জঙ্গিবাদ ঠেকাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কঠোর হচ্ছে
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জঙ্গিবাদ ঠেকাতে চলমান বিভিন্ন প্রক্রিয়াকে আরো জোরদার করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। হাতে নিচ্ছে সময়োপযোগী বিভিন্ন কার্যক্রম। এ লক্ষ্যে মন্ত্রণালয় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম এবং ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সঙ্গে নিয়মিত সমন্বয় করবে। জঙ্গি সম্পৃক্ততায় অভিযুক্ত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের গ্রেফতারের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়সহ প্রায় ১৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শিগগিরই কঠোর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। চলতি সপ্তাহে ঢাকার ইংরেজি মাধ্যমের তিনটি বিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রণালয়। দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পর্যায়ক্রমে জঙ্গিবিরোধী সভার আয়োজন করবে মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
জঙ্গিবাদে উসকানি দেওয়ার অভিযোগ ওঠায় আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে মাদ্রাসার পাঠ্যবইও বদলানো হচ্ছে। বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যবই থেকে জিহাদবিষয়ক উগ্র মতাদর্শের লেখা বাদ দিয়ে নতুন রচনা সংযোজন করে ছাপানো হচ্ছে নতুন বই। উগ্র ব্যাখ্যা থাকা মাদ্রাসার সহায়ক ও গাইডবই নিষিদ্ধ করতে কঠোর ধারা যোগ করে প্রণয়ন করা হচ্ছে শিক্ষা আইন। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশ অনুযায়ী মাদ্রাসার নতুন বই পর্যবেক্ষণে বিশেষজ্ঞ কমিটির সার্বক্ষণিক নজরদারি থাকবে। প্রয়োজনে যেকোনো সময় পাঠ্যবইয়ের কোনো রচনা বদলানোর সুপারিশ করতে পারবে। এই কমিটিতে স্বরাষ্ট্র, শিক্ষাসহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি থাকবেন।
সূত্র জানায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতর (ডিআইএ) ৩৬ হাজার সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন কার্যক্রমকে জোরদার করছে। ডিআইএর মাধ্যমে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জঙ্গি কার্যক্রমের সংশ্লিষ্টতা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে নজরদারিতে রাখছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জঙ্গিবাদবিরোধী সেল খোলা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। নির্দেশের পরও যারা সেল খোলেনি, সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জঙ্গি সংশ্লিষ্টতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ বাতিল করে শাস্তির মুখোমুখি করার উদ্যোগ নিয়েছে ইউজিসি।
জানতে চাইলে দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষাসচিব (অতিরিক্ত শিক্ষাসচিব) মহিউদ্দিন খান এ প্রসঙ্গে প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জঙ্গিবাদ চর্চা যেন না হয়, সেজন্য দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বেশি তদারকি ও নজরদারি করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও তাদের পদ্ধতিতে সন্দেহভাজন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজে নজরদারি ও অনুসন্ধান চালাচ্ছে।’ নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুই কর্মকর্তা বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১০ দিনের বেশি কোনো
শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকলে তা জানানোর জন্য গত বছর কড়া বার্তা দেয় মন্ত্রণালয়। এ নির্দেশ মানায় তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না অনেক প্রতিষ্ঠান। মাসের পর মাস শিক্ষার্থীরা অনুপস্থিত থাকলেও তা মন্ত্রণালয় ও পুলিশকে জানাচ্ছেন না সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা। সাম্প্রতিক সময়ে এভাবে আত্মগোপনে থেকে জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিয়ে হামলা চালিয়েছেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাবেক শিক্ষার্থীরা। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের বিশেষ নজর রাখার নির্দেশনা দেওয়া থাকলেও তারা রাজনৈতিক কর্মকান্ডের ওপর বেশি নজর রাখেন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকায় জঙ্গিবাদ সম্পর্কিত তথ্য আদান-প্রদান অনেকটা একমুখী হয়ে পড়ে।’
যোগাযোগ করলে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম ছায়েফউল্যা বলেন, ‘মাদ্রাসার পাঠ্যবইয়ের যেসব স্থানে বিতর্কিত পাঠ, বিশেষ করে জঙ্গিবাদে উৎসাহিত করার মতো বিষয় ছিল, তা বাদ দেওয়া হয়েছে। জঙ্গিবাদবিষয়ক জাতীয় কমিটির পরামর্শের ভিত্তিতে আমরা মাদ্রাসার কোরআন-হাদিস, আরবি ও ফিকহবিষয়ক বিভিন্ন পাঠ্যবই যৌক্তিক মূল্যায়ন করেছি।’
অভিযুক্ত ও দায়ী প্রতিষ্ঠান : ১৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ৯টি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল ও সাতটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় জঙ্গি সৃষ্টির উৎস হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে গত বছর শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়। গত চার বছরে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কমপক্ষে ৭২ জন ছাত্র ও শিক্ষকের বিরুদ্ধে জঙ্গি কর্মকান্ডে জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গত মঙ্গলবার কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া রাজধানীর লেকহেড গ্রামার স্কুলও ছিল জঙ্গিবাদের কেন্দ্রস্থল। বিভিন্ন সময়ে এ প্রতিষ্ঠানের অন্তত ১২ জন শিক্ষকের জঙ্গিবাদে যুক্ত থাকার প্রমাণ পায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
জঙ্গি কার্যক্রমে মদদের দায়ে লেকহেড গ্রামার স্কুল বন্ধের নির্দেশ গত রোববার দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। দেশের নিষিদ্ধ তিনটি জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে স্কুলটির সাবেক অধ্যক্ষসহ শিক্ষকদের কর্মকর্তার যোগসূত্র পাওয়া যায়। এর মধ্যে দুজন শিক্ষক ছিলেন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের মাতৃসংগঠন জামায়াতুল মুসলেমিনের ও দুজন হিযবুত তাহ্রীরের সঙ্গে যুক্ত। ঢাকার হলি আর্টিজানে হামলাকারীদের প্রশিক্ষণদাতা সাবেক মেজর জাহিদুল ইসলামও স্কুলটির প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করতেন। গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর রূপনগরে জঙ্গিবিরোধী এক অভিযানে তিনি মারা যান। ভারতের বিতর্কিত ইসলামী বক্তা জাকির নায়েকের মতাদর্শ পড়ানোয় দেশের পিস স্কুলগুলোও গত বছর বন্ধ করে দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
৩৫ পাঠ্যবই থেকে উসকানিমূলক লেখা বাদ : বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে মাদ্রাসার ৩৫টি বই পরিশুদ্ধরূপে আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে আসছে। জাতীয় শিক্ষানীতিতে বর্ণিত মাদ্রাসার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুসরণ করে বইগুলো থেকে ধর্মীয় উসকানিমূলক লেখা বাদ দেওয়া হয়েছে। বিতর্কিত লেখার পরিবর্তে নতুন আলোচনা যুক্ত হয়েছে। কোনটি জিহাদ আর কোনটি জঙ্গিবাদ, তা স্পষ্ট করে ২০১৮ সালের শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ করা হচ্ছে।
এর আগে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত যেসব পাঠ্যপুস্তকে জঙ্গিবাদ-সংশ্লিষ্ট বিষয় ছিল, সেসব বই জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কমিটি গঠন করে যাচাই করে। যাচাইয়ে কয়েকটিতে উসকানিমূলক ও অপব্যাখ্যা করার মতো তথ্য মিলে। মাদ্রাসার পাঠ্যবইয়ে জঙ্গিবাদ বিষয়ে পাঠ্য আছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে গত বছরের ২৪ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়। চিঠিতে মাদ্রাসার কোরআন, হাদিস, সংবিধান ও জাতীয় চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিষয় এবং কোনো রাজনৈতিক দল সম্পর্কে লেখা প্রবন্ধ বা রচনা বাদ দেওয়ার নির্দেশনা ছিল।
এর পরিপ্রেক্ষিতে মাদ্রাসা বোর্ড কর্তৃপক্ষ প্রথম থেকে দশম শ্রেণির ৩৫টি বই মূল্যায়নের উদ্যোগ নেয়। এ লক্ষ্যে আটটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠিত হয়। প্রতিটি কমিটিতে পাঁচজন করে মোট ৪০ জন সদস্য কাজ করেন। কমিটির দেওয়া প্রতিবেদনের আলোকে বিভিন্ন বইয়ে পরিবর্তন আনা হয়। এসব বই আগামী বছর শিক্ষার্থীদের হাতে যাচ্ছে।
বই সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে কমিটি : নতুন করে মুদ্রিত মাদ্রাসার পাঠ্যবই পর্যক্ষেণের জন্য প্রথমবারের মতো বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন হচ্ছে। কমিটির সদস্যরা বইগুলোতে নজর রাখবেন। পাঠ্যবইয়ে জঙ্গিবাদসহ বিতর্কিত আর কোনো পাঠ থাকলে তা পরিবর্তনে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়াই কমিটি গঠনের মূল লক্ষ্য। ১৫ সদস্যের এ কমিটি গঠন করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় মাদ্রাসা বোর্ডকে নির্দেশ দিয়েছে। স্বরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অন্তত ১৫ জন প্রতিনিধি কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হবেন। সব মিলিয়ে ৩০ সদস্যের কমিটি হতে পারে। আগামী শিক্ষাবর্ষের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যবই পৌঁছে দেওয়ার আগেই কমিটি গঠন হতে পারে বলে সূত্র জানায়।
উসকানিমূলক গাইডবই নিষিদ্ধ হচ্ছে : মাদ্রাসার বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের সহায়ক হিসেবে লেখা পাঁচটি প্রকাশনীর গাইডবইয়ে জঙ্গিবাদকে উসকে দেওয়া হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা এ অভিযোগ করে আসছেন। সেগুলোতে ধর্মকে অপব্যাখ্যা করা হচ্ছে। কথিত সহযোগী বা গাইডবইয়ের নামে চিহ্নিত পাঁচটি প্রকাশনীর বইয়ে উগ্র বাক্য আছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে গত বছর জমা দেওয়া এনসিটিবির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, আল ফাতাহ, আল ফালাহ, ইসলামিয়া, ইসলামিয়া কুতুবখানা ও আল ইসলাম প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত গাইড ও বইয়ে জিহাদ বিষয়ে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যেখান থেকে জঙ্গিবাদ উসকে যেতে পারে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় মনে করে, শিক্ষা আইনের খসড়ায় মাদ্রাসার পাঠ্যবইয়ের নামে সহযোগী নোট ও গাইডবইকে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। আইনটি শিগগিরই প্রণয়ন হবে। ফলে বাজারে গাইডবই থাকবে না।
লেখক:হাসান শান্তনু
No comments:
Post a Comment