Monday, March 13, 2017

দুশ্চিন্তায় বাড়ে যে পাঁচ রোগ


দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে পাঁচটি রোগ। শুধু তাই নয়, বিশ্বব্যাপী মৃত্যুঝুঁকির কারণ হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে রোগগুলো। যার মধ্যে রয়েছে সেরিব্রোভাসকুলার ডিজিজ বা মানব মস্তিষ্কের রক্তনালী সংকুচিত, ইসমিক হার্ট ডিজিজ বা হৃদপিন্ডের রক্তনালী সংকুচিত, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি) দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসতন্ত্রের রোগ, ডায়াবেটিস এবং লোয়ার রেসপেরেটরি ইনফেকশন বা শ্বাসনালীর নিম্নাংশ সংক্রমণ রোগ।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে মৃত্যুহার বৃদ্ধির জন্য এই পাঁচটি রোগই প্রধানভাবে দায়ী। যা চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য বিষয়ক জনপ্রিয় সাময়িকী ল্যানসেটের বিশ্লেষণেও ফুটে উঠেছে। ১৯৫টি দেশের জনবহুল ভৌগোলিক এলাকাগুলোতে ৩০টি ব্যাধি নিয়ে ১৯৯০ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত গবেষণা করা হয়।
বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, মূলত রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, উচ্চ রক্তচাপ, ধূমপান ও মাদক গ্রহণ, বেশি দুশ্চিন্তায় অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়া, অলস জীবনযাপনের ফলে স্থূলতাবৃদ্ধি, ভেজাল খাদ্য গ্রহণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলেই এসব রোগের প্রকোপ ও প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা নিয়ন্ত্রণ রাখলে রোগগুলোর ক্ষতিকর দিকগুলো এড়ানো সম্ভব বলেও তাদের অভিমত।
ল্যানসেট সাময়ীকিতে উল্লেখিত যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইএইচএমই ইনস্টিটিউট ও বিশ্বব্যাংক পরিচালিত গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যাওয়ার কারণ হলো সেরিব্রোভাসকুলার ডিজিজ বা মস্তিষ্কের রক্তনালী রোগ।
২০১৫ সালে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৬ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়। যেটা মোট জনসংখ্যার ১ লাখ ৩১ হাজার ৩৬০ জন। বাংলাদেশে রোগটির প্রকোপ সম্পর্কে জানতে চাইলে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ নিউরো সাইন্স হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. মাহফুজুর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, মূলত আনকন্ট্রোল প্রোলং ডায়াবেটিস ও বস্নাডপ্রেসার বা অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ধূমপান, ওবিসিটি, জন্মগত রক্তনালী সমস্যার কারণে এমনটা হয়ে থাকে। ফলে মস্তিষ্কের রক্তনালী ছিঁড়ে গিয়ে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়।
এই রক্তক্ষরণ কম হলে ওষুধের মাধ্যমে বেশি হলে সার্জারি করে দূষিত রক্ত বের করে দিতে হয়। ৪০ থেকে ৬০ বছর বয়সী মানুষের এ সমস্যা বেশি দেখা দেয়। এটা থেকে বাঁচার উপায় হলো ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রয়ণ এবং ধূমপান পরিহার করে চলা।
চিকিৎসাসেবার বিষয়ে তিনি জানান, নিউরোসার্জারি চিকিৎসা ক্রমান্বয়ে সফলতা পাচ্ছে। কিন্তু অনেকেই বিষয়টা জানে না বলে সাময়িক সমস্যা ভেবে ফার্মেসিনির্ভর ওষুধ সেবন করে থাকে। আবার প্রয়োজনের তুলনায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও কম আছে। ১৬ কোটি মানুষের জন্য সারাদেশে মাত্র ১২০ জন নিউরোসার্জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছে।
এরপরও সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে এর চিকিৎসা হচ্ছে। ডিএমসি ও নিউরোসাইন্স মেডিকেলে আধুনিক চিকিৎসা ও গবেষণা হচ্ছে। তবে চিকিৎসা পরিধি ও ডাক্তার বাড়াতে সরকারি পদক্ষেপ দরকার। দ্বিতীয়ত, ইসমিক হার্ট ডিজিজ বা হৃদপি-ের রোগ। ২০১৫ সালে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়।
যা বাংলাদেশের জনসংখ্যার ১ লাখ ১৭ হাজার ৪০৩ জন। আর ল্যানসেটের এক প্রতিবেদনে বলা হয় ২০১৩ সালে ১ লাখ ৭৮ হাজার মানুষ ব্রেনস্টোক, ১ লাখ ৬ হাজার মানুষ হৃদরোগে মারা যায়। এমনকি বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৪ ভাগের এক ভাগ হৃদরোগে আক্রান্ত।
এ বিষয়ে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের চিকিৎসক অধ্যাপক সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, ল্যানসেটের প্রতিবেদনে যেটা বলা হয়েছে এটা শতভাগ সত্য। বস্নাড প্রেসারে দেশে ২৫ শতাংশ মানুষের অসময়ে মৃত্যু হচ্ছে যা হৃদরোগের বড় কারণ। এছাড়া দেশে প্রায় চার কোটি মানুষ তামাক ব্যবহার করে।
এটা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এই রোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য লবণ কম খাওয়া, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম করা যেতে পারে। চিকিৎসার বিষয়ে তিনি জানান, এটার চিকিৎসা ব্যয় কিছুটা বেশি তার ওপর আবার ডাক্তার অপ্রতুল। বিশেষজ্ঞ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসকও কম।
তাই সরকারি উদ্যোগে জেলা ও উপজেলা সদর হাসপাতালে জরুরি বিভাগে ১ জন জুনিয়র ডাক্তার হলেও চিকিৎসক নিয়োগ দেয়া ও যন্ত্রপাতি থাকা উচিত।
তৃতীয়ত দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ রোগ বা ক্রনিক অবস্ট্রিকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি)। গত বছর এটাতে আক্রান্ত হয়ে ৮ দশমিক ২ শতাংশ অর্থাৎ ৬৭ হাজার ৩৩২ জন মারা যায়। বাংলাদেশে ২০০৬ সালের এক জরিপে এই রোগীর সংখ্যা ছিল ৬০ লাখ। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো এখন পর্যন্ত উপজেলা পর্যায়ে এ সেবা ব্যবস্থা চালু হয়নি।
সিওপিডি বিষয়ে জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. কেসি গাঙ্গুলী বলেন, এটা দীর্ঘমেয়াদি রোগ। চলি্লশার্ধো ব্যক্তির এ রোগ বেশি হয়ে থাকে। একবার শরীরে বাসা বাঁধলে সেটা আর সাড়ে না। মূলত অতিরিক্ত ধূমপান, মদপান, গ্যাস ও সার কারখানায় কাজ করা মানুষ বেশি আক্রান্ত হয়। এটা হৃদপি- ও ফুসফুসকে দ্রুত আক্রান্ত করার ফলে রোগী মারা যায়।
তবে মৃত্যুর জন্য সবচেয়ে বড় ও চতুর্থ কারণটি হলো ডায়াবেটিস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, গুরুত্বপূর্ণ ৭টি রোগের অন্যতম একটি হলো ডায়াবেটিস। গত বছর এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় ৫ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ।
বর্তমানে এটা মহামারী আকার ধারণ করছে এমনকি বিশ্বে প্রতি ৭ সেকেন্ডে ১ জন রোগী ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ৭১ লাখেরও বেশি মানুষ এ রোগে আক্রান্ত। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ফেডারেশন (আইডিএফ) বলছে বর্তমান বিশ্বে ৪১ কোটি ৫০ লাখ আক্রান্ত ২০৪০ সালের নাগাদ এটা ৬৪ কোটি ২০ লাখ হবে। আর বিশ্বের ৫০ শতাংশ মানুষ জানেই না তার ডায়াবেটিস আছে।
আইডিএফ ও বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতির এক পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছর প্রায় ৫ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে। এসব বিষয়ে ডায়াবেটিস সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ কে আজাদ খান বলেন, এ রোগ সম্পর্কে সচেতন না হলে এবং নিয়ন্ত্রণ না করলে রোগীর হার্ট, কিডনি, চোখ এবং অন্যান্য অঙ্গ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। দেখা দিতে পারে নানা রকম শারীরিক জটিলতা। এ রোগ সম্পর্কে সচেতনতা ও চিকিৎসার অভাবে শহর ও গ্রামে অসংখ্য মানুষ অন্ধ ও পুঙ্গ হয়ে যাচ্ছে।
পঞ্চমত হলো লোয়ার ইনফেকশন রেসপিরেটরি বা শ্বাসতন্ত্রের নিম্নাংশ আক্রান্ত রোগ। শুধু ২০১৫ সালেই এই রোগে ৩ হাজার ২১৯ জন মারা যায়। যা জনসংখ্যার ৩ দশমিক ৯ শতাংশ। এ সম্পর্কে জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. কে সি গাঙ্গুলি জানান, এটা নিউমোনিয়া বা টিবিরোগ যা শিশুদের বেশি হয়।
অ্যাজমা, ব্রংক্রাইটিস, টিবিরোগ বহনকারী যুবকদের ফুসফুসের মাঝে বা উপরে আর বৃদ্ধদের ফুসফুসের নিচে হয়ে থাকে। চিকিৎসার ব্যাপারে তিনি জানান, প্রতিদিন বক্ষব্যাধি হাসপাতালের বহির্বিভাগে এ চিকিৎসার জন্য প্রায় শতাধিক রোগী আসে। দেশে কত রোগী আক্রান্ত স্থানীয়ভাবে তার পরিসংখ্যান এখনো করা হয়নি। তবে আগের চেয়ে সেবার পরিধি কিছুটা বাড়ছে।
দেশে মোট ১৩টি মেডিকেলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছে। এছাড়া রাজশাহী, খুলনা, সিলেট ও চট্টগ্রামে ৪টি বক্ষব্যাধি হাসপাতালে সিনিয়র ও জুনিয়র কনসালটেন্ট চিকিৎসকের পদ আছে। ৪৪টি জেলা সদর হাসপাতালে ১ জন করে জুনিয়র কনসালটেন্ট আছে যিনি বক্ষব্যাধি, টিবিসহ বুকের অন্যান্য চিকিৎসা দেন। কিন্তু জেলা সদর হাসপাতালগুলোতে কোন চেস্ট ফিজিশিয়ান নেই। এমনকি কোনো পদও নেই। তাই এ রোগের পৃথক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, সিনিয়র জুনিয়র কনসালটেন্ট নিয়োগ ও আধুনিক চিকিৎসা যন্ত্রপাতি থাকলে ভালো হয়। তার মতে ১৬ কোটি মানুষের জন্য ১৬০ জনেরও কম বক্ষব্যাধি ডাক্তার আছে। যা জনসংখ্যার তুলনায় খুবই অপ্রতুল।

No comments:

Post a Comment