শিক্ষকরা কেন বৈষম্যের শিকার

আমরা মানুষ। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত শিখছি। আমাদের শিক্ষানবিশি চলমান প্রক্রিয়া। চলতেই থাকে জীবনভর। আমরা প্রতিদিনই শিখি। জীবনযাপনের রোজনামচা আমাদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতায় কত কিছুই না যোগ হচ্ছে। আসলে দৈনন্দিন জীবন প্রক্রিয়াই আমাদের শিখে নিতে বাধ্য করে। কেউ ঠেকে শিখি, কেউ ঠকে শিখি। চলমান প্রক্রিয়ায় আমরা অনেক ভুল করি, ফের ঠিকও করে নিই।
জীবনধারণে ছাত্রাবস্থায় শেখা অনেক ভালো জিনিস কাজে লাগে। আবার অনেকটা কাজে লাগেও না। আমাদের ছাত্রাবস্থায় সেই শেখাটা কিন্তু ঠিক ছিল। তবে, সময় কিংবা যুগের সঙ্গে তাল রেখে চলতে গিয়ে নানা প্রতিকূলতা অথবা বিভিন্ন রকম চাপের কাছে কখনও কখনও নতিস্বীকার করতে হয়। অনেক কিছুই জলাঞ্জলি দিতে হয়। নীতি ও আদর্শ কখনও কখনও শিকোয় তুলে গা-ভাসিয়ে দিতে হয় ইচ্ছের বিরুদ্ধে।
অন্যায়ের কাছে ‘মাথানত’ না করাটা আমরা কিন্তু প্রথম জীবনেই শিখেছি। কোনো লোভ বা স্বার্থের কারণে যাতে আদর্শ জলাঞ্জলি না দেই–এ শিক্ষাটাও প্রথম জীবনেই শেখা। শিক্ষকরা আমাদের আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে নিরলস চেষ্টা করেছেন। তারা না থাকলে আলোর দেখা আমরা পেতাম কী করে? তাই বলা হয়ে থাকে, মা-বাবা জন্ম দেন আর চক্ষুদান করেন শিক্ষক।
সমাজ ও জাতি গঠনে শিক্ষকদের ভূমিকা অপরিসীম। শিক্ষককুল যদি না থাকতেন, আমরা কতটা দূর যেতে পারতাম—এমন প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। আমরা আলোকিত হচ্ছি, আলোকিত করছি চারদিক—এসবের কৃতিত্ব অবশ্যই শিক্ষককুলের। তারা আছেন বলেই মানুষ জ্ঞানের মশাল জ্বেলে এগিয়ে যাচ্ছে। তারা আছেন বলেই মানুষ তৈরি হচ্ছে। এ হিসেবে আমাদের শ্রদ্ধা-ভক্তির মূল স্থান কিন্তু শিক্ষক শ্রেণি।
সভা-সমাবেশ কিংবা বিভিন্ন সেমিনারে আমরা শিক্ষকদের যারপরনাই শ্রদ্ধার জায়গায় রেখে কথা বলি। বক্তব্য রাখি। প্রবন্ধ-নিবন্ধসহ বিভিন্ন আর্টিকেল লিখি। লেখাতে, বলাতে—শিক্ষকদের প্রতি দরদের কমতি থাকে না। একটুও কার্পণ্য করি না। আমাদের লেখাপড়া, আচরণ দেখে যে কেউ বলবে, ইস! কী আদর্শবান ছেলে! শিক্ষকদের প্রতি কত শ্রদ্ধাশীল, কত অমায়িক ব্যবহার। আসলে কি আমরা শিক্ষকদের প্রতি অতটা অন্তরিক; যতটা বাহ্যিকভাবে প্রকাশ করি?
সত্যি যদি শিক্ষকদের প্রতি অতটা আন্তরিক হতাম, দরদি হতাম, তবে কি এই শিক্ষকদের অধিকার আদায়, দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলনে নামতে হতো? আবার এই শিক্ষককেই কি কান ধরে উঠবস করানোর দুঃসাহস দেখাতে পারতাম! কিংবা আন্দোলনরত শিক্ষকদের ওপর নির্বিচারে লাঠিপেটা বা পিটিয়ে হত্যা করতে পারতাম? একটি দেশ, জাতি গঠনে শিক্ষকদের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা একটিবারও কি কেউ ভেবে দেখেছি?
যে জাতি কিংবা দেশের শিক্ষা অবকাঠামো এবং শিক্ষার সামগ্রিক পরিবেশ যত উন্নত, দেশ ও জাতি হিসেবে সার্বিকভাবে তারাই স্বয়ংসম্পূর্ণ। উন্নত জাতি গঠনে শুরু থেকেই শিক্ষকরা ভূমিকা রেখে আসছেন। কিন্তু সেই শিক্ষকরা কতটুকু মর্যাদা পাচ্ছেন বা আমরা দিচ্ছি? অথবা এই শিক্ষকরা কেন প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত? শিক্ষকসমাজ কেন বৈষম্যের শিকার—এমন প্রশ্ন কখনও কি নিজেদের করে দেখেছি?
৫ অক্টোবর ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’। প্রতি বছর এ দিবসটি ঘটা করেই পালিত হয়। শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবং তাদের অবদানকে স্মরণ করার জন্য বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ‘শিক্ষক দিবস’ পালিত হয়। তবে কিছু কিছু দেশে ভিন্ন ভিন্ন দিনে এ দিবস পালিত হয়ে থাকে। যেমন—ভারত ‘শিক্ষক দিবস’ পালন করে ৫ সেপ্টেম্বর। ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের জন্মদিন (৫ সেপ্টেম্বর, ১৮৮৮) উপলক্ষে ভারতে সব ছাত্রছাত্রী এ দিনটিকেই শিক্ষক দিবস হিসেবে পালন করে। তবে সেটি জাতীয় শিক্ষক দিবস হিসেবেই পালন করা হয়।
বাংলাদেশে ১৯ জানুয়ারি ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালন করার রেওয়াজ শুরু হয়েছিল। বাংলাদেশের শিক্ষক সমাজকে যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার অঙ্গীকার নিয়ে এবং ‘জাতি গঠনে শিক্ষক’এমন স্লোগানকে সামনে রেখে তৎকালীন সরকার এ দিবসটি চালু করেছিল। তবে বর্তমান সরকার এ দিবসটি পালনে কোনো আগ্রহ দেখায় না। যার ফলে বর্তমানে কোথাও কোথাও এ দিবসটি ব্যক্তি উদ্যোগেই পালিত হয়, নীরবে।
এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। অনেকে জানেওনি ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ ছিল ১৯ জানুয়ারি! এখানে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে শিক্ষককুল। রাজনৈতিক গ্যাড়াকলে বিভক্ত ‘দিবস’! শিক্ষা, শিক্ষক, শিক্ষার্থী—এ নিয়ে আমাদের কেন রাজনীতি করতে হবে! শিক্ষা, শিক্ষক, শিক্ষার্থী কারও ব্যক্তিগত সম্পদ হতে পারে কি? নাকি আমাদের দেশের সম্পদ, সার্বজনীন?
রাজনৈতিক কারণে আমাদের দেশের শিক্ষকশ্রেণি আজও বৈষম্যের শিকার। কোনো কোনো শিক্ষকের ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ অবস্থা। আবার কেউ কেউ বিলাসী জীবনযাপন করছেন! অথচ এদেশের রাজনৈতিক দলগুলো যদি এক কাতারে এসে শিক্ষা, শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষায় উদার মনোভাব পোষণ করত, তবে এ বৈষম্যের লেশমাত্র থাকত না। শিক্ষকশ্রেণি হতো অর্থবিত্তে সচ্ছল।
সমাজে দেখা যায়—এমন অনেক মানুষ আছে, যারা কখনো স্কুলের বারান্দাও মাড়ায়নি; তারপরও তারা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অঢেল সম্পদের মালিক! রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় কুখ্যাৎ ব্যক্তিরাও রাজকীয় ঢঙে চলাফেরা করছে। তারা হয়ে আছে সমাজের প্রথম শ্রেণির ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ! আর শিক্ষককুল শুরু থেকেই নানা বৈষম্যের শিকার। করছেন অসচ্ছল জীবনযাপন। শেষ বয়সে এসে অসহায় থাকতে হয় তাদের অনেকের।
দেশের শিক্ষাব্যবস্থার শতকরা ৯০ ভাগই বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়। সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থায় পর্বতসম বৈষম্য। এমনকি শিক্ষক-কর্মচারীদের ক্ষেত্রে যেমন ছিল না কোনো চাকরিবিধি, তেমনি ছিল না কোনো বেতন স্কেল। শিক্ষক-কর্মচারীদের পেশাগত মর্যাদা ও ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সব ধরনের বৈষম্য দূর করতে এ যাবৎ বহু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সফলতা এলেও বহু ক্ষেত্রে এখনও বৈষম্যের শিকার শিক্ষক শ্রেণি।
এ সমাজে এখনও অনেক শিক্ষকের দিন শুরু হয় পান্তাভাত, মরিচ এবং এক টুকরা পেঁয়াজ খেয়ে। এর মধ্যে আবার সন্তানদের নানা বায়না। গৃহিণীর নির্দেশ—বাড়ি ফেরার সময় চাল নিয়ে আসতে হবে। এসব ঝামেলা মাথায় নিয়েও রোদ, বৃষ্টি, ঝড় উপেক্ষা করে বিদ্যালয়ে এসে তিনি আবার ঠিকই পাঠদান করছেন। তাদের এমন করুণ পরিণতির কথা কী আমরা কখনও কেউ ভেবে দেখেছি?
শিক্ষকরা যখন নিজেদের ন্যায্য দাবি নিয়ে রাজপথে আসেন, আন্দোলন করেন, তখন আমাদের দেশের পুলিশ উপর মহলের নির্দেশে তাদের ওপর লাঠিপেটা করে! শিক্ষকদের পিটিয়ে মেরেও ফেলে! তাদের ওপর পিপার স্প্রে করা হয়!
এখন কেউ বলতে পারেন, শিক্ষকরা কেন আন্দোলনে নামবেন? তারা কেন মিছিলমিটিং করবে রাজপথে এসে? আমিও বলি, শিক্ষকরা কেন আন্দোলন করবে? শিক্ষকদের আন্দোলন তো জাতির জন্য লজ্জাজনক। তাদের আন্দোলন মানায় না। কিন্তু মহাশয় একবার ভেবে দেখেছেন কি—মানুষ কখন আন্দোলনে নামেন? তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। যার জন্য তারা বাধ্য হয়েই আন্দোলনে আসেন। অথচ এমন হওয়ার কথা নয়।
পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে কিংবা আন্দোলন করে নয়; এজন্য চাই আলোচনা। সমস্যা সমাধানের জন্য যথোপযুক্ত আলোচনার বিকল্প নেই। সুন্দর, সুষ্ঠু আলোচনার মাধ্যমে দাবি পূরণ বা সমস্যার সমাধান করতে হবে, যাতে শিক্ষকদের আন্দোলনে আসতে না হয়। ব্যবস্থা নিতে হবে, তারাও যেন ন্যূনতম সম্মানসহ সমাজে বেঁচে থাকতে পারে। শিক্ষকসমাজকে মর্যাদা দিতে হবে। সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে শিক্ষকদের সব সমস্যার সঠিক সমাধান দিতে হবে। অন্তত এ প্রত্যাশাটুকুও আমরা রাখতে পারি।
লেখক: সীমান্ত প্রধান; কবি ও সাংবাদিক
No comments:
Post a Comment