স্বাধীনতার ছেচল্লিশ বছর

১৯৭১ থেকে ২০১৬। এই ৪৬ বছর ধরে বাংলাদেশের পতাকা আকাশে উড়ছে সগৌরবে। তাতে আঁকা এ দেশের প্রকৃতির চিরসবুজ, অসংখ্য শহীদের শোণিতের লাল। বাংলাদেশের বুক চিরে যে সূর্য একাত্তরে উঠেছে, সেই সূর্য কখনো অস্ত যাবে না। এই ৪৬ বছরে আমাদের অর্জন আছে, ব্যর্থতা আছে, অর্জন ধরে রাখার অপারগতা আছে, আছে আত্মঘাত।
স্বাধীনতা লাভের এক বছরের মাথায় বহুনন্দিত সংবিধান রচনা করেছিলাম আমরা। তার দুই বছর পর থেকেই সেই সংবিধানের মূল কাঠামো পরিবর্তনের শুরু, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ বিসর্জনের পালা আরম্ভ। ১৫ বার সংশোধনের পরও একাত্তরের চেতনায় ফিরে যাওয়া গেল না, একাত্তর-পরবর্তী বাস্তবতাবোধের প্রতিফলন ঘটল না। তাই ধর্মনিরপেক্ষতা আর রাষ্ট্রধর্মের সহাবস্থান, তাই আদিবাসীদের অধিকার সম্পর্কে উদাসীনতা।
সংবিধান নিয়ে কি খেলা করেছি আমরা? যেমন খেলা করেছি দেশনায়কদের জীবন নিয়ে? বঙ্গবন্ধু, চার নেতা, অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার প্রাণ হরণ করেছি, জড়িয়ে পড়েছি একের পর এক আত্মঘাতী সংঘাতে। এর পাশাপাশি আরো একটি কাজ করেছি। যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, হাত মিলিয়েছিল পাকিস্তানি দখলদারদের হাতে, তাদের বসিয়েছি দেশ-পরিচালকের আসনে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে এতদিনে, তাতেও বাধা এসেছে কয়েকবার ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কাছ থেকেই।
নতুন শিল্প গড়ে উঠেছে তৈরি পোশাকের, আর রফতানি হচ্ছে মানুষের শ্রম। এই দুই ক্ষেত্রের আয় সচল রেখেছে অর্থনীতির চাকা। জনসংখ্যা বেড়ে চলেছে। সেই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য আসছে আমাদেরই মাটি থেকে- এই সাফল্য সামান্য নয়। প্রকৃতির সঙ্গে আমরাও বৈরিতা করছি। এক টুকরো জমি ফেলে রাখতে দিচ্ছি না, জলাশয় ভরে ফেলছি, নদী দখল করছি, পরিবেশ দূষণ করছি। জাহাজ ভাঙতে পরিবেশ নষ্ট করছি, মানুষের জীবন নিয়ে নিচ্ছি। গ্রামাঞ্চলে মাটির ঘরের জায়গায় টিনের ঘর দেখে মনে হয় জীবনযাত্রার মান বাড়ছে। নগরে বহুতল ভবন দেখে ভয় হয়, এর শেষ কোথায়! এই নদীবহুল দেশে জলপথে পরিবহনের বৃদ্ধি ও উন্নতি আরো কেন হলো না, তাতে বিস্ময় লাগে। রেলপথের দুর্গতি দুঃখ দেয়। সড়ক বেড়েছে, তাতে চলাচল বেড়েছে, দূর কাছের হয়েছে। কিন্তু রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থা, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনায় প্রাণহানি আর ঢাকা শহরে, এখন বলতে হবে, ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ শহরে, চলাচল বিঘ্নিত হওয়াই নিয়ম। কখন রওয়ানা হলে কখন গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে, এ কথা কেউ বলতে পারেন না।
বাংলা আমার রাষ্ট্রভাষা হয়েছে বটে, কিন্তু রাষ্ট্রের সর্বত্র সেই ভাষা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে তার প্রবেশাধিকার নেই। সর্বোচ্চ বিদ্যাক্ষেত্রেও তার ব্যবহার আশাপ্রদ নয়। তার জন্য বাইরের কেউ নয়, আমরাই দায়ী। বাংলায় উচ্চশিক্ষার বইপত্র আমরা যথেষ্ট লিখতে পারিনি। ভাষা শিক্ষায় আমাদের ত্রুটি আছে যেমন মাতৃভাষায়, তেমনি দ্বিতীয় ভাষায়। আমাদের মনে সন্দেহ ঢুকে গেছে, বাংলা উচ্চশিক্ষার বাহন হতে পারবে কিনা, বাহন হওয়া উচিত হবে কিনা। তাই আমরা ঝুঁকছি ইংরেজিমাধ্যম শিক্ষার দিকে। শিক্ষার হার প্রশংসনীয়ভাবে বেড়েছে। তবে এখনো সবাই সাক্ষর হয়নি, প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় সবাইকে আনা যায়নি। প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকে আনন্দময় করতে নৃত্য-গীত-বাদ্য-চিত্রাঙ্কনের যোগ পৃথিবীর সর্বত্রই ঘটে। তাতে একশ্রেণির মানুষের মহাআপত্তি। সরকার নাকি দেশের সব মেয়েকে বাইজি বানানোর ব্যবস্থা করছে! এরা যে কেবল নৃত্যগীতের বিরোধী তা নয়, চিত্রাঙ্কন এবং ভাস্কর্যেরও বিরোধী। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে একসময় ভাস্কর্য অপহৃত হতে শুরু করেছিল, সেই কথা ভোলা যায় না। অথচ এসব ক্ষেত্র দেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করে রাখে। বাংলাদেশের চিত্রশিল্পের অগ্রগতিকে অনেকেই বিস্ময়কর বলে গণ্য করেন। দেশে সঙ্গীতচর্চার যে প্রসার ঘটেছে, তাও উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের সাহিত্য এখন বিশ্ব দরবারে পৌঁছতে শুরু করেছে।
দেশে স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ সীমিত। তার মধ্যেও যেকোনো রোগ থেকে আমরা মুক্ত হতে পেরেছি, এটি আশার কথা। বাংলাদেশের ৪০ বছরে নারীর অগ্রগতি নিয়ে আমরা সত্যিই গর্ব করতে পারি। শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে নারীর ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ আশাপ্রদ। তার সেই অগ্রগতি রোধ করতে অনেকে তৎপর। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষার কাজে বাংলাদেশের সেনা-পুলিশের ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছে। হয়তো তা দেশে সামরিক শাসনের ঝুঁকিও কমিয়েছে। কিন্তু রাজনীতিবিদরা গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে দিচ্ছেন না। জাতীয় সংসদ যথার্থ কার্যকর নয়। নির্বাহী বিভাগের রাজনীতিকরণ গণতন্ত্রকে সাহায্য করে না, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আরো দৃশ্যমান হওয়া প্রয়োজন। বস্তুত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে আমরা অগ্রসর হতে পারব না।
মুক্তিযুদ্ধে আমরা যে চারটি স্বপ্নের ওপর ভিত্তি করে অংশ নিয়েছিলাম, তার একটি হলো জাতীয়তাবাদ। সেই জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে আমরা সম্পূর্ণ সাফল্য অর্জন করেছি। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
৪৬ বছরে আমি যা দেখেছি, তাতে কিন্তু হতাশ নই; বরং অনেকটাই আশাবাদী। কারণ, বাংলাদেশের এই সময়ে অনেক অর্জন আছে, যা ১৯৭১ সালে কেউ ভাবেননি। কেউ ভাবেননি, বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমানো সম্ভব। আমরা ৪৬ বছরে কৃষির উৎপাদন তিনগুণ করতে পারব। কেউ ভাবেননি, আমাদের মাথাপিছু আয় দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে যাবে, বাংলাদেশ বৈদেশিক সাহায্যের ওপর থেকে নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে সক্ষম হবে। আজ আমরা আমদানিতে যে ব্যয় করি, তার মাত্র ৬ শতাংশ বৈদেশিক সাহায্য থেকে আসে। ৯৪ শতাংশ আমদানিই আমরা নিজেদের আয়ে করতে পারছি। এটি কিন্তু বিরাট একটি অর্জন। পাকিস্তানের সঙ্গে যদি আমরা তুলনায় যাই, তাহলে দেখব, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত অবিভক্ত পাকিস্তান রাষ্ট্রের যে অর্জন, তা বাংলাদেশের গত ৪০ বছরের অর্জনের কাছে কিছুই নয়। এ সময় পাকিস্তানের মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধি একেবারেই স্থবির ছিল। কিন্তু এ দেশে আমাদের সবচেয়ে বড় দুঃখ হলো, আমরা অসম্ভবকে সম্ভব করেছি, সম্ভবকে করেছি অসম্ভব। সম্ভব যেটি ছিল, তা হলো- একটি সমরূপ জনগোষ্ঠী নিয়ে যে জাতি জন্ম নিয়েছিল, তা ছিল রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে আমরা ছিলাম অত্যন্ত খারাপ পর্যায়ে। অর্থনৈতিক সমস্যার যে একটি সমাধান হবে, সেটা কেউ ভাবেননি। সেক্ষেত্রে অসম্ভবকে আমরা সম্ভব করেছি।লেখক: আনিসুজ্জামান
No comments:
Post a Comment