ভেঙে পড়ছে মার্কিন সাম্রাজ্য!

ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া মার্কিন সাম্রাজ্য পতনের একটা ঘণ্টাধ্বনি বৈকি। তবে মার্কিন সাম্রাজ্য যে-সে নয় যে এক ঘণ্টাধ্বনিতেই খান খান করে সব ভেঙে পড়বে। আর এটাই প্রথম ঘণ্টাধ্বনি নয়, শেষও নয়। মার্কিন সাম্রাজ্যের পতন হতে নিঃসন্দেহে আরো অনেক সময় লাগবে। হতে পারে তা কয়েক দশক। তবে যারা প্রতিদিন ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক নিপাত যাক’ বলে রাস্তায় স্লোগান তোলেন, এ পতনে তাদের কোনো হাত নেই। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ধ্বংস কামনা করে চেঁচিয়ে যারা শক্তিক্ষয় করছেন, তাদের অনেকের চোখের আড়ালেই এই বিরাট পতনটি ঘটছে। মার্কিন-ইউরোপিয়ান নেতৃবৃন্দ ও নীতিনির্ধারকরা তা জানেন এজন্য আঁতকেও উঠছেন। এমনকি অনেক আগেই জেনেছিলেন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বড় বন্ধু স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন। কমিউনিজমের পতন তিনি নিজ চোখে দেখেছেন। যে গ্রন্থ সাম্রাজ্যবাদের রক্ষকবচ বলে পরিচিত সেই ‘সভ্যতার সংঘর্ষে’ তিনি মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সভ্যতারও পতনের ছবি এঁকেছেন। কিন্তু সে ছবি এক অতি রক্তাক্ত পথের।
রক্ত ইতোমধ্যে কম ক্ষয় হয়েছে বলা যাবে না। আফগানিস্তান-ইরাক-লিবিয়া হয়ে সিরিয়া পর্যন্ত মানুষের মৃতদেহ ও কান্না ছড়িয়ে আছে ও ঝরে পড়ছে। কান্না মার্কিন দেশেও কম হয়নি। বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রে হামলা থেকে খোদ মার্কিন ভূমিতে একের পর এক নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড—যাতে বহু নিরীহ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। টুইন টাওয়ারে হামলা, আফগানিস্তান-ইরাক আক্রমণ সবই মার্কিন সাম্রাজ্য পতনের একেকটা ঘণ্টাধ্বনি হয়ে বেজেছে। মাঝখানে ওবামা এসে সে পতনকে প্রাণপণে খানিকটা ঠেকিয়েছিলেন। বলা যায়, ভালো মতোই। হিলারি ছিলেন মার্কিন সাম্রাজ্য আরো কিছুদিন টিকিয়ে রাখার অন্যতম ভরসা। কিন্তু সাম্রাজ্যটি ভেতরে ভেতরে এত বেশি ক্ষয়ে গেছে যে, এখন দীর্ঘ রোগ শয্যাগ্রস্ত মানুষের মতো তার আর টিকে থাকার ইচ্ছেও নেই। তবে মার্কিন সাম্রাজ্যের এই অসুস্থতা সহজে চোখে পড়ার নয়। ওবামা-হিলারির আমলে তো সে রীতিমতো ভোরে রমনা পার্কে জগিং করছিল। দেখে আমাদের চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছিল। বিখ্যাত নেতাদের বেলায়ও যেমন তাদের অসুস্থতা বুঝতে দেওয়া হয় না, এও তেমনি। কখনো কখনো মারা যাওয়ার অনেক পরে তাদের মৃত্যুর খবর জানাজানি হয়। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো আর যে-সে দেশ নয়। তবে তার মৃত্যুপূর্ব খিঁচুনি মাঝেমধ্যেই দেখা যাচ্ছে। নির্বাচনে ট্রাম্পের বিজয় তেমনি আরেকটা খিঁচুনি। পতনের আরেকটা ঘণ্টাধ্বনি মাত্র।
ট্রাম্পের বিজয়ে রাশিয়ার আনন্দ আর ইউরোপ জুড়ে আতঙ্কে এ পতনের বার্তা পরিষ্কার। একুশ শতকের কয়েকটি বড় ঘটনার মধ্যে এ বার্তা ছিল। যতই দিন যাচ্ছে তা আরো পষ্ট হচ্ছে। ‘আমেরিকান বিশ্ব কাঠামোর সমাপ্তি’ গ্রন্থের লেখক অমিতাভ আচার্য ১০ নভেম্বর দা ডিপ্লোম্যাটের মারসি এ. কুয়োর সঙ্গে এক কথোপকথনে আমেরিকার বিশ্বনেতৃত্ব ক্ষয়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে যা উল্লেখ করেন তা হলো : চীন ও ভারতের অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি ছাড়াও বিশ্বের দক্ষিণাংশের অর্থনৈতিক উত্থান, এখনই বিশ্ব জিডিপির অর্ধেক যাদের অবদান, যাকে জাতিসংঘের ২০১৩ মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনে ‘দক্ষিণের উত্থান’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাছাড়া বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সামরিক শক্তি হওয়া সত্ত্বেও কোনো লাভ হবে না, কেননা পৃথিবী এখন এমন সব সমস্যা মোকাবিলা করছে—যা এত জটিল যে অনেকের অংশগ্রহণ ছাড়া তা সমাধান সম্ভব নয়। কোনো একক শক্তির পক্ষেই তা সম্ভব নয়। বিশ্ব শৃঙ্খলার এই পরিবর্তন চলতি মার্কিন বিশ্ব কাঠামো ভেঙে পড়ার কারণ বলে তিনি মনে করেন।
ট্রাম্পের বিজয়ের পর প্রমাণ হলো, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির দিক থেকে ইউরোপ এগিয়ে। শুধু সামরিক শক্তির আস্ফালন ছাড়া এখন আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড়াই করার মতো বেশি কিছু নেই। সারা নির্বাচনী প্রচারণা জুড়ে ট্রাম্প যেরকম চীনের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন তাতে তার চীন-আতঙ্ক ভালো ধরা পড়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে আমেরিকার দীর্ঘ ঠাণ্ডা যুদ্ধ জারি রয়েছে। ট্রাম্প ডাক দিয়েছেন, চীনের সঙ্গে গরম ও ঠাণ্ডা সবরকম যুদ্ধ শুরু করার। তবে এবার একা চীন নয়, ভারত ও অন্যান্য উন্নতিশীল দেশের সঙ্গেও তাকে বাণিজ্য যুদ্ধে জড়াতে হবে। মেক্সিকো সীমান্তে দেয়ালের প্রস্তাব প্রতীক মাত্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজের চারপাশে এবার এক অদৃশ্য ‘চীনের প্রাচীর’ তৈরি করে নিজেকে রক্ষা করতে চাইছে।
মার্কিন সাম্রাজ্যের কী পরিমাণ শক্তিক্ষয় ঘটেছে যে, দেখা যাচ্ছে এখন আর সে দুনিয়ার কোথাও শান্তিরক্ষার ও গণতন্ত্র রক্ষার দায়িত্ব পালন করতে চাচ্ছে না, এতকাল যে দায়িত্ব সে কারো তোয়াক্কা না করে গায়ে পড়েই নিত। এখন সে কারো পাহারাদার হতে লজ্জা পাচ্ছে। সৌদি আরবের কাছ থেকে এজন্য মায়না দাবি করবেন বলে ট্রাম্প জানিয়েছেন। একই রকম খরচ দাবি করবেন ইউরোপের পাহারাদারির জন্য। ওবামা-হিলারির বিশ্ব সরকার হওয়ার খায়েশের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন তিনি। এ খায়েশের জন্য যে টাকা গচ্চা যায়, তা দিতে তিনি রাজি নন। ইরাকে ‘গণতন্ত্র’ আনতে আমেরিকার খরচ হয়েছে তিন লাখ কোটি ডলার। সে গণতন্ত্র আনার অভিযান এখনো চলছে যার জন্য ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমেরিকার নেতৃত্বকে নিঃসন্দেহে যুদ্ধাপরাধী বলে চিহ্নিত করবে এবং যে দিন সম্ভব হবে ক্ষতিপূরণও দাবি করবে।
মার্কিন হার্ড পাওয়ারের যখন এই দশা তখন তার সফট পাওয়ার বা কোমল শক্তিরও দফরফা হচ্ছে। আধুনিক সাম্রাজ্যের মূল খুঁটি সামরিক শক্তি নয়, কোমল শক্তি অর্থাৎ মানুষের মনে একটি সাম্রাজ্য সম্পর্কে উচ্চ ধারণা। প্রোজেক্ট সিন্ডিকেটে (নভেম্বর ১১) শশী থারুর লিখেছেন যে, ট্রাম্পের ক্ষমতায় আরোহণের মধ্য দিয়ে মার্কিন সাম্রাজ্য সম্পর্কে সেই বিদ্যমান মানসপ্রতিমাটি ভেঙে পড়েছে। যে দেশ সারা দুনিয়ায় গণতন্ত্র রফতানি করে বেড়াত, তার নিজ ঘরেই গণতন্ত্রের তীব্র সঙ্কট ফুটে উঠেছে। যেসব আদর্শের সে প্রচার ও বড়াই করত, তা নিজের মাটিতেই ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘আমেরিকা আর আগের মতো থাকবে না। অথচ ট্রাম্পের কাল তো এখনো শুরুই হয়নি।’
অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী পল ক্রুগম্যান শ্বেত ভবনে ট্রাম্পের বসানোকে এক মহাকাব্যিক ভ্রান্তি বলেছেন, তার মতে যা ভবিষ্যতে মহাবিপর্যয় ডেকে আনবে। তিনি আগাগোড়া হিলারি-সমর্থক ছিলেন বলে এ কথা বলতেই পারেন। তবে জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেলও ট্রাম্পকে পাঠানো অভিনন্দন বার্তায় জার্মানির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে শর্ত জুড়ে দিয়েছেন, যে রকম শর্ত সবাইকে দিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এতদিন অভ্যস্ত ছিল।
কেউ কেউ আবার অন্ধকারে আলো খুঁজছেন। বলছেন, ক্ষমতায় গেলে ট্রাম্প প্রচারিভানে যা বলেছেন তার অনেক কিছু করবেন না। আবার আমেরিকায় নানা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান মিলে একে অপরকে একচ্ছত্র আধিপত্য অর্জনে বাধা প্রদান করে। সে কারণে ট্রাম্প চাইলেও অনেক কিছু পারবেন না। তাছাড়া তিনি একজন ব্যবসায়ী, তাই বাস্তববাদী। ক্ষমতার রথে চড়ার জন্য যাই বলেন না কেন, এখন পরিস্থিতি বুঝে কাজ করবেন। সেরকম ইঙ্গিত তিনি দিয়েছেনও। যদি ট্রাম্প বদলে যান, তাহলেও তিনি যা বলেছেন, তার ক্ষতি আমেরিকাকে গুনতেই হবে। হিলারি তাই বলেছিলেন, ‘কথা কিছু কাজ করে, ডোনাল্ড।’
কথা কাজ করে এ কথা ডোনাল্ড ট্রাম্প না জানলে আর কে জানবে! তার কথাবার্তা শুধু তাকে ক্ষমতার মসনদে চড়ায়নি, আমেরিকাকে হাস্যাস্পদ করে তুলে দেশটির কোমল শক্তিকে ভেঙে দিয়েছে। অনেকেই তাকে আরো বহুদিন পিঁড়ি পেতে বসার দাওয়াত দেবে, দিতে হবে। তবে আস্তে আস্তে অনেক টেবিলেই তার জায়গা হবে না। মার্কিন সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ছে নিজের ভারে। এতে যদি পুতিনের হাত থাকেও তা খুব বড় নয়। অযথাই মার্কিনিরা সর্বত্র পুটিনের ভূত দেখছে।
লেখক : আলমগীর খান,গবেষণা ও প্রকাশনা কর্মকর্তা, সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট ইনোভেশন অ্যান্ড প্র্যাকটিসেস (সিদীপ)
No comments:
Post a Comment