Monday, February 27, 2017

এগিয়ে আসুন সমাজ উন্নয়নে

একটি সামাজিক উদ্যোগের গল্প দিয়েই শুরু করা যাক। ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার বিত্তিদেবী রাজনগর গ্রামের বাসিন্দা ইনসান আলী বাবু। তিনি একজন চেতনার মানুষ। জীবনের ২৫টি বছর কাটিয়েছেন কানাডায়। মা আমেনা খাতুনের শারীরিক অসুস্থতার কথা শুনে ২০০৬ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন। সেই বছর ২ ফেব্রুয়ারি ইন্তেকাল করেন তার মা। মায়ের মৃত্যুর ২৩ দিন পর বাবা আব্দুর রউফ মিয়াও মারা যান। বাবা-মায়ের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনায় গ্রামের মানুষকে ডেকে মিলাদ মাহফিল করতে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করেন, রাজনীতি আর সামাজিক কর্তৃত্বের ধূম্রজালে পুরো সমাজ বিভক্ত হয়ে পড়েছে। ভিন্নমতাবলম্বনের কারণে একে ডাকলে সে আসে না, তাকে ডাকলে অপরজন মনোক্ষুণ্ন। কী অদ্ভুত ব্যাপার! সমাজের এমন অসহযোগমূলক পরিস্থিতিতে ইনসান আলী সিদ্ধান্ত নেন নতুন কিছু করার। তার মাথায় চিন্তা আসে, যেভাবেই হোক সমাজের মানুষের মাঝে বিদ্যমান এই দ্বন্দ্ব-সংঘাত থামাতে হবে। অন্ধকারে নিবৃত এই সমাজের মানুষগুলোকে আলোর পথে নিয়ে আসতে হবে।
শুরু হয় সমাজ সংস্কারের নতুন সংগ্রাম। অনেক চেষ্টার পর ২০০৬ সালের ৪ মার্চ বাবা-মায়ের দোয়া মাহফিলটাই সামাজিক উদ্যোগের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করে। ইনসান আলী গ্রামের ঘরে ঘরে, হাট-বাজারে গিয়ে মানুষের সঙ্গে তার নতুন ভাবনার কথা তুলে ধরেন। বহুদলগত মতাদর্শে বিভক্ত মানুষদের একমত করতে যথেষ্ট কষ্ট হলেও অবশেষে সফলও হন তিনি। শেষতক ‘ভ্যালী ফিল্ড সমিতি’ নামে ২৩ সদস্যের কমিটি গঠিত হয়। এভাবেই শুরু হয় একটি সামাজিক উদ্যোগের জয়যাত্রা। শৈলকুপার কাঁচেরকোল ইউনিয়নের বিত্তিদেবী রাজনগর, ধর্মপাড়া এবং উত্তর মির্জাপুর তিনটি গ্রাম সমিতিভুক্ত হয়। ভ্যালী ফিল্ড সমিতির সদস্য হয়ে তারা অঙ্গীকার পালনে শপথ গ্রহণ করেন—গ্রামে কেউ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, আলোচনা বা বিতর্কে জড়িত হবেন না, অপ্রাপ্ত বয়সে ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেবেন না, কেউ কাউকে গালাগাল করবেন না, কোনো ধরনের নারী নির্যাতন করবেন না, যাদের অক্ষরজ্ঞান নেই তারা সাক্ষরতা অর্জন করবেন, ৫-৬ বছর বয়সী শিশুদের স্কুলে পাঠানো বাধ্যতামূলক, গ্রামের সব বাড়িতে স্যানিটারি ল্যাট্রিন বসাতে হবে, মহিলারা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হবেন, সর্বোপরি গ্রামের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সমবায়ভিত্তিক প্রকল্প গড়ে তুলে পারস্পরিক সহযোগিতায় কাজ করবেন। এভাবে সমিতির সদস্যরা গ্রামের বিভিন্ন সময়ে পারস্পরিক বিরোধে দায়ের করা ১৫-১৬টি মামলা তুলে নেন। এলাকার প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলনেতারা শপথ নিলেন দলবাজি না করে সামাজিক উন্নয়নে এক হয়ে কাজ করার। সপ্তাহে ১০ টাকা করে সঞ্চয় নিয়ে গঠিত হয় তহবিল। বিনা শর্তে গ্রামের মানুষ ১০ বিঘা জমি সমিতিকে দান করে চাষাবাদের জন্য। সমিতির সদস্যদের ১৫টি দলে ভাগ করে দেওয়া হয়। আছে নারীদেরও পৃথক দল। সমিতির সদস্যদের সপ্তাহে দুই দিন বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করতে হয়। এই সমিতির সদস্যরা গড়ে তুলেছেন ‘ভ্যালী ফিল্ড ওয়েলফেয়ার ফান্ড’। সমিতির আয় থেকে শতকরা ১০ ভাগ জমা হচ্ছে এই কল্যাণ তহবিলে। এভাবেই স্বপ্রণোদিত হয়ে চলেছে তাদের উন্নয়ন কার্যক্রম। এরপর আর কোনো উদাহরণের প্রয়োজন হবে না আশা করছি।
এই হলো সামাজিক উদ্যোগ। এ কারণেই সামাজিক উদ্যোগ হলো রাষ্ট্রের উন্নয়নের হাতিয়ার। সামাজিক উদ্যোগের সবচেয়ে বড় প্রতিফলন হচ্ছে—এর মাধ্যমে সমাজের মানুষ নিজেরা নিজেদের উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হয়। সমাজের মধ্য থেকে উদ্যোগের মাধ্যমে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করা এবং উন্নয়নে প্রতিপক্ষের বাধাকে মোকাবিলা করা সহজতর হয়। সামাজিক জাগরণের মাধ্যমে মালিকানা বোধ সৃষ্টি হয়। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জনগণের স্বার্থ সংরক্ষিত হয় এবং এই তাড়না জনগণকে সরব করে তোলে। সমাজে নারী ও পুরুষের সমঅধিকার এবং সমসুযোগ সৃষ্টি হয়। উদ্যোক্তাদের সমন্বিত ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ ঘটে। একসময় দেশ ও সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সামাজিক উদ্যোগ কার্যকর ভূমিকা রাখত। তখন সেসব উদ্যোগের মূল্যায়ন করা হতো। কিন্তু সত্তর থেকে আশির দশকে এনজিওগুলোর উন্নয়নধারার সূত্রপাত ঘটায় সামাজিক উদ্যোগকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। ফলে সামাজিক উদ্যোগের প্রবাহ ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। দেশ, সমাজ এবং মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা সত্ত্বেও সামাজিক উদ্যোক্তারা রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কৃতি এবং দৃষ্টিভঙ্গির কারণে পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, সামাজিক উদ্যোগই সভ্যতার দিকে পৃথিবীকে এগিয়ে নেওয়ার প্রথম ধাপ। সমাজের মানুষের বিভিন্ন উদ্যোগই মানুষকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। সংগঠিত মানুষের বহুমুখী চিন্ত-চর্চা-চেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি, শিক্ষা, অভিজ্ঞতা, উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং কর্মতৎপরতা সমন্বয়ের স্রোতে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটায়। এর ফলে সামাজিক রীতি-নীতি, আচার-আচরণ, সর্বোপরি সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে সমাজ ক্রমেই সামনের দিকে এগিয়ে যায়। এই সামগ্রিক সামাজিক অগ্রসরতার নাম হলো উন্নয়ন। সামাজিক উদ্যোগ বিভিন্ন কারণে গুরুত্বপূর্ণ; যেমন সমাজের মানুষকে সচেতন করে তোলা, মানুষের নেতিবাচক ও সনাতনী ধ্যান-ধারণা দূরীকরণ, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির জাগরণ সৃষ্টি, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধকরণ, বহুদল-মত ও চিন্তাশীল মানুষের মধ্যে ঐকমত্য সৃষ্টির মাধ্যমে একসঙ্গে মিলেমিশে কাজ করার মানসিকতা সৃষ্টি, নিজেদের মধ্যকার মতপার্থক্য কমিয়ে আনা, স্থানীয়ভাবে সম্পদ সংগ্রহ ও সম্পদের উপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় ও পুঁজি সমন্বয়করণ, সমন্বিত পুঁজি লাভজনক ও উপযোগী খাতে বিনিয়োগকরণ, বিনিয়োগ খাত সম্প্রসারণের মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র সৃষ্টি। এসব কার্যক্রমে সামাজিক সাংগঠনিক উদ্যোগ ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশে এনজিওগুলোর সঞ্চয় সংগ্রহ এক ধরনের সামাজিক পুঁজির প্রচেষ্টা। দরিদ্র পরিবারগুলোতে সাপ্তাহিক সামান্য সঞ্চয় গড়ে তুলছে বিশাল পুঁজিভাণ্ডার। অপরদিকে, মানুষের মাঝে সৃষ্টি হচ্ছে সঞ্চয়কামী মানসিকতা। সামাজিক উদ্যোগের ক্ষেত্রে পথিকৃৎ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে : রাজা রামমোহন রায়—তৎকালীন হিন্দু সমাজের কুপ্রথা ‘সতীদাহ’র বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি করেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর—শিক্ষা বিস্তার ও নারী শিক্ষার বিকাশে সেই সময় ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর—অর্জিত নোবেল পুরস্কারের অর্থ দিয়ে কৃষকদের জন্য সমবায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। হাজী মুহাম্মদ মুহসীন—মুসলমানদের শিক্ষার উন্নয়নের জন্য সমুদয় সম্পত্তি দান করে একটি ফান্ড গঠন করেন। এ রকম সামাজিক উদ্যোক্তার অভাব নেই বাংলাদেশে। অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ আলোকিত মানুষ গড়ার জন্য ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার পরিচালনা করছেন। আমাদের প্রয়াত জনপ্রিয় লেখক হূমায়ুন আহমেদ নিজ অর্থায়নে স্কুল পরিচালনা করেছেন। এমন উদাহরণ অসংখ্য দেওয়া যাবে।
এবার আসা যাক অন্য কথায়। একটি সমাজে নানা পথ, নানা মত, নানা চিন্তার, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ বসবাস করে, যারা কোনো না কোনোভাবে সমাজের উন্নয়নে অবদান রাখে। এ কারণে সামাজিক উন্নয়নে ব্যক্তির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে একক প্রচেষ্টা অনেক সময় সমাজে তেমন ভূমিকা রাখতে পারে না। সমাজের ভেতর থেকে সংগঠিত হয়ে সমবেত প্রচেষ্টায় অনেক অসাধ্য সাধন সম্ভব হয়। বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি উদ্যোগ, চিন্তা এবং চেষ্টাগুলো সমন্বিত হলেই তা পরিণত হয় সামাজিক উদ্যোগে। আবার ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং সামাজিক অবক্ষয় প্রতিরোধে সম্মিলিত সামাজিক প্রচেষ্টা ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়। একে বলা হয় সামাজিক আন্দোলন। যেমন বাল্যবিবাহ, যৌতুক প্রথা, ঘুষ-দুর্নীতি, বিশৃঙ্খলা, অনাচার ঠেকাতে সামাজিক আন্দোলন জোরদার হয়ে থাকে। সমাজবদ্ধ মানুষেরা নিজেদের প্রয়োজনে একত্রিত হয়ে সমাধানের পথ খোঁজে। সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে সক্ষমও হয়। দেখা গেছে, সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সামাজিক স্বেচ্ছাশ্রম প্রদানকারী মানুষেরাই পালন করতে পেরেছেন উদ্যোগী ভূমিকা। একই সূত্রে সমাজের বিচ্ছিন্নভাবে থাকা ব্যক্তি উদ্যোগ সৃষ্টি করতে পারে বৃহত্তর গণজাগরণ। এই গণজাগরণের স্রোতে উঠে আসে সমাজের ঝিমিয়ে পড়া, হতাশাগ্রস্ত অসহায় মানুষেরা; যেখানে কারো পুঁজি আছে, কিন্তু সাহস নেই; কেউ উদ্যোগী, কিন্তু তার পুঁজিসংকট; কারো অভিজ্ঞতা নেই; কারো আছে বুদ্ধি-বিচক্ষণতার দুর্বলতা। এ রকম বহুবিধ না, হবে না, অসম্ভব ইত্যাকার নেতিবাচক ক্রিয়ার শিকলে বাঁধা সমাজের মানুষ। অথচ এই হ্যাঁ-না এবং পারা-না পারার মানুষগুলো এক হলেই পাল্টে যায় দৃশ্যপট, খুলে যায় সম্ভাবনার দুয়ার।
লেখক: এস এম মুকুল; অর্থনীতি বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক।

No comments:

Post a Comment