মাঠভরা শীতের সবজি: কৃষক কি লাভের মুখ দেখবে!

এ বছর বন্যায় জামালপুরের অনেক সবজিখেত নষ্ট হয়ে গেছে। অন্য কৃষকদের মতো ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছেন ইসলামপুর উপজেলার গোড়াইল গ্রামের কৃষক সজ্জল মিয়া। সে ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে শীতকালীন সবজি মুলা, শিম ও ফুলকপি চাষ করেছেন সাত বিঘা জমিতে। স্থানীয় বাজারে প্রতি মণ মুলা বিক্রি করছেন ১৫০-২০০ টাকায়; যা কেজিপ্রতি দাঁড়ায় চার-পাঁচ টাকা। ফুলকপি মণপ্রতি বিক্রি করছেন ৬০০-৮০০ টাকা; যা কেজিতে দাঁড়ায় ১৫-২০ টাকা। লাউ বিক্রি করছেন প্রতিটি ১৫-২০ টাকা।
জামালপুর থেকে ঢাকার দূরত্ব ১৮০ কিলোমিটার। পরিবহনব্যবস্থাও সহজ। অথচ জামালপুরের সেই মুলা রাজধানীর বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকা কেজি, পৌনে এক কেজি ওজনের একটি ফুলকপি ৩৫ টাকা ও লাউ মানভেদে ৪০-৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ জামালপুরে একজন কৃষকের উৎপাদিত এক কেজি মুলা মধ্যস্বত্বভোগীদের দুই হাত হয়ে খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৫ টাকা, ফুলকপি ১৫ টাকা ও লাউ ২০ টাকা বেশিতে। কৃষকদের হাত থেকে খুচরা বাজারে চড়াদামের এই মুনাফা যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে। কৃষদের কোনো লাভ হচ্ছে না।
এ ব্যাপারে কৃষক সজ্জল মিয়া বলছেন, লাভ তো দূরের কথা, কিছু সবজিতে পুঁজিও উঠবে না। মুলা চাষে যে টাকা খরচ করেছি তার অর্ধেক টাকা উঠবে ধারণা করছি। আর ফুলকপি ও লাউতে খরচ মোটামুটি উঠবে। তবে এখনো যে মূল্য পাচ্ছি, সেভাবে চলতে থাকলে লাভের মুখ দেখব বলে আশা করছি।
তবে এখন পর্যন্ত যে সবজির যে দাম পাচ্ছেন তাতে খুশি কুষ্টিয়া জেলার হরিণামপুর গ্রামের কৃষক লিয়াকত আলী। তিনি মুলা, পালংশাক ও ধনিয়া চাষ করেছেন ছয় বিঘা জমিতে। আর পেঁপে চাষ করেছেন ছয় বিঘা জমিতে। স্থানীয় হরিণাথপুর বাজারে মণপ্রতি পেঁপে বিক্রি করছেন ৩০০-৩৫০ টাকা, যা কেজিপ্রতি দাঁড়ায় ৮-৯ টাকা। এ ছাড়া ধনিয়া পাতা বিক্রি করছেন কেজিপ্রতি ১৫০ টাকা। তিনি বলেন, বাজারের চলতি দামে আমি মোটামুটি সন্তুষ্ট। এ রকম দাম থাকলে লাভের মুখ দেখব আশা করছি।
কিন্তু উৎপাদন কেন্দ্র থেকে খুচরা বাজারে দামের এত তারতম্য কেনÑজানতে চাইলে জামালপুর থেকে সবজি নিয়ে আসা কারওয়ান বাজারের ভাই ভাই ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী আবদুল লতিফ মিয়া বলেন, প্রতিটি পণ্য নিয়ে আসতে অনেক টাকা খরচ হয়। ট্রাকভাড়া ও সড়কের বিভিন্ন স্থানে টাকা দিতে হয়। এতে আমাদের খরচ বেশি পড়ে যায়। মূলত এর জন্য কম দামে বিক্রি করতে পারি না।
এমন বাস্তবচিত্রের মধ্য দিয়েই মাঠ ভরে গেছে শীতকালীন সবজিতে। ব্যস্ত সময় পার করছেন সবজি কৃষকরা। উৎপাদন কেন্দ্র থেকে সে সবজি চলে আসছে বাজারে। বাজারে ঢুকলেই চোখে পড়ছে স্তূপাকারে সাজানো শিম, আলু, মুলা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, পুঁইশাক, লালশাক পালংশাকসহ নানা সবজি। দামও কিছুটা নিয়ন্ত্রণে। সবজি পেয়ে খুশি ক্রেতারাও।
আগামী কয়েক সপ্তাহে এ দাম আরো কমবে বলে আশা ব্যবসায়ীদের।
এ বছরের সময়োপযোগী আবহাওয়া চলতি মৌসুমে শীতকালীন সবজিচাষিদের জন্য আশীর্বাদ হয়েছে। পর্যাপ্ত বৃষ্টি হওয়ায় সেচ খরচ বাদেই তারা রকমারি সবজি উৎপাদন করতে পেরেছেন। ফলন হয়েছে আশানুরূপ। লাভের মুখ দেখার সম্ভাবনাও উঁকি দিচ্ছে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত কৃষকের সে হাসি অম্লান থাকবে কি নাÑজামালপুরের কৃষক সজ্জল মিয়ার মতো এমন আশঙ্কা করছেন দেশের কৃষি বিশেষজ্ঞরাও। এর মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব ও কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের অধ্যাপক আরিফুর রহমান বলেন, ফলন বেশি হওয়ায় কৃষকদের লাভের সম্ভাবনা যেমন রয়েছে, তেমনি আশঙ্কা রয়েছে লোকসানেরও। কারণ মাঠপর্যায়ে সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় একসঙ্গে ওঠা প্রচুর সবজি কৃষকদের ছেড়ে দিতে হয়। আর সে সুযোগটায় নেন মধ্যস্বত্বভোগীরা। সবজির জোগান বেশি থাকায় দামও কমে। এমনও হয় সংরক্ষণ করতে না পেরে কৃষক শেষ পর্যন্ত পানির দরে সবজি বিক্রি করে দেন। অন্যদিকে, মধ্যস্বত্বভোগীরা একসঙ্গে প্রচুর সবজি কিনে হীমাগারে রাখেন। পরে সেখান থেকে আস্তে আস্তে বাজারে ছাড়েন। একপর্যায়ে খুচরা বাজারেও দাম বেড়ে যায়। এই কৃষিবিদ আরো বলেন, বাজার মনিটরিং না থাকায় পর্যাপ্ত সবজি থাকা সত্ত্বেও এক শ্রেণির ব্যবসায়ী নিজেদের ইচ্ছেমতো বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণ করেন। অথচ সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকলে কৃষকরা সবজি যথার্থ দাম পেতেন ও সে অর্থ দিয়ে পরবর্তী মৌসুমের ফসল উৎপাদন করতে পারতেন।
কৃষিবিশেষজ্ঞদের এ আশঙ্কার সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক কৃষিবিজ্ঞানী দেবেস চক্রবর্তীও। তিনি বলেন, প্রতিবারের মতো এবারো সরকার শীতকালীন সবজির ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। বিভিন্ন উপজেলার কৃষকদের ১১০ কেজি করে উন্নতজাতের বিটি বেগুনের বীজ সরবরাহ করা হয়েছে। এ ছাড়া সবজির উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যেও মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আবহাওয়া ভালো ছিল। সবজি চাষ ভালো হবে। কিন্তু কৃষক ও খুচরা ক্রেতাদের যে সমস্যা সেটার সমাধান হচ্ছে না। কৃষকরা যেমন মূল্য পাচ্ছে না, তেমনি খুচরা ক্রেতারাও ঠকছে। লাভবান হচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। এ সংকট কাটাতে এমন ব্যবস্থা করতে হবে কৃষকরা যেন খুব সহজে সরাসরি বাজারে নিয়ে সবজি বিক্রি করতে পারে। আইন আছে। সরকার বাজার মনিটরিং করছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত কাজ করছে। তার পরও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমছে না। সরকারের উচিত এদের ন্যূনমত লাভের মধ্যে রাখা।
রাজধানীর শীতের শাকসবজি বাজার : রাজধানীর কারওয়ান বাজার ও হাতিরপুল বাজারে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাজারে প্রত্যেকটি দোকানি তরে তরে সাজিয়ে রেখেছেন শীতকালীন সবজি। কিন্তু দাম নিয়ে ভীষণ অসন্তোষ ক্রেতাদের। প্রচুর সবজি থাকলেও দাম বেশি বলে মন্তব্য তাদের।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, পাইকারি বাজারের সঙ্গে খুচরা বাজারের আকাশ-পাতাল পার্থক্য। খুচরা বাজারে যে সবজি বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়, সেই সবজি পাইকারি বাজারে ২৫-৩০ টাকা। খুচরা বাজারে বেগুন কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৫০-৬০ টাকা, যা পাইকারি বাজারে ২৫-৩০ টাকা; পাইকারি বাজারে কাঁচামরিচ কেজিপ্রতি ৩৫-৪০, যা খুচরা বাজারে ৬০-৮০ টাকা; খুচরা বাজারে শিম কেজিপ্রতি ৬০-৭০ টাকা, যা পাইকারি বাজারে ৪০ টাকা কেজি। মূলা খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৫-৩০ টাকা কেজি, যা পাইকারি বাজারে ১০ টাকা কেজি। ফুলকপি প্রতি পিস (মাঝারি) পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ১৫-২০ টাকায়, যা খুচরা বাজারে ৩৫-৪০ টাকা। একইসঙ্গে খুচরা বাজারে বাঁধাকপি বিক্রি হচ্ছে ১০-১২ টাকা, যা খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৫-৩০ টাকা। কচুরমুখী খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে কেজি ৩০ টাকা, যা পাইকারি ১৫-১৮ টাকা। পেঁপে পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ১২-১৫ টাকা কেজি, যা খুচরা বাজারে ২৫-৩০ টাকা। পটোল বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা, যা কেজিপ্রতি পাইকারি ৩০-৩৫ টাকা। টমেটো খুচরা বিক্রি হচ্ছে ৮০-১০০ টাকা কেজি, পাইকারি ৬০ টাকা।
এদিকে বাজারে ওঠা নতুন আলু খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৮০-১০০ টাকা কেজি। প্রতি কেজি শশা খুচরা বাজারে ৫০-৬০ টাকা, পাইকারি বাজারে ৪০-৪৫ টাকা। এ ছাড়া লালশাক আঁটিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ১০-১৫ টাকা, পাইকারি মাত্র পাঁচ টাকা। পালনশাক, মুলাশাক, লাউশাকসহ অন্যান্য শাক বাজারে আছে প্রচুর। এই শাকগুলোর দাম ১৫-৩০ টাকা প্রতি আটি।
কৃষিবিদদের পরামর্শ : কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, উৎপাদন ছাড়া সবজি বাজারে কৃষকদের কোনো হাত নেই। মূল্য নির্ধারণ করে দেয় মধ্যস্বত্বভোগীরা। সে অনুপাতে বাজার ওঠানামা করে। কৃষকরা শীতকালীন কিছু আগাম সবজি চাষ করে। এখন বাজারে সেগুলোই উঠেছে। এরপর উঠবে মূল শীতকালীন সবজি। এই আগাম সবজি থেকেই কৃষকরা কিছু লাভ করতে চায়। কারণ মূল শীতকালীন সবজিতে তেমন লাভ হয় না। কিন্তু মধ্যস্বত্বভোগীরা যেভাবে জোট বেঁধে বাজারে নেমেছে, তাতে কৃষকদের লাভের কোনো আশা নেই। এ ছাড়া আমরা এক শ্রেণির নাগরিকরাও প্রথম আলু, প্রথম মুলা, প্রথম শিম খাবো বলে দাম বাড়িয়ে দেয়। কয়েকটা দিন পরে যদি খায়, তা হলে কিন্তু বাজার এমন ঊর্ধ্বমুখী হয় না। এই মধ্যস্বত্বভোগীদের হাত থেকে বাঁচতে হলে কৃষকদের নিজেদের সমবায় বাজার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। কৃষকরা সংঘবদ্ধ না হলে লাভবান হবে না।
কৃষিবিদ আরিফুর রহমান বলেন, কৃষকদের উৎপাদিত সবজি দুই হাত হয়ে বাজারে আসছে। ফলে দাম বেড়ে যায়। কিন্তু কৃষক মূল্য পায় না। এর কারণ একমাত্র আলু ছাড়া অন্য কোনো সবজি সংরক্ষণের সুযোগ দেশে নেই। তা ছাড়া কৃষকরা যদি সরাসরি বিক্রি করতে পারত, তাহলে তাদের পাশাপাশি সাধারণ ক্রেতারাও লাভবান হতেন। নির্দিষ্ট জায়গায় কৃষকরা নিজেরা দাম নির্ধারণ করে সবজি বিক্রি করবেন। তা ছাড়া সরকারেরও উচিত বাজার মনিটরিং করা। কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। অথচ প্রচুর সবজি উৎপাদন হচ্ছে। কারণ বৃষ্টি হয়েছে। মাটিতে রস রয়েছে। এমন আবহাওয়া সবজির জন্য ভালো।
No comments:
Post a Comment