জলবায়ু
বজ্রপাত : একটি নির্দয় প্রতিশোধ

‘বিনা মেঘে বজ্রপাত’! প্রবচন যেন সত্যি হয়ে আসছে। মেঘ বৃষ্টি ছাড়াও বজ্রপাত হচ্ছে অহর্নিশ। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আবহাওয়া সম্পর্কিত দ্বিতীয় বৃহত্তম ঘাতক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে বজ্রপাত! ভয়ংকর খবরটি হচ্ছে-প্রতিবছর বিশ্বে বজ্রপাতে যত মানুষ মারা যায় তার এক-চতুর্থাংশ মারা যায় বাংলাদেশে। দুর্যোগ তথ্য বিশ্লেষণে জানা গেছে, বাংলাদেশ হচ্ছে পৃথিবীর মধ্যে বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ মৃত্যুর দেশ।
পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে করা দুর্যোগ ফোরামের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৬ সালে ২৪৫ জন, ২০১৫ সালে ১৮৬, ২০১৪ সালে ২১০, ২০১৩ সালে ২৮৫, ২০১২ সালে ৩০১, ২০১১ সালে ১৭৯ জন বজ্রপাতে নিহত হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর, বুয়েট, দুর্যোগ ফোরাম, গণমাধ্যমের তথ্য ও একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হিসাব মতে, গত ৬ বছরে সারাদেশে বজ্রপাতে সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছে। বজ্রপাতের এমন আচরণই বলে দিচ্ছে মানবজাতির কার্যক্রমের ওপর প্রকৃতি কতটা নাখোশ। মানুষের অধিক চাহিদা আর লোভে প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্টের খেসারত হিসেবেই কি প্রকৃতির প্রতিশোধ এই বজ্রপাত? বিষয়টি এখন গভীরভাবে ভাবতে হবে।
তেলআবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক কলিন প্রাইস তার ‘থান্ডারস্টর্ম, লাইটেনিং অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলেন, ‘বায়ুদূষণ তথা পরিবেশ দূষণের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে বজ্রপাতের।’ এপ্রিল-মে মাসে বজ্রপাত বেশি হচ্ছে। এ সময়ে প্রতি বর্গকিলোমিটারের ৪০টির বেশি বজ্রপাত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্প্রতি কয়েক বছরে যে হারে বজ্রপাতের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে বাংলাদেশ বজ্রপাতে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। গবেষণা তথ্য মতে, সাম্প্রতিকালে বজ্রপাতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো বায়ু দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন। পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ১০ বছরে বাংলাদেশে মারা গেছে সাড়ে চার হাজারের বেশি মানুষ। বছরে গড়ে ৮০ থেকে ১২০ দিন বজ্রপাতের ঘটনা ঘটছে। দুঃখজনক সত্যটি হলো, বাংলাদেশে বজ্রপাতের ওপর তেমন কোনো গবেষণা নেই।
বলা হয়ে থাকে বজ্রপাত প্রকৃতির সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যগুলোর মধ্যে একটি। তবে এটি মানুষের পরিচিত সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক ঘটনাগুলোর একটিও বটে। সম্প্রতি বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতে বজ্রপাতের ও প্রাণহানির সংখ্যা বহুগুণ বেড়েছে। এই অস্বাভাবিকতার কারণ হচ্ছে বায়ুম-লে কালো মেঘের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া। কালো মেঘ সৃষ্টির পেছনে বাতাসে নাইট্রোজেন ও সালফারের পরিমাণ বেড়ে যাওয়াকেই দায়ী করছেন বিজ্ঞানীরা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সামান্য বৃষ্টিপাত বা ঝড়ো বাতাসেও ঘটছে বজ্রপাত। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা বজ্রের শব্দ শুনলে আল্লাহর জিকির কর। জিকিরকারীর ওপর বজ্রপাত হয় না। আর কিয়ামত যত ঘনিয়ে আসবে ততই বজ্রপাতের ঘটনা বাড়বে। এমনকি এক অঞ্চলের মানুষ অন্য অঞ্চলে গিয়ে জিজ্ঞেস করবে, আজ সকালে তোমাদের মধ্যে কার ওপর বজ্রপাত হয়েছে? জবাবে বলা হবে, অমুকের ওপর, অমুকের ওপর, অমুকের ওপর (আহমদ ও তাফসিরে ইবনে কাসির)।’ বজ্রপাতের কারণ সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণে নানা তথ্য বেরিয়ে আসছে। দেশের বেশিরভাগ মানুষের কাছে এখন মোবাইল ফোন আছে। দেশের অধিকাংশ এলাকায় মোবাইল ফোন ও বৈদ্যুতিক টাওয়ার রয়েছে। কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে। সন্ধ্যার পরে মানুষের ঘরের বাইরে অবস্থান বাড়ছে। বেশিরভাগ বজ্রপাতই হয় সন্ধ্যার দিকে। নদীর নব্যতা বিনষ্ট, জলাভূমি ভরাট, গাছ, বন-জঙ্গল ধ্বংস হওয়ায় দেশের তাপমাত্রা এক থেকে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। বিশেষ করে বর্ষা আসার আগের মে মাসে তাপমাত্রা বেশি হারে বাড়ছে। এতে এই সময়ে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর থেকে ভেসে আসা আর্দ্র বায়ু আর উত্তরে হিমালয় থেকে আসা শুষ্ক বায়ুর মিলনে বজ্রঝড় সৃষ্টি হচ্ছে।
অনেকে বলছেন, দেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের তালিকায় নতুন সংযোজন বজ্রপাত। বিভিন্ন পরিসংখ্যানের গড় হিসাবে দেখা গেছে, দেশে প্রতিবছর গড়ে দু’শ’ থেকে চারশ’জনের মৃত্যু ঘটে বজ্রপাতে। বেসরকারি হিসাবে মৃত্যুর সংখ্যা আরো বেশি। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আবহাওয়ার অস্বাভাবিক অবস্থা বায়ুম-লে অস্থিরতা সৃষ্টির কারণে বজ্রপাতের ঝুঁকি বেড়েছে। তারা বলছেন, ঘূর্ণিঝড়ের মতোই ভয়ঙ্কর হতে পারে বজ্রপাত। গত ছয় বছরের পরিসংখ্যান তারই আভাস দেয়। ঘূর্ণিঝড়ে একই সময় একই জায়গায় অনেক মানুষের মৃত্যু ঘটে থাকে। আর বজ্রপাতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ক্ষতির শিকার হয়। তাই বজ্রপাতের ভয়াবহতা খুব বেশি মানুষের চোখে পড়ে না। হাওর অঞ্চলে আর্দ্রতা বেশি হওয়ায় সেখানে বজ্রপাত বেশি হওয়ার একটি কারণ হতে পারে। আসুন বজ্রপাত সম্পর্কে কিছু তথ্য জানি, বজ্রপাত মানে থান্ডার। বায়ুমন্ডলের ওপরের অংশে নিচের তুলনায় তাপমাত্রা কম থাকলে নিচের দিক থেকে উপরের দিকে মেঘের প্রবাহ হয়। তখন এ ধরনের মেঘকে থান্ডার ক্লাউড বলে। মেঘের বিপুল শক্তিশালী বিদ্যুৎক্ষেত্র তার চারপাশের বাতাসের অপরিবাহী ধর্মকে নষ্ট করে দেয়, যাকে বলে উরবষবপঃৎরপ ইৎবধশফড়হি। মেঘে অবস্থিত বিদ্যুৎক্ষেত্র যখন যথেষ্ট শক্তিশালী হয় (প্রতি ইঞ্চিতে প্রায় ১০,০০০ ভোল্ট) তখন তার আশেপাশের বাতাস পজিটিভ এবং নেগেটিভ চার্জে বিভক্ত হয়ে যায়। এই আয়োনিত বাতাস প্লাজমা নামেও পরিচিত। বাতাস আয়োনিত হয়ে মেঘ এবং ভূপৃষ্ঠের মধ্যে বিদ্যুৎ চলাচলের পথ বা শর্টসার্কিট তৈরি করে দিলে বজ্রপাত ঘটে। আকাশে যে মেঘ তৈরি হয় তার ২৫ থেকে ৭৫ হাজার ফুটের মধ্যে বজ্রপাতের ঘটনা বেশি ঘটে। এখানে যে বজ্রপাতের সৃষ্টি হয় তার তাপমাত্রা ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার ডিগ্রি ফারেনহাইট। বজ্রপাতের গতিও প্রতি সেকেন্ডে ৬০ হাজার মিটার। পৃথিবীতে প্রতি সেকেন্ডে কোথাও না কোথাও ১০০ বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। একেকটি বজ্রপাতের সময় প্রায় ৬০০ মেগা ভোল্ট বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। একজন মানুষের মৃত্যুর জন্য মাত্র ১০০ ভোল্ট বিদ্যুৎই যথেষ্ট। বজ্রপাতে মাত্র ১ সেকেন্ডেরও কম সময়ে একজন মানুষের মৃত্যু হয়।
বজ্রপাতের হাত থেকে বাঁচতে সচেতনতার বিকল্প নেই। যদিও বজ্রপাতে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচা খুবই কঠিন। তবে সতর্ক হলে মৃত্যুর সংখ্যা কমানো যেতে পারে। একসময় দেশের বেশিরভাগ গ্রাম এলাকায় বড় গাছ থাকত। তাল, নারিকেল, বটসহ নানা ধরনের বড় গাছ বজ্রপাতের আঘাত নিজের শরীরে নিয়ে নিত। মনে রাখতে হবে আমরা বজ্রপাতের আওয়াজ শোনার আগেই তা মাটি স্পর্শ করে। বজ্রপাতে আহত ব্যক্তিকে স্পর্শ করাও বিপজ্জনক। শুকনো কাঠ দিয়ে ধাক্কা দিতে হবে। বজ্রপাতের সম্ভাবনা আবহাওয়া বিভাগের রাডারে ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘নাউকাস্টনিং’ পদ্ধতিতে রেডিও, টিভি মিডিয়াতে প্রচার করতে হবে, যাতে মানুষ নিরাপদ স্থানে যেতে পারে। জানা গেছে, বিভিন্ন স্থানে আবহাওয়া অফিসগুলোর মধ্যে উচ্চ প্রযুক্তির রাডার ও ডফলার রাডার রয়েছে। বজ্রমেঘ তৈরির ৩০-৪৫ মিনিটের মধ্যে দিক ও সম্ভাব্য স্থান শনাক্ত করে পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব। তৎক্ষণাৎ সতর্কবাণী প্রচার করতে হবে। বজ্রপাতের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে, মানুষের প্রাণ বাঁচাতে এবং এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে পাঠ্যবইয়ে পাঠদান জরুরি। আকাশে ঘন কালো মেঘ দেখলেই সাবধান হতে হবে। মেঘের ডাক শুনলেই নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে হবে। পাকা বাড়িতে আশ্রয় বেশি নিরাপদ। বাসা, অফিস কিংবা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে বের হলে বিদ্যুতের সব সুইচ বন্ধ রাখুন এবং দরজা-জানালা ভালোমতো বন্ধ রাখতে হবে। গাড়ির ভেতরও আশ্রয় নেওয়া যেতে পারে। গাছের নিচে, টেলিফোনের খুঁটির পাশে বা বৈদ্যুতিক সঞ্চালন লাইনের খাম্বার পাশে দাঁড়ানো মোটেই নিরাপদ নয়। ফাঁকা মাঠের মধ্যে অবস্থান সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক। পানির সংস্পর্শে যাওয়া যাবে না। বৃষ্টি ও মেঘের গর্জন না থামা পর্যন্ত নিরাপদে থাকতে হবে। চলন্ত অবস্থায় রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে গাড়িতে অবস্থান করুন। বজ্রপাতের সময়ে আংটি, চাবি, কাস্তে, কোদাল, মোবাইল ইত্যাদি কমপক্ষে ৬০ ফুট দূরে রাখতে হবে। মাটির সঙ্গে সংযুক্ত ধাতব পদার্থে হাত বা হেলান দিয়ে দাঁড়াবেন না।
জেনে রাখুন, তালগাছ বজ্রপাত ঠেকায়! দেশের প্রায় সর্বত্রই তালগাছসহ বড় বড় গাছের সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক কমে এসেছে। জনমনে প্রচলিত আছে, আগে বজ্রপাত হলে তা তালগাছ বা অন্য কোনো বড় গাছের ওপর পড়ত। বজ্রপাতের রশ্মি গাছ হয়ে তা মাটিতে চলে যেত। এতে জনমানুষের তেমন ক্ষতি হতো না। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধে দেশব্যাপী তালগাছের চারা রোপণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আমরা এর দ্রুত বাস্তবায়ন কামনা করি।
লেখক:এস এম মুকুল; বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।
No comments:
Post a Comment