কে বেশি বিপাকে, ট্রাম্প না মুসলমান

গত ১৪ দিনে আমেরিকা যে পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে তার জন্য দায়ী নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি একের পর এক নির্বাহী আদেশ জারি করছেন আর পড়ছেন জনবিক্ষোভের মুখে। আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডনরা যেভাবে হুমকি দেন, ঠিক সেই কায়দাটাই ট্রাম্পের চরিত্রে দেখা যাচ্ছে। যারা ভেবেছিলেন, শপথ গ্রহণের পর তিনি প্রেসিডেন্সির ঐতিহ্যের অনুবর্তী হবেন, সেই আশার গুড়ে বালি ছিটিয়ে দিয়ে আমেরিকান প্রেসিডেন্সির ঐতিহ্য তিনি গুঁড়িয়ে চলেছেন। ‘মহান আমেরিকা’ সৃজনের যে অঙ্গীকারের বাণী তিনি শুনিয়েছিলেন নির্বাচনী প্রচারণায় সে দিকেই তিনি রওনা দিয়েছেন। তিনি যা বিশ্বাস করেন সেই বর্ণবাদিতাই ছড়াচ্ছেন তার নির্বাহী আদেশে। সেই অঙ্গীকার পূরণে যদি দেশের রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক বা আন্তর্জাতিক-জোটগত ক্ষতিও হয়, তা পাত্তা দেওয়ার পাত্র নন তিনি। এ-পর্যন্ত নিজের আচরণে সেই প্রমাণ দিয়েছেন তিনি। আগামী দিনগুলোতে তা আরও জোরদার হবে বলেই আশঙ্কা করছে সাধারণ মানুষ।
একজন মার্কিন মনোবিজ্ঞানী বলেছেন, ট্রাম্পের কথাবার্তা অসংলগ্ন এবং তিনি যে মানসিকভাবে ভারসাম্যপূর্ণ নন, তা প্রমাণ করে চলেছেন। তিনি প্রেসিডেন্সির যোগ্য নন। কিন্তু আমরা দেখছি, মনোবিজ্ঞানীর সেই মতকে কেউ পাত্তা দিচ্ছে না। সিনেটে একের পর এক পাস করে আসছে ট্রাম্পের মনোনীত [মন্ত্রীরা] সচিবরা। সাতটি মুসলিমপ্রধান দেশের মানুষদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ওপর ১২০ দিনের যে নিষেধাজ্ঞার নির্বাহী আদেশ জারি করেছেন ট্রাম্প সে ব্যাপারে দেশজুড়ে সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ জানালেও কংগ্রেসে তার কোনো ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নেই বললেই চলে। আমেরিকার ঐতিহ্য হচ্ছে, বহু ধর্ম-বর্ণ আর সংস্কৃতির এক মিলিত সমাজব্যবস্থায় অভিষিক্ত এ-দেশ। অভিবাসী মানুষরাই এ-দেশটিকে গড়ে তুলেছে তাদের মেধা আর শ্রম-ঘামের বিনিময়ে। সেই সাম্যময়তা, সেই মানবিক ও সাংবিধানিক ঐতিহ্যকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর ফলে এখন আমেরিকার মুসলমানরা হয়ে পড়েছে অভিশপ্তপ্রায় এবং তারা নানা রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে হচ্ছে আতঙ্কগ্রস্ত। তিন মিলিয়ন বা ৩০ লাখ আমেরিকান মুসলমান ট্রাম্পের চরম বিদ্বেষী নীতির ফলে সমাজ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার শঙ্কা নিয়ে দিন কাটাচ্ছে। আর এটা সুস্পষ্ট যে, ট্রাম্প প্রশাসন মুসলমানদের ট্রার্গেট করেছে। ট্রাম্প নির্বাচনের আগে বলেছিলেন, ইসলাম ও মুসলিমদের এ-দেশে আসা নিষিদ্ধ করবেন। এখন সেটাই করে চলেছেন তিনি। যে সাতটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ—ইরান, ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন, সোমালিয়া, লিবিয়া, সুদানকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেসব দেশের খ্রিষ্টান ও সংখ্যালঘু অভিবাসীদের সাদরে বরণ করার কথাও ওই নির্বাহী আদেশে বলা হয়েছে। এ-থেকে ট্রাম্পের আসল ধর্মান্ধবাদী মনোভাব বেরিয়ে এসেছে। ট্রাম্প মানুষকে নয়, নিষিদ্ধ করেছেন মুসলমানদের। তার মূল টার্গেট যে ইসলাম ও মুসলমান, সেটা এখন আর ঢেকে রাখার বিষয় নয়। একটি সূত্রের বরাত দিয়ে রয়টার্স জানিয়েছে, বর্তমানের ‘কাউন্টারিং ভায়োলেন্ট এক্সট্রিমিজম’ [সিভিই] কর্মসূচির নাম পরিবর্তন করে ‘কাউন্টারিং ইসলামিক এক্সট্রিমিজম বা কাউন্টারিং রেডিক্যাল ইসলামিক এক্সট্রিমিজম’ রাখতে যাচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন। এই যদি ট্রাম্প প্রশাসনের ‘রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভিশন’ হয় তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের আইনের আওতার বাইরে চলে যাবে সে-দেশের শ্বেতাঙ্গ গোষ্ঠীবদ্ধ বন্দুকধারী সন্ত্রাসীরা। তারা আর চরমপন্থি বলে বিবেচিত হবে না। তখন লক্ষ্য একটাই, তাহলো ইসলামী রেডিক্যাল এক্সট্রিমিস্ট। সেটা প্রমাণের দরকারও পড়বে না ট্রাম্প প্রশাসনের। স্টিভ ব্যাননের মতো কট্টরপন্থী মানুষরা যখন ট্রাম্পের চারপাশে আছেন তখন তারাই জোগান দেবেন সব অন্ধ ক্রুদ্ধ বিষয়-আশয়। ইসলাম ও মুসলমানদের এক কোনায় ঠেসে ধরা মানে কিন্তু একই সঙ্গে খ্রিষ্টান বিশ্বও এক কোণে অবস্থান নেওয়া। অর্থাৎ, পরস্পরবিরোধী শিবির দুই মানসিক প্রান্তে গিয়ে দাঁড়ানো। মানবতার ইতিহাসের জন্য এটা খুবই ন্যক্কারজনক ঘটনা।
দুনিয়ার প্রজ্ঞাবানরা কি হারিয়ে ফেলবে তাদের সাংস্কৃতিক সহাবস্থানের হাজার হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের পরম্পরা? ১৪৯২ সালের আগে আমেরিকা ছিল কি ছিল না, তাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ট্র্যাডিশন ছিল কি ছিল না, তা জানে না আজকের আমেরিকানরা। তারা জানে না যে, ১৪৯২ সালে কলম্বাস এ-দেশে আসার আগেই স্পেনের মুসলিম নাবিকদের কাছে দেশটি অচেনা বা অজানা ছিল না। খলিফা আবদুল্লাহ ইবনে মুহম্মদের [৮৭১- ৯৫৭] আমলে স্পেনের মুসলমান কিছু নাবিক আমেরিকায় এসেছিলেন। সেই তথ্য আছে ‘দ্য মেডোজ অব গোল্ড অ্যান্ড কোয়ারিজ অব জুয়েলস’ বইয়ে। এই বইয়ের লেখক আল মাসুদি। কলম্বাসের মাত্র ৫০০ বছর আগে মুসলিম নাবিকরা এই দেশ আবিষ্কার করলেও উপনিবেশ স্থাপনের মন-মানসিকতা তারা লালন করেননি। তারা ডঙ্কা বাজিয়ে বলেননি যে, তারা বহুকাল আগেই এইখানে পা রেখেছিলেন। তারা বাণিজ্য করেছেন এখানকার স্থানীয়দের সঙ্গে এবং অনেক জায়গার নামের সঙ্গে আরবীয় নামের উৎসও রয়ে গেছে। এই ইতিহাস খুঁড়ে দেখা উচিত।
আজ মার্কিনি নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়ে মুসলমানদের চেতনার দরজা খুলে যাচ্ছে। কারণ চাপে না পড়লে সাধু সময়ে কোনো সত্য প্রকাশ হয় না। আজ দেখছি মার্কিন প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা পদক্ষেপের অনুবর্তী হয়েছে কুয়েত নামে একটি ক্ষুদ্র মুসলিম দেশ। তারা কোন স্বার্থে মুসলিমবিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ আজ? সে কি তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে? তারা যে জনগণ-বিচ্ছিন্ন রাজাদের মতো, যেমনটা জাজিরাতুল আরবে দখলিস্বত্ব নিয়ে বসে আছে সৌদরা? দেশের নামটি পর্যন্ত ব্রিটিশ ও আমেরিকানদের ওই পুতুল সৌদরা নিজেদের নামে করে নিয়েছে। বাদশাহী কায়েম করেছে ব্রিটিশ আর আমেরিকাকে তেল শোষণের সুযোগ দিয়ে। যে আল কায়েদা বিশ্বের এক নম্বর সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত ও চিত্রিত, সেই সৌদি ব্যবসায়ী পরিবারের ওসামা বিন লাদেন ও তার দেশকে নিষিদ্ধ করেনি আমেরিকা। কারণ দেশটি আমেরিকার এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। যুবরাজ তালাল প্রকাশ্যে বলেছে, আইসিস তাদের সৃষ্টি। তাদের সৃষ্টি মানে হচ্ছে এর পেছনে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল। আইসিসপ্রধান মোসাদের একজন, নাম ও ভোল পাল্টিয়ে চালাচ্ছে সিরিয়া-ধ্বংসের যুদ্ধ। কারণ ওয়াহাবি সৌদরা শিয়া অধ্যুষিত সিরিয়ার আসাদবিরোধী হবেই, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বিশ্ব রাজনীতির মৌলিক স্রোতধারা বুঝতে হলে ধর্ম ও তার নানা শাখা-প্রশাখা এবং তাদের স্বার্থ ও ক্ষমতায়ন ইত্যাদি মনে রাখলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। ট্রাম্পের রাজনৈতিক বিচার-বোধ তার খ্রিষ্টীয় চেতনাজাত। হিটলারি বুদ্ধি তাকে প্রণোদনা দিচ্ছে। তার পূর্বপুরুষ জার্মান থেকে অভিবাসী হয়ে এসেছিল। আজ সেই অভিবাসীর পৌত্র অভিবাসীদের বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখছেন। কারণ কী? কারণ তিনি ঢেকে রাখতে চান তার অভিবাসী পরিচয়। এ-জন্য তিনি মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন ধর্মকে। নৈতিকভাবে স্খলিত একজন মানুষ, জুয়াড়ি ও জুয়ার ব্যবসায়ী, ১৮ বছর যিনি কর ফাঁকি দিয়েছেন, এ রকম একজন অসৎ মানুষের পক্ষেই দেশের ঐতিহ্যিক হারমনি ধ্বংস করা সম্ভব। ১৯৯০-এর দশকের পর থেকে ক্লাস অব টু সিভিলাইজেশনের কুপ্রভাব যে অব্যাহত এবং তা ট্রাম্পের সময় উচ্চকিত হয়ে উঠল আবারও, এ-সব ঘটনা বা দুর্ঘটনা তারই আলামত বলে মনে করতে পারি আমরা।
২৭ জানুয়ারি ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশের পর থেকেই মূলত নেমে এসেছে অচলাবস্থা। ইমিগ্রেশন নিষেধাজ্ঞা জারি করা ওই সব দেশ থেকে আগত বৈধ ভিসাধারীদের এমন কি গ্রিন কার্ডধারীদের আটকে দিয়ে, ডিটেনশনে পাঠিয়ে যে নরক তৈরির কাজ করেছে, তারই প্রতিবাদে এখন চলছে নানা রকম আয়োজন। এর মধ্যেই ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশের বিরুদ্ধে ৪৫টি মামলা হয়েছে। অনেক স্টেটের সরকারি উকিল [অ্যাটর্নি জেনারেল] ট্রাম্পের সপক্ষে লড়বেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। বরং তারা তার বিরুদ্ধে লড়বেন। শুধু তাই নয়, ডেমোক্র্যাট নিয়ন্ত্রিত স্টেটগুলো ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে লড়বার জন্য। এর মধ্যে পাঁচটি স্টেটের অ্যাটর্নি জেনারেল ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশকে অসাংবিধানিক বলে তা বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। আরও ছয় স্টেটের অ্যাটর্নি জেনারেলরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ওয়াশিংটনের অ্যাটর্নি জেনারেল ফার্গুসন গত ৩১ জানুয়ারি মামলা করার কথা ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, যদি মামলায় জেতেন, তাহলে তা গোটা দেশের জন্যই ভালো হবে। ট্রাম্পের অবৈধ আদেশ তাহলে বাতিল হয়ে যাবে। গতকালও একজন ফেডারেল বিচারক ট্রাম্পের ইমিগ্রেশন সম্পর্কিত নির্বাহী আদেশ স্থগিত করেছেন। আমেরিকান আইনে যে ট্রাম্পের আদেশ অবৈধ বিবেচিত হবে, তার আলামত কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে। যারা এর আইনগত ভিত্তি আছে কি না যাচাই করছেন, বিচারকরা তা খতিয়ে দেখেই কিন্তু রায় দিচ্ছেন। প্রতিবাদ মিছিল করে ট্রাম্পকে তার নীতি থেকে সরানো যাবে না। কারণ তিনি এ-ব্যাপারে অন্ধ। একমাত্র আইনি প্রক্রিয়ায় যদি তাকে পরাস্ত করা যায়, তাহলেই মূলত তাকে থামানো যেতে পারে। বিরোধীরা সেই পথেই হাঁটছেন।
সিনেটে ডেমোক্র্যাটরা ঐক্যবদ্ধ হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ রিপাবলিকানদের সঙ্গে পেরে উঠবেন না। তবে রিপাবলিকানরাও ক্ষেপে উঠছেন বলেই ধারণা করা যায়। ম্যাককেইনসহ বেশ কয়েকজন সিনেটর তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সম্মিলিতভাবে ট্রাম্পের অনৈতিক পদক্ষেপগুলো থামানোর কোনো প্রয়াস এখনো নেওয়া হয়নি। তবে সময় তো ফুরিয়ে যায়নি। সামনের দিনগুলোতে আমেরিকান আইনপ্রণেতারা যদি সোচ্চার হন, যদি ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে আসেন, তাহলে যে সাংস্কৃতিক হারমনি বিরাজমান গোটা আমেরিকান সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসরে, তা অব্যাহতই থাকবে। মানবতার ঝা-াই উঁচুতে উঠবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ধর্ম ব্যবসায়ী ও নেতিবাদীরা যদি বিদ্বেষপূর্ণ প্রপাগান্ডা চালায় এবং সংকীর্ণতাকেই আবাহন করে, তাহলে বিশ্বে ঘটে যেতে পারে যেকোনো রকম সামরিক দুর্ঘটনা। আর কে না জানে এখন আর কেবল আমেরিকা ও রাশিয়াই নয়, পরমাণু বোমার অধিকারী চীন, কোরিয়া, পাকিস্তান, ভারতও। এবং সেই বোমা নিক্ষেপ করার মতো স্বল্প ও মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রেরও অধিকারী ওই দেশগুলো। ট্রাম্পের মতো গরম-মাথাওয়ালা আমেরিকান প্রেসিডেন্ট অতীতে কেউ ছিলেন, এমন প্রমাণ নেই। অতএব তাকে নির্বৃত্ত করা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ জানা নেই আমেরিকার সাম্যচেতন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের।
আমরা আশাবাদী।
লেখক: ড. মাহবুব হাসান; কবি ও কলামিস্ট, আমেরিকা প্রবাসী।
No comments:
Post a Comment