Thursday, October 27, 2016

গারোদের একটি প্রণয় উপাখ্যান

বাংলাদেশের রাষ্ট্রসীমায় বসবাসকারী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে গারো নৃ-গোষ্ঠী একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী। প্রায় প্রতিটি নৃ-গোষ্ঠীর মতো এদেরও রয়েছে নৃতাত্ত্বিক, জাতিতাত্ত্বিক, ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য সংবলিত স্বতন্ত্র পরিচয়। এছাড়া রয়েছে লোকজ সংস্কার, উপকথা, লোককথা, কৃত্যমূলক গীত ও গেয় আখ্যানপালার সুবিশাল সম্ভার। কিন্তু অন্যান্য নৃ-গোষ্ঠীর মতো এই নৃ-গোষ্ঠীরও সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও সাহিত্যের সামগ্রিক রূপটি বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর অংশ বাঙালিদের নিকট অপরিজ্ঞাত থেকে গেছে। এর রয়েছে নানাবিধ কারণ। তবে বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে গারোদের সাংস্কৃতিক জীবনের একটি বিশেষ ক্ষেত্র ‘রে-রে নাট্যপালা’।
বাংলাদেশে অভিবাসনকারী বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর অন্যতম গারো নৃ-গোষ্ঠী। ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকায় বৃহত্তম ময়মনসিংহ জেলার মধুপুরের গভীর অরণ্য, হালুয়াঘাট, নালিতাবাড়ি, শ্রীবর্দী, শেরপুর, নখলা, দুর্গাপুর, কলমাকান্দা এবং বাংলাদেশ অংশের গারো পাহাড়ের টিলায় এই নৃ-গোষ্ঠী ঐতিহাসিক কাল থেকেই বসবাস করে আসছে। মঙ্গোলয়েড মহাজাতির নৃ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য এদের মধ্যে বিদ্যমান। অনেকে অবশ্য মনে করেন এরা মঙ্গোলয়েড মহাজাতির একটি শাখা বোদোর অন্তর্ভুক্ত। গারোদের বিশ্বাস খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ সাল থেকেই তারা উল্লেখিত অঞ্চলে বসবাস করে আসছে।
গারো নৃ-গোষ্ঠী একটি স্বতন্ত্র ধর্ম মতে বিশ্বাসী। তাদের সৃষ্টিতত্ত্বের আলোকেই গড়ে উঠেছে এই ধর্ম বিশ্বাস। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, গারো সংস্কৃতির বীজমন্ত্র তাদের ধর্ম বিশ্বাসের মধ্যেই নিহিত। প্রকৃতি পূজক বা পাথর পূজক সাংসারেক গারো সংস্কৃতিতে তাই কৃত্য বা রিচ্যুয়াল অতীব গুরুত্বপূর্ণ। আর কৃত্য বা রিচ্যুয়াল হচ্ছে নাটের প্রাণকোষ।
গারোদের নাট্যপালা ‘রে-রে’ আলোচনার পূর্বে জাতিগত থিয়েটার বা এথনিক থিয়েটার সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরি। নৃ-গোষ্ঠী নাট্য গবেষক অধ্যাপক লুৎফর রহমান মনে করেন, ‘কোনো বিশেষ জনগোষ্ঠীর যে সব পৌরাণিক উপকথা, সংস্কার, লোকাচার ও আত্মিক বিশ্বাসের অভিজ্ঞান সেই জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় কৃত্য বা উৎসবে সম্পূর্ণ অবিকৃত অবস্থায় বিভিন্ন নৃত্য-গীত ও নাট্যমূলক শিল্পরীতিরূপে প্রচলিত তাই এক কথায় নৃ-গোষ্ঠী নাট্য বা এথনিক থিয়েটার, অন্যকথায় কোনো পালা বা নাট্যকাহিনির সঙ্গে যুক্ত কৃত্য যখন একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের নৃ-তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক-নৃতাত্ত্বিক পরিচয়কে একান্তভাবে উদ্ভাসিত করে তখন তাকে জাতিগত থিয়েটার বা এথনিক থিয়েটার বলা যায়।
গারোদের জাতিগত বিশ্বাসের অভিজ্ঞান হচ্ছে সৃষ্টির আদি অবস্থায় বিশ্বজগৎ বলতে কিছুই ছিল না। এই পৃথিবীর চারদিকে তখন নিঃসীম কালো ঘোর অন্ধকার ও অসীম জলরাশিতে পরিপূর্ণ ছিল। চারদিকে কেবল পানি আর পানি ছাড়া কোথাও আলো, ভূমি, প্রাণী বা গাছপালার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। এই অবস্থায় ‘তাতারা-রাবুগা’ (গারোদের সৃষ্টিকর্তার নাম) পৃথিবী সৃষ্টি করার কথা চিন্তা করলেন। তার এই তার সহকারী দেবতা ‘নস্তু-নপান্তুকে’ মনোনীত করলেন। ‘নন্তু-নপান্তু’ একজন স্ত্রী লোকের বেশে তার সহকর্মী ‘মাচি’র সহায়তায় পৃথিবী সৃষ্টির কাজে মনোনিবেশ করলেন।
এদের সৃষ্টিতত্ত্বের প্রাথমিক ধারণা লাভের পর সংস্কৃতিবান এই জাতির নৃত্য-নাট্যের পরিচয়ের দিকে অগ্রসর হওয়া যেতে পারে। গারো নৃ-গোষ্ঠীর রয়েছে সমৃদ্ধ পুরাণ বা মিথ এসব পুরাণ কথার বাঁকে বাঁকে প্রাত্যহিকতার নানান প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও গড়ে উঠেছে নানান উপকথা। মাতৃতান্ত্রিক গারো নৃ-গোষ্ঠীর সামাজিক জীবনে রয়েছে ‘মাহারী’ ও উত্তরাধিকার (নকনা) নির্বাচনের সুকঠিন নিয়ম। এছাড়া ‘ঈৎড়ংং ঈড়ঁংরহ গধৎৎরধমব ঝুংঃবস’-এর নিগড়ে পিষ্ট গারো নারী-পুরুষর প্রেম পরিণয়ের ভিত্তিতে সৃষ্ট বেশকিছু পালার সন্ধান মেলে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ওয়ানগাল্লা, চিরিং, ফদিনি, কান্দোদোলং প্রভৃতি। এর মধ্যে ওয়ানগাল্লা উৎসবের নানান পর্যায়ে বিচিত্র নামের মোট পঁয়তাল্লিশ থেকে ছাপ্পান্ন প্রকার নৃত্যের প্রচলন রয়েছে। তারমধ্যে ‘রে-রে’ এক প্রকার নৃত্য-নাট্য। এসব নৃত্যের অধিকাংশ ক্ষেত্রে সঙ্গীতের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। কোথাও কেবল আদিম অভিনয়। এতদ্ব্যতীত রয়েছে নাট্যিক সংলাপভিত্তিক নৃত্য-গীত ও অভিনয়। গারো নৃ-গোষ্ঠীর বিভিন্ন গোত্রের অন্যতম ‘দোয়াল’ এবং ‘ব্রাক’ গোত্রের মধ্যে প্রেম, বিরহ, মিলনভিত্তিক ‘রে-রে’ নৃত্য-গীত প্রচলিত। ওয়ানগাল্লায় সালজং, সোআৎসা, খ্রাং, রংদিকমিত্তে, নকনিমিত্তের পূজা সম্পন্ন হলে খামাল (কামাল) ও নকমার নৃত্যের পর প্রচুর মদ্যপান করে সব গারো পূজারী। (তবে গারোরা নেশাখোর মদ্যপ জাতি নয়। এরা নিছক নেশা করার জন্য মদ পান করে না। মদপান এদের দৈবশক্তি লাভের উপাচার। প্রচুর পরিমাণে মদ্যপান করার ফলে এক সময় তারা বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় আরম্ভ হয় রে-রে নৃত্য-গীত। রে-রে মূলত অবিবাহিত নারী-পুরুষের নৃত্য-গীত। বিবাহিত অল্পবয়স্করাও এতে অংশগ্রহণ করতে পারে। এর নৃত্য-গীতের মৌল উদ্দেশ্য গারো যুবক-যুবতীদের মধ্যে প্রণয় সংঘটন। রে-রে সংলাপভিত্তিক নৃত্য। তাৎক্ষণিকভাবে মুখে মুখে রচিত হয় সংলাপের ভাষা।
সংলাপগুলো ব্যক্তিনির্ভর এবং একই সঙ্গে ব্যক্তির সৃজন ক্ষমতা নির্ভর এবং একই সঙ্গে ব্যক্তির সৃজন ক্ষমতা নির্ভরও। এ নৃত্যে নারী-পুরুষ প্রথমে দুই ভিন্ন সারিতে দাঁড়ায়। যখন নাচ শুরু হয় দুটো সারি একত্রে মিলি।
এক সারিতে তারা এমনভাবে অবস্থান করে যাতে একজন নারীর পেছনে একজন পুরুষ অনায়াসেই দাঁড়াতে পারে। এতে নৃত্যরতরা জোড়ায় জোড়ায় আলাদা হওয়ার সুযোগ পায়। নৃত্যের পর্যায়ক্রমে কখনো বা তারা মুখোমুখি দাঁড়ায়। প্রতিদলে থাকে একজন করে মূল গায়ক। বাকিরা পালন করে দোহারের ভূমিকা। প্রথম পক্ষের মূল গায়েন বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে তালে নৃত্য সহকারে সঙ্গীতের মাধ্যমে তার প্রতিপক্ষকে প্রশ্ন করে। দোহারগণ ‘হারা-রা’ ধ্বনিতে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। একই প্রক্রিয়ায় অপরপক্ষের মূল গায়ন প্রথম পক্ষের প্রশ্নের উত্তর দেয়। এভাবেই পুরো একটি রে-রে নৃত্যগীত পরিবেশিত হয়। এতে বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কোনো মুদ্রার ব্যবহার নেই। যুবক-যুবতীরা কখনো দুই হাত কোমরের কাছে নিয়ে এসে কব্জি বাঁকিয়ে আনমিত অবস্থায় কোমরে ন্যস্ত করে এবং কোমর দোলায়। বাদ্যযন্ত্রের তালে চলে স্টেপিং। কখনো একহাত ভাঁজ করা অবস্থায় উপরে উঠে যায় প্রায় মাথার কাছাকাছি। অন্যহাত বেঁকে আসে বুকের কাছে। কখনো হাতগুলো পাখির ডানার মতো দুলতে থাকে। আবার কখনো নৃত্যরতরা দুই হাত কাঁধের ওপরে কান সমান উচ্চতায় রেখে নৃত্য করে। কখনো নৃত্যরত নারী-পুরুষ পরস্পরের দিকে মস্তক হেলিয়ে নৃত্য করে। মুখ চলে আসে মুখের কাছে। চোখ নিবন্ধ হয় চোখে। আর তখনই মন বিনিময়ের মাহেন্দ্রক্ষণ। মন দেওয়া-নেওয়ার পালা সংলাপের মাধ্যমে কি প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হয় তার নমুনা দেখা যাক।

No comments:

Post a Comment