পাঠদানে নেই উপযুক্ত শিক্ষক

প্রথমবারের মতো পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রাক-প্রাথমিকের শিশুরা মাতৃভাষায় বিনামূল্যে বই পেতে যাচ্ছে।অথচ আদিবাসীদের নিজ ভাষায় এসব বই পড়াতে নেই কোনো দক্ষ শিক্ষক।তাই শিশুরা বই পেলেও বাধ্য হয়ে বাসায় সাজিয়ে রাখতে হবে। যদিও খসড়া শিক্ষা আইনে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষায় পর্যায়ক্রমে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তর (অষ্টম শ্রেণি) পর্যন্ত চালুর কথা বলা হয়েছে।এ বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আলমগীর হোসেন বলেন, যেসব স্কুলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুরা ভর্তি হবে, সেখানে ওই নৃগোষ্ঠীর শিক্ষক না থাকলে অন্যত্র থেকে বদলি করে পাঠদানের ব্যবস্থা করা হবে। পর্যাপ্ত শিক্ষক ও পাঠদানের জন্য কোনো পরিকল্পনা রয়েছে কিনা প্রশ্ন করলে তিনি কোনো তথ্য জানাতে পারেননি।তবে শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করে দ্রুত শিক্ষক নিয়োগ বা এনজিওদের দায়িত্ব দিয়ে সমস্যার সমধান সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আদিবাসী এলাকায় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার জন্য ওই সম্প্রদায়ের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া বাঞ্ছনীয়। প্রয়োজন হলে শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করে শিক্ষক নেওয়া যেতে পারে, যত দিন পর্যন্ত অবস্থার উন্নতি না হয়। প্রাক-প্রাথমিকের জন্য এইচএসসি পাস শিক্ষক দরকার নেই। প্রশিক্ষিত শিক্ষক অষ্টম শ্রেণি পাস হলেও চলে। এ বিষয়ে সরকারের একটা বলিষ্ঠনীতি ও প্রজ্ঞাপন আছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের মাতৃভাষায় শিক্ষা চালু করার জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, সরকারকেই পাঠদানের দায়িত্ব নিতে হবে, তেমন কোনো কথা নেই। বেশ কিছু এনজিও ইতোমধ্যেই কাজ করছে।
দেশে সরকারি হিসাবে ৩৭টি এবং বেসরকারি হিসাবে ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় সব নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা ও বর্ণমালা রয়েছে। কিন্তু তাদের নিজস্ব মাতৃভাষায় সরকারিভাবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ নেই। ফলে ক্ষুদ্র আধিবাসীদের শিশুরা বাধ্য হয়েই বাংলা ভাষায় শিক্ষা নিচ্ছে। এর ফলে তাদের মাতৃভাষা দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। এমনকি পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে মাতৃভাষায় কথা বলা শিখলেও নিজেদের বর্ণমালা সম্পর্কে ধারণা পাচ্ছে না। ফলে উচ্চারণ ও বিকৃতির কবলে এখন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষা। অথচ এ দেশেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল রাজপথ। আদিবাসীদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার আগামী শিক্ষাবর্ষে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো ও সাদ্রী এ পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রাক-প্রাথমিকের শিশুদের মাতৃভাষায় পাঠদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বর্তমানে জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) তত্ত্বাবধানে বইয়ের পান্ডুলিপি তৈরির কাজ চলছে।
খাগড়াছড়ি জাবারাং কল্যাণ সমিতির নির্বাহী পরিচালক ও ত্রিপুরা ভাষায় পান্ডুলিপি তৈরির সঙ্গে জড়িত মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা বলেন, আদিবাসীদের মধ্যে ত্রিপুরাদের সংখ্যা অনেক কম। প্রায় দুই লাখ ত্রিপুরা সম্প্রদায় বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। ফলে ত্রিপুরারা মাতৃভাষায় সেখার সুযোগ পায় না। যতটুকু সুযোগ আছে তা ব্যক্তি উদ্যোগে। ত্রিপুরা ভাষা রক্ষার জন্য ত্রিপুরাদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদান বহু দিনের দাবি। আদিবাসীরা এনিয়ে অনেক আন্দোলনও করেছে। সরকার আমাদের দাবি পূরণ করায় খুবই আনন্দিত। সরকারের এ উদ্যোগের মাধ্যমে আমাদের ভাষা টিকে থাকার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।ত্রিপুরা ভাষা বিকৃতি থেকেও রক্ষা পাবে বলে তিনি মনে করেন।পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় পাঠদানের জন্য পান্ডুলিপি তৈরি করতে এনসিটিবিকে সহযোগিতা করছে প্রতিটি নৃগোষ্ঠীর পাঁচজন করে মোট ৩০ জন। প্রতিটি গ্রুপ তদারকি করছেন এনসিটিবির পাঁচজন কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ। এদেরই একজন সহযোগী অধ্যাপক মো. মোসলে উদ্দীন সরকার।তিনি বলেন, শিশুদের ভবিষ্যৎ শিক্ষার জন্য প্রস্তুত করতে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে মাতৃভাষায় শিক্ষা দেওয়া জরুরি। পরবর্তীতে সে ধীরে ধীরে মাতৃভাষার সঙ্গে অন্য ভাষায় (রাষ্ট্রীয় ভাষা) শিক্ষা নেবে। আমাদের সংবিধানেও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় শিক্ষা দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ আছে। ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতেও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের নিজ নিজ মাতৃভাষায় লেখাপড়ার সুযোগের বিষয়টি পরিষ্কার বলা আছে। তারই আলোকে বর্তমান সরকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় শিক্ষা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হবে।
চাকমা ভাষার পান্ডুলিপি তৈরির দায়িত্বে থাকা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক প্রসন্ন কুমার চাকমা বলেন, চাকমা ভাষা ও বর্ণমালা আছে। কিন্তু এই বর্ণমালা দিয়ে চাকমা ভাষা লেখা হয় না। চাকমা ভাষা বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষারও সুযোগ নেই। যে কারণে চাকমা ভাষা সম্পর্কে অনেক চাকমারই ধারণা নেই। চাকমা ভাষায় বাংলায় লিখতে গিয়ে অনেক ভুল হয়।শব্দ বিকৃতভাবে প্রকাশ পায়।সরকারের এ উদ্যোগের কারণে চাকমারা মাতৃভাষায় লেখাপড়ার মাধ্যমে নিজেদের ভাষা শিখবে। রক্ষা হবে চাকমা ভাষা। আদিবাসীদের নিজ ভাষায় বই পড়াতে তারা প্রত্যেকে শিক্ষক নিয়োগের দাবি জানান।
No comments:
Post a Comment