Wednesday, February 8, 2017

পরিত্যক্ত জাহাজঅবৈধ অস্ত্রের উৎস 

বঙ্গোপসাগর তীরে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে গড়ে উঠেছে জাহাজভাঙা শিল্প। সেখানকার পরিত্যক্ত জাহাজ থেকে সংগ্রহ করা হয় চাহিদামতো প্রয়োজনীয় লোহা। এসব লোহা থেকে তৈরি হয় হাতল ও ট্রিগার। সাগরপারে সহজেই মিলছে পাইপ, স্ক্রু, স্প্রিং ও ড্রিল মেশিন। আরো পাওয়া যায় লোহা কাটার ব্লেড, তার কাটার যন্ত্র ও স্ক্রু ড্রাইভার। অস্ত্র তৈরির এসব সরঞ্জাম সংগ্রহ করা হচ্ছে স্বল্পমূল্যে। এসব কাঁচামাল দিয়েই আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি করা সম্ভব। কক্সবাজারের মহেশখালীর পাহাড়ে ওই সরঞ্জাম দিয়েই তৈরি হচ্ছে অবৈধ অস্ত্র।
মহেশখালী থানায় দায়িত্ব পালন করেছিলেন পুলিশের এসআই রাজু আহমেদ; বর্তমানে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের পাঁচলাইশ থানার সেকেন্ড অফিসারের দায়িত্বে আছেন তিনি। অস্ত্রের কাঁচামালের উৎস সম্পর্কে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন রাজু আহমেদ।
তিনি বলেন, ‘মহেশখালী থানায় থাকাকালীন তদন্ত করতে গিয়ে জেনেছি, অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহার করা কাঁচামালগুলো সীতাকুন্ডের পরিত্যক্ত জাহাজ থেকে সংগ্রহ করা হয়। দাম কম হওয়ার কারণে সেখান থেকে অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম সংগ্রহ করা হয় সবচেয়ে বেশি। যার কারণে মহেশখালীর পাহাড়ে তৈরি হওয়া অস্ত্রের উৎপাদন খরচও অনেক কম হয়।’
সূত্র জানায়, ভৌগোলিক কারণে কক্সবাজারের মহেশখালীতে এখনো সচল রয়েছে বেশ কিছু অস্ত্র কারখানা। এই
এলাকায় রয়েছে অর্ধশতাধিক অস্ত্র কারিগর। অস্ত্রের অর্ডার পেলেই নিজস্ব কারখানায় অস্ত্র তৈরি করেন তারা। এছাড়া অর্ডার দিলে নির্দিষ্ট স্থানে অস্ত্র পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থাও রেখেছেন অস্ত্র ব্যবসায়ীরা। কয়েকটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এসব অস্ত্র পরবর্তীতে পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়ছে।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনা বলেন, ‘জাহাজভাঙা শিল্পের বিষয়গুলো তদারকি করে পরিবেশ অধিদফতর ও শিপ ব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশন। এমন কিছু বিষয় আছে, যেগুলো আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। এরপরও অপরাধ সংক্রান্ত হওয়ায় এ বিষয়ে খোঁজ-খবর নিতে আমি সীতাকুন্ড থানার ওসিকে নির্দেশ দেব।’
এদিকে বর্তমান সময়ে মাদক প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেভাবে সফলতা পাচ্ছে, সে তুলনায় অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও অস্ত্রধারীদের গ্রেফতারে সফলতা চোখে পড়ছে কম। চট্টগ্রামের রাজনৈতিক কর্মীদের হাতে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র চলে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। গত ৬ ফেব্রুয়ারি রাতে বাকলিয়া থানা এলাকায় প্রতিপক্ষের গুলিতে আহত হন নগর ছাত্রলীগের সদস্য তানজিরুল হক। এর আগেরদিন ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে পাঁচলাইশ থানা এলাকায় মো. জুয়েল নামের এক ব্যবসায়ী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এ দুই ঘটনায় জড়িতরা গতকাল বুধবার বিকেল পর্যন্ত গ্রেফতার হয়নি বলে জানিয়েছে পুলিশ।
চট্টগ্রামে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার যে বেড়েছে, তা পুলিশের হিসাবই বলে দিচ্ছে। চট্টগ্রাম নগর পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় ১৬০টি মামলায় ৩৭১ জন গ্রেফতার হয়েছেন; একই সময়ে ১০০টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়। ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় মামলা হয়েছে ১০১টি ও গ্রেফতার হয়েছেন ২৫১ জন; আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার ৯৩টি। ২০১৬ সালে চট্টগ্রাম নগরে উদ্ধার হয়েছে একটি রাইফেল, ১৮টি একনলা বন্দুক, চারটি ওয়ান শ্যুটার গান, ৪৪টি এলজি, ২০টি বিদেশি পিস্তল, দুটি দেশি পিস্তল, চারটি রিভলবার, একটি পাইপগান, তিনটি কাটা বন্দুক, একটি শটগান, একটি দুনলা বন্দুক ও একটি একে-২২ রাইফেল।
অভিযোগ রয়েছে, যে পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ অস্ত্র মজুদ আছে সন্ত্রাসীদের কাছে। এসব অস্ত্র ছিনতাই-চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে প্রতিনিয়ত ব্যবহার হচ্ছে।
সূত্র জানিয়েছে, বিদেশি অস্ত্রগুলোর কিছু অংশ ফেনী ও খাগড়াছড়ির সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে চট্টগ্রামে আসছে। এর বাইরে তিন পার্বত্য জেলার সন্ত্রাসী সংগঠন ও মায়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছ থেকেও অবৈধ অস্ত্র সংগ্রহ করে আসছে চট্টগ্রামের অবৈধ অস্ত্রধারীরা।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (জনসংযোগ) আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও অস্ত্র ব্যবসায়ীদের গ্রেফতারে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকজন অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী, বহনকারী এবং ব্যবহারকারীকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।’

No comments:

Post a Comment