Monday, April 16, 2018

চুয়াডাঙ্গা থেকে মুজিবনগর 


রক্তের সাথে আস করে নয়, আবার কারো দানেও পাওয়া নয় আমাদের স্বাধীনতা। বাংলার স্বাধীনতা অস্তমিত হয়েছিলো পলাশির আম্রকাননে আবার আরেক আম্রকাননে তার বীজ রোপিত হলো। সেই বিজ থেকে প্রাণের রসদ নিয়ে বাঙালি আবারো প্রমাণ করলো এ জাতি পরাভব মানে না। পরাজয় এজাতির তিলকে কলঙ্ক লেপে দিলেও তা চিরস্থায়ী নয়। ব্যবধান মাত্র ২১৪ বছরের। প্রথম যেদিন স্বাধীনতা হারাতে হয়েছিলো সেদিন কতিপয় মানুষের হীনচক্রান্ত ছিলো প্রবল। এই সব বিশ্বাসঘাতকের নীল নকশায় সেদিন স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। এদের ভিতরে যেমন মীর জাফর আছেন তেমনি আছেন ঘষেটি বেগম, রাজা রায়দুর্লভ, জগৎশেঠ প্রমুখ। এদের কূটজালে আটকে বিরোধীদের চেয়ে চারগুণবেশি সেনা নিয়েও নবাবের বাহিনী পরাজিত হলো। তাইতো যেদিন লর্ড ক্লাইভ বন্দি নবাবকে রাস্তা দিয়ে হাটিয়ে নিয়ে আসছিলেন তখনকার অনুভূতি তিনি এভাবেই ব্যক্ত করলেন। ‘বন্দি নবাবকে চরম অপমানের সাথে আমরা রাস্তা ধরে হাটিয়ে নিয়ে আসছি। দলে দলে লোক দেখছে। আমাদের পোষা বাহিনীর কিছু সদস্য নবাবকে বিদ্রুপ করছে। নানা ধরনের কথার পাশাপাশি তার দিকে অখাদ্য ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ভারতবাসী কেবলই তাকিয়ে দেখছে। আমাদের পরম সৌভাগ্য তারা কোন হাঙ্গামা করেননি। সংখ্যায় তারা এতোবেশি ছিলো যে, তারা প্রত্যেকে যদি আমাদের লক্ষ্যকরে শুধুমাত্র একটি করে পাথর ছুড়ে মারতো তা হলে আমাদের পুরো বাহিনীর আর খোঁজ পাওয়া যেতো না। কিন্তু তারা তা করেনি।‘ তবে ইতিহাস ঠিক তার পাঠ তুলে রেখেছিলো। ক্লাইভকেও পাগল হয়ে বিলেতের রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে হয়েছিলো। এমনকি তার বিচার করা হয়েছিলো। বিচারে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে তার সবসম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিলো। নবাবের বিদেহী আত্মা সেদিন হয়তো খুশি হয়েছিলো এই ভেবে অত্যাচারী যতই প্রবল আর প্রতিপত্তিশালী হোক না কেন তাকে তার কর্মের দায় বইতেই হবে। আবার দেখুন আমাদের মুক্তি সংগ্রামের সময়ে কিন্তু এই মীরজাফর ঘষেটি বেগম আর রায় দুর্লভের দলই ছিলো। তাদের রেখে যাওয়া প্রেতাত্মারা সেদিন আবারো আমাদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধাচারণ করে। তাইতো রাজাকার শিরোমণি গোলাম আযম, মইতা রাজাকার, ত্রিদিব রায়, ফ‘কা সাকার দল জোট বেঁধে জনগণের ইচ্ছের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। পাকিদের পক্ষ নিয়ে তারা এদেশের মানুষকে হত্যা করেছে, নারীদেরকে ধর্ষণ করেছে, মানুষের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে আর লুটপাট করে তাদেরকে নিঃস্ব করেছে। ক্লাইভের প্রেতাত্মা পাকি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পোষ্যরা সেদিন যে অপকর্মে মেতেছিলো তার বিচারের জন্য আমাদের দীর্ঘ সাড়ে চার দশক অপেক্ষা করতে হয়েছিলো। তারপরেই আমরা তাদের বিচার করতে পেরেছি। আর আমাদের ভিতরে একজন সাহসী ছিলেন বলেই তা সম্ভব হয়েছে। যখন এসব ঘৃণিতদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছিলো তখন অনেকেই যাদের ভিতরে বেশির ভাগই পরজীবী বুদ্ধিজীবী বলে সমাজে পরিচিত, তাদের একটি অংশ প্রকাশ্যে অথবা গোপনে সরকারের এই অবস্থানে গোস্বা করেন! এমনো বলতে শোনা গেছে, বিষয়টিতো মিমাংসিত। আবার বঙ্গবন্ধুর নামে মিথ্যা দোহাই দিয়ে বলা হয়, এদেরকে বঙ্গবন্ধু স্বয়ং ক্ষমা করে দিয়ে গেছেন ইত্যাদি। তবে ওই যে সাহসী মানুষটির কথা বলছিলাম যার রক্ত জাতির জনকের রক্ত থেকে প্রবাহিত, যিনি কথা এবং কাজে এক, কোন বেঈমানীকে যিনি মনেপ্রাণে ঘৃণা করেন- সেই তিনিই বললেন, তাদের নিরপেক্ষভাবে বিচার হবে। তাদের অপকর্মের বিচারের এজে-া দিয়েই আমাদের নির্বাচনী ইস্তেহার। এক্ষেত্রে আপসের কোন সুযোগ নেই। তিনি এও ঘোষণা করলেন অভিযুক্তদের আত্মপক্ষের সুযোগ দেওয়া হবে। এভাবেই ন্যায় বিচারের মাধ্যমে দেশে বিচারের সংস্কৃতি চালু হলো। দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠে বিচার না করার সংস্কৃতি থেকে মানুষ মুক্তি পেলো। আজ ১৭ এপ্রিল সেই ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অনন্য এক দিন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এদিনে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা গ্রামের আম্রকাননে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথগ্রহণ করে। পরে এই বৈদ্যনাথ তলাকেই ঐতিহাসিক মুজিবনগর হিসেবে নামকরণ করা হয়। এর আগে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর বর্বরোচিত হামলা চালানোর পর একই বছরের ১০ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী রূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করা হয়। আবার এই সরকারের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে মাত্র নয় মাসের রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে। এ দিন ঘোষিত ঘোষণাপত্রে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন দেওয়া হয়। ঘোষণাপত্রে সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে প্রজাতন্ত্রের উপ-রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়াও তাজউদ্দিন আহমেদ অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন মুহাম্মদ মনসুর আলী অর্থমন্ত্রী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামান স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী নিযুক্ত হন। অপরদিকে, জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী অস্থায়ী সরকারের মুক্তিবাহিনীর প্রধান কমান্ডার এবং মেজর জেনারেল আবদুর রব চিফ অব স্টাফ নিযুক্ত হন। ১১ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ দেশবাসীর উদ্দেশে বেতার ভাষণ দেন, যা আকাশবাণী থেকে একাধিকবার প্রচারিত হয়। তাজউদ্দিনের ভাষণের মধ্য দিয়েই দেশ-বিদেশের মানুষ জানতে পারে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনার লক্ষ্যে একটি আইনানুগ সরকার গঠিত হয়েছে। মুজিবনগর দিবসে সরকারিভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হবে। ঢাকার কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে, ভোর ৬টায় বঙ্গবন্ধু ভবন ও কেন্দ্রীয় এবং দেশের সকল জেলা কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন। সকাল ৭টায় বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে রক্ষিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ। মুজিবনগরের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সকাল ১০টায় মুজিবনগর স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ, সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে গার্ড অব অনার এবং ১০টা ৩০ মিনিটে মুজিবনগরের মেহেরপুরে শেখ হাসিনা মঞ্চে মুজিবনগর দিবসের জনসভা। এতে সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতিম-লীর সদস্য ও ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। আর প্রধান অতিথি থাকবেন উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু। সরকারিভাবে পালিত অনুষ্ঠানের একসময় ইতি হবে। কিন্তু যে মাটি এবং তার মানুষেরা সেদিন শত কষ্টকে অবলীলায় সহ্য করে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বরলিপি তৈরি করেছিলো তাদের প্রতিদান কী? মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কিছু না করেও এমন অনেকে আছেন যারা নিজেদের ঢাক পিটিয়ে চলেছেন। অতি উৎসাহী হয়ে তারা একাজে অনেক সময় সরকারকে বিব্রতকর অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। মুক্তিযোদ্ধার সুবিধা নিতে তারা বিবেক বন্ধক দিতেও রাজী আছেন। কবির ভাষায় ... দ্যাখ কত সুন্দর আমি কহে নকল হীরাটি / তাইতো সন্দেহ লাগে নহ তুমি খাটি। এমন নকলদের কারণে মুক্তিযুদ্ধ এবং আমাদের অনেক গর্বের অর্জন আজ প্রশ্নের মুখে। তোষামোদকারীদের কাছে আত্মসমর্পণ করছেন অনেকেই। নিজেদের গর্ব করার মত কোন প্রামণিক দলিল না থাকলেও তারা চোপার জোরে নিজেদেরকে মহীয়ান করতে দিনরাত পার করছেন। অথচ যাদের আছে তারা কিন্তু কেবলই প্রচারের অভাবে নায্য পাওনাটুকু ঠিকমত বুঝে পাচ্ছেন না। এমনি অবহেলা আর অনাদারের শিকার মুক্তিযুদ্ধের প্রথম রজধানী চুয়াডাঙ্গা। মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রথম রাজধানী চুয়াডাঙ্গা। ১৯৭১ সালের সেই ভয়াবহ দিনগুলোতে নিজেদের ভবিষৎ অগ্রাহ্য করে সেদিন মুক্তিপাগল মানুষের আশ্রয় দিয়েছিলো এই চুয়াডাঙ্গা। পাকিস্তানের বড় দালাল এবং পেয়ারে পাকিস্তানের শেষ ভরসা রাজাকার শিরোমনি ডা. আব্দুল মোতালেব মালিক সংক্ষেপে এ,এম মালিকের নিজ শহরছিলো এই চুয়াডাঙ্গা। কিন্তু চুয়াডাঙ্গার প্রতিবাদী মানুষগুলো নিজেদের ভবিষৎকে প্রশ্নবিদ্ধ করে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলো। নিজের সব সামর্থ দিয়ে সেদিন তারা মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহিত করেন। এম এন সাহা তৈরি করেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মনোগ্রাম। মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য দিয়ে সহায়তা দেন চুয়াডাঙ্গাবাসী। নিজেদের ঘরে চাল বাড়ন্ত রেখেও তারা সেদিন মুক্তিপাগল মানুষের জন্য খাবারের যোগান দেন। নিজের জীবন বিপন্ন করে তাদের এই ত্যাগ আজো রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পায়নি। এখনো চুয়াডাঙ্গাবাসীকে স্বীকৃতির জন্য রাস্তায় দাঁড়াতে হয়। মানববন্ধন করতে হয়। তারপরেও দাবিটি কোনভাবেই সরকারের কানে ওঠেনা। আবার সরকারের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ চুয়াডাঙ্গার বিষয়ে একেবারেই নিশ্চুপ। পানি জমে বরফ হয়ে গেছে। কোনভাবেই এই বরফ আর গলবে না! মুুক্তিযুদ্ধ আমাদের গর্ব ঠিক তেমনি গর্বের স্থান হিসাবে চুয়াডাঙ্গা তার অংশীদার। কিন্তু নির্মম সত্যি হচ্ছে স্বাধীনতার ৪৭ বছর পেরিয়ে গেলেও তার স্বীকৃতি থেকে চুয়াডাঙ্গাবাসী বঞ্চিত। তাদের ন্যায্য পাওনা কোনভাবেই পরিশোধিত হচ্ছে না। আবার পাওনা আদায়ের পথে হেটেও কোনো সুফল আসছে না। জটটি কোথায় তার হিসাব মেলতে এখন ব্যস্ত চুয়াডাঙ্গাবাসী। আর সেই হিসাবটি হচ্ছে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিলো স্বাধীনতার বিরুদ্ধ শক্তি। যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় বিরোধীতার নামে, মুক্তিযোদ্ধার বিজয় হলে তাদের পরাজয় ঘটে। ৭৫ সালের নির্মম হত্যাকা-ের পর ক্ষমতায় ফেরে। যেমন রাজাকার মিয়া মুনসুর, রাজাকার হাবিবুর মাওলানা, শান্তি কমিটির সদস্য হাজী মোজাম্মেল হক বঙ্গজ। আবার সরাসরি রাজাকার না হয়েও এমন অনেকেই ছিলেন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে যারা দেহমনে রাজাকার। তবে বর্তমানের ক্ষমতাসীন এমপি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। যিনি গণমানুষের নেতা হিসাবে সারা চুয়াডাঙ্গাতেই পরিচিত মুখ। প্রথম রাজধানীর কর্মকা-ের সময়ে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার চোখের সামনে স্পষ্ট সেদিনের ইতিহাস। সেই সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার সেলুন এমপির ওপরে এখন চুয়াডাঙ্গাবাসীর ভরসা। ইতিহাসের সত্যপাঠ এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসের সেরা স্বাক্ষী প্রথম রাজধানী চুয়াডাঙ্গা। তার স্বীকৃতি পেতে আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে? মুক্তিযুদ্ধে সব হারানো চুয়াডাঙ্গার মাটি কি তার সেই স্বীকৃতিটুকু পাবে? এমনি প্রত্যাশা নিয়ে দেশরত্ন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার দিকেই চেয়ে আছে চুয়াডাঙ্গাবাসী।
লেখক:কামাল সিদ্দিকী, সিনিয়র সাংবাদিক, ছোটগল্পকার, কলামিস্ট ও কবি।

No comments:

Post a Comment