থলেই নিহত হন চারজন। ওই দুর্ঘটনায় আহত হন কমপক্ষে ২৩ জন। সেই দুর্ঘটনাকবলিত বাসের ভেতর থেকে এক শিশুকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন পুলিশের এক কনস্টেবল। তার নাম শের আলী। শিশুকে বাঁচানোর সময় কান্নারত শের আলীর সেই ছবি মুহূর্তেই ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। একজন পুলিশ সদস্যের এমন মানবিক গুণ দেখে অবাক হয় গোটা দেশ। শের আলীর তোলপাড় সৃষ্টি করা সেই ছবি বিভিন্ন গণমাধ্যমে গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়। ফলস্বরূপ, এ বছর রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদকও (পিপিএম) পেয়েছেন শের আলী।
কেস স্টাডি-২: ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল পল্লীর চিনিকল কর্তৃপক্ষের জমি দখল নিতে গিয়ে পুলিশ ও স্থানীয়দের সঙ্গে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোকজনের ভয়াবহ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সেই ঘটনায় গোলাগুলিতে তিন সাঁওতাল নিহত হন। আহত হন কমপক্ষে ৩০ জন। পুড়িয়ে দেওয়া হয় সাঁওতালদের অসংখ্য বাড়িঘর। ঘটনার দিন থেকেই বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের জন্য পুলিশকে দায়ী করেন সাঁওতালর। কিন্তু ঘটনার কয়েকদিন পর সাঁওতাল পল্লীর একটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করছেন পুলিশ-এমন একটি ভিডিও প্রচার করে বিদেশি গণমাধ্যম আল জাজিরা। সেই ভিডিও এবং ছবি ভাইরাল হয় ফেসবুকে। পুলিশের এমন কা-ে স্তব্ধ হয়ে যায় বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্ব। দায়ী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন আদালত। কিন্তু ঘটনার আড়াই মাস পেরিয়ে গেলেও ‘দায়ী পুলিশ’ সদস্যদের বিরুদ্ধে দৃশ্যত কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। গত বছরের ১৮ নভেম্বর রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেল মোড়ে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার সময় হাতেনাতে ধরা পড়েন ট্রাফিক পুলিশের এক কনস্টেবল। ছিনতাইয়ে জড়িত আরেক কনস্টেবলকে পরে উত্তরা থেকে গ্রেফতার করা হয়। এ ঘটনা পুলিশ প্রশাসনে ছড়িয়ে পড়লে সবাই হতবাক হয়ে যান। কেমন করে সুশৃঙ্খল এ বাহিনীর সদস্যরা দিনের বেলা প্রকাশ্যে এ ধরনের অপরাধ করার সাহস পায় সে প্রশ্নও তোলেন তারা। যদিও ছিনতাইয়ে জড়িত পুলিশের দুই সদস্যকে ওইদিনই বরখাস্ত করা হয়।
ছিনতাইয়ের অপরাধে এক কিশোরকে আটকের পর জনতার হাতে দিয়ে তাকে পিটিয়ে হত্যায় সহায়তার অভিযোগও রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে। সেই ভিডিও-ও ফেসবুকে ভাইরাল হয়।
সমাজের অপরাধ দমনের দায়িত্ব যাদের ঘাড়ে, সেই পুলিশের মধ্যেই ভীষণভাবে বাড়ছে অপরাধপ্রবণতা। রক্ষক থেকে ভক্ষক হওয়ার এসব ঘটনায় পুলিশের বিভিন্নপর্যায়ের কর্মকর্তারা জড়িত। বিশেষজ্ঞদের মতে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুলিশের শাস্তি হিসেবে বদলি, প্রত্যাহার বা সাময়িক বরখাস্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আর তাই শুধু শাস্তি দিয়ে পুলিশ সদস্যদের অপরাধ কমছে না। শাস্তির পাশাপাশি মোটিভেশন ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পুলিশের অপরাধ কমানোর চেষ্টা করার বিষয়ে মত দেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, উপযুক্ত শাস্তি ও জবাবদিহিতা না থাকায় পুলিশে অপরাধ বাড়ছে। শাস্তির পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের মোটিভেশনাল প্রোগ্রাম করলে পুলিশের এ ধরনের অপরাধ কমবে বলেও মনে করেন তিনি।
পেশাদার অপরাধীদের মতো নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়া পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও সদস্যদের নিয়ে চরম বিপাকে পুলিশের উচ্চপর্যায়ের কর্তাব্যক্তিরা। আবার পুলিশ যখন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, তখন শীর্ষ ব্যক্তিরা একটা সাধারণ বক্তব্য দিয়ে থাকেন। আর সেটা হলো- ব্যক্তির অপরাধের দায় বাহিনী নেবে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ব্যক্তি যখন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, সে ঘটনার তদন্ত পুলিশই করে থাকে। তাই দায়ী পুলিশের পক্ষে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করা কোনো ব্যাপারই না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপরাধের ধরন অনুযায়ী জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও থামছে না তাদের অপরাধ। ফৌজদারি মামলার অপরাধ করলেও অনেক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দিয়েই ইতি টানা হয়। অনেক সময় পরিস্থিতি সামাল দিতে অভিযুক্তকে প্রত্যাহার বা সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পরিস্থিতি শান্ত হয়ে গেলে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যকে রক্ষা করার ব্যবস্থা হচ্ছে।
পুলিশপ্রধান এ কে এম শহীদুল হক বলেন, ভালো কাজের পুরস্কার এবং মন্দকাজের তিরস্কার না থাকলে কাজে গতি আসে না। পুলিশে এ বিষয়টা নিশ্চিত করা হয়েছে। ফলে এ বাহিনীতে গতি এসেছে। পুলিশ বাহিনীর কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে দায়িত্ব-কর্তব্যে অবহেলা বা কোনো অপরাধে জড়িত অভিযোগ পেলে কোনো ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। তবে বাহিনীতে কর্মরত কোনো ব্যক্তিগত অপরাধের দায় পুরো বাহিনী নেবে না।
পুলিশ আইন অনুযায়ী, অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িত পুলিশের বিরুদ্ধে দুই ধরনের বিভাগীয় শাস্তির বিধান রয়েছে। কোনো পুলিশ সদস্য ফৌজদারি অপরাধ করলে গুরুদ- দেওয়া হয়। এ দ-ের আওতায় রয়েছে চাকরি থেকে বরখাস্ত, পদাবনতি, পদোন্নতি স্থগিতকরণ ও বেতন বৃদ্ধি স্থগিতকরণ। গুরুদ- দিতে হলে বিভাগীয় মামলা করতে হয়। মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে সংশ্লিষ্ট পুলিশকে গুরুদ- দেওয়ার বিধান রয়েছে। তবে গুরুদ-ের বিরুদ্ধে আপিলেরও সুযোগ আছে। আর হুমকি দেওয়া, ঘুষ নেওয়া, চাকরি শৃঙ্খলাপরিপন্থি কাজ করা, দায়িত্বে অবহেলা করা, নির্দেশ অমান্য করা, ভিত্তিহীন বা তুচ্ছ বিষয়ে অভিযোগের জন্য পুলিশ সদস্যদের লঘুদ- দেওয়া হয়।
পুলিশ সদর দফতরের সরবরাহ করা তথ্যমতে, ২০১১ থেকে ২০১৬ সালের আগস্ট পর্যন্ত গত ছয় বছরে নানা অপরাধে জড়িত থাকার দায়ে প্রায় সাড়ে ৭৭ হাজার পুলিশ সদস্যকে অর্থদ-, তিরস্কার, বদলি, বরখাস্ত, বাধ্যতামূলক অবসর ও চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। শাস্তি পাওয়া এই পুলিশের মধ্যে ৭৬ হাজার ৯৯ জনই কনস্টেবল থেকে এসআই পদমর্যাদার। অন্যদিকে পরিদর্শক থেকে তদূর্ধ্ব পর্যায়ের কর্মকর্তা রয়েছেন ৩২৭ জন। এ সময়ে বিভিন্ন অপরাধে শাস্তি পাওয়া পুলিশ সদস্যদের মধ্যে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় চাকরিচ্যুত হয়েছেন ৬২৩ জন পুলিশ সদস্য। এর মধ্যে ৬০৮ জন কনস্টেবল থেকে এসআই পদের পুলিশ কর্মকর্তা। বাকি ১৫ জনের মধ্যে ২ জন পুলিশ পরিদর্শক ও ১৩ জন এএসপি থেকে তদূর্ধ্ব পদের কর্মকর্তা। চাকরিচ্যুত হওয়া পুলিশদের মধ্যে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পর তার পারিবারিক অবস্থা ও চাকরির মেয়াদ বিবেচনায় নিয়ে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে ৭২ জন পুলিশকে। এর মধ্যে ৬৮ জনই কনস্টেবল হতে এসআই পদের পুলিশ কর্মকর্তা। বাকি ৪ জনের মধ্যে দুজন পুলিশ পরিদর্শক এবং ২ জন এএসপি থেকে তদূর্ধ্ব পদের কর্মকর্তা।
সূত্র জানায়, পুলিশের বিরুদ্ধে প্রতিদিনই জমা পড়ছে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ঘুষ, ডাকাতি, নারী কেলেঙ্কারি, নির্যাতন, প্রতারণাসহ নানা অভিযোগ। এসব অভিযোগের তদন্ত করে পুলিশ সদর দপ্তর। কনস্টেবল থেকে এসআই পদমর্যাদার সদস্যদের সাজা প্রদান করেন সংশ্লিষ্ট পুলিশ সুপার। পরিদর্শক পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের সাজা প্রদান করেন সরাসরি পুলিশের মহাপরিদর্শক। সহকারী পুলিশ সুপার থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাজার বিষয়টি দেখে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ ছাড়াও অভিযুক্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করতে পারে পুলিশ সদর দপ্তর।
পুলিশি অপরাধের কয়েকটি ঘটনা: গত বছরের ৯ জানুয়ারি মধ্যরাতে মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পের কাছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা গোলাম রাব্বীর কাছ থেকে টাকা না পেয়ে এসআই মাসুদ শিকদার তাকে বেধড়ক পেটান। ১৫ জানুয়ারি যাত্রাবাড়িতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিদর্শক বিকাশ চন্দ্র দাসকে মারধর করে পুলিশ। ১৬ জানুয়ারি বরিশালের আগৈলঝাড়ায় ব্যবসায়ী বাদল সেরনিয়াবাতকে বেধড়ক পেটায় পুলিশ। এ ঘটনায় ওসির গাড়িচালক কনস্টেবল মোকলেসুরকে প্রত্যাহার করা হলেও বহাল তবিয়তে ওসি মনিরুল। গত ২০ জানুয়ারি এক নারীর শ্লীলতাহানির অভিযোগে ওসি অবনী শংকর করসহ যাত্রাবাড়ি থানার পাঁচ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা হয়। ২৯ জানুয়ারি উত্তরায় এক যুবক ও তার বান্ধবীকে আটকে ইয়াবা মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে আড়াই লাখ টাকা নেয় পুলিশ। ২৮ জানুয়ারি যশোরের ঝিকরগাছায় সুইডেনপ্রবাসী দম্পতির কাছ থেকে তিন হাজার ডলার ছিনিয়ে নেয় পুলিশ। একই দিন রাতে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে ছিনতাই করতে গিয়ে গণপিটুনির শিকার হন দুই পুলিশ কর্মকর্তা। ৩১ জানুয়ারি মোহাম্মদপুরে এক ছাত্রীকে অনৈতিক কাজের প্রস্তাব দেয় এক এসআই। গত বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি মিরপুরে পুলিশের সামনেই এক সোর্স চা-দোকানি বাবুলকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা সেই আগুন নেভানোর চেষ্টা করেননি। ৬ ফেব্রুয়ারি কল্যাণপুর পোড়া বস্তিতে পুলিশ নিরীহ রিকশাচালক সাজু মিয়াকে গুলি করে আহত করে। ১৫ ফেব্রুয়ারি রাতে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নার্স আবুল ফজলকে পিটিয়ে আহত করে। আর গত বছরের ১৩ নভেম্বর পুলিশ হেফাজত থেকে আসামি রুবেলকে পালাতে সহায়তা করেন বাড্ডা থানার এসআই ইমরান উল হাসান ও এক কনস্টেবল। গুরুতর সব অপরাধেরও পরও অভিযুক্ত এসব পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ‘অ্যাকশন’ বলতে সাময়িক বরখাস্ত আর বদলি।
লেখক: জুবায়ের চৌধুরী

No comments:

Post a Comment