শিশুর সঙ্গে মিশুন

একটি শিশু যদি সৎ চরিত্র ও বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব নিয়ে সমাজে নিজের জায়গা করে নিতে পারে সেখানেই বাবা–মায়ের সাফল্য। আদর্শ অভিভাবক হয়ে উঠতে পেরেছেন কি না বোঝা যায় তখনই। এখনকার দিনে শুধু ছেলেরাই নন, মেয়েরাও আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। স্বামী–স্ত্রী যখন দুজনেই কর্মক্ষেত্রে যাচ্ছেন বাচ্চাদের ওপর তাদের দায়িত্ব বেড়ে যাচ্ছে অনেক বেশি। সব শিশুর আচার আচরণ একরকম হয় না। কারওর রাগ বেশি, কারওর মনে রাখার ক্ষমতা কম। আবার কেউ বা বেশি চঞ্চল। তাই : —
❚ প্রথমে শিশুর চরিত্র বোঝার চেষ্টা করুন। কোনও কোনও শিশুর মধ্যে রাগ বেশি থাকে। আপনি হয়ত আপনার সন্তানকে বাড়ির কোনও একটি কাজ করতে বললেন। কিন্তু কাজ করতে বলার কারণেই হয়ত রেগে গেল। কারণ সে ভাবছে বাড়ির কাজ করার দায়িত্ব শুধুমাত্র বাবা এবং মায়ের। যখন সে রেগে থাকবে তখন তাকে বকবেন না যতক্ষণ না রাগ কমছে ততক্ষণ অপেক্ষা করুন। রাগ কমলে কথা বলা শুরু করুন। বাবা এবং মা দুজনেই বোঝান সেও বাড়ির একজন সদস্য এবং বাড়ির প্রতি তারও কর্তব্য আছে।
❚ আদর্শ অভিভাবক হতে গেলে বাচ্চার সঙ্গে বন্ধুত্ব তৈরি করা প্রয়োজন। ছোট থেকেই বোঝাতে হবে আপনারাই আপনাদের সন্তানের সবচেয়ে কাছের মানুষ এবং সবচেয়ে ভাল বন্ধু। আট থেকে ১০ ঘণ্টা বাড়ির বাইরে থাকতেই হয় কাজের জন্য। কিন্তু তারপরও অনেকটা সময় বাকি থাকে। বাবা–মা এক সঙ্গে সন্তানকে সময় দিন। মজার গল্প বলুন, খেলুন, গল্প করুন। এতে শিশুটির মনে বাবা–মায়ের প্রতি বিশ্বাস জন্মাবে। ভরসা তৈরি হবে। আপনাদের কাছে সব কথা বলা যায়, এই বিশ্বাস তৈরি হওয়া খুবই প্রয়োজন।
❚ এখনকার দিনে মাঝে মাঝেই শোনা যায় বাচ্চা মেয়েদের যৌন–হেনস্থার শিকার হতে হচ্ছে। এর মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে মেয়েটির পরিবারের সদস্যই জড়িয়ে থাকে। তারা ভয়ে বা অপরাধীর কাছ থেকে কোনও লোভনীয় জিনিস পাবে এই প্রত্যাশায় অনেক সময় ঘটনাটি চেপে যায়। বাবা–মাকে যেন মন খুলে সব কথা একটি বাচ্চা বলতে পারে সেই দিকটি খেয়াল রাখতে হবে।
❚ বাচ্চাদের অনেক সময় পড়া মনে থাকে না। অভিভাবকরা বকাবকি করবেন না। তাতে শিশুটির নিজের ওপর থেকে ভরসা চলে যাবে। বার বার অভ্যাস করান। একই পড়া প্রতিদিন অভ্যাস করালে শিশুর মনে গেঁথে যাবে। তার সঙ্গে লেখার অভ্যাস করান।
❚ অনেক সময় দেখা যায় বাচ্চারা অন্যের জিনিস নিয়ে চলে আসছে বা কোনও দোষ করে মিথ্যে কথা বলছে। এই ধরনের ঘটনা নজরে এলেই বকবেন না তাকে। অভিভাবকরা সন্তানের সামনে বিষয়টিকে খুব গুরুত্ব দেবেন না। শিশুটি যেন ‘চুরি’ করেছে বা ‘মিথ্যে বলেছে’ – এই বিষয়টার ওপর গুরুত্ব দিয়ে না ফেলে। অপরাধ বোধ তৈরি হতে দেবেন না। ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক এভাবেই হালকা করে দেবেন। পরে অন্য কোনও সময়, অন্য কোনও ঘটনার মাধ্যমে বোঝান, যে না বলে কারওর জিনিস নেওয়া অন্যায়, বা সত্যি কথা না বলা অন্যায়। সে যেন নিজে থেকে বুঝতে পারে সে অন্যায় করেছিল। তাকে আপনারা বোঝাবেন না।
❚ নিজেদের অফিসের চাপ কখনওই শিশুর ওপরে দেখাবেন না। কাজের জায়গায় চাপ থাকতেই পারে। কিন্তু বাড়িতে ঢুকে বাচ্চাদের সামনে সেই চাপ প্রকাশ করবেন না। মেজাজ হারাবেন না কথায় কথায়। হাসি মুখে বাচ্চাদের সঙ্গে মিশতে হবে। তাদের ওপর চাপ দেওয়া চলবে না। বাবা–মা যে তাকে ভালবাসে তা শিশুকে বোঝানোর দায়িত্ব কিন্তু অভিভাবকদেরই।
❚ দিনের যতটুকু সময় সে পরিচারিকার কাছে থাকছে সেই সময় কী, কী শিখছে সে দিকে খেয়াল রাখুন। ১২–১৩ বছরের বাচ্চারা কাদের সঙ্গে মিশছে সে দিকটি নজর রাখুন। হঠাৎ কোনও কারণে চুপ করে গেলে বা খিটখিট করলে বা রোজকার থেকে অন্যরকম আচরণ করলে বিষয়টি এড়িয়ে যাবেন না।
❚ আপনারা চাইছেন সন্তান ডাক্তার হোক, কিন্তু বাচ্চাটির মন রঙ–তুলির দিকে। তার বিজ্ঞান হয়ত ভাল লাগে না। কখনওই নিজেদের ইচ্ছে চাপিয়ে দেবেন না। একটি শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ বাধা পায়। সে হয়ত একজন ভাল চিত্রশিল্পী হতে পারত, কিন্তু আপনাদের ইচ্ছে পূরণ করতে গিয়ে সে ক্রমশ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়বে। না আপনাদের ইচ্ছে পূরণ হবে, না ওই শিশুটির।
❚ শিশু যদি চঞ্চল প্রকৃতির হয় তা হলে তার বই পড়তে ভাল নাও লাগতে পারে। জোর করবেন না। তাকে কম্পিউটারে নানান ধরনের জিনিস শেখান। ছবি, লেখা, কবিতা সবই এখনকার দিনে কম্পিউটারে শেখানো সম্ভব। বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করতে সময় লাগবে। কম্পিউটারে শেখালে চঞ্চল বাচ্চারা তাড়াতাড়ি শিখবে। পড়ায় আগ্রহ তৈরি হবে।
❚ বাচ্চারা কোনও জিনিসের বায়না করলে সঙ্গে সঙ্গে সেই বায়না মেটাবেন না। এতে পরিশ্রম ছাড়া সব কিছু পাওয়ার অভ্যেস তৈরি হবে। কোনও ভাল কাজ করলে পুরস্কৃত করুন। পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করলে উপহার দিন। খেয়াল রাখবেন সেই উপহার যেন শিশুমনের বিকাশে সাহায্য করে।
❚ প্রকৃতির সঙ্গে একটি শিশুর বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে সাহায্য করুন। অনেক সময় দেখা যায় শিশুরা নিজেদের রাগ ও জেদ দেখাচ্ছে গাছের পাতা ছিঁড়ে বা ডাল ভেঙে। অথবা রাস্তার কোনও কুকুরকে ঢিল ছুঁড়ছে। একটি গাছেরও প্রাণ আছে বা পশুদেরও আঘাত লাগে এই বিষয়গুলি ভালভাবে বোঝান। বিকেলে পার্কে খেলতে নিয়ে যান। বাড়িতে বাগান তৈরির জায়গা না থাকলে ছোট ছোট টবে গাছ লাগান। বাচ্চার সামনে গাছে জল দিন। একটু বড় হলে এই জল দেওয়ার দায়িত্ব তাকেই দিন। এতে ছোট থেকেই শিশুর মধ্যে মমত্ব বোধ গড়ে উঠবে।
❚ বাচ্চার সামনে কখনওই স্বামী–স্ত্রী একে অপরের ওপর দোষারোপ করবেন না। মনে রাখবেন বাচ্চাদের ওপর সবচেয়ে বেশি চাপ পড়ে যখন তার সবচেয়ে কাছের মানুষ দুটি একে অপরের সঙ্গে লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েন। শিশুরা একাকিত্ব বোধ করতে থাকে। যে কোনও কাজে বাবা ও মা একে অপরকে সাহায্য করুন। বাড়িতে অতিথি আসার কথা থাকলে দুজনে মিলে বাচ্চার সামনে ঘর সাজান। এতে শিশুদের মধ্যে অন্যকে সাহায্য করার প্রবৃত্তি তৈরি হবে।
No comments:
Post a Comment