রোহিঙ্গাদের ওপর নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ
নিরাপত্তা ঝুঁকির শঙ্কা

শুরুতেই মিয়ানমার থেকে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ওপর সতর্ক নজর রাখছে বাংলাদেশ। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে মানবিক সহায়তার পাশাপাশি এসব শরণার্থীকে কঠোর নজরদারিতে রাখা হয়েছে। বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের অধিকার লড়াইয়ে থাকার দাবিদার আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিসহ (এআরএসএ) মিয়ানমারের সশস্ত্র গেরিলা সদস্যরা যাতে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে সেদিকে নজর রাখা হয়েছে। তেমনি এসব রোহিঙ্গা যাতে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে না পড়ে ও তাদের উসকে দিয়ে বা রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে কেউ কোনো ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করতে না পারে, সেজন্য নেওয়া হয়েছে বিশেষ সতর্ক ব্যবস্থা। এজন্য ত্রাণ দিতে আসা এনজিওসহ বেসরকারি সংস্থাগুলোর কার্যক্রমের ওপর নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। নিরাপত্তা ইস্যুকে কেন্দ্র করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যেই গঠন করেছে রোহিঙ্গা সেল। স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে এ সেল কাজ করছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ ও বিজিবি সদর দফতর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এমন অবস্থার মধ্যে গত শুক্রবার রাতে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার বালুখালী ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের হামলায় চার বাংলাদেশি আহত ও আটক দুই রোহিঙ্গার কাছে অস্ত্র পাওয়া গেছে। গতকাল কক্সবাজারের রামুতে এক রোহিঙ্গা যুবকের হামলায় এক বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এই রোহিঙ্গা যুবক তার ফুফুকে সঙ্গে নিয়ে দেড় মাস আগে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। এছাড়া আশ্রিত রোহিঙ্গাদের আরো কিছু বিচ্ছিন্ন বিশৃঙ্খল ঘটনায় দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তায় ঝুঁকির শঙ্কা দেখা দিয়েছে। আটক দুই রোহিঙ্গার কাছে থাকা একনলা বন্দুক, এলজি, চারটি কার্তুজ ও দুটি কার্তুজের খোলা খোসা কোথা থেকে এলো, কে বা কারা দিল—তা নিয়ে উদ্বিগ্ন প্রশাসনও। আটক রোহিঙ্গারা দুজনেই শিবিরে নতুন এসেছেন বলে জানিয়েছেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার চাইলাউ মারমা।
এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের রোহিঙ্গা গবেষক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তারা বলেছেন, এত সতর্ক অবস্থা ও কঠোর নজরদারির মধ্যেও রোহিঙ্গাদের হাতে অস্ত্র আসার বিষয়টি ভীষণ উদ্বেগের। এর একমাত্র সমাধান যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো। কিন্তু অবস্থা যেখানে দাঁড়িয়েছে, মনে হচ্ছে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে সময় লাগবে। সুতরাং এখনই সরকারকে রোহিঙ্গাদের ওপর আরো বেশি নজরদারি বাড়াতে হবে। ‘কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল’ পদ্ধতিতে রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নির্দিষ্ট কয়েকটি ক্যাম্প করে সেখানে রাখতে হবে। ক্যাম্পে সতর্ক পাহারা বসাতে হবে যাতে কেউ সহজেই সেখানে ঢুকতে ও সেখান থেকে বেরুতে না পারে। বাউন্ডারি দিতে হবে। প্রত্যেক ক্যাম্পের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে আলাদা কমিটি করতে হবে। আশ্রিত সব রোহিঙ্গার বায়োমেট্রিক নিবন্ধন নিশ্চিত করতে হবে। সরকারকে খুব সতর্কতার সঙ্গে এ ইস্যুকে মোকাবিলা করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়ে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে হবে। ‘নতুবা এসব রোহিঙ্গা ভবিষ্যতে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে’ বলেও মন্তব্য করেন তারা।
এ বিষয়ে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, রোহিঙ্গাদের ওপর আরো সতর্ক ও কঠোর নজর দেওয়া দরকার। গত দুই মাসে নতুন রোহিঙ্গারা এলেও রোহিঙ্গা সংকট বহু বছরের। এসব রোহিঙ্গা দুই ধরনের সংকটে রয়েছে। মিয়ানমারে নির্যাতন, বাংলাদেশে আশ্রিত। এরা বহু বছরের নির্যাতিত। চোখের সামনে স্বজনের নির্মম মৃত্যু ও নির্যাতন দেখেছে। বাড়িঘর পুড়তে দেখেছে। নিরুপায় হয়ে নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয় নিয়েছে। সুতরাং এদের ভেতর এক ধরনের ক্ষোভ থাকবেই। সেখান থেকে তারা এক দিন প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টাও করবে। এসব রোহিঙ্গা এই দেশ থেকে মিয়ানমারে গোপন হামলা চালালে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি ঘটবে। সীমান্তে শান্তি বিঘিœত হবে। উত্তেজনা দেখা দেবে। তখন এসব রোহিঙ্গা অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়বে। সুতরাং সেদিকটা এখনই ভাবা দরকার।
অবশ্য আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান ও অতিরিক্ত ডিএমপি কমিশনার মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে নির্যাতিত হয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কেউ যাতে তাদের জঙ্গিবাদের দিকে টানতে না পারে সে ব্যাপারে নজরদারি রাখছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সবাই আমরা সতর্ক রয়েছি। মিয়ানমারে যে মানবিক বিপর্যয় চলছে তার সুযোগ নিয়ে কোনো মহল যাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে।’
এমন পরিস্থিতিতে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে-জানতে কথা হয় দেশের কয়েকজন সাবেক কূটনীতিক, গবেষক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকের সঙ্গে। কক্সবাজারে বালুখালী ক্যাম্পে দুই দিন থাকার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, ক্যাম্পে দেখেছি উঠতি বয়সী রোহিঙ্গা ছেলেরা ভীষণ বেপরোয়া, উচ্ছৃঙ্খল ও সাহসী। তারা যা কিছু করতে পারে। স্থানীয় লোকজন আতঙ্কে আছে। এভাবে চলতে থাকলে সামাজিক অপরাধের পাশাপাশি দুর্বৃত্তায়ন বাড়বে। সুতরাং আশ্রিত রোহিঙ্গাদের নির্দিষ্ট ক্যাম্পে রাখতে হবে। ক্যাম্পে সতর্ক নজর রাখতে হবে যাতে কেউ সহজেই ঢুকতে বা বেরুতে না পারে। কঠিন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। তা না হলে বহু ধরনের অপরাধ সৃষ্টি হতে পারে। তারা একসময় টিকে থাকার কারণেই স্থানীয়দের সঙ্গে নানা ধরনের দ্বন্দ্বে লিপ্ত হবে। জমি দখল করবে। গরু-বাছুর কেড়ে নেবে। এ রকম অভিযোগ ইতোমধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে।
এই রোহিঙ্গাদের নানা গোষ্ঠী ব্যবহার করতে পারে উল্লেখ করে এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, উগ্র মৌলবাদী ধর্মীয় গোষ্ঠী বিপদের সুযোগ নিয়ে জিহাদি তন্ত্রে নেওয়ার চেষ্টা করবে। বিপথে নিতে উদ্বুদ্ধ করবে। তাদের তৎপরতা ও অপতৎপরতা বন্ধ করতে না পারলে নানামুখী বিপদ দেখা দেবে। স্থানীয়দের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখা দিতে পারে। রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার হতে পারেন। কারণ তাদের উসকানি বা ইন্ধনদাতার অভাব নেই। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ঝুঁকি তো বটেই, বহুমুখী বিপদের আশঙ্কাও রয়েছে। সুতরাং জরুরি ভিত্তিতে শতভাগ নিবন্ধন করে কঠোর নজরদারির মধ্যে রাখতে হবে। যে কয়েকটা ক্যাম্প প্রয়োজন সেখানে আলাদা করে রাখতে হবে। প্রত্যেক ক্যাম্পের জন্য আলাদা কমিটি করতে হবে। ‘কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল’ পদ্ধতিতে কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই।
মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর (অব.) ইমদাদুল ইসলাম বলেন, আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে, যত দিন না তাদের মিয়ানমারের ফেরত পাঠানো যায়। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমারকে ফেরত নিতে বাধ্য করতে হবে। এ ছাড়া এ সংকটের আর কোনো সমাধান নেই। এই কূটনীতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, সরকার যথেষ্ট সতর্ক। রোহিঙ্গাদের ওপর কড়া নজরদারিও রেখেছে। বড় কথা হলো সরকার এই রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে কোনো উসকানি, উৎসাহ বা ইন্ধন দিচ্ছে না। কারণ রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সরকার উত্তেজনা চায় না। শান্তিপূর্ণভাবেই সমাধান চায়। আশ্রিত রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে জড়াক, তা সরকার চায় না ও সে ব্যাপারে কোনো ইন্ধনও দিচ্ছে না। এর উদাহরণ হিসেবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়ানমারে গিয়ে জিরো টলারেন্স-সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছেন। এর মধ্য দিয়ে মিয়ানমারকে বার্তা দিয়েছে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের কোনো ধরনের ইন্ধন দিচ্ছে না। তারা যেন দ্রুত ফিরিয়ে নেয়। নতুবা ইন্ধন দেওয়ার লোকের অভাব হবে না।
এই বিশ্লেষক বলেন, ভূ-প্রাকৃতিক কৌশলগত কারণেই নানা মহল নিজ নিজ স্বার্থে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ব্যবহারের চেষ্টা চালাতে পারে। জাতিসংঘ আগেই বলেছে, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে দেরি হলে আরাকান রাজ্য মিলিট্যান্সির জন্য উর্বর ভূমি হবে। উগ্রবাদ জঙ্গিবাদ জন্ম নিতে পারে। রোহিঙ্গারা ব্যবহৃত হতে পারেন। কারণ ইয়ং জেনারেশনের মধ্যে তাদের ওপর নির্যাতনের কারণে এক ধরনের উগ্র চেতনাবোধের জন্ম নেবে। তারা নির্যাতিত। চোখের সামনে স্বজনদের হত্যা হতে দেখেছেন। ঘরবাড়ি পুড়েছে। ভেতরে এক ধরনের ক্ষোভ সৃষ্টি হচ্ছে। সেখানে ইন্ধন দেওয়ার লোকের অভাব হবে না।
‘তবে সরকার যতই সতর্ক বা নিরাপত্তাব্যবস্থা নেক না কেন-ভূকৌশলগত স্বার্থ যাদের আছে, তারা এই রোহিঙ্গাদের ব্যবহারের চেষ্টা করবেই। যদি রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে দেরি হয়, তাহলে এসব আশ্রিত রোহিঙ্গার মধ্যে এক ধরনের মিয়ানমারের বিরুদ্ধে উগ্রচেতনাবোধ আসবে। কেউ না কেউ তাদের উসকে দেবে। তারা সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে ঠেলে দেবে। বিপদে পড়বে বাংলাদেশ। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাঝুঁকির মুখে পড়বে। সুতরাং এই রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে হবে। সেটাই সমস্যার সমাধান’ উল্লেখ করেন মেজর (অব.) ইমদাদুল ইসলাম। তবে তিনি এ কথাও বলেন, রোহিঙ্গাদের কাছে এখন অস্ত্র থাকার কথা নয়। অস্ত্র নিয়ে প্রবেশও কঠিন। সুতরাং বালুখালীতে যে অস্ত্র পাওয়ার কথা বলা হচ্ছে, সেটি কোনো পক্ষের কোনো চক্রান্ত কি না-সেটিও খতিয়ে দেখতে হবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শরণার্থী গবেষক জাকির হোসেন বলেন, বাংলাদেশের পক্ষে এত বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার দীর্ঘদিনের জন্য আশ্রয় দেওয়া সম্ভব নয়। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা ইতোমধ্যেই দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে এই রোহিঙ্গাদের জড়িয়ে পড়ার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। ইয়াবাসহ সমুদ্রপথে আসা মাদকদ্রব্য পাচার বেড়েছে। এমনও হতে পারে, এই রোহিঙ্গারাই এই দেশে থেকে এক দিন মিয়ানমারে, এমনকি ভারতেও হামলা চালাতে পারে। সে ক্ষেত্রে ওই দুই দেশের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটবে। ফলে রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধান করতেই হবে।
লেখক: প্রতীক ইজাজ
No comments:
Post a Comment