Sunday, January 22, 2017

আইন পেশা ও জনসচেতনতা

আইনজীবী আর ডাক্তারের মধ্যে বড় একটা মিল আছে। দুটি পেশাই ‘জীবন’ নিয়ে কাজ করে। তাই সতর্কও থাকতে হয় অধিক। শুরুতেই বলে নিই, এই লেখার লক্ষ্য আইন পেশার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি বা শিক্ষার্থী নন; লক্ষ্য সাধারণ পাঠক, যারা জানতে চান অথচ আইনি ভাষার মারপ্যাঁচে পড়তে আগ্রহী নন। দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় আইন বিষয়ে সবার জানার সুযোগ নেই। স্নাতক পাস করার পরও বিদ্যমান আইন সম্পর্কে অনেকের সুস্পষ্ট ধারণা থাকে না, যদিও আমাদের সংবিধান ধরে নিচ্ছে, নাগরিকরা দেশের সব আইন মেনে চলবেন। রাষ্ট্র কাউকে আইন জানানোর দায়িত্ব নেয় না। অথচ আশা করে, নাগরিকরা সবটাই জানবে এবং মানবে!
আইন না জানা আদালতে অজুহাত হিসেবে গণ্য হয় না। কেউ আইন না জানলে মানবে কিভাবে? আমাদের দেশে সব আইনই লিখিত। সরকার ওয়েবসাইটে আইনগুলো প্রকাশ করছে। কিন্তু কতজন এখনো ইন্টারনেটে সেসব পড়ার সুযোগ পাচ্ছে? সংখ্যা যদি অনেকও হয়, তাতেও সীমাবদ্ধতা থকে যায়। এ দেশের আইনের ভাষা সহজবোধ্য নয়; এবং এটি এখনো ইংরেজি ও ল্যাটিন ভাষার ওপর নির্ভরশীল। এর বহু শব্দের সঠিক বাংলা পরিভাষা এখনো রপ্ত করা যায়নি। কিছু ইংরেজি শব্দের সঠিক বাংলা প্রতিশব্দই হয় না। অনুবাদকের মনগড়া বাংলা প্রতিশব্দ ব্যবহার আইনের দুর্বোধ্যতাই বাড়ায়। এসব সীমাবদ্ধতা আগেও ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও হয়তো থাকবে। তাই উকিলরাই আইনের এসব জটিল শব্দ নাড়াচাড়া করেন। সাধারণ জনতার ভরসাও তাই উকিল সমাজ।
আইন ও বিচারব্যবস্থার শুরুর দিকে উকিল বলে কিছু ছিল না। নিজেদের বক্তব্য নিজেরাই বিচারককে জানাতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে আইন জটিলতর হতে শুরু করল, সাধারণের পক্ষে তা আর ভালোভাবে জানা বা বোঝা সম্ভবপর হলো না। আনুমানিক ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিস ও রোমে আইনের ব্যাপ্তি আরও বৃদ্ধি পেল। তখন প্রয়োজন হলো আইনজ্ঞের। ফলে উকিল শ্রেণির আত্মপ্রকাশ ঘটে। রোম সাম্রাজ্যের শেষদিকে তারা সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ওই সময় থেকে তাদের অনেক নথিপত্র তৈরি করতে হতো। ধীরে ধীরে এটি একটি সম্মানীয় জীবিকা হিসেবে সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত হলো। গ্রিসের এথেন্সে সেই সময় কোনো উকিল তার মক্কেলদের কাছ থেকে পারিশ্রমিক নিতে পারত না। সামান্য উপহার গ্রহণও সেই সময় অপরাধ হিসেবে গণ্য হতো। পেশাটিকে অত্যন্ত মহৎ, আভিজাত্যপূর্ণ এবং মানবকল্যাণের একটি সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ৪০৫ খ্রিস্টাব্দে এথেন্স সুপ্রিম কোর্ট এই মর্মে রায় দেয় যে, উকিল যদি তার মক্কেলের কাছ থেকে কোনো পারিশ্রমিক গ্রহণ করেন, তাহলে তা ঘুষ বলে বিবেচিত হবে। গ্রিসের পর বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু যখন রোমে চলে এলো, তখন দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনের ব্যাপ্তি আরও বৃদ্ধি পেল। উকিলদের কাজের পরিধিও বহুগুণ বেড়ে গেল। তারপরও কোনো আইনজীবী হাত পেতে বা দরদাম করে মক্কেলদের কাছ থেকে কিছু নিতে পারতেন না। ওকালতি একটি সম্মানিত পেশা, এটাকে ব্যবসা বলা যায় না। ফলে কোনো উকিল তার পেশার প্রসারতার জন্য আইনত কোনো বিজ্ঞাপন দিতে পারেন না। এমনকি নিজ অফিসের বাইরে বড়সড় সাইনবোর্ড টানানোও নিষিদ্ধ। উকিলরা তাদের মক্কেলদের সঙ্গে নিজেদের পারিশ্রমিকের ব্যাপারে কোনো চুক্তি যেমন করতে পারেন না, তেমনি নিজেদের পারিশ্রমিক আদায়ের জন্য মক্কেলের বিরুদ্ধে মামলাও করতে পারেন না।
আইন পেশার সনদ : আইন পেশার সনদ প্রদানকারী এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ বার কাউন্সিল। নতুন আইনজীবীদের তালিকাভুক্তির জন্য পরীক্ষা গ্রহণ, আইনজীবীদের পেশাগত আচরণের জন্য নীতিনির্ধারণ এবং আইনজীবীদের কর্মকা- নিয়ন্ত্রণ করে থাকে এই সংস্থাটি। ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ লিগ্যাল প্র্যাক্টিশনারস অ্যান্ড বার কাউন্সিল আদেশ অনুযায়ী বার কাউন্সিল গঠন এবং পরিচালনা করা হয়। দ্য বাংলাদেশ লিগ্যাল প্র্যাক্টিশনারস অ্যান্ড বার কাউন্সিল অর্ডার অ্যান্ড রুল্্স-১৯৭২ এবং ক্যাননস অব প্রফেশনাল কন্ডাক্টে উল্লেখ আছে আইনজীবীদের দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে। রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা হিসেবে অ্যাটর্নি জেনারেল পদাধিকারবলে এই সংস্থার প্রধান।
কালো কোট  : আমাদের দেশে কালো কোট ও গাউনের মতো পোশাক বিচারব্যবস্থায় অনেকটা ওয়ারিশ সূত্রে টিকে আছে। কেন আদালতে কালো কোট পরিধান করা হয়? সম্রাট জাস্টিনিয়ানের শাসনামলে উকিলরা লম্বা এবং কালো রঙের বিশেষ গাউন পরিধান আরম্ভ করেন। তারা গাউনের পেছনে ঘাড়ের দিকটায় ছোট্ট একটি পকেট স্থাপন করেছিলেন। মামলা শেষে মক্কেল যদি খুশি হয়ে স্বর্ণ বা রৌপ্যমুদ্রা দিতে চাইত, তাহলে উকিলের অজান্তে তার গাউনের পেছনের পকেটে তা ফেলত। উকিল কোনো কোনো দিন দু-একটি মুদ্রা পেতেন, আবার কখনো হয়তো কিছুই পেতেন না। উকিলদের গাউনের হাতা আগে লম্বা থাকত। এটা নাকি আইনের হাত যে লম্বা, তা বোঝাত। এখন অবশ্য হাতা ছোট করা হয়েছে। তবে ফিতার মতো প্রতীকী একটা হাত থাকে। ইংল্যান্ডের কোর্টে ড্রেস-কোডের প্রচলন শুরু হয় সপ্তদশ শতাব্দীতে। তখন আইনজীবী এবং বিচারকরা কোর্টে কালো কোট, বিভিন্ন রঙের গাউন, ব্যান্ড ও পরচুলা পরতেন, যার অনেক কিছু এখনো ইংল্যান্ডের কোর্টে প্রচলিত আছে। কিন্তু ১৯৬৪ সালে ইংল্যান্ডের তৎকালীন রানী মেরি-২-এর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে বিচারকরা রানীকে সম্মান দেখানোর জন্য সবাই কালো গাউন পরেছিলেন। তখন থেকে কোর্টে কালো কোট, কালো গাউন তাদের ঐতিহ্যে পরিণত হয়। পরবর্তীকালে ইংল্যান্ড যেসব দেশ শাসন করেছে, তেমন অনেক দেশের আদালতে এখনো আইনজীবী ও বিচারকদের একই পোশাক চালু আছে। ভারতবর্ষের দেশগুলো গর্বের সঙ্গেই তা অনুসরণ করে চলেছে এখনো। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু এখনো পর্যন্ত আমরা ব্রিটিশ আমল থেকে প্রচলিত আইনগুলো অনুসরণ করে চলেছি। ব্রিটিশদের চাপিয়ে দেওয়া মানসিকতা আজও আমরা লালন করে চলেছি। কোর্টে কালো কোট, গাউনের পরিবর্তে বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে অন্য কোনো আরামদায়ক পোশাক পরা হলে কেমন হয়, ভেবে দেখার সময় হয়তো এসেছে।
দীর্ঘদিন ধরেই আইন পেশা সমাজে সম্মানিত পেশা হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু যে মহান নৈতিকতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে এই পেশার উদ্ভব, এই যুগে পেশাটি তা থেকে বিচ্যুত বলা যায়। দায়িত্ব পালনে গাফিলতি, জামিনের নামে টাকা খাওয়া, শুনানির দিন উপস্থিত না হওয়া, ব্যস্ততা দেখিয়ে মক্কেলকে ঘোরানো কিংবা মক্কেলের সঙ্গে প্রতারণার মতো অনৈতিক আচরণের শিকার হচ্ছেন অনেক বিচারপ্রার্থী। তারা বিচারের আশায় নীরবে এসব নিগ্রহ সহ্য করে যান। কী করবেন, বুঝে উঠতে পারেন না। এ রকম কিছু ঘটার আগেই, যার কাছে মামলা দেবেন, তার পরিচয় একটু যাচাই করে নিন। কিছুটা সতর্কতা অবলম্বন করুন। তাছাড়া বিচারপ্রার্র্থী বা অভিযুক্ত যখন আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হয়ে পেছনের দরজায় বিচার কিনতে চায়, গুটি কয়েক অসাধু উকিল সুযোগটাকে কাজে লাগায়। অথচ এর দায়ভার নিতে হয় সমগ্র আইনজীবী সমাজকে। আইনের শাসন এবং বার-বেঞ্চের সম্পর্ক সংক্রান্ত এক আলোচনায় প্রধান বিচারপতি যথার্থই মন্তব্য করেছেন যে, শতকরা ৬০ শতাংশ মামলায় আইনজীবীদের অদক্ষতা ও গাফিলতির জন্য মক্কেলরা সুবিচার থেকে বঞ্চিত হন।
আইনজীবীর বিরুদ্ধে অভিযোগ : কোনো আইনজীবীর অসদাচরণের কারণে যেকোনো ব্যক্তি সংক্ষুব্ধ হলে তিনি বার কাউন্সিলের সচিব বরাবর অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য বার কাউন্সিলে পাঁচটি ট্রাইব্যুনাল আছে। একজন চেয়ারম্যান এবং দুজন সদস্যের সমন্বয়ে একেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়। অভিযোগ পাওয়ার পর ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ তদন্ত করবেন এবং তদন্তে অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীকে তিরস্কারসহ তার সদস্যপদ স্থগিত অথবা সমিতি থেকে বহিষ্কার করার মতো শাস্তি প্রদানের বিধান রয়েছে। কেউ যদি মিথ্যা বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অভিযোগ করে এবং তা প্রমাণিত হয়, তাহলে তাকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীকে ৫০০ টাকা দিতে হবে। সংশ্লিষ্ট পক্ষ ট্রাইব্যুনালের রায়ের রিভিউ আবেদন করতে পারে। এছাড়া যেকোনো পক্ষ ট্রাইব্যুনালের রায়ের ৯০ দিনের মধ্যে হাইকোর্ট বিভাগে আপিল করতে পারবে। প্রভাষক পদ এবং আইন পেশা একসঙ্গে পরিচালনার বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় আইনজীবী সমিতির সদস্য মো. কামরুজ্জামান চৌধুরীকে আইন পেশা থেকে অপসারণ করা হয়। মাদ্রাসার অধ্যক্ষের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে শ. ম. রেজাউল করিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল গত বছর ওই আইনজীবীর সনদ বাতিলের এই সিদ্ধান্ত নেন।
আদালত চত্বরে হয়রানির প্রতিকার : প্রতারণার শিকার হচ্ছেন অনেক বিচারপ্রার্থী। আদালত চত্বরের প্রতারক-দালাল-বাটপাড়দের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিতে আইনজীবী সমিতির নিকট অভিযোগ দায়ের করা যায়। অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ হলে সমিতির মাধ্যমে ওই দালাল বা প্রতারকের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। প্রয়োজনে মামলা করে তাকে জেলহাজতে দেওয়ারও ব্যবস্থা করা হয়। আদালত চত্বরে এসব লোককে আইনের ভাষায় ‘টাউট’ বলা হয়। দ-বিধিতে আদালত চত্বরের এমন টাউটদের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।
আইন পেশায় নিয়োজিতদের শিক্ষাদীক্ষা, রুচিবোধ এবং আভিজাত্যের ওপর একটি দেশের সার্বিক উন্নয়ন, রাজনীতি ও সুশাসন নির্ভর করে। তারা যেমন মামলাবাজ লোকজন পয়দা করবে না, তেমনি নিজেরাও মামলাবাজ লোকদের হাতিয়ার হবে না। তারা মামলা গ্রহণে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করবে এবং ভিত্তিহীন ভুয়া মামলা থেকে বিচারাঙ্গনকে পবিত্র রাখার জন্য দায়িত্ব পালন করবে। ব্রিটিশ জমানার প্রিভি কাউন্সিলের একটি বিখ্যাত পর্যবেক্ষণ আজও আইন অঙ্গনকে লজ্জায় ফেলে দেয়। ব্রিটিশ আমলে ভারতের একটি মুন্সেফ কোর্টে জনৈক ব্যক্তি অভিযোগ দায়ের করল যে, অভিযুক্ত ব্যক্তির গরু তার জমির ফসল নষ্ট করে ফেলেছে। মামলা মুন্সেফ কোর্ট থেকে জেলা কোর্টে গেল। তারপর জেলা থেকে গেল হাইকোর্টে। হাইকোর্টের রায়ে বিক্ষুব্ধ পক্ষ মামলাটি নিষ্পত্তির জন্য লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিলে আবেদন করল। প্রিভি কাউন্সিল মামলার সব কাগজপত্র দেখে রায় দিল, ‘অভিযোগকারীর কোনো জমি ছিল না এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিরও কোনো গরু ছিল না।’
সব মিলিয়ে আশার কথা হচ্ছে, গত কয়েক মাসে বিশেষ করে বর্তমান প্রধান বিচারপতির শপথ গ্রহণের পর থেকে বাংলাদেশের আদালতপাড়ায় সংস্কার শুরু হয়েছে। বিশেষ করে সুপ্রিম কোর্ট চত্বর বিচারপ্রার্থীদের জন্য আগের তুলনায় নিরাপদ হয়েছে। আদালত চত্বরে আইনজীবী এবং আইনজীবীর সহকারীদের বাধ্যতামূলক কার্ড পরিধান করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
লেখক : রাশেদ মজুমদার ; আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট।

No comments:

Post a Comment