Thursday, February 9, 2017

ভোটাধিকারের স্বাধীনতা চায় ইইউ

আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ অনেকাংশে নির্ভর করবে আগামীতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ওপর। তাই সাহসী, প্রজ্ঞাবান, দলনিরপেক্ষ, বিবেকবান, পরিশ্রমী ও সমযোগ্য ব্যক্তিদের দিয়ে ইসি গঠন করার মত দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘বোর্ড অব ইলেকশনস’ সব ভোট প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। এরা কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনের একটি সংস্থা। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছরই কোনো না কোনো নির্বাচন হয়। নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে কোনো ঢাকঢোল থাকে না। অনেক মানুষ খোঁজও রাখে না নির্বাচন হচ্ছে কি না। বিশ্বের কোনো সভ্য দেশেই নির্বাচন কমিশন নিয়ে কোনো আপত্তি-অনাপত্তি, টানাটানি নেই। যা বাংলাদেশে আছে। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন নিয়ে আলোচনা সবসময়েই হয়। দেশের মানুষ তো বটেই রাজনীতিকদের কেউ কেউ মনে করেন, নির্বাচন কমিশন সরকারের আজ্ঞাবহ হবে কিংবা থাকবে। বিদেশেরও নজর থাকে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের ওপর।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে যাওয়া ইউরোপীয় পার্লামেন্টের বাণিজ্য প্রতিনিধি দলের প্রধান বারন্ড লাঙ্গা বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী ও সক্ষম নির্বাচন কমিশন গঠনের আহ্বান জানিয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন, এমন নির্বাচন কমিশন প্রয়োজন, যার ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা থাকবে। সরকারি অতিথি ভবন পদ্মায় প্রতিনিধি দলটি প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমামের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছেন বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের বাণিজ্য প্রতিনিধি দলের প্রধান বারন্ড লাঙ্গা বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল রয়েছে। আমরা মনে করি, পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে গঠিত হওয়া উচিত। আমরা বিভিন্ন জায়গা থেকে আশ্বস্ত হয়েছি, নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠুভাবে গঠন করা হবে। তবে নির্বাচন কমিশনে দক্ষ ও যোগ্য লোকদের দেখবো বলে আশা করছি।
বারন্ড লাঙ্গা বলেছেন, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের স্পিকারের সঙ্গেও আমরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছি। মধ্যম আয়ের দেশে উপনীত হওয়ার পর বাংলাদেশকে ইইউ বাজারে সুবিধা নিতে জিএসপি প্লাসের আওতায় যেতে হবে। তবে এজন্য গণতান্ত্রিক অবস্থা, পরিবেশের মান এবং লেবার স্ট্যান্ডার্ড থাকতে হবে। প্রতিনিধি দলের সদস্য জিন ল্যামবারট বলেছেন, এবারের সফরের মূল ফোকাস ছিল বাণিজ্য। বেশিরভাগ সময়ে এটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অল্প সময় রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ঢাকায় নিযুক্ত ইইউ রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদোন বলেছেন, বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকায় এ সময়টাকে অনেক দূরে বলে মনে হয়। প্রকৃতপক্ষে এটা খুব বেশি দূরে নয়। গণতন্ত্র, সুশাসন ও মানবাধিকার সংক্রান্ত উপকমিটির বৈঠকে এটি এক নম্বর এজেন্ডা।
শিশু অধিকার, প্রতিবন্ধীদের অধিকার সুরক্ষা এবং নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য রোধ করার পাশাপাশি নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সমুন্নত রাখারও আহ্বান জানায় ইইউ। শ্রমিক সংগঠন এবং শ্রমিকনেতাদের বিরুদ্ধে সহিংস আচরণ এবং হেনস্তার বিষয়েও ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানায় ইইউ। বিএনপির নির্বাচনী প্রস্তাবনাকে সাম্প্রতিককালে ক্ষমতাসীন দল যেভাবে মূল্যায়ন করছে সেভাবে দেখতে চাই। প্রধানমন্ত্রী গত কয়েক সপ্তাহ আগে বলেছেন, তিনি আর বিতর্কিত নির্বাচন দেখতে চান না। এরপর ক্ষমতাসীন দলের নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদকও বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের নিয়োগ হবে সংবিধানের নিয়ম অনুসারে। খালেদা জিয়ার বক্তব্যকে এই আলোকেই দেখতে চাই। আমরা যদি সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করতে চাই, তাহলে নির্বাচন কমিশনকে সঠিকভাবে পুনর্গঠন করতে হবে। অর্থাৎ, সৎ, যোগ্য, সাহসী ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়েই নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। তা হলেই আমরা একটি গ্রহণযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আশা করতে পারি। পিয়েরে মায়াদোন আরও জানান, নভেম্বরে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করবে। ওই প্রতিনিধি দল মূলত বাংলাদেশ-ইইউ বাণিজ্য সম্পর্ক বিষয়ে আলোচনা করবে।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৮(৪), অনুচ্ছেদ ১২৬ এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর অনুচ্ছেদ ৪-এ নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা এবং দায়িত্ব বর্ণিত হয়েছে। সংবিধানের এ অনুচ্ছেদ বলে নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবে এবং কেবল সংবিধান ও আইনের অধীন হবে। নির্বাচন কমিশনের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে প্রয়োজনে কমিশনের সভাপতিকে বা এর যেকোনো সদস্যকে বা এর কোনো কর্মচারীকে আইনের অধীনে থেকে কমিশনের পক্ষে ক্ষমতা অনুশীলনের অনুমতি প্রদান করতে পারবে। অনুচ্ছেদ ১২৬ এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর অনুচ্ছেদ ৪ ও ৫-এর ধারা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য। নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনের জন্য যেরূপ কর্মচারী প্রয়োজন হবে, নির্বাচনের কাজে সহায়তার লক্ষ্যে সেরূপ কর্মচারী নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। নির্বাচন কমিশনের নিয়োগ সংবিধানের আলোকেই দিতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদ অনুসারে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য এখনো কোনো আইন না হওয়া দুঃখজনক। সংবিধানের ওই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগদান করিবেন।’ আমাদের যদি সংবিধান মেনে চলতে হয়, তাহলে একটি নির্বাচনী আইন করা জরুরি। আমাদের আশপাশে সব দেশেই (কেবল ভারত ছাড়া) নির্বাচন কমিশন আইন রয়েছে। তাই আমাদের দেশেও এই আইন করা অত্যন্ত জরুরি। এই আইনে মোটা দাগে তিনটি বিধান থাকা দরকার। প্রথম বিধান, নির্বাচন কমিশনারদের ও প্রধান নির্বাচন কমিশনারের যোগ্যতা সম্পর্কে। অর্থাৎ, এই বিধানের মাধ্যমে তাদের যোগ্যতাসংক্রান্ত বিষয়গুলোকে যুক্ত করা যেতে পারে। দ্বিতীয় বিধান, অনুসন্ধান কমিটি গঠনসংক্রান্ত। কাদের নিয়ে অনুসন্ধান কমিটি হবে, কীভাবে নিয়োগ দেওয়া হবে ইত্যাদি সংক্রান্ত নিয়মাবলি এখানে অন্তর্ভুক্ত থাকবে। তৃতীয়ত, কীভাবে এই অনুুসন্ধান কমিটি তার কাজ পরিচালনা করবে। কীভাবে তাদের নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দেওয়া হবে ইত্যাদি পদ্ধতিটা সুস্পষ্ট করা। এই সুস্পষ্টতার ফলে কমিশন নিয়োগ প্রক্রিয়া এবং পদ্ধতিটা স্বচ্ছ এবং অংশগ্রহণমূলক হবে
বাংলাদেশের ইতিহাসের বাস্তবতার সঙ্গে সংবিধান আমদের মিলিয়ে দেখা খুবই দরকার। আবার একটু ফিরে আসি যুক্তরাষ্ট্র প্রসঙ্গে। শুধু তুলনামূলক আলোচনার জন্যই এ বিষয়টি আমাদের বিবেচনায় রাখা দরকার। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ক্ষেত্রে কংগ্রেস এবং সাধারণ জনগণের রায়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার প্রয়াসের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রতিষ্ঠাতা পিতারা ইলেকটোরাল পদ্ধতিকে সংবিধানে অঙ্গীভূত করেছিলেন আজ থেকে প্রায় দু’শ’ বছর আগে। ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতি আসলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে একজনকে বেছে নেওয়ার জন্য ‘ইলেকটর’ বা নির্বাচক মনোনয়নের একটি প্রক্রিয়া। ইলেকটর নামে অভিহিত এ মনোনীত নির্বাচকরাই মূলত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট বেছে নিতে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে থাকেন। আর সমগ্র প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয় মার্কিন আইন পরিষদ কংগ্রেসে। ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতিতে যুক্তরাষ্ট্রে মোট নির্বাচক বা ইলেকটরের সংখ্যা ৫৩৮ জন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে একজন প্রার্থীকে কমপক্ষে ২৭০টি ইলেকটোরাল ভোট নিশ্চিত করতে হবে। কংগ্রেসে কোনো রাজ্যের তরফে থাকা প্রতিনিধির অনুপাতে নির্ধারিত হয় ওই রাজ্যের মোট ইলেকটরের সংখ্যা। মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ বা হাউস অব রি-প্রেজেন্টেটিভে কোনো রাজ্যের প্রেরিত প্রত্যেক প্রতিনিধির বিপরীতে একজন করে ইলেকটর মনোনীত হন। এছাড়া প্রত্যেক সিনেট সদস্যের বিপরীতেও একজন করে ইলেকটর মনোনীত হয়ে থাকেন। অবশ্য মার্কিন সিনেটে প্রত্যেক রাজ্যের জন্য দুটি সিনেট সদস্য পদ সংরক্ষিত থাকে। এক্ষেত্রে জনসংখ্যা ও আয়তন বিবেচনায় নেওয়া হয় না। তবে মার্কিন সংবিধানের ২৩তম সংশোধনী অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি রাজ্য ছাড়াও ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ার জন্য তিনজন অতিরিক্ত ইলেকটর বা নির্বাচকের সুযোগ রাখা হয়েছে। আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ অনেকাংশে নির্ভর করবে আগামীতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ওপর। তাই সাহসী, প্রজ্ঞাবান, দলনিরপেক্ষ, বিবেকবান, পরিশ্রমী ও সমযোগ্য ব্যক্তিদের দিয়ে ইসি গঠন করার মত দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
দেশের স্বার্থে নির্বাচন কমিশনের ওপর সংবিধান যে দায়িত্ব দিয়েছে, এই দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করার জন্য এমন ধরনের যোগ্য ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা দরকার। অনুসন্ধান কমিটি নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যে মতবিনিময় করেছেন, এটা খুবই শুভ পদক্ষেপ। এটা ভবিষ্যতে চালু রাখা উচিত বলে বিশিষ্ট নাগরিকরা মনে করেন। ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতির স্বার্থে এজন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়াকেও একটি রাজ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রত্যেক প্রার্থী নিজের অথবা তার দলের পছন্দ অনুযায়ী ইলেকটরের মনোনয়ন দিতে পারবেন। বাংলাদেশে বর্তমানে জেলা পরিষদ নির্বাচন যে প্রক্রিয়ায় হচ্ছে, তা নতুন করে মানুষকে ভাবতে শেখাবে নিঃসন্দেহে। ১৯৯৪ সালের মাগুরা-২ আসনের উপনির্বাচনের মতো ঘটনাও তো বাংলাদেশে ঘটেছিল। আমরা যা দেখছি, তা হলো বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনে ছিলেন এমন ব্যক্তি এখন অবসরে গিয়ে এ কমিশনেরই সূক্ষ্ম সমালোচনা করছেন। অথচ তারা যখন কমিশনার ছিলেন, তখন ইনিয়ে-বিনিয়ে এ কমিশনের পক্ষেই সাফাই গেয়েছেন সব সময়। বাংলাদেশে এখন যে গণতন্ত্র চলছে, তাতে ক্ষমতাসীনরা খুব বুঝে শুনেই পা ফেলছেন এবং ফেলবেন। কারণ তারা তাদের গন্তব্য জানেন।
লেখক: রায়হান আহমেদ তপাদার; কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য প্রবাসী।

No comments:

Post a Comment