ভালোমন্দ
সংযমের মাসে অসংযমী বণিক

রোজা শুরুর আগেই আরেক দফা বেড়েছে ভোগ্যপণ্যের দাম। রোজার অন্যতম খাদ্যসামগ্রী চিনি, ছোলা, বেসন, বেগুন, লেবু, শসা ও খেজুরের চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দামও বেড়েছে বেসামালভাবে। মসলাজাতীয় পণ্য রসুনের দাম সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। বেড়েছে আদার দাম। তা ছাড়া ভোজ্য তেল, চাল, ডাল, আটাসহ অন্য সব ভোগ্যপণ্য বিক্রি হচ্ছে আগের চেয়ে বেশি দামে। সিটি করপোরেশনের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে বেশি মূল্যে বিক্রি হচ্ছে গরু ও খাসির মাংস। বেড়েছে বিভিন্ন জাতের মাছের দাম। সেই সঙ্গে যেন পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ইফতার আইটেমের দাম। চলে আসা ধারাবাহিকতায় দেখা যাচ্ছে, রোজার মাস মানেই বাড়তি বাণিজ্যের মাস।
মন্তব্য: আমাদের প্রিয় নবীজি হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘জনগণের জীবিকা সংকীর্ণ করে যে ব্যক্তি খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করে, সে অপরাধী। আর জেনে রাখো, সে গুনাহগার সাব্যস্ত হবে।’ (মুসলিম শরিফ, হাদিস : ১৬০৫)। অপর এক হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি আমদানি করবে, সে রিজিকপ্রাপ্ত হবে, আর যে ব্যক্তি গুদামজাত করবে, সে অভিশপ্ত হবে।’ আশ্চর্য লাগে বাংলাদেশ একটি মুসলিমপ্রধান দেশ! পৃথিবীর মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে রমজান মাস মানেই মূল্যছাড়ের মাস। রোজাদার মুসলমানদের যাতে কোনো প্রকার কষ্ট না হয়, সেজন্য সেসব দেশের ব্যবসায়ীরা রোজার সব খাদ্য উপকরণসহ ইফতার আইটেমে অবিশ্বাস্য মূল্য ছাড় দিয়ে থাকেন। একেই বলা হয় সংযম। যদিও বাঙালি বণিকরা রোজার মাসকে অধিক মুনাফা অর্জনের মাস হিসেবে রোজাদার মানুষের ওপর উচ্চ লাভের যমদূতকে চাপিয়ে দেন। ভাবতে অবাক লাগে এই দেশেই ধর্ম অবমাননা বা স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে তুখোড় আন্দোলনে নামেন ইসলামী দল, সংগঠনসহ ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। বুঝতে কষ্ট হয় মহিমান্বিত এই রমজানের ভাবার্থ সংযমকে মজুদদারি, মূল্যবৃদ্ধি এবং ভেজালের মাধ্যমে অবমাননা করা হলেও সবাই এ বিষয়ে নিশ্চুপ থাকেন। কিন্তু কেন? এ দেশে এটি কাম্য হতে পারে না। এ বিষয়ে সরকার, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ধর্ম মন্ত্রলায়, টিসিবি মিলে আগামী বছর রোজার আগেই কঠোর আইন, বাধ্যকরণ, শাস্তি নিশ্চিতকরণ, মজুদদারি বন্ধ করা, ভেজাল বন্ধ করা সর্বোপরি এ বিষয়ে ব্যাপক জনমত ও জনসচেতনতা সৃষ্টির পদক্ষেপ নেবেন-এটাই প্রত্যাশিত।
ব্যাংকে রাখলে টাকা পকেট হবে ফাঁকা: একজন ব্যাংকার হিসাব করে দেখেছেন যে, সরকারি ব্যাংকে কেউ এক লাখ টাকা তিন মাস মেয়াদে এফডিআর করলে উৎস কর ও আবগারি শুল্ক কেটে নেওয়ার পর গ্রাহক ফেরত পাবে ৯৯ হাজার ৯৫৬ টাকা।
জুলাই থেকে সরকার আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক বসাবে এমন খবরেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে আমানতে। এ ছাড়া আগামী অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের সুদের হারও কমানো হচ্ছে বলে বলেছেন অর্থমন্ত্রী। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে ব্যাংকের সামগ্রিক আমানতের প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ৬৩ শতাংশে নেমেছে; যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১৩ দশমিক ১২ শতাংশ। জুলাই থেকে ব্যাংকে স্থায়ী আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক বসানোর সরকারি সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আবগারি শুল্ক বসালে আমানতে ধস নামবে। একজন ব্যাংকার হিসাব করে দেখছেন যে, আবগারি শুল্ক বসানোর পর স্থায়ী আমানতে গ্রাহকের মুনাফা তো হবেই না, বরং আরো লোকসান হবে। যেমন এক লাখ টাকার ওপর থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আবগারি শুল্ক (এক্সাইজ ডিউটি) ধরা হচ্ছে এক হাজার টাকা। সরকারি ব্যাংকে কেউ এক লাখ টাকা তিন মাস মেয়াদে এফডিআর করলে মেয়াদ শেষে সাড়ে ৪ শতাংশ হারে (বেসরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রে সুদ ১ শতাংশের মতো বেশি) সুদ পাবেন ১ হাজার ১২৫ টাকা। উৎস কর হিসাবে এর ১৫ শতাংশ (১৬৯ টাকা) কেটে নেওয়া হবে। আর আবগারি শুল্ক হিসেবে কাটা যাবে ১ হাজার টাকা। অর্থাৎ মোট ১ হাজার ১৬৯ টাকা কেটে নেওয়া হবে। এতে তিন মাস পরে গ্রাহক ফেরত পাবে ৯৯ হাজার ৯৫৬ টাকা। অর্থাৎ তিন মাস টাকা খাটানোর পর লাভের পরিবর্তে নিজের আসল টাকা থেকেই কম পাবেন গ্রাহক।
মন্তব্য: মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা ছাড়া একে আর কী বলা যায়! এমনিতেই ব্যাংক ছাড়া মধ্যবিত্তের সামান্য সঞ্চয় বিনিয়োগের তেমন কোনো নিরাপদ ক্ষেত্র নেই। আমাদের সীমিত সঞ্চয় খাত হলো ব্যাংকে আমানত, সঞ্চয়পত্র আর পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ। এমনিতেই সঞ্চয়ের সুদহার দফায় দফায় কমানো হচ্ছে। এর ফলে ব্যাংকে আমানত অস্বাভাবিক হারে কমছে। সুদের হার কমায় আমানতকারীরা এখন আর ব্যাংকে টাকা রাখতে উৎসাহী হচ্ছেন না। মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর জন্য এটি দুঃসংবাদ। সরকারের বিষয়টি পুনর্বিবেচনায় নেওয়া উচিত। এসব পদ্ধতি উন্নত দেশের জন্য প্রযোজ্য-কারণ সেসব দেশে জনগণের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পুঁজিকে ব্যাংকে অলস পড়ে থাকতে দেওয়া হয় না। তবে তারা জনগণের পুঁজি বিনিয়োগের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। আমাদের দেশে ব্যাংকের টাকা ঋণখেলাপির নামে লুটপাট হয়। বেসরকারি ক্ষেত্রে আমানত বা বিনিয়োগে নিরাপদ, নির্ভরশীল কোনো ক্ষেত্র নেই। তাই সরকারের উচিত দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতার সঙ্গে সমন্বয় রেখে ধীরালয়ে বা পর্যায়ক্রমে আবগারির মতোন পদক্ষেপকে সহনীয় করে তোলা। অর্থনীতিবিদদের ধারণা, সরকার হয়তোবা চাইছেন আবগারি শুল্ক বসানো হলে ব্যাংকে টাকা রাখার চাইতে মানুষ ভোগে বেশি ব্যয় করবে। তাতে হয়তো ভোগব্যয় বাড়ার কারণে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। উন্নত দেশ কিংবা আমাদের দেশের উচ্চবিত্তের জন্য এই ধারণা সঠিক মনে হলেও সত্যিকার অর্থে এ দেশে মধ্যবিত্ত সমাজ কোণঠাসা হয়ে পড়বে। আমাদের সামাজিক ও অর্থনীতির চালিকাশক্তির মেরুদন্ড হচ্ছে মধ্যবিত্ত সমাজ। এখন সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, মধ্যবিত্ত সমাজকে বাঁচাবেন? নাকি! সামাজিক অর্থনীতির চাকাকে পেছন দিকে ঘুরাবেন?
বিদ্যুৎ ও সাক্ষরতায় উন্নতি: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মনিটরিং দ্য সিচুয়েশন অব ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস অব বাংলাদেশ-২০১৬ প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে দেশের ৮১ দশমিক ২ শতাংশ পরিবার বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ সুবিধার সম্প্রসারণ হলেও দেশের ১৩ শতাংশ মানুষ এখনো কেরোসিন বাতির ওপর নির্ভরশীল। সৌরশক্তির আলো জ্বলে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষের ঘরে। বেড়েছে বয়স্ক শিক্ষার হার। ১৫ বছর ও তদূর্ধ্ব জনসংখ্যার শিক্ষার হার ৭২ দশমিক ৩ শতাংশ। তবে সাত বছর ও তদূর্ধ্ব জনসংখ্যার মধ্যে শিক্ষার হার ৭১ শতাংশ। প্রতিবেদন মতে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ১৭ লাখ ৫০ হাজারে দাঁড়িয়েছে। ২ হাজার ১২টি নমুনা এলাকার ২ লাখ ২০ হাজার ৮৭২টি খানার তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের মোট প্রাক্কলিত জনসংখ্যা ১৬ কোটি ১৭ লাখ ৫০ হাজার। এর মধ্যে পুরুষ ৮ কোটি ১০ লাখ ও নারী ৮ কোটি ৭৫ হাজার। মোট জনসংখ্যার মধ্যে ৮৮ দশমিক ৪ শতাংশ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। মোট জনসংখ্যার মধ্যে ৩০ দশমিক ৮ শতাংশের বয়স ১৫ বছরের নিচে। বেড়েছে প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল ৭১ দশমিক ৬ বছর। এর মধ্যে পুরুষের তুলনায় নারীদের গড় আয়ু বেশি বেড়েছে।
মন্তব্য: খবরগুলো ভালো। সরকারি সব প্রচেষ্টার বাস্তব অবস্থার প্রতিফলন বটে। তবে যদিও সরকারের বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্র অনেক ঊর্ধ্বে, সেজন্য স্থায়ী বিদ্যুতায়নে সঞ্চালন লাইন ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অসততা, দুর্নীতি বন্ধ করা, প্রশিক্ষণ, অবৈধ বিদ্যুৎ লাইন কাটা, ভৌতিক বিল থেকে জনগণকে রেহাই দেওয়াসহ বিদ্যুৎ চুরি, অবচয় এবং পরিমিত ব্যবহারে ব্যাপক জনসচেতনতা ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। শিক্ষায় সাক্ষরতার হার বাড়লেও কর্মমুখী শিক্ষার বিস্তার লাভ না করায় যোগ্যতাভিত্তিক সবার জন্য কর্মসংস্থান নিশ্চিত হচ্ছে না। এ বিষয়ে সরকারের মনোযোগ দিতে হবে। শিক্ষার বিভিন্ন স্তরভিত্তিক কর্মসংস্থান নিশ্চিত হলে প্রকৃতঅর্থে শিক্ষার হারের সুফল পাবে দেশ। সেসঙ্গে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণ এবং ১৫-২৫ বছর বয়সী তরুণশক্তি প্রায় ৫০ ভাগকে দ্রুততম সময়ে কাজে লাগাতে হবে। পাশাপাশি আয়ু বৃদ্ধির ফলে বয়স্ক লোকের সংখ্যা যে ক্রমেই বাড়বে তাদের ভরণপোষণ নিরাপত্তার বিষয়টি আগে থেকে ভাবতে হবে। যাতে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ ৬০ বছর থেকে ৭০ বছরেও কম পরিশ্রমে উৎপাদনমুখী কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পারেন। তাহলেই সার্বিক উন্নয়নের চাকা গতিশীল হবে।
No comments:
Post a Comment