কম্বোডিয়া থেকে আসছে ১০ লাখ টন
তবু আশানুরূপ কমছে না চালের দাম
সরকারি গুদামে গত মাসে চাল ছিল এক লাখ ৯১ হাজার টন। বর্তমানে তা এসে দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ১০ হাজার টনে। অর্থাৎ এক মাসে মজুদ বেড়েছে মাত্র ১৯ হাজার টন। অথচ গত বছর এ সময় মজুদ ছিল পাঁচ লাখ ৮২ হাজার টন। এর আগে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ছয় লাখ ৯৬ হাজার টন; ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সাত লাখ ৯৭ হাজার টন; ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ছয় লাখ ৫৮ হাজার টন; ২০১২-১৩ অর্থবছরে ছয় লাখ ৯৯ হাজার টন এবং ২০১১-১২ অর্থবছরের একই সময়ে চালের মজুদ ছিল নয় লাখ ৯৮ হাজার টন। অর্থাৎ গত পাঁচ বছর ধরে খাদ্য মজুদের পরিমাণ এই সময়ে কখনোই পাঁচ লাখ টনের নিচে নামেনি। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, এখন চাহিদা অনুযায়ী কমপক্ষে ছয় লাখ টন চাল মজুদ থাকার কথা।
অন্যদিকে, চালের মজুদ বাড়াতে গত ২২ জুন চালের আমদানি শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করে সরকার। তুলে নেয় ৩ শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটি। এর আগে গত ১৯ জুন বিনা জামানতে চাল আমদানির সুযোগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে বাড়তে থাকে চাল আমদানি। গত মাসে বেসরকারি পর্যায়ে এক লাখ ২০ হাজার টন চাল আমদানি হয়েছে, যা প্রায় গত এক বছরের সমান আমদানি। গত অর্থবছরে এক লাখ ৩৩ হাজার টন চাল আমদানি হয়েছিল। একইভাবে পাঁচ দেশ থেকে ১২ লাখ টন চাল আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে ভিয়েতনাম থেকে আড়াই লাখ টন চালবাহী জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছে। তবে এখন পর্যন্ত সরকারি পর্যায়ে আমদানিকৃত কোনো চাল গুদামে পৌঁছেনি।
ফলে গত জুনের শেষের দিকে সরকারি গুদামে তলানিতে নেমে আসা চালের মজুদ এখন পর্যন্ত আশানুরূপ বাড়েনি। তারওপর কমেছে অভ্যন্তরীণ ধান উৎপাদন। গত কয়েক মাসে হাওরে বন্যা ও বোরো ধানে ব্লাস্ট রোগের কারণে ২০ থেকে ২৫ লাখ টন চাল নষ্ট হয়েছে। আর এসবের প্রভাব পড়েছে চালের বাজারে। প্রায় দেড় মাস ধরে চালের বাজারে দেখা দেওয়া অস্থিরতা কাটছে না। বেসরকারি উদ্যোগে চাল আমদানি বাড়লেও আশানুরূপ কমছে না চালের দাম। এর আগে গত ২২ জুন আমদানি শুল্ক কমানোর সময় বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছিলেন, মোটা চাল কেজিপ্রতি ছয় টাকা করে কমবে। কিন্তু গত দেড় মাসে কমেছে গড়ে দুই টাকা করে। বিশেষ করে মোটা চালের দর কিছুটা কমলেও প্রায় আগের মতো চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে সরু চাল। অথচ এর ফলে কেবল সাধারণ মানুষের দুর্ভোগই বাড়েনি; খাদ্যাভাব পূরণ করতে গিয়ে বেড়েছে আমদানি ব্যয়ও। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রমতে, সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরে খাদ্য আমদানিতে ব্যয় বেড়েছে ৩৬ শতাংশ। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এর দৈনিক কেনাবেচার তথ্য অনুযায়ী, গতকাল বুধবার বাজারে মোটা চাল কেজি প্রতি ৪২ টাকা ও মিনিকেট চাল কেজি প্রতি ৫৪ টাকায় বিক্রি হয়। এ ছাড়া টিসিবির মতে, মাঝারি মানের চাল বিক্রি হচ্ছে কেজি প্রতি ৪৭ টাকা। তবে বাজারে গিয়ে টিসিবির মূল্য তালিকার মিল পাওয়া যায়নি।
চালের দাম কেন কমছে না জানতে চাইলে ব্যবসায়ীরা বলেন, আমদানি করা চালের উচ্চমূল্যের প্রভাবে দেশি চালের দাম কমছে না। উপরন্তু ধানের দাম কিছুটা বাড়ায় চালের দাম ফের বাড়তে পারে বলে আভাস দিয়েছেন তারা। এ ব্যাপারে কারওয়ান বাজারের চাল ব্যবসায়ী মায়ের দোয়া জেনারেল স্টোরের স্বত্বাধিকারী মাসুম বিল্লাহ বলেন, আমদানির চাল বেশি দামে বিক্রি হওয়ায় দেশি চালের দামও কমছে না। ইসমাইল অ্যান্ড সন্স এর স্বত্বাধিকারী ও চাল ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন বলেন, বাজারে চাল সরবরাহ পর্যাপ্ত রয়েছে। মিল মালিকরা অর্ডার অনুযায়ী, এখন চাল দিচ্ছেন। মিল মালিকদের ওপর চালের দাম নির্ভর করছে। তবে আল্লাহর দান ট্রেডিংয়ের এক বিক্রেতা জানান, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে যে চাল আসছে তার দাম বেশি। ফলে দেশের বাজারে দাম খুব বেশি কমবে না।
চালের মজুদ বৃদ্ধি ও বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের নানা উদ্যোগের কথা জানিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, মজুদ বাড়াতে সরকারি পর্যায়ে (জিটুজি) ভিয়েতনাম থেকে আড়াই লাখ টন চাল আমদানি করা হচ্ছে। এরই মধ্যে কিছু চাল দেশে এসেছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক দরপত্রে দুই লাখ টন চাল কেনার জন্য চারটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। এসব চালও শিগগিরই আসবে। ভারত ও থাইল্যান্ড থেকে জিটুজিতে চাল আমদানির আলোচনা হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত বেশি দরের কারণে দুই দেশের সরকারের কাছ থেকে চাল কেনা হচ্ছে না। গত সোমবার রাতে কম্বোডিয়ায় গেছেন খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল। পাশাপাশি ভিয়েতনাম থেকে আরো আড়াই লাখ টন চাল আমদানির চিন্তা করা হচ্ছে। এ ছাড়া বাজার নিয়ন্ত্রণে কঠোর হচ্ছে সরকার । যেসব চালকল মালিক সরকারকে চাল দেয়নি, তাদের কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। ধান-চাল সংগ্রহ চলছে। এ ব্যাপারে খাদ্য সচিব কায়কোবাদ হোসেন বলেন, খাদ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল কম্বোডিয়া গেছেন। সেখানকার অবস্থা জেনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আগামী ৯ আগস্ট খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। সেখানে অর্থমন্ত্রীসহ সরকারের নীতিনির্ধারকরা থাকবেন। মূলত সেখানেই চালের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। আশা করছি শিগগির চালের বাজার স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
কিন্তু ব্যবসায়ী, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা আপাতত চালের বাজার স্বাভাবিক হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখছেন না। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, সরাসরি আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমেও চাল কেনার প্রক্রিয়ায় কাক্সিক্ষত সাড়া মিলছে না। গত এপ্রিলে ৬টি দরপত্রের মাধ্যমে তিন লাখ টন চাল কেনার প্রক্রিয়া শুরু হলেও এখন পর্যন্ত এক কেজি চালও গুদামে ওঠেনি। এসব চালের দুটি চালান আগামী সপ্তাহে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে ভিড়তে পারে। একইভাবে খাদ্য অধিদফতর সূত্রগুলো বলেছে, অভ্যন্তরীণ উৎস বা চালকলের মালিকদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহের চিত্রও হতাশাজনক।
আগামী পাঁচ বছরে ১০ লাখ টন চাল আমদানির লক্ষ্যে কম্বোডিয়ার সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। দেশটির রাজধানী নমপেনে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম এবং কম্বোডিয়ার বাণিজ্যমন্ত্রী প্যান সোরাসাক এই চুক্তিতে সই করেন। চুক্তির অংশ হিসেবে চলতি বছরেই ২ লাখ টন সাদা চাল এবং ৫০ হাজার টন আধা সিদ্ধ চাল কিনবে বাংলাদেশ। কম্বোডিয়ার বাণিজ্যমন্ত্রী প্যান সোরাসাক রয়টার্সকে বলেন, এই চুক্তির পর আগামী অক্টোবরের মধ্যেই এই আড়াই লাখ টান চাল আমরা বাংলাদেশে রপ্তানি করতে পারব।
বাংলাদেশকে বিশ্বের চতুর্থ সর্বোচ্চ চাল উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে তুলে ধরে রয়টার্সের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, কিন্তু চলতি বছরের এপ্রিলে বন্যায় ধানের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর তারা এখন এই শস্যের অন্যতম বড় আমদানিকারকে পরিণত হয়েছে। হাওরে ফসলহানির পর বাংলাদেশে চালের মজুদ কমে যাওয়া এবং অভ্যন্তরীন বাজারে দাম বাড়ার প্রসঙ্গও তুলে ধরা হয় এতে।
কম্বোডিয়া সফররত খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম রয়টার্সকে বলেন, বন্যার কারণে এ বছর আমাদের সমস্যা হয়েছে। কম্বোডিয়ার সঙ্গে একটি সমঝোতা চু্ক্তি বাস্তবায়নে আমরা এখানে এসেছি।বাংলাদেশের সঙ্গে এই চুক্তিই কম্বোডিয়ার সবচেয়ে বড় চাল রপ্তানির চুক্তি জানিয়ে রয়টার্স জানায়, দেশটি চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ২ লাখ ৮৮ হাজার ৫৬২ টন চাল রপ্তানি করেছে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি। খরায় উৎপাদন ব্যাহত হলেও গত বছরে কম্বোডিয়া প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টন চাল রপ্তানি করেছে।
গতবছর এপ্রিলে যেখানে সরকারি গুদামগুলোতে সাড়ে ৭ লাখ মেট্রিক টনের বেশি চাল ছিল, সেখানে এ বছর জুনে তা ১ দশমিক ৯৩ লাখ মেট্রিক টনে ঠেকেছে। ফলে ভরা মৌসুমেও বেশ কিছু দিন ধরে বাজারে চালের দাম বেড়ে চলেছে। ফসলহানীর পাশাপাশি ধানের দাম বেশি থাকার কথা বলে চালের বাড়তি দাম নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এ অবস্থায় চাল আমদানিতে ২০১৫ সালে ২৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়া শুল্কহার এবার ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। এরপর সরকার ভিয়েতনাম থেকে আড়াই লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানির চুক্তি করে, যার মধ্যে দুই দফায় ইতোমধ্যে ৪৭ হাজার মেট্রিক টন চাল দেশে এসেছে।
No comments:
Post a Comment