Wednesday, June 7, 2017

সঞ্চয়পত্রকে নিয়মের গাটছড়ায় বাঁধতেই কি?

অর্থমন্ত্রী আরো বলেন, ‘চলতি অর্থবছরে ১৯ হাজার ৬১০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে এপ্রিল পর্যন্ত সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৪২ হাজার ৯৮ কোটি টাকা। এজন্য আগামী অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র এবং অন্যান্য ব্যাংকবহির্ভূত উৎস থেকে ৩২ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা সংগ্রহের আশা করছি।’
এ সম্পর্কে কথা বলছেন দেশের অর্থনীতিবিদরাও। তারা সঞ্চয়পত্রের সুদের হার না কমিয়ে সঞ্চয়পত্রব্যবস্থাকে একটি নিয়মের মধ্যে আনার পরামর্শ দিয়েছেন। তাদের মতে, সবার জন্য উন্মুক্ত না রেখে সঞ্চয়পত্র নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর জন্য রাখা উচিত। কিন্তু তা না করে কেবল সুদের হার কমানো হলে মধ্যবিত্ত এবং সীমিত আয়ের মানুষকে চাপের মুখে ফেলে দেওয়া হবে। অনেকেই সংসার চালাতে হিমশিম খাবে। কারণ, দেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠী, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী, গৃহবধূ এবং স্বল্প আয়ের মানুষের কথা ভেবেই সঞ্চয়পত্রের স্কিমগুলো চালু করা হয়েছিল। ব্যাংকে টাকা রাখলে খরচ বাড়বে, আবার সঞ্চয়পত্রে মুনাফা কমবে। এতে নিরাপদে টাকা রাখা মধ্যবিত্তের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে।
সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর ঘোষণায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরাও। তারা জানিয়েছে, দেশে ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগের কোনো প্রকল্প নেই। সারা জীবনের সঞ্চয় বিনিয়োগ করে নির্দিষ্ট পরিমাণের কিছু টাকা পাওয়া যায়, যা মূল্যস্ফীতি এবং কর বাদ দিলে সামান্য পরিমাণ অবশিষ্ট থাকে। এরপরও সরকার সঞ্চয়পত্র প্রকল্পে সুদের হার কমানোর সিদ্ধান্ত নিলে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী ক্ষতির মুখে পড়বে।
বর্তমানে ব্যাংকগুলোতে আমানতের সুদের হার ৪ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে। অন্যদিকে, বিভিন্ন সঞ্চয় প্রকল্পের সুদের হার ১১ থেকে ১২ শতাংশের মতো। বিক্রির লাগাম টেনে ধরতে ২০১৫ সালের ১০ মে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার গড়ে ২ শতাংশ করে কমিয়েছিল সরকার। দুই বছর পর আরেক দফা কমানো হচ্ছে।
অর্থমন্ত্রীর মতে, দেশে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার আসলেই বেশি। সাধারণত ব্যাংক আমানতের সুদের হারের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১-২ শতাংশ বেশি হয়ে থাকে। বর্তমানে এই ব্যবধান ৪ শতাংশের বেশি।
গত দুই বছর ধরে ব্যাংকে আমানতের সুদের হার কমায় সঞ্চয়পত্রে ঝোঁক বেড়েছিল মানুষের। বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার চলতি (২০১৬-১৭) অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে যে পরিমাণ অর্থ ধার করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল, ৯ মাসেই তার দ্বিগুণ সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। ব্যাংকঋণের সুদের হার নিম্নমুখী থাকায় সঞ্চয়পত্র বিক্রি আরো বাড়ছে। সেই কারণে সুদের ব্যবস্থাপনায় সরকারকে আরো বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে।
বাজেট বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মূলত আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বিশাল বাজেটের বড় অঙ্কের ঘাটতি মেটাতেই সরকার সঞ্চয়পত্রের মতো মানুষের ছোট ছোট আয়ের ওপর হাত দিয়েছে। বাজেটে মোট ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ শতাংশ। বিদায়ী অর্থবছরে ঘাটতি ছিল ৯৬ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা। আর এই বিশাল ঘাটতির অর্থ সংস্থানে অভ্যন্তরীণ ঋণ হিসেবে জাতীয় সঞ্চয়পত্র থেকে ৩০ হাজার ১৫০ কোটি টাকা গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিদায়ী অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ হিসেবে নেওয়া হয়েছিল ৪৫ হাজার কোটি টাকা।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ জানান, দেশে সামাজিক নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা নেই। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তার জন্য একটা ব্যবস্থা থাকা দরকার। সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে তা কিছুটা করা সম্ভব হচ্ছিল। সেখানেও তাদের সুবিধা কর্তন করা ঠিক হবে না। সামাজিক নিরাপত্তার স্বার্থে সঞ্চয়পত্রে যতদূর সম্ভব সুদেও হার বেশি থাকা দরকার। সেটা বর্তমান হারে বহাল থাকাই শ্রেয়। বিশেষ করে বয়স্ক মানুষ এবং কিছু সংখ্যক গৃহবধূর পক্ষে কোনো ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য করা সম্ভব নয়। তারা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকে নিরাপদ মনে করে। সুদের হার কমায় তাদের পক্ষে জীবনধারণ করা কঠিন হয়ে পড়বে।
তবে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদের মতে, সঞ্চয়পত্রে উচ্চ সুদের হার থাকায় সরকারের বোঝা বেড়েছে। এখানে সবার জন্য উন্মুক্ত রাখায় সমস্যা দেখা দিয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করছে। সঞ্চয়পত্রের একটা নিয়ম করে দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে সিনিয়র সিটিজেন, মহিলা এবং অবসরপ্রাপ্তদের জন্য উচ্চ সুদের হার রেখে বাকিটা কমিয়ে ফেলা যেতে পারে। কারণ, সরকার রাজস্ব আয়ের যে ১৭-১৮ শতাংশ সুদ পরিশোধে ব্যয় করছে, সেটাকে কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না।
নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জন্য সঞ্চয়পত্র হচ্ছে নিরাপদ বিনিয়োগ। যাদের ব্যবসা-বাণিজ্য করার সামর্থ্য নেই, আবার যেটুকু সঞ্চয়, সেই অর্থ কোথাও বিনিয়োগের মতো পরিস্থিতি নেই কিংবা ঝুঁকি নিতে চান না, এমন মানুষের শেষ ভরসা জাতীয় সঞ্চয় ব্যুরোর সঞ্চয়পত্র স্কিম। আর সেই সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এই হার কত হবে, তা নির্দিষ্ট না করলেও অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ব্যাংকঋণের সুদের তুলনায় সঞ্চয়পত্রের সুদের হার হবে ২ শতাংশ বেশি। বর্তমানে ব্যাংকগুলোতে আমানতের সুদের হার ৪ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে।
বাজেটের এমন প্রস্তাবে বিপাকে পড়েছে সাধারণ মানুষ এবং ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। এই প্রস্তাব কার্যকর হলে সামান্য সঞ্চয়ের শেষ সুযোগটুকুও হারাতে হবে তাদের। এ নিয়ে সমালোচনাও হচ্ছে সরকারের। বাজেটব্যবস্থায় সঞ্চয়ের এসব পথে এর আগে এমন শুল্ক আরোপ এবং সুদের হার কমানোর ঘটনা কখনোই ঘটেনি।
বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, আগামী অর্থবছরের বাজেটের ঘাটতি মেটাতে বরাবরের মতো ব্যাংকের ওপর ভরসা না করে এবার সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার কথা ভাবছে সরকার। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংকবহির্ভূত উৎস, বিশেষ করে সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে অর্থায়নের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে পারে। এতে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ গ্রহণ কিছুটা কমবে।

No comments:

Post a Comment